সতীন

নইমুদ্দি মিয়া দ্বিতীয় বিবাহ করিয়া অদ্য সন্ধ্যার অন্ধকারে গ্রামের সকলের অলক্ষ্যে বাড়িতে আসিয়া উঠিয়াছে। তাহার প্রথম স্ত্রী শুরুতে ঠাওর করিতে পারেন নাই। অল্পক্ষণে যখন সে বুঝিল, ততক্ষণে সে রান্নাঘরের খিড়কিতে মূর্ছা গিয়া পড়িল। নইমুদ্দি প্রথমে বুঝিয়া উঠিতে পারিল না- সে কী করিবে। পরক্ষণে বোধোদয় হইলে প্রথমা স্ত্রী রহিমনের মুখে কয়েক ফোঁটা পানি ছিটাইয়া দিল। দাঁতে দাঁত লাগিয়াছে কি-না, তাহা দেখিতে গেলে রহিমন চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। নইমুদ্দি আচমকা ভয় পাইয়া ছিটকাইয়া কয়েক হাত দূরে সরিয়া গেল।

রহিমন কাঁদিয়া-কাটিয়া চিৎকার করিয়া বাড়ি মাথায় তুলিল। পাড়াসমেত লোক জড়ো হইবার পূর্বেই নইমুদ্দি যেমন করিয়া আসিয়াছিল তেমন করিয়া স্ত্রী লইয়া চোরের মতো ঘরে ঢুকিল। একে একে পাড়ার সকলেই আসিল। ভুলু দাদা, করম কাকা, ঠেন্ডি বুড়ি সকলে। ছেলে-বুড়ো, পাড়ার নানা বয়সের বউয়েরা আসিয়া তামাশা দেখিতে লাগিল। কীভাবে কী ঘটিল তাহার ভালোমন্দ আলোচনা-সমালোচনা চলিতে থাকিল। রহিমনের বিলাপ চলিতে লাগিল। বহুজনে বহু সান্ত্বনা দিয়া গেল, কিন্তু কোনো কিছুতেই তাহার মন প্রবোধ মানিল না। নইমুদ্দিকে বহুজনে ডাকিল কিন্তু সে বাহির হইল না। যাহাদের অতি আগ্রহ ছিল তাহারা ছনের দেয়াল আঙ্গুল দিয়া ফাঁক করিয়া আধা-আবছা বাতির আলোতে দেখিল।

রহিমনের রূপ ছিল, গুণ ছিল। অভাবের ক্লিষ্টতায় শুধু তাহার মুখের লাবণ্যটা মুছিয়া গিয়াছিল। ছাগল চরাইয়া, মুরগি পালিয়া, ডিম বিক্রি করিয়া, বাড়ির উঠানে শাক-সবজি চাষাবাদ করিয়া অকর্মণ্য স্বামীর সংসার টানিয়া আসিতেছিল। পাড়ার দোকানে দিন-রাত অলস বসিয়া থাকিয়া পান চর্বণ করিয়া, বিড়ি ফুঁকাইয়া, তাস পিটাইয়া নইমুদ্দির সময় কাটিত। অন্যের কাছে শুনিয়া শুনিয়া কিছু রাজনৈতিক জ্ঞান আহরণ করিয়া মূর্খজনে তাহাই বিতরণ করিয়া তিন ক্লাস পাস নইমুদ্দি জ্ঞানীর ভাব ধরিয়া চা স্টলে পা ঝাঁকাইত। রহিমন সবকিছু মানিয়া লইয়া সংসারের হাল নিজ কাঁধে তুলিয়া লইয়াছিল। কিন্তু এ জীবনে সতীনের ঘর করিতে হইবে- ইহা তাহার কল্পনারও বাহিরে ছিল। ইহা শুধু তাহার নয়; গ্রামের সকলেরই ধারণার বাহিরে। অনেকে হা-হুতাশ করিল; রঙ্গ-রসের আলাপ হইল। সর্বশেষে যে যাহার ঘরে ফিরিল। রহিমন পড়িয়া থাকিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে ক্লান্ত হইল। আরও কতক্ষণ ডুকরিয়া কাঁদিয়া চোখ বুজিয়া উঠানে পড়িয়া রহিল।

দুই.

দুই থালায় ভাত সাজাইয়া রহিমন দরজায় নাড়া দিয়া ডাকিল। গত পাঁচ বছরের বিবাহের বয়সে স্বামীকে সামনে বসাইয়া খাওয়াইছে। যত রাত্রিই হোক, থালায় খাবার সাজাইয়া তালপাতার পাখা লইয়া অপেক্ষা করিয়াছে। আজ কেন তাহা ভিন্ন অন্য হইবে?

সতীনকে ডাকিয়া নিচে পিঁড়ি দিয়া খাইতে বসাইয়া দিল। স্বামীর জন্য চৌকিতে ব্যবস্থা করিয়া খাইতে দিয়া হাতপাখা দিয়া বাতাস করিতে লাগিল। এই প্রথম তাহার স্বামীকে অন্য দেশের লোক মনে হইল। তাহার স্বামী কোনো কথা না বলিয়া সম্পূূর্ণ সময় মাথা নিচু করিয়া গোগ্রাসে আহার শেষ করিল। আহারান্তে রহিমন তাহার সতীনকে বলিল, ‘যাহাই হউক, যেভাবেই হউক, তুমি আমার স্বামীর ভাগ লইয়াছ; এবার সংসারের ভাগটাও লওয়া চাই। বড় হিসেবে মান্য করিতে ভুল করিও না।’

নইমুদ্দি সকল কিছুই শুনিল কিন্তু কোনো এক অজানা আশঙ্কায় কিছুই বলিতে পারিল না। পাছে না আবার বড় করিয়া গোলযোগ ঘটে। এইবার রহিমন বলিল, ‘তোমরা তাহলে ঐ ঘরে গিয়া ঘুমাও। রাত্রি অনেক হইয়াছে।’

নইমুদ্দি ক্ষেপিয়া গিয়া বলিল, ‘ঐ ছাগলের ঘরে ছাগলের সাথে কীভাবে ঘুমানো যাইবে? তাও আবার বাঁশের মাচার চৌকি!’

রহিমন শান্ত স্বরে বলিল, ‘তোমারে ছাড়িয়া দিয়াছি বলিয়া ঘরও ছাড়িব নাকি? ঘর তোমার বাপের টাকায় তৈয়ার করা হয় নাই।’

রহিমনের বাপের বাড়ি হইতে বিবাহের বছরেই বারো হাজার টাকা খরচা করিয়া দক্ষিণমুখী এই দোচালা টিনের ঘর তুলিয়া দিয়াছিল। এই জন্য তাহার বাবাকে দুই বিঘা জমি বন্ধক রাখিতে হইয়াছিল। গমের খড় দিয়া চাল দেওয়া ঘরে ঝরঝর করিয়া বৃষ্টি ঝরে। সেই জন্য রহিমন তাহার বাবার কাছে বায়না করিয়া এই ঘর তুলিয়া লইয়াছে। সেই তাহার বাপের কষ্টের টাকায় তোলা ঘরে তাহারই স্বামীকে অন্য নারীর কাছে সমর্পণ করা জীবন থাকিতে সম্ভব নহে।

নইমুদ্দি দেখিয়া লইবে বলিয়া লাফ দিয়া উঠিয়া গিয়া ঐ ঘর হইতে ছাগল বাহির করিয়া এই ঘরে দিয়া চলিয়া গেল। সদ্য বিবাহিতা দ্বিতীয়া স্ত্রী তাহাকে অনুসরণ করিল। রহিমন ওয়াক থু বলিয়া এক দলা থুতু নিক্ষেপ করিল। তাহার সতীন তাহা দেখিল না, নইমুদ্দিও না।

তিন.

ফজরের আজনের আগেই রহিমন গিয়া তাহার সতীনকে কাজ আছে বলিয়া ডাকিয়া তুলিল। দরজা খুলিয়া বাহির হইলে রহিমন তাহাকে দেখিবামাত্র হোঁচট খাইল। তাহার সতীনের চোখ ট্যারা, হাঁটিতেছে খুঁড়াইয়া খুঁড়াইয়া। ভালোভাবে লক্ষ্য করিল, তাহার দুই পা ছোট-বড়। রহিমন কিছু বলিল না। শুধু বুঝিল, মানুষের চরিত্র লোপ পাইলে হিতাহিত জ্ঞানও শূন্য হয়। চরিত্রহীন মানুষের ভালো-মন্দ বিচার-বিবেচনা থাকে না।

রহিমন সতীনকে ধান ভানিতে ঢেঁকিতে তুলিয়া দিল। নিজে হাত লাগাইল। বলিল, ুকী করিবে বোন! গরিবের ঘরে রাজরানী হইয়া আসিয়াছ বটে, কিন্তু তাহার মান কোনভাবে দিব, ভাবিয়া পাইতেছি না। নবাবের পকেটে চুরুট টানিবার পয়সাই জোটে না; মিল ঘরে দিয়া ধান ভাঙাইব কীভাবে? ভালোই হইয়াছে, দুইজনে মিলিয়া মিশিয়া করা যাইবে। আমার একটু আরামই হইল। খাইতে তো হইবে।

নতুন বৌ চুপ করিয়া শুধু ঘাড় নাড়িয়া ঢেঁকিতে পাড় দিতেছিল। রহিমন তাহাকে বলিল, ‘পাড়াইতে পাড়াইতে হয়রান হইয়া গিয়াছ। তুমি বরং নিচে আসিয়া ধান নাড়িয়া দাও।’

রহিমন ঢেঁকিতে পাড় দিতে লাগিল আর তাহার সতীন হাত দিয়া ধান নাড়িয়া দিতেছিল। কিছুক্ষণ এইভাবে চলিবার পর রহিমন ঢেঁকিতে পাড় দিয়া আবার একটুখানি তুলিয়াই ছাড়িয়া দিল। ঢেঁকির শুঁড় গিয়া তাহার সতীনের হাতে পড়িলে চিৎকার দিয়া উঠিল। নইমুদ্দি ঘুম হইতে মোচড় দিয়া উঠিয়া কী হইয়াছে জিজ্ঞাসা করিল। বড় বউ বলিল, ‘কিছুই হয় নাই। নিশ্চিন্তে ঘুমাও।’

রহিমন ধৈর্যের সাথে চতুরতা করিয়া সতীনের মন বিষাইয়া তুলিতে আত্মনিয়োগ করিল। পাড়ার জন কয়েককে লাগাইয়া দিয়া স্বামীকে নানান জায়গায় নানানভাবে ব্যস্ত করিয়া রাখিল। যেটুকু সময় তাহারা এক হইয়া থাকে তাহাতে রহিমনের সারাদিনের সব কথা বলিয়া শেষ করা যাইবে না। আর সব কথা শেষ করিয়াও লাভ হইবে না। পাড়ার লোক তো বটেই, নইমুদ্দি নিজেই দেখিয়াছে বড় বউ তাহার প্রাণের ছোট বউয়ের সহিত কেমন মিল-মিশ দিয়া চলিতেছে। নইমুদ্দি মনে মনে দাঁত কেলাইয়া হাসে আর ভাবে, লাত্থি দিয়া বাহির করিয়া দিলে রহিমন যাইবে কোথায়? মিল-মিশ দিয়া পথ চলা ভিন্ন তাহার আর কোনো উপায় নাই।

চার.

মাসাধিককাল অতিক্রান্ত হইয়াছে। রহিমন নানান কায়দায় নানান রকম ফায়দা হাসিল করিবার চেষ্টা করিয়াছে। সতীনের মন বিষাইয়া তুলিতে সর্বান্তঃকরণে যাহা করা আবশ্যক তাহা করিতে ত্রুটি রাখিল না। নিজে ভালো থাকিয়া অন্যকে খারাপ করিয়া তুলিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলিল।

এই কয়দিনে রহিমনের মনের শান্তি উধাও হইলেও, শরীরের আরাম ঠিকই মিলিয়াছে। রন্ধনশালায় চেয়ারে বসিয়া পাট শলাকা হাতে নির্দেশনা দিয়া ছোট বৌ কর্তৃক অন্ন ব্যঞ্জন প্রস্তুত করিয়া আরাম আয়েশে দিন অতিবাহিত হইতে লাগিল। রাত্রিতে স্বামীকে খাবার খাওয়াইয়া নিজে খাইয়া ভাতে পানি ঢালিয়া দিল। ছোট বৌকে বলিল, তুমি যে খাও নাই, আগে বলিবা না? মৃদু ভর্ৎসনা করিয়া দুঃখ প্রকাশপূর্বক অনুতাপ করিয়া পান্তা ভাতই গ্রহণ করিতে অনুরোধ করিল। মাঝে মাঝেই এমন হইতে লাগিল। কখনও ভাতে পানি দিয়া খাওয়া পণ্ড হয়, কখনও ভাতই থাকে না; কখনও বা ভাত থাকিলেও তরকারি শেষ হইয়া যায়। আর কখনও কখনও আহার জুটিলেও প্রচ্ছন্ন বৈষম্য সুস্পষ্ট।

মানুষ সব সহ্য করিতে পারে কিন্তু অবহেলা সহ্য করিতে পারে না। অনেক সময় এমন কিছু অভিযোগ সামনে আসিয়া দণ্ডায়মান হইল যে, তাহা না কাউকে বলা যায়, না সহা যায়। নিজে নিজে বুঝিয়া চুপ করিয়া থাকিয়া গুমরিয়া মরা ভিন্ন অন্য কোনো উপায় থাকে না। বেশি কিছু বলিতে গেলে নিজেরই দোষ হয়, এমনকি ছোট হইতে হয়। কেহই পক্ষে কথা বলিতে চাহে না।

নইমুদ্দির ছোট বৌ সেই সংকটেই পড়িল। পড়িল বলিলে ভুল হইবে; রহিমন সংকটে ফেলাইল। প্রত্যুষ হইতে শুরু করিয়া রাত্রি পর্যন্ত খাটিয়া যতটুকুন ঘুমায়, তাহা পর্যাপ্ত নহে। গায়ের ব্যথা সারিবার আগেই ডাকিয়া তোলে। ঘন ঘন সকল ঘর, ভিতর-বাহিরের উঠান কাদা-মাটি দিয়া লেপা-মোছা করিয়া ঘর-বাড়ি নতুন করিয়া তুলিল। ভগ্নদশা রন্ধনশালা দুই সতীনে মিলিয়া মেরামত করিল, নতুন উনুন জ্বলিল। আধাপাকা শৌচাগার প্রায় পরিত্যক্ত হইয়া গিয়াছিল, তাহাও পরিপাটি করিল। কাঁথা-বালিশ, জামা-কাপড় যাহা ছিল তাহার সবই ধোয়া হইয়া গেল। ধান ভানিয়া রান্না করিয়া খাইবার পরে আরও নানাবিধ কার্য সমাধা করিতে থাকিল। গত তিন বছরের কার্য এক মাসেই দুই সতীনে মিলিয়া করিল।

রহিমনের সতীন কাজ করিল ষোল আনা, কিন্তু চার আনা খাবার খাইয়া অনাহারে অর্ধাহারে দিন চালাইয়া শরীরটাকে জীর্ণ-শীর্ণ করিয়া তুলিল। গায়ে শক্তি নাই বলিলেই চলে। তাহার মুখায়ব রক্তশূন্য মানুষের ন্যায় ফ্যাকাসে হইয়া গেল। মুখ দিয়া যেন কথা ফুটিতে চাহে না। অপর প্রান্তে, রহিমন এই কয়দিনে আরামে থাকিয়া রূপ যেন রসে ভরিয়া উঠিল। কাঁচা হলুদের ন্যায় লাবণ্য ঠিকরাইয়া পড়িল।

পাঁচ.

নইমুদ্দি রাত্রি করিয়া ঘরে ফেরে। বড় বৌ সামনে বসাইয়া পাখা দিয়া বাতাস করিয়া খাওয়ায়। ছৌট বৌ খানিক দূরে পিঁড়িতে বসিয়া মুরগির মতো ঝিমায়। নইমুদ্দির বিরক্তি লাগে। মাঝে মাঝে পরখ করিবার জন্য লবণের ঘটি আনিবার হুকুম করে। ছোট বৌ যে ভাবলেশহীনভাবে আনিয়া দেয়, তাহা সে বুঝিয়া মনে মনে রাগে ফুঁসিয়া ওঠে।

ছোট বৌকে যতটা ভালো সে মনে করিয়াছিল, ততটা সে নহে। দেড় মাস যাইতে না যাইতেই ছোট বৌয়ের শরীর জাগে না; পাখা পেখম মেলে না। কথার কোনো তেজ নাই। যাহা বলে তাহা শ্রুতিমধুর নহে। নইমুদ্দির কাছে মনে হয়, সে একটা মরা আমড়া কাঠের ঢেঁকি লইয়া রাত্রি যাপন করিতেছে। যাহার কাজই হইল শুইবার পরে বেঘোরে নিদ্রা যাওয়া। সমস্ত শরীর যেন বৃক্ষকাষ্ঠ দ্বারা নির্মিত। ধরিলে ব্যথা ভিন্ন আরাম বোধ হয় না।

ঘরের দেয়ালের এপারে থাকিয়া অন্য পাড়ের রঙ দেখা যায় না। রহিমনকেও সে এতদিন বুঝিতে পারে নাই। কত কষ্ট করিয়া রহিমন এই সংসারকে তিল তিল করিয়া সাজাইয়াছে, ধরিয়া রাখিয়াছে। কিন্তু তাহাকে সে কী দিয়াছে? নইমুদ্দির অন্তরে শুধু বাজিতে লাগিল, সে সারাটি জীবন রহিমনকে ঠকাইয়াছে। রহিমনের অভাব-ক্লিষ্ট মুখচ্ছবি তাহার চক্ষুর সম্মুখে ভাসিয়া উঠিল। রহিমন তাহাকে কতই না ভালোবাসিয়াছে! অথচ কী তার প্রতিদান দিয়াছে? অনেক দিন পরে রহিমনের জন্য নইমুদ্দির মনে করুণার উদ্রেক হয়। রহিমনের রূপ-সৌন্দর্যের ঢেউ তাহার মনে আছড়াইয়া পড়ে। অনুতপ্ত হয়, ভালোবাসা জাগে; দায়িত্ব-কর্তব্যরা ভিড় করিতে থাকে।

এক লাত্থিতে গায়ের কাঁথা ফেলাইয়া দেয় নইমুদ্দি। লাত্থি গিয়া ছোট বৌয়ের ঊরুতে আঘাত হানে। ঘুমের ঘোরে আচমকা আঘাতে ছোট বৌ চিৎকার দিয়া ওঠে। নইমুদ্দি ঘটনার বিহ্বলতায় তাহার কণ্ঠ রোধ করিলে ছোট বৌ আরও বেশি ভয় পাইয়া বাঁচাও-বাঁচাও, মারিয়া ফেলিল বলিয়া চিৎকার করিতে থাকে।

বাড়িসুদ্ধ লোকে লোকারণ্য। দাঁড়াবার ঠাঁই নাই। নইমুদ্দি ছোট বউকে বেদম পিটাইয়াছে। রাগের মাত্রা বাড়িয়া গেলে তিন তালাক বলিয়া তালাকও দিয়াছে। রহিমন সতীনকে তাহার ঘরে লইয়া গিয়াছে। পিঠে গরম ছেঁক দিয়া দিতেছে। ছোট বৌয়ের চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িতেছে। সে জল অনেক গরম। সে সামান্য শব্দ পর্যন্ত করিয়া কাঁদিল না।

ছোট বৌ আজ আর ছোট বৌ নাই। সকাল হইলে কাপড়ের পুঁটলি লইয়া রহিমনের নিকট হইতে বিদায় লইতে আসিলে রহিমন তাহার সতীনকে জড়াইয়া ধরিল। আজ তাহার খুশির দিন, আনন্দের দিন। কিন্তু সেই সবের কিছুই যেন হইতেছে না। কিসে যেন তাহার বুকে আঘাত হানিতেছে!

রহিমন জানে, তাহার সতীন নিরুপদ্রব, প্রতিবাদহীন বলিয়াই তাহাকে আজ এহেনভাবে বিদায় করা গেল। অন্য কেহ হইলে বিষয়টা এত সহজ হইত না। কোথাকার মেয়ে, কী তাহার বংশ-পরিচয় সেই সব কিছুই জানা নাই রহিমনের। জানিবার প্রয়োজনও বোধ করে নাই। শুধু জানে, সে কাছের কাহারও কেউ নহে। রহিমনের একমাত্র ব্রত ছিল কী করিয়া তাহার সতীনকে তাড়াইবে। এই জন্য সে তাহার সারা জীবনের নীতির বিপক্ষে গিয়া ঈষৎ নীতিভ্রষ্ট হইয়াছে। তাহাই আজ তাহার বিবেককে বারংবার দংশন করিতে লাগিল।

যে শরীরের ক্ষুধায় নইমুদ্দি তাহাকে ঘরে আনিয়াছে, সেই ক্ষুধা আজ তাহার মিটিয়াছে, নয়তোবা ছোট বৌয়ের শরীর সেই ক্ষুধা মিটাইবার যোগ্যতা হারাইয়াছে। ছোট বৌকে ঘরে আনিবার দিনে নইমুদ্দি যেমন নিশ্চুপ ছিল, আজও তেমনই সে ভাবলেশহীনভাবে ঘরে পড়িয়া রহিল। নইমুদ্দিকে দেখিলে বোঝা যায়, একমাত্র চরিত্রহীন মানুষের অনুতাপ থাকে না; মানবতা কাজ করে না।

রহিমনের পায়ে কদমবুসি করিয়া তাহার সতীন বলিল, আপনার কথা সারাজীবন মনে থাকিবে। ভুল কাউকে ক্ষমা করে না। আপনার মতো সতী-সাধ্বী, কর্তব্যপরায়ণ স্ত্রীর ঘর যে নারী ভাঙিতে চাহিয়াছে, প্রায়শ্চিত্ত সেই করিবে। যাইবার কালে বলিয়া যাই, আপনার কথা গোপন রাখিয়া সে আমাকে প্রলুব্ধ করিয়া বিবাহ করিয়াছে। ভুল না বুঝিয়া এই ছোট বোনকে প্রাণ ভরিয়া আশীর্বাদ করিবেন।

কথা শেষ করিয়া কাপড়ের পুঁটলিটা হাতে লইয়া ছোট বৌ রওনা করিল। যতদূর চোখ দিয়া দেখা গেল, রহিমন তাকাইয়া থাকিল। ধু-ধু ফাঁকা মেঠোপথ ধরিয়া যাইতে যাইতে বটতলার মোড়ে রহিমনের সতীন পথের সাথে মিলিয়া গেল। রহিমন সামনাসামনি বলিতে পারে নাই। এই কয়দিনে রহিমনের মনে সতীনের জন্য ভালোবাসা তৈয়ার না হইলেও একটুখানি সহানুভূতি জন্মাইয়াছিল। রহিমন দূর পথপানে চাহিয়া অনুচ্চ স্বরে উচ্চারণ করিল- অন্যায় করিয়া থাকিলে ক্ষমা করিয়া দিও ছোট বোন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত