পাগলা ঘরে আসি আর যাই

পাগলা ঘরে আসি আর যাই

আমার একটা তুমুল প্রেম ভেঙে গিয়েছিল ভোরবেলায়। লোকটার বউ ছিল, সন্তান ছিল। আর আমার ছিল অল্প বয়সের মাখোমাখো আবেগ, অন্ধ ছুটে যাওয়া।

তুলতুলে এক খরগোশ পুষেছিলাম। কোনো এক রাতে গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো তার। ভোরের আলো জ্বলে উঠবার ঠিক আগের মুহূর্তে একবার মৃদু খিঁচুনি তুলে মরে গেল সে।

সকাল ৯টায় অ্যারোপেল্গনের টিকিট কাটা বলে রাত ফুরোবার আগেই বাক্স গুছিয়ে গাড়িতে উঠত আমার প্রবাসী বোনেরা। ভোরের বাতাসে চুল নড়ত বারান্দার গ্রিলে গাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আমার বয়সী মায়ের। চারতলা থেকে যতদূর পারা যায় গাড়িটাকে অনুসরণ করত তার চোখ। তারপর ফিরে আসতেন ঘরে। ঘুমিয়ে পড়তেন। সন্তান চলে গেলে মায়েদের জেগে থাকবার সব সাধ ফুরিয়ে যায় বলে!

আমার সকল বিষাদ ভোরবেলার অবয়ব নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে আছে।

শৈশব থেকে আজ অব্দি ভোরবেলাটায় শুধুই কান্না পেত। মনে হতো, হাতের মুঠো ফসকে কী যেন কী বেরিয়ে যাচ্ছে আমার, ফুরিয়ে যাচ্ছে সব! ঠিক সেই মধ্যবয়সী লোকটার মতো। সারারাত আদর আদর কথা কইবার পর যে ফিরে গেল সেই ভোরবেলাটাতেই!

তখন আমার বুকের ভেতরে ফুরিয়ে যাবার, হারিয়ে ফেলবার তীব্র শোক। আমি উত্তরের বারান্দাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খুব করে ওই নির্বিকার ঈশ্বরকেই ডাকছিলাম। ঈশ্বরও বোধ করি সারারাত ভালোবেসেটেসে ভোরের ঘুম ঘুমোতে গিয়েছিলেন। বিন্দুমাত্র সাড়াও দিলেন না। আমি কুয়াশায় মাখোমাখো পথটার দিকে চেয়ে রইলাম। ঘরের ভেতরে কাঁথা-বালিশে জড়ানো বিছানাটা পড়ে রয়েছে হতাশায়। আমি তারই গভীরে নিজেকে সেঁদিয়ে দিলাম আর বললাম, আর যেন কোনোদিন আমার কারুকে ভালোবাসতে না হয়!

অথচ তোমাকে ভালোবাসবার পর মনে হতো, যেন আমি দেবী কোনো। মনে হতো, আমার অপরিণত বয়সের সব কাঁচামি আর প্রেমে পড়ার পাকামি সব মিলেমিশে এক তীব্র তীক্ষষ্ট ঐশ্বরিক শক্তি আমাকে ভর করেছে। যে শক্তি তোমাকে আমার দিকে ঝুঁকিয়ে রাখে নমমুখে, আধো আধো কথায়, হৃদয় সমর্পণে। মনে হতো যেন আমি একটা পরী। যেন আমার ডানা আছে। যেন আমি চাইলেই উড়ে এসে বসতে পারি তোমার বুকজুড়ে। যেন আমার নারী হৃদয় এই মোহের গভীরে ডুব দিয়ে দিয়ে তুলে আনতে চেয়েছে শুধু তোমাকেই। ভালোবাসা এমন একমুখী অবাধ্য হতে পারে! ভালোবাসা এমন দৃষ্টিহীন, বুদ্ধিহীন হয়ে যায়! ভালোবাসা এমন বোকা সে ভালোবাসাহীনতাকেও চিনতে পারে না। পারে না?

ভালোবাসলেও ভেতরের মানুষটা দিব্যি রয়ে যায় নিজের একান্ত আগুনটুকু নিয়ে। হয়তো সে আগুন লজ্জাবনত, হয়তো সে শান্ত, স্থির। হয়তো সে তুষের ভেতরে চুপ করে বসে থাকে, একা, বিস্ময় বিমূঢ়। তবু সেও টের পায় ভালোবাসার চলে যাওয়া, ফুরিয়ে যাওয়া, আর না থাকা। দেবীর মনও তাই কু ডাকে। পরীর ডানার শক্তি ক্ষয়ে যায়।

ভাবতাম ভোরটা অশুভ। বয়স বাড়লে জানলাম, জীবনে মানুষেরা আসে, সে শুধু চলে যাবে বলেই। যাবার কোনো কাল নেই। ভোর হোক, দুপুর কি রাত, সন্ধ্যা বিকেল, মানুষ যখন যেতে চায়, তাকে আর ধরে রাখা যায় না কোনোভাবে।

এক মস্ত সন্ধ্যায়, হলুদ আলোর নিচে পায়ে হেঁটে ফিরে আসতে হয় আমাকে। আর কোনোদিন দেখা হবে না। বিদায় শব্দটা, কিংবা ওই চলে যাওয়া, কি চলে আসা- যে নামেই ডাকি, মাথার ভেতরে সে এক অবোধ পাথর হয়ে বারবার বসিয়ে দিতে চেয়েছে আমাকে তোমার দরোজার সামনে, বিবাগী রাস্তার পাশে ধূসর ফুটপাথে। চলে আসা তবে এত সহজ সুন্দর নয়! এত অনায়াস নয়?

কেন সে এত কান্নামুখর! মৃত্যুর মতো হাহাকার নিয়ে যে কান্নারা আসে, আর কোনোদিন ছেড়ে যায় না! রয়ে যায় গোপনে, বুকের ভেতরে!

এই তো যেদিন আমি ফুলচন্দনে মাখা! আগের রাতে রাঙা আসরে আমাকে হলুদে চন্দনে মেন্দিতে ঢেকে একটা গোলাপ গোলাপ সুগন্ধি বউ করে দিয়েছে ওরা। মাথায় টিকলি জুড়িয়ে মোনাজাত ধরিয়ে দিয়েছে পরের দিন সকালে। বাড়ির ছোট মেয়ে থেকে হুট করে একটা লালবউ হয়ে গিয়েছি। দুপুরে নিজেকে নতুন তাঁতের শাড়িতে মুড়ে, শ্যাম্পু করা চুল পিঠময় ছড়িয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম পার্লারের উদ্দেশে। হঠাৎ মা বললেন, ‘বউ সাজতে কতক্ষণ লাগবে? কখন আসবি?’

মা এমন কেন বললেন? অভ্যাসবশত! তাই তো। আমিও তো জবাব দিতে যাচ্ছিলাম, ‘এই ধর ঘণ্টা চারেক।’

হঠাৎ মনে পড়ল, না তো, আমি তো আর ফিরব না এই বাড়িতে! এই যে যাচ্ছি, সেজেটেজে ওই পার্লার থেকেই তো চলে যাব কমিউনিটি সেন্টারে। তারপর সেখান থেকে সোজা শ্বশুরবাড়ি। তার মানে, এই বাড়ি থেকে এই আমার শেষ বেরিয়ে যাওয়া। আর কোনো ফিরে আসা নেই।

বয়সটা কম ছিল বলেই মনের কথা মনে রাখতে পারতাম না। বলে দিলাম মাকে, ‘আর ফিরব না তো মা। চলে যাচ্ছি। এই বাড়ি ছেড়ে।’

আমার মা আর দুই বোন অকস্মাৎ এ কথা শুনে বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইল মুহূর্তখানেক। তারপর ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল একযোগে।

ইস! সে এক কাহিনী বটে। আমি হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলাম। কান্না পেয়েছিল কি? জানি না। আমার কান্নারা আমাকে তাদের আসা-যাওয়া বুঝতে দেয়নি কখনও!

আমি খুব খেলতাম, জানো? সেই রোদ রোদ বারান্দাটার এ মাথা-ও মাথা আমার রাজ্যের খেলনা ছড়িয়ে থাকত। আমি সারাদুপুর ঘুরে ঘুরে পুতুলের ঘর সাজাতাম। একলা শিশুর একলা একলা খেলা। মাঝে মাঝে তাকাতাম দূরে- ওই নারকেল গাছের ঝিরিঝিরি পাতা বরাবর। ছায়াছায়া বাতাসে আলোতে! জীবন আর যাপনের জটিলতা আমাকে তখনও ততটা কাবু করে ফেলতে পারেনি বটে, কিন্তু বড্ড একা একা যেত দিনগুলো। এরই মাঝে হুট করে কোনো এক ভোরবেলা ট্রেন ধরতে হতো। ঘুম চোখে কোনোমতে রেডি হয়ে মায়ের হাত ধরে স্টেশনে আসতাম। পিছে পিছে বাবাকেও দেখতাম, আসছে। নীলফামারীর ট্রেনটা হুইসেল বাজিয়ে চলতে শুরু করলে জানালা দিয়ে বাবার শুকনো করুণ মুখখানা কুয়াশার গভীরে লীন হয়ে যেত। ভোরবেলার আদিম গন্ধটা বিদায়ী কান্নার বাষ্পে আর বিষাদের অদ্ভুত আঁধারে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে উঠত আমার বুকের ভেতরে। ট্রেন চলত, আমি জানালার পাশে বসে সুকুমার রায় খুলে বসতুম। বাবার মুখখানা মনে পড়ত বারবার। তাকাতাম মার দিকে। অভিমানী মা তখন কমলালেবু ছিলে ছিলে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরেছে।

আমরা যাচ্ছি বড়খালার বাড়িতে। রাগ করে মা এমন নাইওর যেত প্রায়ই। নেহাতই শিশু বলে সঙ্গী হতাম আমিই। অন্য বোনেরা থেকে যেত বাসাতেই।

ভোরকে তাই আমি ভালবাসতে পারিনি। ভোরবেলাটা বিচ্ছেদের বেদনা নিয়ে এসেছিল শৈশবে। অথচ ভোর একা নয়, দায়ী ছিল ট্রেনও, দায়ী ছিল পথঘাট, দোষ ছিল বাবার, ভুল ছিল মায়েরও।

অনভিজ্ঞ শৈশবে তবু ভোরবেলাকেই আসামিকাষ্ঠে তুলে বকা দিতাম। তারপর কত কত সন্ধ্যা, দুপুর, বিকেল, গভীর রাত এসেছে জীবনে, বিদায় দিতে দিতে সেইসব একেকটি সময়ের মুখে কালো কালো কলঙ্কের স্থায়ী ছাপ পড়ে গেছে। আমি তাদের বুকভাঙা রূপ দেখতে দেখতে নিজেকে সইয়ে নিতে চেয়েছি সকল বিদায়ের আঘাত থেকে। কেননা, সইতে পারাই জীবন। আর যা কিছু তা সবই ব্যর্থতার খাতায় উঠে যায়। এই যেমন আমাদের আবেগ, বুকের ভেতরে জমে থাকা কান্নার ঢেউ, ঠোঁটের কাঁপুনিতে প্রকাশিত প্রেম অপ্রেম, অপমান, অবহেলা- সব। এমনকি ওই মেঘটাও, যাকে আমি সঙ্গী ভেবে চোখ রাখি বিমানের জানালা বরাবর, অথচ সেও একবুক বেদনা নিয়ে ভাসতে ভাসতে কোথায় ভেসে যায়! অথচ ওর ভেসে যাবারই কথা। মেঘের জীবনই তো তাই! তবুও যখন বিরহ বুকে ধরে ভাসতে শুরু করে, তখন ওই মেঘই এক ব্যর্থতার দলিল।

পরাজিত মেঘ, বিরহী মেঘ, প্রেমে পড়া মেঘ, প্রেমক্লান্ত মেঘ- সকলেই এক ও অভিন্ন। ভাসতে ভাসতে ভেসে যাচ্ছে কোথায়? তোমার জানালায়? নাকি সেই নিরানন্দপুরে? দুপুরের ভেতরে আরও আরও দুপুর খুঁড়তে নেমে যাচ্ছে মাটিতে? বিমানের পাখায় পাখায় যে রঙধনুর হামলা হয় প্রতিবার, পাহাড়ের পিচ্ছিল শরীর বেয়ে ঢলে পড়ে যে হৃদয়ের রঙ, সেইসব অদ্ভুতুড়ে কা, সবই কি আমার বানানো? নাকি আমি নিজেই একটা আস্ত অদ্ভুত, যাকে কেউ আজ অব্দি বুঝে উঠতে পারল নাকো! কে জানে! হয়তো ওই মেঘই জানে, যেহেতু ওকেই বারবার ছেড়ে যেতে হয়। যেহেতু মেঘ পাহাড়ের মতো স্থির নয়!

এই যে একটা গান, ওকেও যদি ধরে রাখতে পারতাম! কিন্তু গানও কি থাকে? ওরও তো শেষ আছে। বাণীর, সুরের, গায়কীর, তালের, লয়ের, ওরও তো বাড়ি ফিরতে হয়। ওরও সংসার আছে, ঠিক তোমার মতো। যেরকম ওই লোডশেডিংয়ের রাতে তোমাদের নিজস্ব জলসায়, যেমন আমি এক নিতান্ত বহিরাগত। তবু ওই সুর লয় বাণী- সবই শুনতে পাই। তারাদের ভেতরে আরও আরও তারা যত যত আলোই ঢালুক, তারপরও এরচেয়ে বেশি অন্ধকার আর কোনোখানে হয় না কোথাও, যখন তুমি আমার থেকে দূরে! যখন তুমি কবিতা পড়ছ। যখন তোমাদের গান হচ্ছে মৃদুস্বরে। আমি তখন ছেড়ে যেতে যেতে, দূরে যেতে যেতে নিজেকে নিজেই একবার স্পর্শ করি।

চুম্বনের জন্য সারা সন্ধ্যে কাটিয়ে দিলাম যে জানালায়, রুপালি গ্রিলের দিকে ধেয়ে আসা জ্যোৎস্নার দিকে সেই চুমু ছুড়ে দিই। গানগুলো এত আপন, তবু গানেরাও ছেড়ে যাচ্ছে। ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে, তবু চলেও যাচ্ছে।

“নাথ তুমি এসো এসো ধীরে/ সুখ দুখ হাসি নয়ন নীড়ে/ লহো আমার জীবন ঘিরে/ সংসারে সব কাজে ধ্যানে জ্ঞানে হৃদয়ে রহো”

হৃদয়, হৃদয়, তুমিও কি যাও চলে? তুমিও কি ছেড়ে যাও সকালের মেঘ? দুপুরের ছায়া, সন্ধ্যের প্রেম? রাতের চুমুগুলো? তুমিও কি ছেড়ে যাও আমাদের? আমাদের বুকও কি শূন্য হেয়ে যায় প্রেমহীনতায়? পাখির ঠোঁটের গভীরে যে তৃষ্ণা নিয়ে আমাদের সময় শুরু হয়, তাও কি একদিন ছেড়ে যায় আমাদের? আমরা কি আমাকে, তোমাকে, আমাদের ছেড়ে যেতে যেতে একদিন এক বিস্বাদ বিবর্ণ সময়কে আবিস্কার করে ফেলি? কেন আমাদের সব ছেড়ে যাওয়ারাই তুমুল বিপন্নতা নিয়ে হামলে পড়ে প্রতিবার? কেন আমাদের প্রতিটি প্রেম মৃত্যুর মতো আঁধারসহ ঘিরে ধরে বারবার?

আমার যে গান তোমরা নিয়ে নিলে, আমিও তার স্বত্ব ছেড়ে দিলাম। ভালোবেসেই দিলাম। যেহেতু আমি নিজেই প্রস্তুত চলে যাবার জন্য। এই এক মুঠো জীবনে এইটুকু জানতে পারা গেল, বারবার চলে যেতে পারাই জীবন, প্রকৃত অর্থে। গেঁড়ে বসা নয়। আমাদের অন্তর্গত বোধ, বেদনা, দহন- এইসব বিপুল হিসাব-নিকাশের পাতা উল্টে উল্টে যা পাই, তার নাম- না পাওয়াই। তোমাকে না পাওয়া, নিজেকেও না পাওয়া। না পেতে পেতে ছেড়ে চলে যাওয়া। ছেড়ে যেতে যেতে আবার নতুন করে পাওয়া। আসলে কী পাওয়া?

দাঁড়িয়ে ছিলাম ছাতিম গাছের নিচে। রোদ পুড়িয়ে ছায়া দিচ্ছিল মরা দুপুর। আমার হাতের মুঠোয় সাদা কাগজে কালিতে ঘামে নাভিশ্বাস উঠেছে প্রথম প্রেমের। তুমি আসবে বলে দাঁড়িয়ে আছি ঠাঁয়। বুকের ভেতরে ঘুঘু ডাকছে। মাথার ভেতরে ঘাই দিচ্ছে পানকৌড়ি। আমার শ্যামবর্ণ ত্বকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা কিশোরী ব্রণ আর বেণিতে জড়ানো সাদা ফিতের স্যাটিনের কোমলতা ঠাওর করে করে তুমিও চলে এসেছ পথ চিনে। ছাতিম গাছের ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে একটা অস্থির চুমু! এরপর আমাদের গোবেচারা কৈশোর ওই লেকের জলে নিজের মুখ দেখিয়ে দেখিয়ে লজ্জা দিচ্ছিল। তারপর পুরোটা বিকেল শুধু আলোদের চলে যাওয়া দেখতে দেখতে ভেবেছি, এভাবে আলো নিবে গেলেই সন্ধ্যারা আসে। আর সন্ধ্যে নামার আগেই বাড়ি ফিরতে হয়। মুখ ধুয়ে পড়তে বসতে হয়। প্রতিটি উৎসবের আগে-পরে পাড়ার মাইকে চিত্রা সিংয়ের গান, মাঠজুড়ে মরিচবাতির আলো, ডেকোরেটরের হৈ রৈ, তোমার ওই ভিড়ে মিশে যাওয়া, বারান্দায় দাঁড়িয়ে উৎসব দেখার উসিলায় আমি কোনো এক গ গ্রামের মেয়ের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম, কেন কে জানে! কেন আমার মনে হলো, এই উৎসবই শেষ উৎসব! এরপর আর কখনও কোনোদিন এমন সাড়ম্বরে আমরা আর পরস্পরকে কাছে পাব না! অথচ আমরা তো কাছেই ছিলাম না মোটে। দোতলার বারান্দা থেকে পাড়ার মাঠ- এই দূরত্ব ডিঙিয়ে আমাদের চোখাচোখি, এটাই মস্ত হয়ে বুকের ভেতরে বীণা বাজিয়ে যাচ্ছিল। আর এই উৎসবসমাপ্তিতে সেই বীণখানাই ভেঙেচুরে আছড়ে পড়ল দ্বিগুণ বেগে!

ঠিক যেরকম হতো কালবৈশাখীর দিনেও। আষাঢ়ের কালে। সন্ধ্যায়। মধ্যরাতে। অথচ বহুকাল আমরা পরস্পরের নামটা পর্যন্ত জানতাম না। এরপর ছেড়ে যাবার কালেও আমরা একে অপরকে বিদায় কথাটিও উচ্চারণ করতে পারিনি। কিন্তু একে একে মালপত্র বাঁধাছাদা, ট্রাকে উঠোনো, গাড়িতে উঠে পড়ে জানালা দিয়ে বাড়িয়ে দেয়া মুখ, তুমি তখন কোথায় কোন রকের আড্ডায় কান্না মুছতে ভিড়ে মিশে গেছ? নদী পেরিয়ে যেতে যেতে আমি মেলে ধরেছি উপন্যাসের পাতা। যাও পাখি, শীর্ষেন্দুর লেখা।

পাখি, তুমি তবে যাও! যেরকম প্রতিটা সন্ধ্যা চলে যায়, সেই একই সন্ধ্যা আর কি ফিরে আসে? যে মানুষ কবরে শুয়ে পড়ে, ঘাসের বিছানা তাকে জড়িয়ে ধরে বুকে, শিরশিরে হাওয়ার কাঁপনে তারও কি কখনও খুব একা লাগে? সেও কি আবার ফিরে আসতে চায়? নাকি আমরাই? আমরা কি কখনও কোথাও কবরের পাশে বসে থাকি ঠাঁয়, যদি তার একা একা লাগে- এইটুকু ভেবে?

যে সন্ধ্যাকে আমি ছেড়ে এসেছি কৈশোরে, যে কবিতার বই হারিয়ে গেল তাড়াহুড়োয়, আমার তরুণবেলা, মেঘের মতো দিন, সব কেমন ছেড়েছুড়ে গেল একের পর এক! আমি ওদের কাউকেই আটকে রাখতে চাইনি। কোনো উত্তাল মিছিলেও তো খুঁজিনি কখনও চিরস্থায়ী সমাধান। যে মানুষটা আজ পাশে বসে ছিল, যখন একই ভাঁড়ে করেছি চা পান, একটি শলাকায় আগুন জ্বালিয়ে ধরিয়েছি নেশা, বুদবুদের মতো আমাদের পরস্পরের ধোয়া মিলেমিশে এক হয়ে গেছে সঙ্গমের মতো। কিন্তু ফের উঠে চলে এসেছি যে যার মতোই। সে হারিয়ে মিশে গেছে স্লোগানে, আমিও হয়তো কবিতায়, অথবা রোজগারে। শাহবাগের মোড়ে ভিড়ে ঠাসা বাসে নিজেকে সেঁদিয়ে দিয়ে সোজা একটানে এসে নেমে গেছি নাবিস্কোর মোড়ে। তখনও হয়তো সে দাবি আদায়ে ওপরে ছুড়ছে হাত, জ্বালাচ্ছে মশাল, চিবিয়ে খাচ্ছে মাথা শত অনুজের।

যার যার পথে আমরা একলা পথিক। চেনা আলোর ছায়াটুকু যখন ছেড়ে যায়, তখন প্রবল আঁকড়ে ধরি পরস্পরকে। কেন এই অন্ধ বোধটুকুকেই জীবন বলে ডাকি? কেন তাকে বেঁচে থাকা ভাবি? এইসব ভুল ভুল ভাবনার অপচয় ছেনেছুনে, কাদামাটির প্রলেপ দিয়ে বারবার কেন জীবনই গড়তে চাই?

ফ্রেঞ্চ টোস্ট কফির ঘ্রাণ ঘিরে রেখেছে রেস্টুরেন্টটাকে। মন কেমনের ধোঁয়া উড়ছে, বুক ভারী করা মেঘ হচ্ছে। সেই মেঘ কেটে বৃষ্টি নামবে একবার- এই স্বপ্ন ঠোঁটে গুঁজে বসে আছি মুখোমুখি। তোমার ত্বকের লাবণ্যকণা, আমার বেদম বখাটেপনা, আমাদের খুঁটিনাটি ঝুঁকিটুকি, ভয়-অভয়, বৈধ-অবৈধ, চুমুটুমু, সঙ্গমটঙ্গম ওই হারাই হারাই পাখিটার ডানার নিচে গুটিশুটি শুয়ে আছে। লুকিয়ে আছে। আত্মগোপনে আছে। আর আমরা যুদ্ধে আছি।

ভালোবাসা একটি যুদ্ধ। ভালোবাসা মানে জানেন শুধু কবি রফিক আজাদ। ভালবাসলে চলে যেতে হয়, সেটি জানতেন নির্মলেন্দু গুণ। তোমাকে ছেড়ে যেতে যেতে, কিংবা তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে যেতে, আমরা কবে হারিয়ে ফেললাম ছেড়ে যাবার বোধটোধ, আবেগ-টাবেগ, ব্যথাট্যথা সব! তবু কি ছেড়ে যেতেও পারলাম?

তোমার বুকের নিশ্চিন্তপুরে একটি বাসা গড়েছি আর সেই আবাসে কত কত ঝড় হয়, জল হয়, মেঘ ডাকে, বজ্র পড়ে ধুমধাম। তবু যে জীবন আমি ছেড়ে ছেড়ে যাই, বেলায় অবেলায়, পাওয়ায় না পাওয়ায়, সেই অধীর অস্থির পথচলার কালও এই নিশ্চিন্তিপুরের উঠোনে এসে স্থির হয়, শান্ত আর ধ্যানী হয়। কফির পেয়ালা সরিয়ে রেখে, বেয়ারার হাতে টিপস গুঁজে দিয়ে, ক্লান্ত বিবর্ণ দুটো মানুষ ফিরে যায় যার যার ঘরে। শুধু এই নিশ্চিন্তিপুরই একলা রয়ে যায়।

আমরা সেই পাগলা ঘরে আসি আর যাই, যাই আর আসি। আমাদের গোপন আদরে, ঈর্ষায়, কলহে, অন্তহীন মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবার পরেও, তুমি আমার নাম ধরে ডাকো। আমি তোমার নাম ধরে ডাকি। কাছে ডাকা মানে, কাছে কাছে থাকা।

আমাদের তাই যাওয়া হয় না কোথাও। আমাদের তাই ফেরা হয় না আদতে সেই ঘরে, যে ঘরকে ঘর বলে জানি। ঘর কি তবে তাই-ই, যার কাছে আদতে আমরা কখনও ফিরে আসি না? তুমিও না, আমিও না!

তবে তুমি রোজ রোজ ‘বিদায়’ বল কেন? তবে আমি রোজ রোজ ‘বিদায়’ বলি কেন?

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত