আমার সামনে তেইশ চব্বিশ বছরের এক যুবক, হাতে হুমায়ুন আহমেদের তেঁতুল বনে জ্যোৎস্না। এখনকার ছেলেমেয়েদের উপর হুমায়ুন আর তার ভাইদের প্রভাব ব্যাপক। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে আমরা সামনাসামনি বসে, কিন্তু কথা হয় নি। শুরুতে ছেলেটা চেষ্টা করছিল গল্প জমানোর। আমি পাত্তা দেই নি। এই বয়সের ছেলেদের সাথে গল্প করতে হয় না, নিয়ম নেই। মেয়ে মানুষ হলে না হয় টুকটাক আলাপ করা যেত।
প্রায় চার বছর পর খুলনা যাচ্ছি, মুশারফের বিয়ে। শুধু যে মুশারফের বিয়ের জন্যই যাচ্ছি তা না অন্য কারণও আছে। কি কারণ পরে বলছি।
খুলনায় কোনদিন ট্রেনে গিয়েছিলাম কিনা মনে পড়ছে না। আজও যাওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না। রাস্তায় অবরোধ দেখে বাধ্য হয়েই চিত্রার কেবিন রিজার্ভ করl। অবরোধের কারণটাও অদ্ভুত। স্কুলের বাচ্চারা নাকি রাস্তার ট্রাফিক কন্ট্রোল করছে, সেই দুঃখে পরিবহন মালিক সমিতি অবরোধ ডেকেছে। অদ্ভুত এক দেশে আছি। যার কাজ সে করে না, অন্য লোক করে। গায়ক অভিনয় করে, অভিনেতা রাজনীতি করে, রাজনীতিবিদ গান গায়, কি এক অদ্ভুত চক্র!
ট্রেনে উঠার পর থেকেই মেজাজটা খিঁচড়ে আছে। ঝাঁকড়া চুলের গিটারওয়ালা তেইশ চব্বিশ বছরের লাফাঙ্গা ছেলের সাথে এক কেবিনে বার ঘণ্টার ভ্রমণ করতে হলে কার মেজাজ ভালো থাকে বলেন? আমজাদকে (আমাদের অফিসের পিওন) বলেছিলাম সিঙেল কেবিন রিজার্ভ করতে, সে পায় নি। রাস্তায় অবরোধ থাকায় ট্রেনের উপর নাকি চাপ বেশি।
ট্রেন এখন ঈশ্বরদি। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়াবে মনে হয়।
-চা খাবেন? ছেলেটা প্লাস্টিকের কাপে চা এগিয়ে দিতে দিতে বলল। ছেলেটার হাতেও একটা কাপ, তার মানে সে কনফিডেন্ট যে আমার চা খাওয়ার অভ্যাস আছে।
-আপনি বারবার চাওয়ালাদের দিকে তাকাচ্ছিলেন, আর আমার নিজেরও ইচ্ছে হচ্ছিল চা খেতে।
-আসলে আমি চা তেমন খাই না … চাওয়ালার দিকে এমনিতেই তাকিয়ে ছিলাম… কিন্তু আপনি যখন এনেছেন খাবো, খাবার নষ্ট করা ঠিক না।
ছেলেটা হতাশ চোখে তাকিয়ে ছিল…
কোনো কথা না বলেই চা শেষ করলাম… ছেলেটা একবার বাইরে তাকায় আরেকবার তাকায় ট্রেনের ছাদের দিকে… অস্বস্তি গোপনের চেষ্টা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা দরকার।
– আমি জাহাঙ্গীর, খুলনা যাচ্ছি
– আমি অয়ন… একই গন্তব্য
– আপনি কি করেন গেইজ করবো?
– হুম করেন
– আপনি মেডিকেল স্টুডেন্ট… অ্যাম আই রাইট?
– কিভাবে বুঝলেন?
– (বেশ ভাব নিয়ে) আমার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ভাল, আপনার ব্যাগে একটা মাউথোয়াশের বোতল, আর ফার্স্ট-এইডের কিট দেখলাম। ডাক্তাররাই সাধারণত এসব নিয়ে জার্নি করে। আপনার এইজ ডাক্তার হওয়ার মতো না।
– আরেকটা বিষয় আপনি কথা কম বলেন। সাধারণত ডাক্তারি পড়ুয়ারা সাধারণের সাথে কথা কম বলে। নিজেদের মেধাবী ভাবে তো। সবসময় সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভুগে।
বেশি বেশি মিসির আলি পড়লে যা হয়! এই ছেলে নিজেকে মিসির আলি ভাবছে। হুমায়ুন আহমেদের এই এক সাফল্য, পাঠকের উপর তার গল্পের চরিত্রগুলো ভর করে।
– আচ্ছা বুঝলাম। কিন্তু আপনার পর্যবেক্ষণে গলদ আছে। আমার সার্টিফিকেট বয়স উনত্রিশ। অরজিনাল কত শিওর না … দুই এক বছর তো বেশি হবেই। তো ডাক্তার হওয়ার মতো বয়স তো আমার হয়েছে, কি বলেন!
– ওহ স্যরি। তাহলে আপনি মেডিকেল স্টুডেন্ট না মেডিকেল অফিসার… আমার অ্যাজাম্পশন তো কাছাকাছিই ছিল।
– ঘটনা হল আমি ছাত্র হিসেবে অতি নিম্নমানের, যেকারণে আমার বাবা-মা সায়েন্সে পড়ানোর সাহস করেন নি।
ছেলেটা এবার দমে গেছে … আর কথা বলছে না। এই টাইপের ছেলেরা খুব ওভার কনফিডেন্ট হয়। এদের কনফিডেন্স একবার ভেঙ্গে দিলে এরা রোহিঙ্গাদের থেকেও অসহায় বোধ করে।
নাহ ছেলেটাকে এভাবে তাচ্ছিল্য করা ঠিক হয় নি। গোমট পরিবেশটায় তাজা বাতাস দেয়া দরকার …
– আপনার বাড়ি কি খুলনায়?
– নাহ নারায়ণগঞ্জ, আপনার?
– ময়মনসিংহ, খুলনায় কেন যাচ্ছেন?
– আসলে আমার জিএফ এর বাড়ি খুলনায়… ওর সাথে দেখা করতেই যাচ্ছি।(একটু লাজুক হেসে)
– জিএফটা আবার কি?(পিএফ এর কথা জানি…প্রতি মাসে এই বাবদ অনেক টাকা কেটে নেয়… না জেনে উপায় আছে!)
– হা হা … গার্ল ফ্রেন্ড… সংক্ষেপে সবাই এটাই বলে।
– আচ্ছা
– খুবি চিনেন? ফারহানা মানে আমার প্রেমিকা খুবির ছাত্রী।
– হুম চিনি…
এই ছেলের সাথে আর কথা বলার মানে হয় না।।সারা রাস্তা সে তার জিএফ এর কাহিনী শুনাবে… তার চেয়ে ঘুমানো ভাল…
– খুলনায় কি ঘুরতে যাচ্ছেন?
– নাহ, একটা বিয়েতে এটেন্ড করতে…
– শুধুই কি বিয়েতে ?
– কেন বলুন তো?
– আপনি শুরু থেকেই কিছু একটা নিয়ে টেনশন করছেন…মনে হচ্ছে কিছু একটা খুলনায় ফেলে এসেছেন। দেরি করলে অন্য কেও নিয়ে যাবে … বারকয়েক গার্ডকেও ট্রেন পৌঁছানোর সময়টা জিজ্ঞেস করলেন। কারো বিয়েতে এটেন্ড করার জন্য নিশ্চয়ই এত ছটফট করছেন না।
নাহ যতটা বলদ ভেবেছিলাম অয়ন ততটা বলদ না… এর সাথে সমস্যা শেয়ার করা যায়… আবার তার প্রেমিকাও যেহেতু খুবির ছাত্রী আমার কাজটা সহজেই করে দিতে পারবে।
– আপনার প্রেমিকার মতো আমিও খুবির ছাত্র ছিলাম…
– ও আচ্ছা
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভাবছি দ্বিতীয় কারণটা অয়নকে বলব কিনা… অবশ্য বললেও কোনো সমস্যা নাই… ট্রেন থেকে নামার পর ভবিষ্যতে অয়নের দেখা হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যই বলা যায়। আর এমনিতেও খুলনা পৌঁছুতে আর ঘন্টা পাঁচেক লাগবে… টেনশনে ঘুমও আসছে না…
– কই কিছু বলছেন না যে?
হটাৎ অয়নের কথায় চিন্তায় ছেদ পড়ল…
– আমি আসলে একজনকে খুঁজতে যাচ্ছি খুলনায়…কিন্তু তার নাম ঠিকানা কিছুই জানি না… শুধু জানি খুবিতে পড়ে।
– কি বলেন আপনি নিজেও তো ওখানকারই ছাত্র
– হুম…
– তাহলে?
– পরিচয় জানার সুযোগ হয়নি, বলতে পারেন সুযোগটা হেলায় নষ্ট করেছি।
– খুলে বলুন
– বলছি … খুবি থেকে ৫টা দশে বিভিন্ন রুটে বেশ কয়েকটা বাস ছাড়ে…..দেখেছেন?
– হুম একদিন ঐ বাসে করে ক্যাম্পাস থেকে ফারহানার বাসায় গিয়েছিলাম।
– আমার বাসে খুব একটা চড়া হতো না। হলে থাকা কারোরই আসলে বাসে চড়ার দরকার পড়ত না। কিন্তু পরিবহন ভাতা ঠিকই দিতে হয়। আমি এই ভাতার কিয়দংশ উসুল করার চিন্তা করলাম। এক বিকেলে আমি মুশারফ আর ওমার ডাকবাংলার একটা বাসে উঠে বসলাম…
– ওমার,মুশারফ এরা আপনার ফ্রেন্ড?
– নাহ ছোটভাই…কিন্তু বন্ধুর মতই…কিংবা বন্ধু থেকেও বেশি। যাইহোক, বাসে উঠে পেছনের দিকে জানালার পাশে একটা সিটে বসলাম। পাশে ওমার। গাড়ি চলতে শুরু করার পর, একটা সুঘ্রাণ পেতে লাগলাম। চোখ বন্ধ করে সুঘ্রাণে ফুসফুস পূর্ণ করছিলাম…ঐ যে শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনে ছেলে মডেলরা নেয় না ঐ রকম।
– কিসের ঘ্রাণ ছিল ?
– শ্যাম্পুরই ছিল… সামনের সিটের মেয়ের চুল থেকে আসছিল। আগে খেয়াল করি নি যে, সামনে এত চমৎকার চুলের অধিকারী এক মেয়ে…মেয়েটার চেহারা দেখার জন্য মন উশখুশ করছিল… কিছুক্ষণ পর সে পেছন ফিরল। চেহারা হুমায়ুন আহমেদের গল্পের নায়িকাদের মতো। অপ্সরি বলাটা মোটেও বাড়াবাড়ি হবে না।
– তারপর?
– ওমার আর মুশারফের সাথে মেয়েটার চুল নিয়ে উল্টাপাল্টা মন্তব্য ছুড়ছিলাম…অনেকটা এখনকার ইভটিজিংয়ের পুরাতন সংস্করণ। বুঝতেই পারছেন বয়স কম, আপনার মতো জিএফও ছিল না। অবাক করা বিষয় কি জানেন… মেয়েটা আমাদের কথা বেশ উপভোগ করছিল। আশকারা পেয়ে পুরা রাস্তাই ওর চুল নিয়ে কবিতা আওড়াতে থাকি। পিটিআই মোড়ে মেয়েটা নেমে যায়…
– এরপর কোথায় দেখা হয়েছিলো?
– নামার পর লাজুক মুখে নিচের দিকে তাকিয়ে বার দুয়েক হাত নেড়েছিল… এরপর আর দেখা হয়নি। ওমার বলেছিল নিচে নেমে কথা বলতে, আমার সাহসে কুলোয় নি।
– জানেন… ওর ঐ লাজুক মুখ এখনো আমার চোখে লেগে আছে… কোথাও সেই শ্যাম্পুর ঘ্রাণ পেলেই থমকে দাঁড়াই।
আমি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলাম… অয়নের ফোন বেজে উঠল। মনে হয় ফারহানা দিয়েছে…
– জাহাঙ্গীর ভাই উঠেন… দৌলতপুর পার হয়ে এসেছি।
অয়নের ডাকে উঠে বসলাম… রাতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম খেয়াল নেই।
– রাতে ফারহানার সাথে কথা বলে এসে দেখি আপনি ঘুম। চেহারা খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল তাই আর ডাকি নি। ফারহানাকে বলব সেই অচেনা যাত্রীকে খুঁজে বের করতে?
– হুম বলতে পারেন।
ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকছে। বসে বসে পরিকল্পনা আঁটছি কিভাবে ওকে খুঁজে বের করব… আস্তে আস্তে ট্রেন থামল। কেবিন থেকে বের হতেই একটা ঘ্রাণ পেলাম… পরিচিত সেই ঘ্রাণ। চোখ বন্ধ করে ফুসফুস পূর্ণ করা দরকার। জানি এখানে সে নেই। কিন্তু ফুসফুসে ভাল কিছু ঢুকাতে তো মানা নেই।
চোখ খুলে যা দেখলাম তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না, অয়নের হাত ধরে হাসছে একটা মেয়ে… হুমায়ুন আহমেদের গল্পের নায়িকার মতো তার চেহারা, কি যেন নাম বলেছিল অয়ন! থাক মনে করে আর লাভ নেই। প্লাটফর্মের এই দিকটায় প্রস্রাবের গন্ধ, এই বগি দিয়ে নামার কোনো মানে হয় না।