এইবার দেখতে না দেখতে গরম কাল চলে গেল। শীত চলে আসছে। জানলায় তাকিয়ে আছি। বাইরে মন খারাপ। বাইরে মন কেমন করা রঙ। কান্নাভেজা। মনমরা। একটাও পাখি নাই। গান নাই। ভিনদেশি গাছগুলো সবুজ হারাচ্ছে। চারপাশে পড়ে আছে পাতাহীন, পুষ্পহীন করুণ ডালপালা। বিরান বাগান। সুরহারা। আলোহারা। ছড়িয়ে আছে বিষণ্ণতা। ঘরে বাইরে। সূর্যের দেখা নাই। ভিজে আছে মন। এই রকম এক করুণ দৃশ্যের ভেতর এই যে ‘কালের খেয়া’ কথা নাই বার্তা নাই হঠাৎ করেই আমার গোপন বেদনাটুকুু উস্কে দিল, ভেতরটা কেঁপে উঠল স্বরচিত দুঃখকষ্টে, কান্নায়; এই যে ‘শুধু আসাযাওয়া’ আমাকে আবার ফানা করে দিল, আউলা করে দিল, কী করে আমি তা গদ্যে ধারণ করতে পারি! কী করে লিখতে পারি স্বরচিত আসাযাওয়া, দম বন্ধ করা বেদনা আমার! আমি তো এই স্বরচিত বেদনাগুলোই বহন করে চলছি দিনের পর দিন। বহন করে চলছি এই সব হাহাকার, আহাজারি, করুণ রোদন। লিখতে চাচ্ছি কবিতায়। এই সব ‘ডায়াস্পোরা দুঃখকষ্ট’, এইসব স্বরচিত ‘জন্মরোগ’, কান্নাকাটি নিয়েই তো তৈরি করছি পাণ্ডুলিপি। কবিতার। কান্নার। রোদনের। হয়তো প্রকাশিত হবে মেলায়। আর আমি হাজার পায়ে ছুটে যাবো দেশে, আবারও ফিরে আসবো এক পায়ে। শীতের দেশে। ডানা ভাঙা, মন ভাঙা জালালী কৈতর। যেভাবে একদিন আমি ভুল করে উড়াল দিয়েছিলাম। পরদেশে। পরবাসে। আর কেউ না কেউ হয়তো পড়বে তখন আমার স্বরচিত ‘জন্মরোগ’, বইয়ের পাতায়, যা আমি লিখে রেখেছি অসীম কান্নায়, অনন্ত রোদনে :
“শ্রাবণ মাসের কোনো এক বিষণ্ণ সকালে আমি দেশছাড়া হই। সেই ৯৯। পবিত্র সংখ্যার দিন। সেই পুরানা পল্টন লেন। পবিত্র শহরের ঋণ। বাড়ি তো আমি ছেড়েছিলাম তারও আগে। কৈশোরে। সেই উচ্চ মাধ্যমিক দিনে। তারপর আরো দূর নিদয়া নগরে। বাড়িছাড়া ঘরছাড়া বেহুঁশ মানুষ। জ্বরগ্রস্ত। জালালী কৈতর। বৈতল পরিন্দা। সুরমা নদীর চিল। ডানাভাঙা। পতিত পবন। নগরে নগরে ঘুরি। গান হয়ে। সুর হয়ে। জনে জনে বলি- ও, তোমরা আমায় চিনোনি? আহা, কে যে কারে চিনে!
আর আমি সেই উজাইয়ের মাছ, আরও আরও উজানে যাব বলে ভুল করে ভুল জলে পা রাখি। আর আমি সন্তরণ ভুলে যাই। আর আমি পথ ভুল করি। ভুল করি স্রোতের নিয়ম। আর দেশখেশের জন্য আমার মন কাঁদে। আর আমি শীতের দেশে শীত হয়ে নামি। আর আমি এক ঘোরের ভেতর, কান্নার ভেতর ঘুমিয়ে পড়ি। দেখতে পাই সেই জন্মে পাওয়া গ্রাম। শীত উঠেছে। মা মুরগি তার বাচ্চাগুলোকে পাখার নিচে ওম দিচ্ছে। কী তুলতুলে শরীর! কী হলুদ হলুদ রঙ! সেই অলৌকিক বাঁশঝাড়ের নিচে আমি যেন দৌড়ে যেতে চাই। আমি যেন হলুদ হলুদ ছানা হয়ে ঘুমিয়ে পড়তে চাই। মা মুরগির পাখনার নিচে। ভর দুপুরে। বাঁশবাগানে। নালিহুরী গ্রামে। আশ্চর্য হলুদ, আশ্চর্য রোদের দিনে। তুলতুলে ঘুমের ভেতর। আমি দৌড়াই। কিন্তু পৌঁছাতে পারি না। আমার পায়ের নিচে কে যেন বেঁধে দিয়েছে হাজার-মণি লোহার শিকল!
আর আমি স্বপ্নের ভেতর, ঘুমের ভেতর, হু হু কান্নায় ভেঙে পড়ি। জেগে উঠি। আর আমার জ্বর আসে। গা-কাঁপানো জ্বর। মন কাঁপানো জ্বর। অচেতন এক জ্বরের ঘোরে কান্নাকাটি করি। দেশখেশ করি। ভিনদেশি বদ্যি বলে, সেরে যাবে জ্বর। আর আমি সেরে উঠি। দেহ থেকে জ্বর সারে। মন থেকে সারে না তো, হায়! সেই দেশ ছাড়া শোক, সেই সান্নিপাতিক মনের অসুখ, আমাকে করে রাখে শব্দের ফকির। আর আমি দিনরাত করে যাই সুরের ফিকির; আর আমি দিনরাত গেয়ে যাই বৈদেশি বেদনা, দেশের জিকির।”
এইসব জিকিরে জিকিরে দিন কাটে। রাত কাটে। আমার ভেতরে এক দেশ থাকে। জন্মে পাওয়া গ্রাম থাকে। আমি তারে নিয়ে যাই দেশ থেকে দেশে। গ্রাম থেকে গ্রামে। তাকে আমি সুরে বাঁধতে চাই। ধরতে চাই শব্দে-বাক্যে-গানে। বেচঈন হয়ে থাকি। দেশের জন্য, দশের জন্য কান্নাকাটি করি। বারবার যাই। বারবার ফিরে আসি। যেভাবে একদিন আমি চলে এসেছিলাম। ঘোরের ভেতর। ভুলের ভেতর। ভুল দেশে। ভুল ঠিকানায়। দেশ ছেড়ে। খেশ ছেড়ে। সেই উজাইয়ের মাছ। হুঁশহারা। উজান স্রোতে। ভিনজলে সন্তরণশীল পথহারা মাছ। নিয়ম না জানা, ক্লান্ত, শ্রান্ত, আহত মীন। সেই আমি কি আর জেনেছিলাম আটকা পড়ব ভিনদেশি ফাঁদে! এ এক এমনি ফাঁদ, একমুখী, ফিরিবার পথ নাই। শুধু যেতে হয় উজানে। রক্তাক্ত। আহত। তবু হঠাৎ ফিরি। ফিরে যাই। ৩৭০০০ ফুট উচ্চতায়। মেঘের দেশ পাড়ি দিয়ে। হাজার পায়ে। হাজার ডানায়। ঠিক ঠিক পৌঁছাই। পৌঁছে যাই। আর আমার ডানা গজায়। হাজার ডানায় ভর করে নামতে থাকি। যখন তোমাকে আমি দেখতে পাই, হে মায়াবী সবুজ, হে প্রেয়সী মৃত্তিকা আমার, মন আমার নেচে ওঠে শত তবলার ঠোকায়, যেন মনের ভেতর উড়াল দেয় শত সহস্র কবুতর, ডানার উচ্ছ্বাস। আর আমি রচনা করি এই সব নিবেদন, মনের আরাম :
“সত্যি সত্যি আমি এবার নাড়ছি কড়া। খোলো তোমার দেহের কপাট, হাসির কিলান, মায়ার অভিমান। কতো দিন হয় আমি তোমার দেহজলে সিনান করি নি! কতো দিন হয় হারিয়ে গেছি ফেরত আসি নি!
দিও তুমি দেহধূলি, দিও তুমি ঘামের শরীর, শান্ত নীরবতা। সত্যি আমি ফিরে এলাম, সত্যি আমি ঘরের মানুষ। দিও তুমি সান্ত্বনার ঢেউ, স্রোতের উজান, তেঁতুল জলে শীতল দুপুর, কাগজী লেবুর ঘ্রাণ। দিও তুমি পাখার বাতাস, নিমের ছায়ায় শুশ্রূষার হাত, দিল উচাটন গান।
আহা, কতো দিন হয় নিজ ইঁদারায় নিজের মুখের ছায়া দেখি নি! কতো দিন হয় তুকমা জলে তৃষ্ণা মিটে নি!”
আমি যাই। ধুলায় গড়াই। সাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানাই। তাকে আমি নাম ধরে ডাকি। ডাকাডাকি করি। ডাক নামে জেগে উঠি। আমি যেন হারিয়ে যাওয়া পুত, বহু পথ ঘুরে, বহু দিন পরে মায়ের কোলে ফিরে এসেছি। আমি যেন সেই গোপন প্রেমিক, না জানিয়ে দোতারা হাতে বেরিয়ে পড়েছিলাম তীর্থে। আর গান বাঁধতে বাঁধতে, কান্না করতে করতে ফিরে এসেছি। অনেক দিনের পরে। গেরুয়া বসনে। আমার গান, আমার সুর, আমার কণ্ঠ ধুলায় লুটায়। গড়াগড়ি যায়। তবু সেই তৃষ্ণা তৃষ্ণাই থেকে যায়। মিটে না। আবারও ফিরে আসতে হয়। ফিরে আসাই যেন নিয়তি। যেন আমি অভিশপ্ত সেই কিচ্ছার পাখি। বৈদেশি পরিন্দা। বিবাগী তাকে হতেই হয়। দেশ ছেড়ে। খেশ ছেড়ে। আত্মাহীন দেহে। ডানা ভাঙা। মন ভাঙা। বারবার। প্রতিবার। উড়াল দিতে হয়। ৩৭০০০ ফুট উচ্চতায়। করুণ মেঘের দেশে। কান্না হয়ে। বহন করতে হয় হাজার-মণি পাথর। বুকের ভেতর। দম বন্ধ হয়ে আসে। কান্নায়। অভিমানে। বিচ্ছেদ বেদনায়। হাহাকারে। রচনা করতে হয় এইসব মর্সিয়া, এইসব করুণ ক্রন্দন, কলিজা কাটা বিচ্ছেদী :
“বাড়ির পাশে কাঁঠালগাছ কাঁঠাল ধরে ডালে, আইসো বাড়ি কেউ বলেনি জ্যৈষ্ঠমাসী কালে। বাড়ির পাশে আমের গাছ বাতাস এলে নড়ে, এই কথাটি লিখতে গিয়ে চোখের জল পড়ে। বাড়ির পাশে জামের গাছ জাম পেকেছে কালো, দেশের ফল দেশের ফুল তোমরা থেকো ভালো।
ঘরের পাশে ডালিম গাছ ডালিম ধরে লাল, বৈদেশেতে আছি কেমন জিগাও না তো হাল। ঘরের পাশে বরই গাছ মিঠা বরই তাতে, তোমার কথা পড়ছে মনে বৈদেশিয়া রাতে। ঘরের পাশে ডুমুর গাছ ডুমুর ধরে আছে, তোমার ডাক না-পাই যদি বৈদেশি মন বাঁচে!
ভালা থাইকো তোমরা সবে আমি খবর লইবো, দুখী ইরম জিতে মইলে কার কী আর অইবো!”
এই যে মর্সিয়া, এই যে মাতম, এই যে যাওয়া-আসা, কান্নাকাটি, এসব কি আর গদ্যে লেখা যায়? কী করে লেখা যায়! ভাবি। ভাবতেই থাকি। বাইরে হাওয়া বয়। শীত শীত হাওয়া। বাইরে পাতা ঝরে। পরদেশি পাতা। বৃষ্টি পড়ে। হিম হিম বৃষ্টি। কে যেন নাম ধরে ডাকে। কে যেন হারিয়ে গেছে। কে যেন ভুলে গেছে ফেরার পথ। কে যেন ধরেছে সুর আফালি বাতাসে। ভরা বর্ষায়। শনির হাওরে। নইনার হাওরে। কে যেন উজান জলে ছুটবে বলে আটকে গেছে ফাঁদে। করুণ সুরে বাজাচ্ছে দোতারা। মুরালিয়া বাঁশি। কদমের তলে। বটবৃক্ষের ছায়ায়। কবরে। শ্মশানে। সেই সুর ছুটে আসছে জানলায়। সেই বিচ্ছেদী সুরে, সেই বাঁশরির ডাকে হুঁশ ফেরে। মন খারাপ বাড়ে। আর বুঝতে পারি, এ আমার স্বরচিত বেদনা, স্বরচিত কান্নাকাটি, যা আমার বহন করতে হবে জীবন ভর। লিখতে হবে রক্ত পানি করা শ্রমে। ক্ষয় করে আয়ু। রাত্রি জেগে। জিকির দরদে। ক্রন্দনে। মাতমে। আর আমি দেখতে পাই প্রতিটি সাদা পাতায়, কবিতা নয়, যেন আমার চোখের জল মুদ্রিত হচ্ছে, বইমেলায়, ‘কালের খেয়া’য় :
“আমি তারে কী এক ভুলে রাইখ্যা আসি দূরে, জোছনা ধরা রাত্রি শেষে কালনী ধরা ভোরে। আমি তারে বুকের ভেতর রাখি, আমি তারে চোখের পাতায় মাখি। তারে ছাড়া এক জীবনে রইলো কী আর বাকি? আমি তার নাম লৈয়া গদ্যপদ্য বাঁধি, আমি তার নাম লৈয়া দিবানিশি কাঁদি।
ইরম ইরম করো তোমরা ইরম কী আর আছে! ইরম সে তো দূর প্রবাসে জিতে মরা বাঁচে।”