বৃহন্নলা

বৃহন্নলা

ষোল পেরিয়ে গেলেও এ যাবত আলমের মত সুশ্রী, সুন্দর আর সুপুরুষ দ্বিতীয়টি দেখেনি শাকিলা। ঝারা ছয় ফুট লম্বা, উজ্জ্বল শ্যামলা রঙের পেটা পেশীবহুল শরীর। মনকারা হাস্যোজ্জ্বল চেহারা। নিমিষেই যে কোন নারীর নজর কেড়ে নিতে সক্ষম।
শের-এ-বাংলা মহাবিদ্যালয়। নবীন বরণ অনুষ্ঠান। শাকিলা ও তার চাচাতো বোন, বন্ধু, সহপাঠী মিলা। যেন এক বৃন্তে প্রস্ফুটিত দুই ফুল। একই রকম দেখতে। উভয়ের জন্ম একই সময়ে। শাকিলা মাত্র এক দিনের বড়। অস্থির হরিণীর মত চঞ্চল। সেই শিশু শ্রেণী থেকেই উভয়ে এক ক্লাসে। রেজাল্টও বরাবর পাশাপাশি। এস এস সি তে দুইজনই গোল্ডেন এ প্লাস রেজাল্ট করে এখন এই কলেজে ভর্তি। দু’জনের চেহারার মিল যথেষ্ট লক্ষ্যণীয়। অনেকেই শাকিলা ও মিলাকে জমজ বোন ভেবে ভুল করে। তাদের চলন বলন, আচরণ অত্যন্ত আকর্ষণীয়। অনেক যুবকই কামনার তীব্র দহনে জ্বলে পুড়ে মরে। অথচ কেউ কখনো নেতিবাচক প্রভাব বিস্তারের সাহস করেনি। সাহস করেনি কখনো মুখ ফুটে কিছু বলার। কারণ কুংফু-ক্যারাতে শাকিলা বিভাগীয় চাম্পিয়ন, আর দু’জনের এক সাথে বø্যাকবেল্ট অর্জনের খবর প্রায় সকলেই জানে।

আজকের অনুষ্ঠানে শাকিলা এসেছে কাল রঙের কমপ্লিট পরে টাই লাগিয়ে বুট পায়ে। র‌্যাবের মত রুমালে লুকানো লম্বা চুল আর কাল সানগ্লাস পরিহিত শাকিলা যেন বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‌্যাবের দুঃসাহসী নওজোয়ান। আর মিলা লাল শাড়ি-ব্লাউজে বাংলার কিষাণ বধূর নিষ্পাপ প্রতিচ্ছবি।

পরপর কয়েকবার ঈর্ষণীয় ফলাফলের পর শের-এ-বাংলা মহাবিদ্যালয় এখন জেলার সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানের নবীন বরণ। পাশের বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র- ছাত্রীদের ভীড়ে গমগম করছে। অনুষ্ঠানের সাংস্কৃতিক পর্বে শাকিলা – মিলার যৌথ অভিনয়–

“যদি বউ সাজো গো,
আরও সুন্দর লাগবে গো”

জনপ্রিয় এই বাংলা গানে ঠোঁট মেলানো। একগানেই বাজিমাত। মুহুর্মুহু হাততালিতে মুখরিত পরিবেশ। কিন্তু এরপরেই মঞ্চে আসে কলেজের সবচেয়ে সুদর্শন ছাত্র সিরাজুল আলম। আলমের আগমনে যেন অনুষ্ঠানে ফিরে আসে অদ্ভুত এক সুন্দর ভাবগাম্ভীর্যময় পরিবেশ।

এরপর তার গানের ভরাট কন্ঠ সহসা শাকিলার হৃদয় তন্ত্রীতে তীব্র আঘাত হানে। মুহূর্তেই কেন যেন সব এলোমেলো হয়ে যায়।
আলমের কন্ঠ শুনে হয় কালজয়ী কন্ঠ শিল্পী বাংলার কিংবদন্তী আব্দুল জব্বার। অথবা বছরের সৈয়দ আব্দুল হাদী স্বয়ং মঞ্চে হাজির। আবার মনে হয়, না না, এ যে সিরাজুল আলম। কারো সাথেই এর তুলনা চলে না। সবার চেয়ে ব্যতিক্রম এক স্বর্গীয় সুরের অভূতপূর্ব মূর্ছনা! রূপ লাবণ্যে উচ্ছল এক সুন্দর সুপুরুষ যার কাছে রূপকথার রাজপুত্র হার মানতে বাধ্য। অনার্স শেষ বর্ষের সেরা ছাত্র। কোটিপতি ব্যবসায়ী আশরাফুল আলম সাহেবের একমাত্র সন্তান। একমাত্র বলেই তুখোড় মেধাবী হওয়া সত্তে¡ও আশরাফুল আলম সাহেব তাকে হাতের কাছে এই শের-এ-বাংলা মহাবিদ্যালয়ে রেখেছেন। তাঁরই বিশেষ প্রচেষ্টায় শের-এ-বাংলা মহাবিদ্যালয় আজ এত উন্নত। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকল্প এই মহাবিদ্যালয়। অবশ্য ধনী, প্রভাবশালী পিতার সুবাদে নয়, নিজের আদর্শেই আলম ঈর্ষণীয়। ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, আকর্ষণীয় গঠন, আবেদনময় চেহারা, মনকারা কন্ঠ।

আলমের গানের পর অনুষ্ঠানের আর কিছুই মাথায় ঢোকেনি শাকিলার। শাকিলার এই আনমনা অবস্থা মিলার নজর এড়ায় না। অনুষ্ঠান শেষে ফেরার পথে জিজ্ঞাসা করে, “হঠাৎ কী হল তোর? এমন নিরবতার রহস্য কি?”

কিছু ভাল লাগছে না। বাড়ি চল, তারপর সব বলবো।

শাকিলার কথায় রহস্যের গন্ধ পেয়ে মিলা আর কথা বাড়ায় না।

শাকিলা, মিলা-দের একান্নবর্তী পরিবার। দুইবোন এক ঘরেই থাকে।শাকিলাদের পরিবার রক্ষণশীল তবে ধর্মান্ধ নয়, আধুনিকতার ছোঁয়ায় উজ্জ্বল তবে তথাকথিত অত্যাধুনিক নয়। যৌবন তরঙ্গে উচ্ছল এই দুইবোন কখনো শালীনতার গন্ডী অতিক্রমের সামান্য চেষ্টাও করেনি। ধর্মীয় অনুশাসনের শৃঙ্খল ছাড়াই তারা ধর্মপরায়ণ।

সমসাময়িক কালের তরুণীদের চোখে ঈর্ষণীয়, অনুসরণীয় বা অনুকরণীয় জুটি।

রাতে ঘুমানোর আগে মিলা পুণরায় শাকিলার সেই ভাল না লাগার কারণ জানতে চায়। শাকিলা তখন কোন রকম রাখ ঢাক না করে আলমের জন্য হঠাৎ করে দুর্বল হয়ে পরার কথা সরাসরি খুলে বলে। তখন মিলা হাসতে হাসতে তাকে বলে, “এতে ভেঙ্গে পরার কি আছে? তোর মত মেয়ের ‘অফার’ পেলে ওর চৌদ্দ গোষ্ঠীর ছটফটানি শুরু হয়ে যাবে।”

–কিন্তু আমার ভেতর এই অস্থিরতার কারণ কি মিলা?

–কারণটা ঘোড়ার ডিম। এর নামই তো প্রেম।

যার কারণে রাজা রাজ্য ছাড়ে, সন্তান ছাড়ে পিতামাতা।

–সমস্যা তো সেখানেই। কারণ আমরা সেই পিতামাতার সন্তান নই। তাদের ছেড়ে যাওয়া তো দূরের কথা, মতের সামান্য বাইরে যাওয়ার শিক্ষাও আমরা পাইনি।

–তা ভাবছিও না আমি। ভাবছি কায়দা করে কোন এক সময়ে আমিই যোগাযোগ করে প্রথমে আলমের নিকট এ বিষয়ে প্রস্তাব দেবো। প্রস্তাবে সামান্য সাড়া পেলেই পরবর্তী করণীয় আমিই ঠিক করব।উভয় পক্ষের অভিভাবকদের সম্মতিক্রমেই সব ঠিক করবো ইনশাআল্লাহ্। এখন লক্ষী মেয়ের মত ঘুমা।

একসময় উভয়ে ঘুমিয়ে পরে। তবে আধো ঘুম, আধো জাগরণে শাকিলার রাত কেটে যায়। আলমের দরাজ কন্ঠের আবেগী সুর বারবার কানে বাজে।

“হাজার তারার ভীড়ে

হাজার বছর ধরে

খুঁজেও পাবে না তুমি আর।

এইতো আমি হারিয়ে যাবো

চলে যাবো বহুদূরে —”।

এরপর সময়ের গতিতে সময় চলে যায়। হরিণীর মত চঞ্চল বিদ্যালয় মাত করা শাকিলা কলেজে এসে কেমন যেন শান্ত, চিন্তাক্লিষ্ট, অস্থির। মিলা সবই বোঝে আর মনে মনে মিলা মওকা খোঁজে।

হঠাৎ একদিন কাঙ্খিত সেই সুযোগ মিলে যায়। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বুধবার দিন। প্রচন্ড দাবদাহে সকলেই অস্থির। পাশের কনফেকশনারী থেকে আইসক্রিম কিনে ফিরছিল। পথে শুরু হয় ভয়াবহ কালবৈশাখী। দৌড়ালে ঠিকই শাকিলাদের নিকট পৌঁছতে পারতো। কিন্তু যখন দেখলো আলম সাইকেল গ্যারেজের দিকে দৌড়ে আসছে তখন সে ঐ গ্যারেজে দাঁড়িয়ে পড়ে। আলমও কয়েক মুহূর্ত পর ঐখানে আশ্রয় নেয়। সুযোগ বুঝে সাতপাঁচ না ভেবে মিলা আলমকে শাকিলার পক্ষে সরাসরি প্রস্তাব দেয়। আলম মৃদু হেসে অন্য প্রসঙ্গে টুকটাক দুই-চারটি কথা বলে। অতঃপর পরদিন বিকেলে দুইবোনকে একসাথে খালের ধারে তালগাছটার নীচে দেখা করতে বলে।

হায়রে জীবন! কত সহজেই জীবনে কত কি ঘটে। নিমিষেই কতক জীবনে কতই না পরিবর্তন হয়ে যায়। কে রাখে অত শত হিসাব! জীবনকে মনে হয় চলন্ত কবিতা। জীবন মানে জ্বলন্ত ইতিহাস। আনন্দ-বেদনা ভরা বা রহস্যঘেরা কুহেলিকা। নীহারিকা, ধুমকেতুর অন্তর্নিহিত রহস্য ভেদ করা সহজ হলেও জীবনের রহস্য দূর্ভেদ্য! অন্ধকারে ঢাকা যেন ঘন ঘোর ধোঁয়াশা। জীবন নদীর কূলকিনারা সুখ-শান্তির সোপানে না দুঃখের কাঁটা ভরা বাগানে তা কে জানে! জানে না মিলা আর শাকিলাও যে তাদের আনন্দের ঐপারে কি অপেক্ষা করছে।

পরদিন দুই বোন, সহপাঠী, বান্ধবী নির্ধারিত সময়ের আগেই যায়গায় উপস্থিত। আলম উপস্থিত তারও আগে। যথারীতি হাসিমুখে সকলের কুশল বিনিময়। শাকিলার মুখে হাসি থাকলেও অন্তরে কালবৈশাখী ঝড়। হঠাৎ আলম মিলার হাত ধরে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“দুনিয়াটা বড়ই বিচিত্র মিলা। বৈচিত্র্যময় জগতের সবচেয়ে বিচিত্র আমরা। হ্যাঁ মানুষের জীবনটা বড়ই বিচিত্র। পাশাপাশি সুদীর্ঘ সময় বসবাস সত্বেও কত স্ত্রী ষোলআনা জানে না স্বামীকে, আর অনেক স্বামীও বুঝে উঠতে ব্যর্থ হয় তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রীকে। আর তোমাদের খুব সামান্য সময়ের দেখা, সম্পূর্ণ অজানা এই আমিটাকে তোমরা যে কিছুই জান না সেটাই খুব স্বাভাবিক। সুতরাং আমাকে ভাই বা বন্ধু হিসাবে তোমরা দুই জনেই চাইতে পারো আপত্তি নাই। কিন্তু তার চেয়ে কেউ বেশী অগ্রসর হলে তার সর্বনাশ হবে।”

—তবে কি আপনি কারো নিকট প্রতিশ্রুতিবদ্ধ? না বিবাহিত?

—না মিলা না। এর কোনটাই নয়।

— তাহলে?

এতক্ষণে শাকিলা কথা বলে —

“তাহলে আর কি, আমি উনার যোগ্য নই।”

—-কাউকে আমার যোগ্যতার মাপকাঠিতে মাপার সৌভাগ্য নাই শাকিলা। আসলে আমি নিজেই চরম অযোগ্য, অপদার্থ। তুমি ভুল করতে যাচ্ছো, চরম ভুল, যার মাশুল অতি নির্মম!

—কিন্তু আমি তো তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে আমার জীবন সঙ্গী কোনদিনই ভাবতে পারবো না। তোমার পায়ে পড়ি, আমাকে সীমাহীন দুঃখের সাগরে ভেসে দিও না।

—শাকিলা শান্ত হও। জীবন মোটেও তুচ্ছ নয়। অশান্ত আবেগে জীবন চলে না। আমার অক্ষমতা ক্ষমা কর।

—হাঃ হাঃ হাঃ। অক্ষমই বটে। কোটিপতি ব্যবসায়ী আশরাফুল আলম সাহেবের একমাত্র সন্তান অক্ষম! কলেজের সবচেয়ে সুদর্শন, মেধাবী ছাত্রটাইতো অক্ষম।

— আমার জীবনই একটা রঙিন ফানুস! এই জীবন শতসহস্র নীল নীল বিষাক্ত বেদনার রঙিন জলছবি!

—ঐ বেদনাক্লিষ্ট সুন্দর ছবিটা আঁকড়ে ধরে আমার জীবন নদীর অচেনা পথে পাড়ি জমাতে চাই! তুমি আমার জীবন তরীর যোগ্য
মাঝি, শতজনমের ভালবাসা, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দর, সাহসী, প্রত্যয়ী সুপুরুষ।

আলমের চোখ জলে ছলছল করে। কণ্ঠের শব্দ জড়িয়ে যায়। ঈশানের ঘনকালো মেঘ যেন দ্রিম দ্রিম করে গর্জে ওঠে, “ভুল শাকিলা, সবই মারাত্মক ভুল। আমি কখনোই পুরুষ ছিলাম না, এখনো নেই। আমার জীবনের সবচেয়ে নির্মম সত্য উচ্চারণ এই যে আমি পুরুষের আবরণে ঢাকা এক চরম ভাগ্যহত বৃহন্নলা।”

আকাশের ঘনকালো মেঘ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। শুরু হয় প্রচন্ড কালবৈশাখী ঝড়। মুহুর্মুহু মেঘের গর্জন আর দুনিয়া কাঁপানো ঝড়বৃষ্টির মধ্যেই আলম দৌড়ে হারিয়ে যায় আঁধারে। শাকিলা দুঃখ ব্যাথায় কাতর হয়ে সেই বৃষ্টিঝড়ের তান্ডবের মাঝেই মিলার বুকে ঢলে পড়ে। কানে তখনও বাজতে থাকে আলমের সেই বিষাদ ভরা সুর,

“এইতো আমি হারিয়ে যাবো

চলে যাবো বহুদূরে —

হাজার তারার ভীড়ে

হাজার বছর ধরে

খুঁজেও পাবে না তুমি আর।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত