মাটির গন্ধ

মাটির গন্ধ

পুবের আকাশ তখনো ফর্সা হয়নি। চাপ চাপ অন্ধকার চারিদিকে শক্ত দেয়াল তুলে দাঁড়িয়ে আছে। দৃশ্যমানতার আড়াল থেকে ভয়াল কোনো দৈত্য যেনবা লোমশ দু’হাত বাড়িয়ে আলোর শিখার টুঁটি টিপে ধরতে চায়। উঠোনের কোনে কুয়াশাভেজা উনুনে লাকড়ি ঠেলে দিয়ে মরিয়ম একবার ঘাড় উঁচিয়ে তাকায় আকাশের দিকে- নাহ্‌, অন্ধকার এখনও অনড়। ফাল্কগ্দুনের শেষ রাতে গা-শিরশিরানো ঠাণ্ডা সামলাতে একবার সে শাড়ির আঁচল ঘুরিয়ে শরীর পেঁচিয়ে নেয়, তারপর উনুনের কম্পমান শিখার দিকে তাকিয়ে মনে মনে জিভ ভেংচি কাটে। আর একা একা ঠোঁট তড়পায়- আন্ধার দেইখি তুইও ভয়-তড়াশে মরিস! অ্যাঁ?

ভোররাতে উঠে উনুন জ্বেলে ভাত চাপানো নতুন কিছু নয়, মরিয়মের নিত্যদিনের কাজ। শীত-গ্রীষ্ফ্মের তফাৎ নেই, দম দেওয়া ঘড়ির কাঁটার মতো প্রায় প্রতিদিনই শেষ রাতের নির্দিষ্ট এক প্রহরে তার তলপেট টনটন করে টাটিয়ে ওঠে। তখন তাকে শয্যা ত্যাগ করতেই হয়। ঝাঁপ ঠেলে ঘরের বাইরে এসে প্রথমে ভারমুক্ত হওয়া, তারপর উঠোনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনের নিকানো উনুনের মুখে আগুন দেওয়া- এভাবেই শুরু হয় মরিয়মের দিনযাপন। উনুনে লাকড়ি ঠেলতে ঠেলতেই সে ঘাড় কাত করে আকাশ দেখে। আকাশের ওড়নায় হেলেপড়া সাতভাইচম্পা খোঁজে, শাকসবজি আনাজপাতি মিলিয়ে তরকারি কোটে, এরই মাঝে মসজিদের মাইক্রোফোন থেকে ইথার কাঁপানো কণ্ঠে মন্দ্রিত হয় ভোরের আজান। সারাদিনে একাধিক মসজিদের আজান শোনার সুযোগ হয় মরিয়মের, একই সুরে বাঁধা উচ্চারণ হওয়া সত্ত্বেও এই প্রভাতী আজানের মধ্যে কী যেন এক ভিন্নতা খুঁজে পায় সে! কী সেই ভিন্নতা? চুলচেরা বিশ্নেষণের ক্ষমতা নেই তার, তবু মনে হয় আলাদা কিছু। মনে হয় যেন সে নদীপাড়ে দাঁড়িয়ে আছে আর জোয়ারের উঁচু ঢেউ প্রবল গর্জনে আছড়ে পড়ছে। এই আছড়ে পড়া ধ্বনিতরঙ্গে কেঁপে ওঠে তর অন্তরের নিভৃত প্রদেশ পর্যন্ত। তখন সে কী করে! উঠোন থেকে উঠে আসে ঘরে। ঘোর ঘোর অন্ধকারের মধ্যেই বৃদ্ধ স্বামীর বিছানা হাতড়ায়, বগলের তলে দু’হাত লাগিয়ে দাঁড় করানোর পর হাতের লাঠি এগিয়ে ধরে জানতে চায়,

কাপড়-চোপড় নষ্ট হয়নি তো আজ?

বয়সের ভারে ন্যুব্জ ইনসান আলি বাহ্যি-পেচ্ছাপের উপরে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না বলে প্রায়ই পরনের কাপড়-চোপড়, বিছানাপত্র নোংরা করে ফেলে এবং এ জন্য স্ত্রী মরিয়মের সামনেও খুব লজ্জা পায়। হোক তিন নম্বর স্ত্রী, তবু স্বামী হিসেবে সে কর্তৃত্ব ফলাতেই পারে। কিন্তু কী যেন এক অব্যাখ্যেয় কারণে সারাদিন আপন বৃত্তে লেজ গুটিয়ে বসে থাকে। লালা ঝরানো মুখে মাঝেমধ্যে দুর্বোধ্য গোঙানির ভাঁজে ভাঁজে বেশ গজরগজর করে। তার অর্থ কেউ না বুঝলেও হয়তো মরিয়ম বোঝে, তবে সেসব বিশেষ আমলেই নেয় না। তার যা করণীয় তা মুখ বুজে দ্রুত হাতে করে যায়। এই ভোরবেলাটায় তার হাতে খুব সময়ের টান। দু’হাতে কাজ করেও কুলিয়ে ওঠা দায়। এদিক-সেদিক তাকাবার উপায় আছে! বৃদ্ধ স্বামীর পরনের কাপড় পাল্টেপুল্টে দিয়ে অজু করিয়ে নামাজে বসিয়ে দেয়। বেশ কিছুদিন থেকে সকাল-সন্ধ্যা দু’বেলা নামাজের খুব টান হয়েছে লোকটার। মরিয়ম সাধ্যমতো সহযোগিতা করে। তোলা-শাড়ির আঁচল বিছিয়ে জায়নামাজ বানিয়ে সেইখানে বসিয়ে মাথায় টুপি পরিয়ে দেয়। তার নামাজ মানে অনুচ্চারিত দোয়া-দরুদে কেবল ঠোঁট জোড়া তড়পানো। নামাজ শেষ হলে ভাপ ওঠা গরম ভাত এনে তাকে খাওয়ায়, তারপর নিজে দু’মুঠো নাকেমুখে গুঁজে মাটিকাটা ঝুড়ি হাতে বেরিয়ে পড়ে মরিয়ম।

কোথায় কবে কেমন কাজ, কতদূরে কীভাবে যেতে হবে- এসব নিয়ে মরিয়মের কোনো ভাবনা নেই। সে দায়িত্ব সরদারের এবং জোড়ের সাথীর। মাটি-কাটার জগতে প্রবেশের সময় ‘জোড়ের সাথী’ ব্যাপারটা বুঝে ওঠার পর নিচের ঠোঁট দাঁতে চেপে মনে মনে বলেছে মরিয়ম- তার মানে জোড়মানিক! ঘরের বাইরে বেরিয়ে পুরুষের পাশাপাশি মেয়েরাও এখন কৃষিকাজ করছে, রাজমিস্ত্রির জোগাল দিচ্ছে, ইট ভাঙছে, এমনি ধারার আরও কত কী! তাই বলে মাটি-কাটার কাজে এ কী বিদ্ঘুটে নিয়ম! যে কোনো এক পুরুষের সঙ্গে জোড় বাঁধতেই হবে, কাজের সময় সে-ই তাকে চালিয়ে ফিরিয়ে নেবে। এই জোড় দীর্ঘদিন স্থায়ী না হলেও ক্ষতি নেই, এক জোড় ভেঙে নতুন জোড় বাঁধাও দোষের কিছু নয়। জোড়মানিক একটা থাকতেই হবে। সরদারের মতো রাক্ষুসে হাত বাড়িয়ে উপার্জিত অর্থে ভাগ বসায় না ঠিকই, কিন্তু দৃশ্যের আড়ালে এই জোড়মানিকরা ভাগ বসায় আরও অনেক কিছুতে। এ জগতে রাখঢাকের বিশেষ বালাই নেই, সবাই জানে ভেতর-বাইরের সব কিছু। ছোটবেলার সই পুকুরপাড়ার ছামেনা যখন পুরনো জোড় ভেঙে বাঁশবাড়িয়ার জলিল ফারাজির সঙ্গে নতুন করে জোড় বাঁধে, তখন কত অবলীলায় মরিয়মের কাঁখে বাঁশের ঝুড়ি তুলে দিয়ে বলতে পারে- নে সই, আমার পুরনো জোড়ের সাথী ইনুচকে দিয়ি দিলাম, কাজের অভাব হবে না তোর।

তা ঠিক। অচিরেই টের পেয়েছে মরিয়ম, গাট্টাগোট্টা শক্ত-সমর্থ শরীর স্বাস্থ্যের জন্য ইনুচের কদর সব সরদারের কাছেই। কাজপাগল পরিশ্রমী মানুষ। ফাঁকিজুকি বলে কিছু জানে না। নিজেও খাটতে পারে, জোড়ের সাথীকেও খাটিয়ে নিতে পারে। খেটে-খুটে সামান্য রোজগারের জন্যই তো ঘর ছেড়ে বাইরে বেরুনো। যার সঙ্গেই জোড় বাঁধুক, খাটতে তো হবেই। কোদাল দিয়ে মাটি কেটে ঝুড়ি ভরে ইনুচ যেদিন প্রথম ঝুড়ি তুলে দেয় মরিয়মের মাথায়, সেই প্রথমদিনেই অমন শক্ত-পোক্ত জোয়ান মর্দ লোকটির চোখের গভীরে অকপট সারল্য আবিস্কার করে বসে মরিয়ম। সেটা কি ইনুচ ধরতে পারে? নইলে দুপুরে গাছের ছায়ায় বসে জলখাবার খাওয়ার সময় এভাবে সে বলে কী করে- চোখের মধ্যি চোখ ঢুকিয়ি দিয়ি কী দেখিস তুই?

মরিয়মও কম যায় না। ছামেনার কাছ থেকে আগেই শিখে রেখেছে- এসব জায়গায় মুখের দাপট কিছুতেই কমালে চলবে না। সমানে সমান না হোক উনিশ-কুড়ির বেশি তফাৎ হলে চলবে না। সেই গুরুবাক্য শিরোধার্য করে সেও মুখের ওপর সপাং সপাং করে ঝেড়ে দেয়,

তুমার নজর কুন দিকি, আমি জানিনি?

নির্বিবাদী মানুষটা রুষে ওঠে,

কুন দিকি?

ক্যানে, মেয়িমান্‌ষির বুকির মধ্যি!

ইনুচের মেজাজ খারাপ হয়। তবু মাথা ঠাণ্ডা রেখে মুখে কটাক্ষের গরল ঢেলে দেয়,

আধবুড়ি মাগির আবার বুক ফুলানো গর্ব!

‘আধবুড়ি’ শব্দটির ধাক্কায় অথবা অন্য যে কারণেই হোক মরিয়ম সহসা চুপ্‌সে যায়। মনে মনে নিজেকে বুঝ দেয়- আধবুড়ি বইকি! তারই পেটের মেয়ে ময়নার বিয়ে হয়েছে বছর দুই হয়ে গেল, নাতিপুতি হতেইবা কদ্দিন! প্রথম পক্ষের খোকাটা বেঁচে থাকলে, সেও অ্যাদ্দিন কত সেয়ানা হয়ে যেত! আয়-উপার্জন করতে শিখত নিশ্চয়ই। অভাব যতই থাক, সেই ছেলে কি তার মাকে মাটি কাটতে যেতে দিত! দীর্ঘশ্বাস পড়ে মরিয়মের বুক চিরে- বাব্বা! মেঘে মেঘে এত বেলা!

বাবলাতলার ছায়া থেকে ছামেনা এগিয়ে এসে মুখ চাপা দিয়ে ধরে,
কিরে সই, মন ভার ক্যানে?
মরিয়ম স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে,
কই, না তো!
নাতো বুললি হবে! সত্যি সত্যি কী হয়িচে তাই বোল দিনি!
মুখে কুলুপ এঁটে থাকে মরিয়ম। ছামেনা মুখঝাম্‌টা দেয় তাকে,

তোকে তো আমি আগেই বুলিচি- মাটি-কাটা অতো সোজা কাজ নয়, কত পুরুষ মানুষ জিভ কেলিয়ি হেদিয়ি যায়। তুই তালি ইখানে আলি ক্যানে, এ্যাঁ?

মরিয়ম তো সব কিছু শুনে জেনে বুঝেই এ পথে পা বাড়িয়েছে। নাহ্‌, এ জন্য আবার অভিযোগ কিসের! যেমনই হোক, কাজকর্ম একটা কিছু না করলে মুখের আহার জুটবে কী করে! একমাত্র কন্যার বিয়ে দেবার পরও তো সে ঝাড়া হাত-পা মুক্ত মানুষ হতে পারেনি! তার মাথার উপরে আছে বটবৃক্ষ বৃদ্ধ স্বামী। তার কথা ভাবতে হবে না? যার ছায়া নেব, তার দিকটা না দেখলে চলে?

মরিয়মকে ছেড়ে ছামেনা এতক্ষণে চেপে ধরে ইনুচকে। সোজা তার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে- কী বুইলিছো আমার সইকে?

ইনুচ চোখ সরিয়ে নেয়, কিন্তু কোনো উত্তর দেয় না। মুখে গজরগজর করে ছামেনা- নতুন একটা মানুষ দলে আয়িচে, তাকে এট্টু থিতু হয়ি দাঁড়াতি দ্যাও, সব কিছু বুঝতি দ্যাও, তারপর না হয় হাত বাড়ায়ু …

কী বালের ভ্যাজর ভ্যাজর কত্তি আলি তুই? ইনুচ হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে হাতের আঙুলে গোঁজা আধপোড়া বিড়িটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে ওঠে- তোর সইকে শুধিয়ি দ্যাখ দিনি- কী বুইলিছি আমি, শুধা!
মরিয়মের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে, দু’হাত নেড়ে সে প্রতিবাদ জানায়,
না না, সে তো কিছুই বুলিনি।

তালি আবার হলু কী! বইসি বইসি কার ধ্যান করছিস- ইনসান চাচার?

রক্তের কোনো বন্ধন না থাকলেও মরিয়মের তৃতীয় পক্ষের বৃদ্ধ স্বামী ইনসান আলীকে গ্রাম সুবাদে চাচা বলে ডাকে ছামেনা। সেই চাচাও বেশ গুরুত্ব দেয় ছামেনার কথায়। মরিয়ম সেটা জানে বলেই মাটি-কাটার কাজে যাবার জন্য স্বামীর অনুমতি আদায় করে ছামেনাকে কাজে লাগিয়েছে। এমনিতে আলাভোলা সাদাসিধে মানুষ, তবু মরিয়মের আশঙ্কা ছিল, ঘরের বউকে সহজে বাইরে খাটার অনুমতি দেয় কি-না! পুরুষ মানুষ, একটুখানি গার্জেনগিরি ফলাবে না? পেটের ক্ষুধা মানুষকে এতটাই নতজানু করে! প্রস্তাব শুনে তো ইনসান আলীর চোখের কোনা ভিজে আসে। ঠোঁট বিড়বিড় করে সে জানায়- ভাত দেবার ভাতার না, কিল মারার আমি কে?

তার মানে, অনুমতি দিতে মোটেই আপত্তি নেই তার। বরং তার মতো অক্ষম অথর্ব বৃদ্ধ স্বামীর অনুমতিরও কেউ তোয়াক্কা করে- এটাই তার কাছে অবাক ঘটনা। এখনকার দিনে কে কার তোয়াক্কা করে! আগের দুই পক্ষ মিলিয়ে প্রায় দুই হালি ছেলেমেয়ে তার, এ দুঃসময়ে কে নেয় খোঁজ-খবর! বাপকে তিন নম্বর বিয়ে করতে দেখে তাদের গায়ে ফোস্কা পড়ে যায়, জন্মদাতা বাপকেই বাড়ি থেকে বের করে দেয়; উহ্‌ সে কী অপমান! বার্ধক্যে বিপত্নীক হবার জ্বালা যেন ওদের কাউকে সইতে না হয়। তেমন দুর্ভাগ্য যদি হয়-ই কারও, ইনসান আলী নিশ্চিত- মরিয়মের মতো মেয়ে পাবে না কেউ।

বৃদ্ধ স্বামী ইনসান আলীর এই আস্থা মরিয়মকে খুব দগ্ধায়, মর্মে মর্মে আগুন ধরিয়ে দেয়, এমনকি কর্তব্যবিমূঢ় করে তোলে। দূরে কোথাও কাজে গেলে সেদিন বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যায়, সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসিয়ে পঙ্খিরাজের মতো উড়িয়ে নিয়ে আসে ইনুচ। একেবারে উঠোন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যায়, যাবার সময় কখনও-সখনও রঙ-রসিকতাও করে- এসবের কিছুই কি নজরে পড়ে না ইনসান আলীর! দৃষ্টিশক্তি বা শ্রবণশক্তি ক্ষয়াটে হয়ে এলে অনেকের মনের ভেতরে নানান রকম সংশয় উঁকি দেয়, তখন সামান্য রজ্জুকেও সর্প বলে ভ্রম হয়। কিন্তু মরিয়মের ব্যাপারে ইনসান আলীর যেন কোনো রকম উদ্বেগ বা সংশয় নেই। মাটি-কাটা মহলের নারী-পুরুষের ঘর-ভাঙা, ঘর-গড়া নিয়ে কত না মুখরোচক কেচ্ছা হাওয়ায় নাচে! গ্রাম্য কবি ছইরুদ্দি সেসব কেচ্ছা ত্রিপদী পয়ারে বেঁধে হাটেঘাটে গেয়ে শোনায়। শ্রোতাদের সে কী উল্লাস আর উচ্ছ্বাস! সেই গানই আবার মানুষের মুখে মুখে ডালপালা ছড়ায়, খিস্তি-খেউড়ের গন্ধ জড়ায়। এ সমাজের মানুষ হিসেবে এসবের কিছুই যায় না ইনসান আলীর কানে! সে অচল-অক্ষম বলে বাড়ির বাইরে তার যাবার সুযোগ নেই বটে, কিন্তু এসব মজাদার কেচ্ছা-কাহিনী তো ঘরের ফাঁকফোকর গলে অনায়াসেই ঢুকে পড়ে! অথচ ইনসান আলী এসবের কিছুই যেন শুনতে পায় না। শুনেও তার বিশেষ কিছুই যায় আসে না।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও মরিয়মকে সে কখনও নাম ধরে ডাকে না। ডাকে ময়নার মা বলে। প্রতিবাদ করেনি মরিয়ম। ময়নাকে পেটে ধরেছে, জন্ম দিয়েছে, বড় করে তুলেছে। কাজেই ‘ময়নার মা’ পরিচয়টি তো মোটেই ছোট কিছু নয়। ময়নার বাপ তো এককথায় বউ তালাক দিয়ে ময়নাকেও দু’হাতে ঠেলে সরিয়েছে। কদাকার কুৎসিত কথা রটাতে একটুও মুখে বাধে না লোকটার। সেয়ানা মেয়ের মুখের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকায়, ঘাড়-মাথা দু’দিকে নাড়ায়, তারপর স্পষ্ট জানিয়ে দেয়- সে মোটেই মিল খুঁজে পাচ্ছে না। ময়না তার মেয়ে নয়। ময়নার বুকভাঙা আর্তনাদও তার সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারে না। অন্ধ দৈত্যের মতো এক ধাক্কায় সে সংসারের খুঁটি ভেঙে ফেলে। পেছনে ফিরে তাকায় না।

ময়নার মা আপন বাপ-ভাইয়ের সংসারে ফিরে এসে মরিয়মের ফেলে যাওয়া আসনটি তন্নতন্ন করে খোঁজে। খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়, মেলাতে পারে না। গতর ঢেলে ঘানি টানে সংসারের, তবু মন পায় না ভাই-ভাবিদের; এমনকি বাপের সহানুভূতিও দিন দিন কর্পূর হয়ে উবে যায়। অল্প দিনের মধ্যে মা-মেয়ে দুইয়ে মিলে জগদ্দল বোঝা হয়ে ওঠে ভাইদের অভাবী সংসারে। তারা এই বোঝা কাঁধ থেকে নামাবার উপায় খোঁজে। কী উপায়! স্বামী-সংসারের সোয়াস্তি মরিয়মের কপালে খুব একটা সয় না- সে প্রমাণ দু-দুবারের দৃষ্টান্ত থেকে যথেষ্ট পাওয়া গেছে, তবু পুনর্বার তার বিয়ের আয়োজন করা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে বোঝা নামিয়ে ভারমুক্ত হবার পথ আবিস্কারে তারা তৎপর হয় না। পিতৃবয়সী পাত্র জুটাবার পর ঘাড় বাঁকা করে বসে মরিয়ম নিজে। তার যুক্তি অত্যন্ত সোজা- ঘর-সংসারের সাধ খুব মিটেছে তার। ওপথে আর নয়। ভাই-ভাবি বোঝাতে চেষ্টা করে, পুরুষ মানুষের বয়স কোনো ব্যাপারই নয়, লোকটার ঘরে বউ নেই বলেই বিয়ে করতে চাইছে। এ আর এমন অন্যায় কিসের! মরিয়মের আপত্তি যে সেখানে নয়, সেটা বোঝাতেই সে দুম করে বলে ফেলে- আজ বাদে কাল ময়নার বিয়ি দিতি হবে, সিডা কারু নজরে পড়ছে না? এ প্রশ্ন শুনে সবাই নতুন করে ময়নার দিকে তাকায়। গ্রামে অমন দশ-বারো বছরে অনেক মেয়েরই বিয়ে হয়, ময়নারও হতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মরিয়মের এ আপত্তি ধোপে টেকেনি। গার্জেনরা সোজাসাপ্টা জানিয়েছে, সময় হোক, দেখা যাবে; ময়না তো ঘাড়ে-মাথায় বেড়ে লম্বা তালগাছ হয়ে যায়নি!

পাঠক, আমাদের এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র কিন্তু ময়না নয়, গল্পের বুননশৈলীতেও তার বিশেষ ভূমিকা নেই, তাই তার সম্পর্কিত বিবরণ বা বর্ণনাতে অধিক মনোযোগ আমরা দেব না। তবে হ্যাঁ, গল্পের শেষ পর্বে এসে আমরা যে আকস্মিক বাঁক বদলের খেলা দেখতে পাব, তার নেপথ্যে খুবই পরোক্ষ এবং দৃশ্যাতীত ভূমিকা এই মেয়েটির থাকতেও পারে, কিন্তু সে নিজে এ তথ্য যে জানে না- এ ব্যাপারে গল্পকার এক প্রকার নিশ্চিত; নদীজলে জোয়ার-ভাটা সৃষ্টিতে নিজের প্রভাব সম্পর্কে আকাশের চাঁদ কতটুকু অবহিত- সে প্রশ্ন যেমন কাজী নজরুলের গানে উত্থাপিত হয়েছে, ময়নার বেলাতেও সে প্রশ্ন সমানভাবে সত্য। কাজেই ময়না সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কিছু তথ্য জানিয়ে রাখাই যথেষ্ট হবে।

নানির মৃত্যুর পর ময়নাকে খানিকটা বাধ্য হয়েই চলে আসতে হয় মায়ের সংসারে। নতুন জায়গায় নতুন মানুষজনের মধ্যে যে তার ভালো লাগে, তা নয়। সংকোচে ম্রিয়মাণ দিন কাটে তার। সবেমাত্র যৌবনের আলো এসে ঠিকরে পড়েছে সারা শরীরে। সে আরেক বিড়ম্বনা। কারও দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারে না। এমনকি তার মায়ের স্বামী লোকটি কন্যাস্নেহে কাছে ডাকলেও কী যেন অজানা কারণে হাত-পা অসাড় হয়ে আসে, চোখের পাতা তড়পায়। অথচ সেই মানুষটিই দায়িত্ব নিয়ে বছর খানেকের মাথায় দূর সম্পর্কের এক মামাতো বোনের ছেলের সঙ্গে ময়নার বিয়ে দিয়ে দেয়। তারা যথেষ্ট ভালো আছে। দেহে-মনে কানায় কানায় পূর্ণ। দুটিতে মানিয়েছেও বেশ। ময়নার মা শুধু আনন্দিত নয়, তৃতীয় পক্ষের এই স্বামীর প্রতি প্রবল কৃতজ্ঞতাও অনুভব করে। বাপ না হয়েও লোকটি বাপের কাজ করেছে, অতি সঙ্গোপনে লুকিয়ে রাখা শেষ সঞ্চয়ের সবটুকু উদার হাতে খরচ করেছে এ বিয়েতে। মা-মেয়ে কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে পারে!

সেই কৃতজ্ঞতার কথা বারবার মুখের ভাষায় প্রকাশ করেও যেমন স্বস্তি হয় না মরিয়মের, কী যে ভিমরতি ধরে একদিন সে শরীরের ভাষার কাছে আশ্রয় খোঁজে। বিয়ের পর বয়সের বাধা ঠেলে তার স্বামী বেশ কয়েক দফা উদ্যত হয়েছে দাম্পত্য নদীতে স্নান করতে। কিন্তু সে কেবল প্রাথমিক উদ্যম পর্যন্তই, তারপর সাঁতার-অপটু বালকের মতো হাবুডুবু খেয়ে একাকার। মরিয়ম নিজের শরীরকে বোবা-বধির বানিয়ে রাতের প্রহর পার করেছে। কে জানে- আপন মেয়ে-জামাইয়ের বাঁধভাঙা শারীরিক উন্মাদনা অতি নিভৃতে তার ভেতরের নিভন্ত বাতির অচেনা কোনো সলতেয় আগুন ধরিয়ে দেয় কি-না। সে রাতে মরিয়ম স্বপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসে স্বামীর কাছে, প্রগাঢ় মমতায় ঘুম ভাঙাতে চায় তার শরীরের। পাথরে পাথর ঘষে আগুন বেরোয় বলে কি সেই পাথর কাদা-মাটিতে ঘষলেও জ্বলে উঠবে? সে রাতে বুকের বারুদ ভিজিয়েছে মরিয়ম বিনিদ্র চোখের জলে।

মরিয়মের জীবনে সর্বনাশের আগুন লাগে আরও কিছুদিন পর।

সেদিন বৈশাখের প্রথম দিন। বহুদূরে ছিল মাটি-কাটার কাজ। বিকেল থেকেই আকাশজোড়া মেঘের মাতামাতি। কাজের ছুটি হতে তবু দেরি হয়ে যায়। মরিয়ম পড়ি কি মরি করে উঠে বসে ইনুচের সাইকেলের ক্যারিয়ারে। নতুন কিছু নয়, এটাই এখন নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। দলের কেউ কেউ ভ্যানে বা ভটভটানো নছিমনে যায়, কেউবা জোড় বেঁধে সাইকেলে ওঠে। কদাচিত জোড় বদল ঘটলে তা নিয়ে সামান্য হাসি-তামাশাও হয়। রাত পেরোলেই সে রঙ আবার ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যায়।

মেঘের গর্জন ছাপিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয় ঝড়ো হাওয়ার মাতম। ধুলোবালির ঘূর্ণি এসে চোখে-মুখে ঝাপটা মারে। অতিদ্রুত ঘনিয়ে আসে অন্ধকার, তারই সঙ্গে ঝুম বৃষ্টি। তৃষ্ণার্ত মাটির বুক উদোম হয়ে যায়, বৃষ্টিকণা পড়তেই সে কী সোঁদা ঘ্রাণ! সারাদিন মাটি নিয়েই কেটে যায়, কই এই ঘ্রাণ তো কখনও পায়নি ইনুচ! ভারি ভালো লাগে সেই ঘ্রাণ, নেশা ধরে যায় মগজ পর্যন্ত। এদিকে সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে মরিয়ম ছটফট করে- বিষ্টিতে ভিজি গেলাম যে, দাঁড়াও কুথাও! দাঁড়াও!

কোথায় দাঁড়াবে ইনুচ! সামনের এই মাঠ পেরিয়ে তালসারি বাগানের পর গোলাপনগর, ঘনবসতির গ্রাম। অতদূর যেতে যেতে দু’জনেই কাকভেজা হয়ে একাকার। অন্ধকারে হ্যান্ডেল ঠিক রেখে সাইকেল চালানো সোজা কথা! গোলাপনগর প্রাইমারি স্কুলের কাছে আসতেই সাইকেলের ব্যালান্স হারিয়ে দু’জনেই লুটিয়ে পড়ে কাদাপানিতে। সাইকেল ফেলে ইনুচ দু’হাতে জাপটে ধরে মরিয়মকে। বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে উঠে আসে স্কুলের বারান্দায়। চমকে ওঠে ইনুচ- নাসারল্প্রেব্দর দরজায় আছড়ে পড়ে সোঁদা মাটির ঘ্রাণ। এতক্ষণের বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে তাদের দেহের ভাঁজে জমে ওঠা ধুলোমাটির আস্তর। তবু সে দিব্যি টের পায় বৃষ্টি পড়া মাটির মদির ঘ্রাণ!

পাঠক, আপনাদের হয়তো জানা থাকতে পারে- একই ঘটনার প্রতিক্রিয়া কখনো কখনো দু’জনের কাছে দু’রকমও হতে পারে। অথবা অন্যজনের কাছে অন্যরকম। আমাদের এ গল্পের নায়ক ইনুচের শক্ত বাহুবেষ্টনীর মধ্যে আটকে পড়া মরিয়ম সহসা বারুদের গন্ধ পায়। শুধু গন্ধ নয়, যেন-বা আগুনের উত্তাপে দগ্ধ হয় মরিয়ম। তখন সে খাঁচাবন্দি পাখির মতো ডানা ঝাপটায় এবং তার কণ্ঠ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে মৃদু ফোঁপানির ধ্বনি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত