সবুজের বাবা একাব্বর আলি প্রায়ই কিছুদিনের জন্য গায়েব হয়ে যায়। একেকবার ফিরে এসে নতুন নতুন সব গল্প। সাথে থাকে সবুজের জন্য আজগুবি সব উপহার। যেমন এবার এনেছে একটা পাখি। তাও আবার যেনতেন পাখি নয়- সুখ পাখি, যে কিনা কথা বলতে পারে। এরপর এই সুখ পাখিটা কোথায় কেমন করে পেল সেই গল্পের পালা। একাব্বর আলি তার বিড়ি খাওয়া ফেসফেসা কণ্ঠে রূপকথার গল্পের মতো উৎকণ্ঠা নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলে। এবার উত্তরে গেছিলাম। সমুদ্রপথে সাতদিন ছয় রাত নোকার জার্নি, তারপর একটা লাল মাটির দ্বীপ। সেইখানে গিয়া এক জাদুকররে পাইলাম- তার জটা ধরা চুল বহন করতে আবার আরেকজন লোক লাগে। আর চোখের পাপড়ি গুলান বোধহয় প্রায় ইঞ্চি খানেক লম্বা হইব। এত লম্বা চুল আর এত বড় চোখের পাপড়ি আমি এর আগে কোনো মানুষের দেখি নাই। তাও আবার ব্যাটা ছেলে। জাদুকর সে, তবে রুমালের ভেতর থিকা খরগোশ বাইর করার জাদু কিন্তু সে দেখায় না। সে গল্প বলে। রাজারাজড়ার গল্প। আর গল্প যতদূর আগায় চোখের সামনে তা ততদূর সত্যি হইয়া ভাইসা উঠতে থাকে। সুখ পাখি, পঙ্খিরাজ ঘোড়া কিংবা সোনার হরিণ সব। দশ বছরের ছেলে সবুজ তার সমস্ত বুদ্ধি-বিবেচনা আর স্বপ্ন কল্পনার যুক্তি নিয়ে হাঁ হয়ে শোনে তার বাবা একাব্বর আলির সেসব আজগুবি গল্প কথন। বিদেশি ওই জাদুকরের গল্পের মতোই একাব্বর আলির গল্প জগতের পাত্রপাত্রীরাও সবুজের চোখের সামনে সত্য হয়ে ধরা দেয়। আর তার সাথে প্রমাণ তো আছেই। জাদুকরের জাদুকরি সুখ পাখি- যে কিনা গল্পের ফাঁকে ফাঁকে এমন এমন সব শব্দ অনুকরণ করে যাতে কিনা গল্পের নাটকীয়তা আরও বহুগুণ ঘনীভূত হয়ে ওঠে। কয়েকদিন রাতের পর রাত চলতে থাকে। এই স্বপ্ন বাস্তবতার খেলা। একাব্বর আলির গল্প কথার পসরা। কিছুদিন পর গল্প ফুরিয়ে এলে আবার গায়েব হন তিনি নতুন কোনো স্বপ্ন গল্পের খোঁজে।
স্বচ্ছ পানির নিচে পোনা মাছের নাচন দেখতে দেখতে সবুজ তার বাদামি চোখ কচলায়। সূর্য যখন দূর গ্রামের ওইপাড়ে পানির শেষ মাথায় গিয়া টুপ কইরা ডুব দেয়, হোগলার চাটাইয়ের ওপর হইলদা হারিকেনের আলো ফুটাইয়া তখন টাপুরটুপুর গ্রামে সন্ধ্যা নামে। মা মরা সবুজের চারপাশের সেই কমলা মাটির ঘরটা যেন জাদুকরের সেই সোনার রাজ্যে পরিণত হয়। শুরুতে সবুজের একলা লাগে না। দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোটে পাশের বাড়ির মাদুলি খালার হাত থেকে। আর কথা বলা সুখ পাখির মুখে নিত্যনতুন শব্দ, ব্যস আর কী চাই। রাতের বেলা মাথার ওপরের ছনের ছাউনি উড়ে যায় কল্পনার জোয়ারে। সেখানে তারাদের ফুল ফোটে। রূপালি চাঁদের রোশনাই যেন একাব্বর আলির গল্পের রেশ হয়ে ছেয়ে থাকে সারাটা রাত্তির জুড়ে।
কিন্তু একাব্বর আলির গায়েব থাকার দিন যতই বাড়তে থাকে সবুজের চোখের নিচের কালি ততই গাঢ় হতে থাকে। একাব্বর আলির গড়ে যাওয়া স্বপ্নরাজ্যের আনাচে-কানাচে ঘুরে ঘুরে দুর্গ জয়ের আনন্দ যখন ফুরিয়ে আসে সেই স্বপ্ন রাজ্যের জৌলুসও তখন ততই ম্লান হতে থাকে। তখন সবুজের একলা লাগে। তার মায়ের অভাব বোধ হয়। বৃষ্টির মতো কান্না পায় তার। মাঝরাতে সেই বৃষ্টির শব্দ গ্রামবাসী শুনতে পায় না, শুনতে পায় না মাদুলি খালাও। তারপর রাত ভোর করে সে অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে। দূর আকাশের অচেনা পাখির দল তাকে একলা ফেলে রেখে চলে যায় যার যার গন্তব্যে। হয়তো একাব্বর আলির সাথে তাদের দেখাও হয়, কথাও হয়। কিংবা হয় না, একাব্বর আলি নিজেই কেবল জানে সে এবার কোন পথে গ্যাছে। হ্যারিকেনের হলুদ আলো কমলা মাটির ঘরে রহস্যময় রাত্রি নামায়। গরাদের মতন জানালার বাইরে সাদা জোনাকির ঝাঁক সবুজকে ও তার একাকিত্বকে যখন আরও নিবিষ্ট করে তোলে, তখন জোনাকি গুনতে গুনতে সে সিদ্ধান্ত নেয়, এইবার সে তার বাবাকে আর নতুন কোনো স্বপ্নরাজ্য খোঁজার সুযোগ দেবে না।
তারপর আবার একাব্বর আলি ফিরে আসে নতুন গল্পের পসরা নিয়ে।- এবার গেছিলাম দক্ষিণে। সারি সারি নারিকেল গাছের দূর দূর রাস্তা পার হওয়ার পর দেখি যতদূর চোখ যায় তুলার বাগান। সেইখান দিয়া পার হওয়ার পথে তুলার ঝড়ে বেহুঁশ হইয়া সেই মাঠে পইড়া থাকলাম দু’দিন এক রাত। তারপর এক ডানাওয়ালা পরী আমারে তার ঘরে নিয়া সুস্থ করল। একাব্বর আলির সাথে এইবার সেই পরীর ডানা থেকে খুলে আনা একটি চমৎকার গোলাপি পালক। কিন্তু সবুজের বাদামি চোখে এবার আর স্বপ্ন নাচে না। একাব্বর আলির গল্প কথায় সে অতর্কিতে হামলা চালায়। – এইবার তুমি আর কোনো দিকে যাইতে পারবা না। আমার কান্না লাগে একলা ঘরে। একাব্বর আলি তার কষ্ট বুঝতে পারে, তাকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে সে। সান্ত্বনা দেয়।- ঠিক আছে বাজান আর যামু না। তয় হইলো কি শোন- বলে আবার এক কল্পনার রাজ্য গড়েন তিনি। ছোট্ট সবুজ নিজেরই অজান্তে সেই গল্পের অলিতে গলিতে আবারও হারিয়ে যায়। কিছুদিন পর একাব্বর আলি তার স্বভাবের কাছে নিরুপায়। যথারীতি আবার গায়েব হন তিনি।
আবার স্বপ্নের দিন ফুরিয়ে গেলে। পরীর ডানার পালক কিংবা সুখ পাখির চমক সবুজকে আর ব্যস্ত রাখতে পারে না। আবার সবুজের বৃষ্টির মতো কান্না পায়। আবার সেই কান্না গ্রামবাসী শুনতে পায় না, মাদুলি খালাও না। আবার রাত ভোর হলে পাখিরা সবুজকে একা ফেলে চলে যায়। আবার কমলা মাটির ঘরে হলুদ হ্যারিকেন জ্বলে। এভাবে সবুজের চোখের নিচের কালি গাঢ় হলে একাব্বর আলি আবার ফিরে আসে। এবার তার সাথে সবুজের মতো হুবহু আর একটা সবুজ। সবুজ আবারও তার সমস্ত বুদ্ধি-বিবেচনা আর যুক্তির রাজ্যকে এক করে হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকে তার বাবা একাব্বর আলির দিকে। একি দেখছে সে? জলজ্যান্ত আর একটা সবুজ? একাব্বর আলি বলে- গেছিলাম পশ্চিমে। সেখানে গিয়া দেখি বিরাট মেলা বসছে- মানুষের মেলা। এ দোকান সে দোকান ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ দেখি এক দোকানে এই সবুজ দুই। ব্যস পকেটে যা পয়সা ছিল সব দিয়া কিনা আনলাম তারে। তুই খুশি হইসস বাজান। এইবার আর তোর একলা লাগব না। এই সবুজ দুই তোর সাথে খেলব, কথা কইব, গান কইব।
এইবার একাব্বর আলি গায়েব হলে সবুজের সময়টা ভিন্ন কাটে। সবুজ দুই সবুজের সাথে খেলে, কথা কয়, গান কয়। কিন্তু এটাই সবুজের জীবনে নতুন সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। সবুজ আর তার সেই কল্পনার রাজ্যের দরোজা খুঁজে পায় না। কিংবা যখনই বা যতবার সে সেই দরোজার সামনে যায় সবুজ দুই সেখানে পিছুটান হয়ে দাঁড়ায়। একটা সরব উপস্থিতি সবুজের এতদিন ধরে গড়ে তোলা স্বর্গরাজ্যের সুখ স্থিতি যেন ভেঙেচুরে খান খান করে দিতে থাকে। দশ বছরের ছেলে সবুজ। তাই সে বুঝতে পারে না তার কমলা মাটির ঘর কেন আর স্বর্ণরাজ্যে পরিণত হয় না। সেই ঘরকে তার কেবলই এক জীর্ণ মলিন একাব্বর আলির গরিব-ঘর মনে হতে থাকে। আকাশে তারারা আর ফুল হয়ে ফোটে না। দূর আকাশের পাখিদের কথাও তার আর মনে হয় না, আর রাতভর জোনাকি গোনা তো অসম্ভব। আসলে বোধহয় এতদিন ধরে সবুজ তার যে পৃথিবী গড়েছিল সবুজ দুই সেখানে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ভাগীদার হয়ে দাঁড়ায়। সবুজের সবুজ দুইকে আর ভালো লাগে না। একাব্বর আলির নিয়ে আসা অন্যসব উপহারের মতোই এই উপহারটাও সবুজের কাছে ম্লান হয়ে আসে। এবার সবুজের বৃষ্টির মতো কান্না পায় না। মরুভূমির মতো মন খারাপ হয়।
কিছুদিন পর একাব্বর আলি যথানিয়মে আবার ফিরে আসে। কোনো এক আজব দেশের আজব গল্পের উপাখ্যান নিয়ে, আর সাথে বিশ্বাসযোগ্য উপঢৌকন নিয়ে। কিন্তু ঘরে ঢুকেই সে আবিস্কার করে সেখানে একটাই সবুজ আছে। সে তার ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কিন্তু সে বুঝতে পারে এটা তার ছেলে নয়, এটা সবুজ দুই হবে হয়তো। তবে তার ছেলে সবুজ গেল কোথায়? সবুজ দুইও জানে না তার উত্তর। একাব্বর আলি বুঝতে পারে কোথাও কোনো বড় ঝামেলা হয়ে গেছে। তার কপালের ভাঁজে উৎকণ্ঠা হয়, মগজের গহ্বরে প্রশ্নেরা কা কা করে। আর দূরে কোথাও কোনো তুলার ঝড়ে, কোনো ডানাওলা পরীর অপেক্ষায় সবুজ এক তখন তার প্রথম গল্পের খোঁজে পাড়ি দিয়েছে।