মা আইজ কী বার গো?
-কেন রে, বাবা?
-না; শইলডা কেমন জানি করতাছে।
-কি অইছে তোর?
-তেমন কিছু না, ব্যতাডা বাড়ছে।
-আরে আইজ তো বিশসুদ বার। বুজছি। একাদশীর কারণেই এই ব্যতা। একাদশী তিথিতে বাবা নতুন পুরান সব ব্যতা দেহা দেয়। সমুদ্দের যেমন জোয়ার আইয়ে তেমনি আমাদের দেহের মাজেও জোয়ার-ভাটা আছে। বাবা এই দেহের মাজে হাজার হাজার নদী আছে। সেহানেও তিথি আইলে জোয়ার হয়, ভাটা নামে। হুন বাবা ওশুদ খাইয়া ল্যা।
-এক বছর হইল মা। জানোয়ারের কথা মনে অইলে এহনো বুক কাঁপে।
রাজনের মা মিনতীবালা। বড় বাপের কাছে দেহতত্ত্বের কথা যখন শোনে, তখন তার বয়স নয় বছর। বড় বাপ ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির। তিনি প্রায়ই গুনগুনিয়ে গান গাইতেন। টুটা জাল ঠিক করতে করতে মনের মাঝে সুর খেলা করত তার। মিনতীবালা কখনো-সখনো হুক্কা দিতে গিয়ে গানের দু-চার পদ শুনে ফেলত।
-অ বড় বাপ তুমি কী গাও!
বড় বাপ বা হাতে হুক্কা নিয়ে বলে- তুই মা এসব বুজবি নে।
-কও না তুমি।
মিনতীর মিনতিতে শেষে বড় বাপ বলে- এইখানডায় বঅ দেহি।
শোন- শ্যামের বাঁশি বৃন্দাবনে, ডাকে সদাই রাধে রাধে
আমি রাধে উদাস মনে কেমনে ঘরে রই।
কথা দিয়ে ব্রজের বাঁশি, কলিতে গৌরাঙ্গ আসি
হৃদয়পুরে ভাসায় প্রেমরসে (সই)
বড় বাপ গানটা শেষ করতে পারেনি, গলা ভেঙে আসে। দু’চোখ জলে ভিজে যায়।
-বড় বাপ তোমার চোক্ষে জল।
-মা তুই অহন যা। এইসব তুই মা বুজবিনে।
মিনতী চলে আসে। এই বড় বাপের কাছ থেকে মাঝে মাঝে মন শিক্ষা, দেহতত্ত্ব, ব্রজের রাধাগোবিন্দের গান শুনেছে। মিনতীর বিয়ের দু’বছর আগে বড় বাপ স্বর্গবাসী হয়। মিনতীর তিন ছেলে, দু’মেয়ে। রাজন হচ্ছে মেজো, তার বড় ভাই রাজস আর ছোট ভাই রজত। তিন ছেলের বড় দু’মেয়ে। চৌদ্দ-পনেরো পেরোতে না পেরোতে বিয়ে হয়ে যায় ওদের। মিনতীর স্বামীর নাম উপেন দাস। সরল মানুষ। কম কথা বলে সে। সংসারের ছোট-বড় সিদ্ধান্ত সব মিনতীকেই নিতে হয়। জল-মাছ- বাজার-জাল এই নিয়েই উপেন দাসের জীবন। সন্তান কীভাবে বড় হলো, কখন কী প্রয়োজন তার দিকে খেয়াল নেই তার। এই নিয়ে ঘরে অভাব কথার যুদ্ধ চলে। মিনতী যত কথাই বলুক না কেন, তার কথায় কোন জবাব দেয় না উপেন। কেবল এক পক্ষের যুদ্ধ। সংসারটা একপক্ষের খবরদারিতে চলতে লাগল।
যেদিন আকাশীবিল থেকে মাছ ধরে ঘাটে ভেড়ে। সেদিন হঠাৎ কিছু লোক নৌকা থেকে টেনেহিঁচড়ে প্রথমে রাস্তায় ওঠায় রাজনকে। তারপর ওদের দল বাড়তে থাকল। রাজন হকচকিয়ে যায়। কিছুই বুঝতে পারছে না। এরই মাঝে দু-তিনজন ছেলে তাকে কিল-ঘুষি দিতে লাগল।
মাঝবয়সী এক লোক তার পাছায় লাথি মেরে বলে-
-শালা পেইজ বুক চুদাছ।
আরেকজন বলে-
-হেরে এহানেই জেন্তা পুইত্তা ফেল। শালা বাইনচোদ।
সেদিন থানা-পুলিশ হবার সময় রাজন তার মূল অপরাধ সম্পর্কে জানতে পারে। পরদিন হাজার হাজার মানুষ পুরো গ্রাম তছনছ করে দেয়। যত মন্দির ও মূর্তি ছিল তাও ভাংচুর থেকে রেহাই পেল না। ওই দিনগুলো শুয়ে শুয়ে রাজন আজ আবার স্মরণ করল। ভয়াবহ স্মৃতি বুকের মাঝখানে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। রাজন ভুলেও ভুলতে পারে না। রাজনের বড় ভাই রাজেস অনেকটা তার বাপের মতো হয়েছে। মুরব্বিরা বলে- রাজেস বাপের ধারা পাইছে। কিন্তু রজত ঠিক তার উল্টো। খুব জেদি স্বভাবের হয়েছে। পড়াশোনায় তার মেধা আছে বলেছেন স্কুলের কৈলাস স্যার। মায়ের পরেই সংসারের কর্তা বনে যায় রাজন। রাজন যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, তাতে তার মায়ের কোনো দ্বিমত থাকে না। তাই রজতকে আর মাছ মারার কাজে পাঠায় না সে। রজত এখন বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যায়। এ বছর রজত স্কুল পাস দিয়ে কলেজে ভর্তি হয়। ঘরে এক আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। রাজন চায় তার ছোট ভাই একদিন কলেজ পাস দিয়ে বড় অফিসার হবে। যারা তাকে বিনা অপরাধে মেরেছে, মন্দির ও গ্রাম ভাংচুর করেছে তাদের ওপর একদিন খবরদারি করবে এই রজত। রাজনের ভাবনাগুলো বড় হতে থাকে। আর একটু একটু করে আকারও পেতে থাকে।
রজত কলেজে পড়ার ফাঁকে ডাকবাংলোর ঘাট থেকে ভলাকুট বাজার পর্যন্ত নৌকার মাঝি হিসেবে কাজ করে। যেসব যাত্রী নিয়মিত তার নৌকা দিয়ে চলাচল করে, তারা জানে রজতের শিক্ষার দৌড়। তাই তারা ওকে সম্মানের চোখে দেখে। আর রজতেরও জল-নৌকা এসব নিয়ে থাকতেও ভালো লাগে।
একদিন ক্লাস শেষে জামিল স্যার রজতকে ডেকে বলেন- শোন রজত আগামী পরশু তোমার নৌকাটা দরকার আছে।
-কেন স্যার?
-একজন মহান ব্যক্তি আসবেন সেদিন। বলতে পারিস রাজার চেয়েও বড়, মহারাজা। ধর গত বছর যত জন মহা মহা ব্যক্তি এসেছেন তোমাদের গ্রাম ও মন্দির দেখতে, তাদের চেয়েও তিনি অনেক বড় মানুষ। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো গে ওই মানুষটি তোমাগো জাতের। সমুদ্রে মাছ ধরা মানুষ। তার সঙ্গে আরও গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও আসবেন।
-তয় স্যার নৌকার দরকার কী।
-তারা সবাই প্রথমে ভলাকুট কে বি স্কুলে যাবেন। তারপর সেখান থেকে ফিরে তোমাদের গৌরমন্দির দেখবেন। যদি সময় পান তবে তোমাদের পাড়ার দু-চারজন মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন।
-স্যার অসুবিধা হবে না। আমাগো নৌকা ঘাটে থাকবে নে।
সেদিন রজত খুশি মনে বাড়ি ফেরে। রাতে মেজো ভাই রাজনের সঙ্গে অতিথিদের ব্যাপারে কথা বলে।
রাজন- স্যার কী বলল রে, আমাগো জাতের মানুষ। মহারাজা। তা অলে তো দেহন লাগে।
-হ দাদা, জামিল স্যার, আরও কইল, তিনি নাকি সাগরে মাছ ধরতেন। পড়াশোনাও করতেন। হের মাঝে নাকি জেদ ছিল একদিন অনেক বড় হবেন বলেছেন স্যার। জানো, শেষে কলেজের অধ্যক্ষ হইয়া অবসর নিছেন তিনি।
-তয় এইডার মাজে মহারাজা হবার কী আছে। কত বড় শিক্ষিত মানুষ ঢাকা থাইক্যা আইছে হেগ থাইক্যা তিনি কী এমন বড় মানুষ।
-দাদা, আসল কথা তো তোমারে কই নাই। স্যারে কইছে তিনি নাকি অনেক বড় লেখক। দেশে-বিদেশে ঘুইরা বেড়ান। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় তার বই পড়ায়। আর বড় কথা অইচে তিনি আমাগো জাতের বিষয় নিয়াই লেখেন বেশি।
সেদিন রাতে রজত ওই মহান লোকটির কথা ভাবতে ভাবতে মনের মাঝখানে একটা রূপ নির্মাণ করে তার মতো করে। তারপর একসময় ঘুমিয়ে পড়ে সে।
পরদিন সকাল ১০টায় ডাকবাংলো ঘাটে নৌকা নিয়ে আসে রজত। জামিল স্যারের কাছ থেকে মহারাজার জীবনের বিভিন্ন গল্প শুনতে থাকে সে। আর কিছুক্ষণ পরপর স্যার কাকে যেন ফোন করছেন। আর কতক্ষণ লাগবে ঘাটে পৌঁছতে। দু-চার বার ফোনে মানদা নামটি বলেছেন স্যার। রজত বুঝতে পারছে ওই মানদাই তাদের নিয়ে আসছেন।
যাহোক ১০টা পেরিয়ে শেষে অতিথিরা পৌনে এগারোটায় ঘাটে আসেন। নৌকার কাছেই একটা চায়ের টং। তার পাশেই সারি সারি কড়ইগাছ। অতিথিরা সবাই প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে তার ছায়ায় বসলেন। একনজর অতিথিদের দেখলেন রজত। একজন নজরুল মার্কা লোক। মুখে কী যেন চিবুচ্ছে। একজনের দাড়িভর্তি মুখ। বয়সী মানুষ। দু’জনের মাথায় টাক। একজন ফর্সা পরিপাটি আর একজন কালো। ওই কালো লোকটির গলায় আবার মালাও রয়েছে। সঙ্গে বিভিন্ন বয়সের চার-পাঁচজন রয়েছেন। তাদের একজনের মাথায় স্বাভাবিকের চেয়ে লম্বা চুল। শ্যামলা বর্ণ। আর সবার মধ্যে শুধু একজন ব্যতিক্রম। কে তিনি! তাহলে কি স্যারের কথায় তিনিই মহারাজা। দেখতে গৌরবর্ণ। লম্বা ছয় ফুটের কাছাকাছি হবে। একদম সাদাসিধে পোশাক। ওই যে মালাধারী কালো মানুষটার সঙ্গে চা খেতে খেতে কী যেন বলছেন। যাকগে নৌকায় চড়লে শেষে বুঝা যাইব।
এগারোটা পেরিয়ে যায় নৌকা ছাড়তে ছাড়তে। সবাই নৌকার ছাদে বসে। দু-একজন ছাড়া সবাই যার যার মোবাইলে কেবল ছবি তুলছে। শুধু একজনের হাতেই ক্যামেরা। বেশির ভাগ অতিথি ঘুরেফিরে ওই মহারাজের সঙ্গে ছবি তুলতে ব্যস্ত।
রজত নৌকাটিকে প্রথমেই জলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা খসেপড়া প্রাচীন ভাঙা মঠের কাছে নিয়ে গেল। মঠটিকে একটি অশ্বত্থ গাছ চারপাশ দিয়ে পেঁচিয়ে এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছে যে, মনে হয় মাতৃমমতায় আগলে রেখেছে তার সন্তানকে। দু’চক্কর দিয়ে নৌকাটিকে সোজা এবার ভলাকুটের উদ্দেশে ছেড়ে দেয় রজত।
পথের মাঝামাঝি এলে স্যার সবাইকে চিপস, মটরশুঁটির প্যাকেট দেন। রজতও পায়। মহারাজা উদাস মনে হাওর দেখছেন। কখনও অতিথিদের কথার সঙ্গে হেসে উঠছেন। আবার কখনও-বা আপন মনে কী যেন ভাবছেন। নৌকার খানিক দূরে জেলেরা জাল পেতেছে। মৃদু ঢেউ। স্রোতশূন্য জল। ধীর-স্থির-শান্ত। এক বিশাল জলাশয়ে জেলেদের জালে মাছ বলতে নেই। প্রায় মাছশূন্য জাল টেনেই চলেছে জেলেরা। এখানে জালে কী ওঠে? এমন প্রশ্নে মালাধারী লোকটি বলে- এই কেচকি, বইচা গুঁড়া মাছ। তেমন কোনো বড় মাছ ওঠে না। যা পায় জেলেরা স্থানীয় বাজারেই ওসব বিক্রি করে।
দূরে অন্য একটি জাল দেখে- এমন জলেই তো আমাদের অদ্বৈত মাছ ধরতেন। বিলের পাশে বাড়িঘরের মানুষগুলো দেখে কেমন যেন মায়া পড়ে যায় তার। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর জল-জাল-জেলে-মানুষ আর মাছ এসব যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে তার মনে। তবে একালে এসে কিছু কিছু বাড়ি-ঘরে ইট-বালি সিমেন্টের আঁচড় দেখা যায়। মানুষ পারাপারে এখন যে নৌকা ব্যবহার হচ্ছে, একদিন সেটাও থাকবে না। পাকা রাস্তা হচ্ছে। এ দেখে মহারাজ ভাবলেন হয়তো একদিন নৌকা দিয়ে দূরের পথ পাড়ি দেবে না। চারিদিকে জল, মধ্যখানে ছোট ছোট ঘরবাড়ি। এরই মাঝে কোশা নৌকাও দেখা যায়। মানুষগুলোর জীবনযাত্রা দেখে মনের কোণে কোথায় যেন দুঃখময়তা ছড়িয়ে পড়ে মহারাজের।
মালাধারী ছোটখাটো মানুষটি মহারাজের চোখের গহিনে মহাভাবের ভাবনা জমা হতে দেখে। কথা বলতে গিয়ে মহারাজা বললেন আমার জীবনের প্রথম হাওর যাত্রা। এমন দৃশ্য ভাবনায় আমার প্রথম সাক্ষাৎ। আমরা তো বংশপরম্পরায় সাগর জলে মাছ ধরেছি। ঢেউগুলো খুবই ব্যস্ত রাখত আমাদের। তিনি লোনা জলে মাছ আর মিঠা জলের মাছ ধরার ব্যবধান মিলিয়ে দেখেন। কিন্তু যেখানেই মাছ ধরি না কেন মিল কিন্তু একটা জায়গায় আছে- আর সেটা হচ্ছে আমরা জাতে জাল্যা। সমাজের কাছে অদ্বৈতর মালো সম্প্রদায়।
প্রায় এক ঘণ্টা লাগল ভলাকুট বাজার ঘাটে পৌঁছতে। শুনেছে ভলাকুট স্কুলে একটি অনুষ্ঠান আছে। সেখানে দুপুরে খাওয়ার পর তারা ফিরবেন। প্রায় ঘণ্টা তিনেক পর অতিথিরা ফিরে আসেন। ফেরার পথে ঘাটে অতিথিদের বিদায় দিতে এলেন চেয়ারম্যান সাহেব। সঙ্গে এক বক্স মিষ্টিও কিনে দিলেন তিনি। বোঝা গেল তারা যথাযোগ্য আপ্যায়ন পেয়েছেন সেখানে। এমনিতেই গিলমান স্যার অতিথিপরায়ণ। তিনি নিশ্চয় ভালো খাওন দিয়েছেন।
অতিথিরা আবার নৌকার ছাদে উঠে বসেন। বিকেলের ঝিরঝির বাতাস আর দিনের শেষ রোদের ঝাঁঝ। কালো করে মানুষটি যার গলায় মালা রয়েছে, মনে হয় তিনি আমাগ জাতের লোক হবেন। ছাতাটা তিনি মহারাজের মাথায় খুব যত্নসহকারে ধরে রয়েছেন। মহারাজ কিছুক্ষণ পরপর রুমাল দিয়ে মুখ মুছছেন। এরই ফাঁকে চেয়ারম্যানের মিষ্টি বিতরণ শুরু হলো। রজতও একটি ভাগ পেল।
ঘণ্টাখানেক পর যখন নৌকা ঘাটে ভিড়ল, তখন বেলা হেলে পড়েছে। রজত শেষ বারের মতো মহারাজকে দেখে নিলেন।
রাতে মেজো ভাই রাজনকে বলছে- দাদা মহারাজকে দেকছসনি।
-কই না তো
-তিনি তো আমাগ পাড়ায় আসবেন বলেছিলেন।
-কই আইয়ে নাই। আমি তো হেই সারাদিন বাড়িতেই আছিলাম।
-মনে হয় সময় পায় নাই। তাই চলে গেছে। দাদা, জাল্লার মানুষ এমন সুন্দর হয় আমি কোনোদিন দেখি নাই। তুমি দেখলে কইতা এই মানুষটি মাছ ধরছে কেমনে। স্যার যে কইছে মহারাজা ঠিকই কইছে।
-সাগরে থাকে বড় বড় মাছ। কত বড় বড় ঢেউ। এমন মানুষ না অইলে কি পারব মাছ ধরতে। রাজন নিজের মতো করে বর্ণনা করে। আর রজত মনে মনে সাগরের সঙ্গে মিলিয়ে ধরে মহারাজের উচ্চতা।