গল্পটা আপনার পরিচিত হতে পারে। কিংবা মনে হতে পারে অন্য সাধারণ গল্পের মতোই। যেখানে এক চরিত্রের সঙ্গে আরেক চরিত্রের ঘটনাগুলো সুতো হয়ে একটির সঙ্গে আরেকটি গিঁট লেগে হয়ে উঠবে বানানো এক গল্প। যা পড়ে আপনি বা আপনারা বিনোদন পাবেন, আবার বিনোদন না পেলে গালিও দেবেন। আর সাহিত্য যারা পড়েন তারা ভাষা শক্ত না নরম সেই বিশ্নেষণের সাগরে চার-পাঁচবার ডুবও দেবেন। কিংবা গাঁজাখুরি কাহিনী কি-না তাও কোদাল চালিয়ে বের করবেন। কিংবা এক অখ্যাত লেখকের গল্প বলে পড়বেনই-বা কেন? দরকার নেই। নিস্তার নিন। এই গল্পের চরিত্র মোসাদ্দেক চৌধুরীকে নিয়ে এপার-ওপার পড়ে আপনার কোনো লাভও নেই।
তবুও বলি, মোসাদ্দেক চৌধুরী আমার-আপনার মতো খুব সাধারণ। তাকে আপনি মধ্যবিত্ত বলতে পারেন কিংবা চাইলে নিম্ন মধ্যবিত্তও বলতে পারেন। কারণ আজকাল তো মধ্যবিত্তের যে পয়সা, তেমন পয়সা মোসাদ্দেকের পকেটে এখনও ঢোকেনি। অনলাইনে ছোট্ট ব্যবসা করে কোনোমতে টিকে থাকার এক চেষ্টার সমুদ্রে সাঁতরাচ্ছে মোসাদ্দেক।
পড়াশোনা করেছিল গণিতে। ঢাকা কলেজে। অনার্স শেষ করে আর মাস্টার্স করা হয়নি। তারপর চাকরি খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হওয়ার মুহূর্তে একটা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি জুটল কপালগুণে। তাও জুতসই হয়নি।
মানুষ পটানোর ক্ষমতা নেই মোসাদ্দেকের। মিথ্যার সাগরে ডুবিয়ে, আকাশে ওড়ার স্বপ্ন হাতের মুঠোয় দিয়ে ইন্স্যুরেন্সের খপ্পরে ফেলে কাউকে ধোঁকা দেবে মোসাদ্দেক! এই চরিত্র তার স্বভাবে নেই। কী করবে বেচারা?
এর মধ্যে আবার প্রেম করে বসেছিল জিনিয়ার সঙ্গে। বেকারের প্রেম এক মুশকিলের কাজ। অবশ্য বেকারত্বের একমাত্র স্বপ্নকাঠি হলো প্রেম। যার হাতে হাত রেখে বিধ্বস্ত নগরে বসে রঙিন নগর গড়ার মিথ্যা আলাপ করা যায়।
জিনিয়া নিউমার্কেটে এক ফ্যাশন হাউসের সেলস পারসন। সাধারণ ছিমছাম মেয়ে জিনিয়া। ছিমছামের অর্থ জানতে চান? অর্থটা হলো, জিনিয়ার স্বপ্ন একটাই- মোসাদ্দেককে বিয়ে করা।
ক্যারিয়ারের উন্নতি, দেশের ভবিষ্যৎ, নারীর ভবিষ্যৎ, পুরুষতন্ত্র, নারীবাদ, সাহিত্য- এসবের কোনো বিষয়ের সঙ্গে যোগ নেই জিনিয়ার। তার জীবন পুরনো আমলের ঘড়ির টিক-টিক আওয়াজের মতো। ঘুম থেকে উঠে শোরুম। শোরুম থেকে এসে ঘুম।
যখন স্টুডেন্ট ছিল তখন ক্লাস, বাসা, পড়া আর ঘুম। এর বাইরে তার জগৎ নেই। সাহিত্য-টাহিত্য, পুরুষ চরিত্র- এসবের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ কখনোই তার অনুভূতির সিলেবাসে ছিল না। কিন্তু কেমন করে যেন মোসাদ্দেকের মতো এক ছেলের প্রেমে পড়ে হাবুডুবু করে নিঃশ্বাস কোনোমতে টিকিয়ে রেখেছে জিনিয়া। প্রেমে পড়ার গল্প আরও বড়। সেটা অন্য কোনো গল্পে হাজির করা যাবে।
যাহোক, তাদের প্রেমের উন্মাদনাও বেশিদিন টেকেনি। মানে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি পাওয়ার কয়েকদিনের মাথায় মোসাদ্দেক জিনিয়াকে বলে- চলো বিয়ে করি।
জিনিয়াও প্রেমের ঘোরে বলে ফেলেছিল, চলো।
‘চলো বিয়ে করি’- বলা সহজ ছিল বটে। কিন্তু বিয়ে করার পর সামনে এক কঠিন বাস্তব পাথার তৈরি করা আছে, এ কথা কে জানত?
বিয়ে করার পর পরিবার-পরিজন নিয়ে সে এক মহা ঝামেলায় পড়ে গেল। দুই পরিবারই মানতে পারেনি।
ছেলের পরিবার বলা শুরু করল, ‘দোকানদাররে বিয়া করলি? মান-ইজ্জত কিছু রাখলি না।’
অন্যদিকে মেয়ের পরিবারও বলতে শুরু করল, ‘একটা ইন্স্যুরেন্সের দালালরে বিয়া করলি? মান-ইজ্জত কিছুই রাখলি না।’
দুই পরিবার যখন মান আর ইজ্জত নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, তখন মোসাদ্দেক আর জিনিয়া মিলে সংসার গুছিয়ে নিল। সংসারের নিয়মে পরিবারের ইজ্জত একটা বড় ইস্যু হাজির করে বটে। কিন্তু তাদের দু’জনের হৃদয় কোঠরে প্রেমের উন্মাদনায় ইজ্জত বিষয়টা ডিকশনারি থেকে হাওয়া হয়ে গেল।
কিন্তু ডিকশনারিতে ইজ্জত না থাকলেও সংসার যখন হয় তখন তো ঘর ভাড়া, বাজার-সদাই, আনুষঙ্গিক খরচ- কত কী দরকার হয়। এই সব দরকারের মধ্যে হুট করেই মোসাদ্দেক চাকরি ছেড়ে দিল। এটাও একটা ইজ্জতের প্রশ্ন নিয়ে দু’জনের সংসারে হাজির হলো।
কী এক মহা মুশকিল হাজির করল ইজ্জত ইস্যুটা।
জিনিয়া শুনে এক গ্লাস পানি গিলে জিজ্ঞেস করল, করলা কী? চলবা কেমনে?
মোসাদ্দেক তখন এক স্বপ্নবাক্স হাজির করল জিনিয়ার সামনে। সে বলল, সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগে তরুণদের ডিজিটাল মার্কেটিং কোর্সে বৃত্তি দিচ্ছে।
স্বপ্নবাক্স তখনও খোলে না জিনিয়া।
বলে, তোমার কি মাথা নষ্ট নাকি? বৃত্তি তুমি পাবা, তা কেমনে নিশ্চিত হইলা? আর কোর্স কয় মাসের? কাজ পাবা কেমনে? এইসব হিসাব করবা না? যতদিন কোর্স ততদিন চলবা কেমনে?
মোসাদ্দেক তখনও চায় জিনিয়া স্বপ্নবাক্স খুলে চুপ থাকুক।
সে বলে, বৃত্তি হবেই। বয়স আমার আর কত! কাজ শিখব। কাজ করব। চাকরি করে অন্যের গোলামি করব নাকি?
মোসাদ্দেক তার এক বন্ধু অভির প্রসঙ্গ টানে ফর ইনস্ট্যান্স হিসেবে। অনলাইনে ব্যবসা করে নাকি সে এখন রাস্তায় গাড়ি হাঁকিয়ে চলে। মন চাইলে কাজ করে, মন চাইলে ঘুমায়।
মোসাদ্দেক জিনিয়াকে বলে, আমি হবো মালিক, আমিই হবো শ্রমিক। দেশ আমার, রাজত্ব আমার।
জিনিয়া হাসে। শুধু বলে, পাগলামি কয়দিন টেকে দেখি…
২.
সরকারি বৃত্তি মোসাদ্দেক পেলো তো ঠিকই। ক্লাসও শুরু করল মনোযোগ দিয়ে। বন্ধুদের থেকে ধার-কর্জ করে মাত্র ৩০ হাজার টাকায় ডেস্কটপ কম্পিউটারও ঘরে হাজির করে মোসাদ্দেক।
জিনিয়ার বিরক্ত হওয়া মোসাদ্দেক দেখেও দেখে না। এই কাজের ভবিষ্যৎ নিয়ে জিনিয়া যতই অন্ধকারে থাকুক, মোসাদ্দেক যেন জীবনে প্রথম নিজ রাজ্যের রাজা হওয়ার অভিপ্রায়ে অটল হতে থাকল। রাতভর ইউটিউব, সোশ্যাল মিডিয়ায় গুঁতাগুঁতি। ওই এক কম্পিউটারই হয়ে ওঠে মোসাদ্দেকের প্রথম স্ত্রী।
আমি নই। জিনিয়া ভাবতে শুরু করেছে, সে হলো মোসাদ্দেকের প্রায়োরিটি লিস্টে দ্বিতীয়। তাই প্রথম স্ত্রী হিসেবে আমরা কম্পিউটারকেই বলতে পারি।
কচ্ছপের মতো মোসাদ্দেক এগিয়ে চলে। কোর্সের দুই মাস যেতেই কাজে নামে মোসাদ্দেক। তার পুরনো শখ হলো পুরনো বই সংগ্রহ করা। প্রথম সে চেষ্টা করে পুরনো বই বিক্রির। গল্প, উপন্যাস, পাঠ্যবই।
ফেসবুক গ্রুপ খুলে বসে পুরনো বইয়ের বাজার। বাহ! চলছে তো বেশ! এরই মধ্যে ইউটিউব ঘেঁটে শিখে নিয়েছে কেক বানানোর উপায়। হয়ে গেল দ্বিতীয় ব্যবসার ছক। জন্মদিনের কেক বানিয়েও সাপ্লাই দেওয়ার অর্ডার আনার চেষ্টায় মোসাদ্দেক।
জিনিয়া তো দিনকে দিন অবাক আর বিস্ময়ে আত্মহারা। কোথায় এগিয়ে দেশ, সে তো পিছিয়ে এখনও। এই বিধ্বস্ত নগরীতে সত্যিই রঙিন স্বপ্ন বুনে ফেলা যায়।
সংসারের স্রোতে সচ্ছলতাও ধীরে ধীরে ফেরার আশা শুরু হয়।
পাঠক হিসেবে ভাবতে পারেন, গল্পে আর টুইস্ট কোথায়? সেই সফলতার গল্প। এমন গল্প হর-হামেশা পত্রিকার ফিচার পাতায় পড়া হয়। তারুণ্যের উদ্যোগ, তরুণদের সফলতা- এমন কত হাজার খানেক নিউজে হাস্যোজ্জ্বল এন্টারপ্রেইনার দেখে আপনারাও ভাবেন- ‘আরে! শালাহ! দেশ তো এগিয়ে। চাকরি নেব না আর, চাকরি শুধু দেব- টাইপ স্লোগানে মত্ত দেশ’।
এসব গল্পের জন্য এই আয়োজন তো না। এই গল্পের টুইস্টটা হলো যখন সংসারে সচ্ছলতা উঁকি দিচ্ছিল ঠিক ওই সময়ে এক রাতে ঘরে এলো সাদা পোশাকে কিছু অনাগত মানুষ। নিয়ে গেল মোসাদ্দেককে। ঠিক তখনই জিনিয়ার সংসারে নেমে এলো এক বীভৎস অমানিশার অন্ধকার।
৩.
এরপরের ঘটনা জানার জন্য স্রেফ সংলাপ পড়ে যেতে হবে। কে কী বলল, সেটা থেকে জেনে নেবেন কী হলো জিনিয়ার সংসারে।
এক সাংবাদিক ফোন দিয়েছে জিনিয়াকে। জিনিয়াকে প্রশ্ন করছে। জিনিয়া দিচ্ছে উত্তর।
জিনিয়া আপা বলছেন?
– জি বলছি।
আসলে মোসাদ্দেক সাহেবের সঙ্গে কী হয়েছে একটু বলবেন?
– ভাই, বুঝতে পারছি না। রাতে কিছু লোক এসে বললেন তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোক। এই বলে ওনাকে নিয়ে গেলেন।
কিন্তু থানা থেকে তো বলছে- মোসাদ্দেক চৌধুরী নামে তারা কাউকে তুলে আনেনি।
– ভাই, সেটাই বুঝতে পারছি না। আপনারাই একটু খোঁজ নিয়ে যদি সহযোগিতা করেন…
তা তো বটেই। আচ্ছা উনি কি সরকারবিরোধী কিছু লিখেছিলেন ফেসবুক কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায়?
– না ভাই। উনি অনলাইনের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করেন।
কী ধরনের পণ্য?
– পুরান বইয়ের ব্যবসা করেন। এ ছাড়াও কেক বানাতে পারেন। কেকের অর্ডার নেন। বানিয়ে নিজে গিয়ে অর্ডারকারীকে পৌঁছেও দিয়ে আসেন।
পুরান বইয়ের ব্যবসা বিষয়টা বুঝলাম না আপা।
– মানুষের কাছ থেকে গল্প, উপন্যাসসহ বিভিন্ন পুরান বই সংগ্রহ করেন। মাঝে মাঝে নীলক্ষেতে পুরান বই যা মার্কেটে নেই সেটা সংগ্রহ করে আনেন। তারপর ফেসবুকের মাধ্যম বিক্রি করেন। ওনার একটা গ্রুপ আছে। সেখান থেকে সেল করেন। গ্রুপটার নাম হচ্ছে ওল্ড বুকস কালেকশন। আর কেক বানানোর ব্যবসাও করেন। বার্থডে কেক। ফেসবুকে কেক বানানোর জন্যও আরেকটা গ্রুপ আছে। নাম হলো কেক ফর ইউ।
আপা, কিছু মনে না করলে আরেকটা প্রশ্ন করতে পারি?
– জি, বলেন ভাই।
উনি কি নেশা-টেশা করতেন?
– না ভাই। উনি কখনও সিগারেটই খান নাই। নেশা কী করবে?
ঠিকাছে আপা, ধন্যবাদ।
৪.
জিনিয়া দ্বিতীয় দিন থানায় গেল। সেখানে ওসির সঙ্গে জিনিয়া দেখা করল। ওসির সঙ্গে কিছু কথাও হলো জিনিয়ার।
কেন আসলেন আবার?
– ভাই আমার স্বামীর কি কোনো খোঁজ পেলেন?
ভাই? ভাই আবার কে আপনার? আমি কি আপনার ভাই লাগি?
– দুঃখিত স্যার। আমার স্বামীর খোঁজ কি পেলেন?
আশ্চর্য! আপনাকে কালকেও তো বললাম- আমরা আপনার স্বামীকে উঠিয়ে আনিনি।
– না স্যার, আমি আপনাদেরই বিশ্বাস করি। তাই তো ভাবছি আপনারাই আমার স্বামীকে খুঁজে দেবেন।
ফালতু আলাপ করবেন না। বিশ্বাস মারানি ফালায় আবার? আপনি সাংবাদিকদের খবর দিছেন কেন?
– স্যার। বিশ্বাস করেন, আমি কোনো সাংবাদিককে খবর দেই নাই। উনারাই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
খুব বিশ্বাস করলাম।
– স্যার আমি এখন কী করব একটু বলবেন?
আপনার স্বামী কি গাঞ্জা খায়?
– জি না স্যার।
মদ, ইয়াবা?
– না স্যার, উনি এমন কিছু খান না।
আইছে ভদ্র পোলা। মাগিপাড়ায় যায়?
জিনিয়া এই প্রশ্নের উত্তর দেয় না। কিন্তু তখন জিনিয়ার গা কেমন যেন হিম হয়ে আসে। খুব ঘেন্না লাগে। ইচ্ছে করে একদলা থুতু লোকটার মুখের ওপর ছুড়ে মারতে। কিন্তু পারে না।
চুপ আছেন কেন? বললেন না তো, যায় নাকি?
– জি না।
হা হা হা… মদ খায় না, গাঞ্জা খায় না, মাগিপাড়ায়ও যায় না। এত ভদ্রপুরুষরে তাইলে কে তুইলা নেবে?
– জানি না স্যার।
পরকীয়া করে?
– জি না স্যার।
জি না স্যার মানে? কেমনে কইলেন? পরকীয়া কি আপনারে জানায়া করবে? এমনও তো হইতে পারে পরকীয়া করত। তারপর কোনো মহিলার জামাই তারে তুইলা নিয়ে গেছে।
– স্যার, আমার স্বামী এমন কিছু করলে আমি টের পাইতাম।
আইচ্ছা বোঝা গেছে। সাধারণ ডায়েরি একটা করে রাখেন। কিন্তু এখন দরকার নাই। দেখেন দুই দিন। এমনও তো হইতে পারে তিনি কোনো নাটক সাজাইছেন। সেসব নিশ্চিত হইয়া তারপর ডায়েরি কইরেন।
জিনিয়া চলে আসে।
৫.
জিনিয়া থানা থেকে আসার পর মোসাদ্দেকের বন্ধু সাজেদ ফোন দিয়েছিল।
সাজেদ একজন নামকরা ফেসবুকার। সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক জনপ্রিয়। ৮০ হাজারের মতো ফলোয়ার। তার এক স্ট্যাটাসে লাইক কমেন্টে ভরপুর। সাজিদ হলো মোসাদ্দেকের ছোট্টবেলার বন্ধু। সে জিনিয়াকে ফোন দিয়ে খোঁজ নেয় মোসাদ্দেকের।
ভাবি, কী অবস্থা?
জিনিয়া জবাব দেয় না, কাঁদে।
ভাবি কাঁইদেন না। থানায় ডায়েরি করেছেন?
– ওসি সাহেব বললেন দু’দিন দেখতে।
দু’দিন দেখতে বলে কেন?
জিনিয়া বলতে পারে না। থানার ওসি তার সঙ্গে কী সব কথা বলেছে, সেটা জিনিয়ার আবার মনে পড়ে। শরীরটা হিম হয়ে আসে আবার। এই নিপীড়নের আলাপ সে বলতে চায় না সাজেদকে।
আচ্ছা ভাবি থাক। আপনার মানসিক অবস্থা আমি বুঝি। পুলিশকে সাংবাদিক দিয়ে চাপে রাখতে হবে। আমি এই বিষয়টাই খেয়াল রাখছি। আমি গতকালই স্ট্যাটাস দিয়েছি। তারপর সাংবাদিক মহলে জানাজানি হয়েছে বিষয়টা।
– ভাই, পুলিশ আমাকে জিজ্ঞেস করছিল আমি সাংবাদিকদের জানিয়েছি নাকি।
আপনি কী বললেন?
– ভাই, আমি তো কোনো সাংবাদিকদের জানাই নাই। সেটাই ওনাদের বলেছি।
খুব ভালো কাজ করেছেন ভাবি। একটা কথা মনে রাখবেন, এ ধরনের কেইসে একমাত্র ভরসা কিন্তু মিডিয়া। তারা নিউজটা ফলোআপে রাখলে একটা চাপ তারা অনুভব করবে।
– ভাই, আমার একটাই প্রশ্ন, লোকটাকে ধরে নিল কেন?
এই প্রশ্ন তো আমারও ভাবি।
– আপনি সাবধানে থাইকেন ভাই। আপনার বন্ধু তো কিছু না করেই বিপদে পড়ল। আপনিও সাবধানে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েন। আমাদের ওসব দরকার নেই। আমরা চুপচাপ ঠাণ্ডা নীরব জীবনযাপন করতে পারলেই হলো।
ভাবি, মোসাদ্দেকও তো চুপ ছিল। কী লাভ হলো? চুপ থাকলেই কি সব নিরাপদ হয়ে যায়?
জিনিয়া কিছু বলে না। চুপ থাকে।
৬.
এলাকার লোকজন থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজন। সবার কানে চলে গেল কেউ তুলে নিয়ে গেছে মোসাদ্দেককে। তারপর নানান জনের নানান মত আর প্রশ্ন।
অপহরণ নাকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী? অপহরণ যেহেতু হয়নি সে বিষয়টা তো এতক্ষণে সবাই মোটামুটি নিশ্চিত।
নতুন এই উৎপাতের সমস্যা জিনিয়া সহ্যই করতে পারে না। কারও সহযোগিতা নেই ঠিকই কিন্তু নানান কথা আর মাতব্বরিতে একজনের চেয়ে আরেকজন যেন সেরা। এ জন্য কেউ আসুক জিনিয়া তা চায় না। জিনিয়া সবাইকে জানিয়ে দেয়, কারও সাহায্য তার দরকার নেই। সে একাই লড়বে তার সংকট।
কিন্তু বাড়িওয়ালাকে তো আর এড়িয়ে চলা সম্ভব না। বাসার সামনের মিতুল কনফেকশনারিকে তো এড়িয়ে চলা সম্ভব না। বাকির টাকা শোধ করতে বলা হয়েছে মিতুল কনফেকশনারি থেকে। সঙ্গে নতুনভাবে বাকিতে আর সদাই করা যাবে না- এ নির্দেশনাও চলে এসেছে।
আর বাড়িওয়ালা? সে তো এলো ঘরে।
আপনাদের বিষয়গুলো ক্লিয়ার করেন।
– কী বিষয় ভাই?
থানা-পুলিশের গ্যাঞ্জামে আমি পড়তে চাই না। ধরে নিয়ে গেল কেন বাসা থেকে?
– কেমনে বলব ভাই। আপনারাই তো দেখলেন। কিন্তু পুলিশ তো স্বীকার করছে না।
আমরা কই দেখলাম? খবরদার, এসব বাজে কথা বলবেন না।
– কী বলেন ভাই? আপনিও তো দৌড়ে নিচে চলে আসছেন তখন।
কী সব আবোল-তাবোল বকেন আপনি? আপনি তো খারাপ মহিলা! জামাই আকাম কুকামে ধরা খায়। আবার মিথ্যা কথা বলেন।
জিনিয়াও তখন চুপ থাকে। তার কিছু বলার থাকে না। বাড়িওয়ালাও বলে যায় বাসা ছাড়ার কথা। জিনিয়া বোঝে কখনও কখনও মানুষকে অন্ধ হয়ে যেতে হয়। এই অন্ধত্ব কখনও কখনও জরুরি।
জিনিয়ার মনে প্রশ্ন আসে। আচ্ছা, একজন মানুষ যাকে এলাকায় সবাই চেনে, জানে। সাধারণ একজন মানুষ। তাকে কেউ তুলে নিয়ে গেলেই কি সে খারাপ হয়ে যায়?
এই প্রশ্ন সে কাকে করবে?
৭.
তিন দিন পার হওয়ার পর হঠাৎ সাজেদ ফোন করে জিনিয়াকে। কোনো এক অনলাইন পোর্টালে নিউজ এসেছে মোসাদ্দেক নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করেছে পুলিশ। ছবি দেয় নাই। তাই কনফার্ম না। জিনিয়াকে বলে দ্রুত খোঁজ নিতে।
জিনিয়ার তখন সাজেদের একটা কথা মনে পড়ে। মিডিয়াই একমাত্র ভরসা। জিনিয়াকে অনেক সাংবাদিক ফোন করেছিল গত দুই দিনে। কিন্তু রুবিনা ইয়াসমিন নামে এক নারী রিপোর্টারের নম্বর সে মোবাইলে সেভ করে রেখেছিল। তাকে দ্রুতই ফোন দিয়ে জানায় জিনিয়া। রুবিনা তাকে থানায় আসতে বলে। রুবিনাও রওনা হচ্ছে বলে জানায়।
রুবিনা তখন ওসিকে ফোন দেয় বিষয়টা নিশ্চিত হওয়ার জন্য।
ওসি সাহেব, সায়েদাবাদ থেকে নাকি একজনকে আটক করে আপনার থানায় নিয়ে আসা হয়েছে?
-জি, ঠিক শুনেছেন। ব্যাটা ইয়াবা বেচে।
তার নাম কী?
মোসাদ্দেক চৌধুরী। আমার এলাকাতেই তার বাসা। তাই সায়েদাবাদ থানা এখানে চালান দিয়েছে।
পরিবারের দাবি হলো, তাকে তিন দিন আগেই বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
– সে ইয়াবা ব্যবসা করত। ইয়াবা চালান আনতে চট্টগ্রাম গিয়েছিল। আজই ফিরেছে। তখন টহল পুলিশের কাছে ধরা খাইছে। তাকে আগে কেন তুলে আনবে?
টহল পুলিশ? তাহলে তো যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা হওয়ার কথা। মামলা হলো আপনাদের থানায়।
– তার বাসা এদিকে। তাই তারে এখানে নিয়ে আসা হইছে। একবার তো বললাম।
এটা কোন নিয়মে পড়ে? এটা তো কখনও শুনিনি।
– আপনার কাছে নিয়ম শিখবো নাকি? আমি রাখছি।
পরিবারের দাবিটা…
– পরিবার কী বলল তা দেখার টাইম আমাদের আছে? আর তার স্ত্রীকে গিয়ে প্রশ্ন করেন, তিন দিন হয়ে গেল থানায় তো একটা ডায়েরিও করে নাই। এত ভালো হলে তো সঙ্গে সঙ্গেই ডায়েরি করত।
তিনি তো আপনার থানাতেই এসেছিলেন। আপনিই তো মানা করেছেন জিডি করতে। দুই দিন দেখতে চেয়েছেন।
– উনি অসত্য বলছেন। উনি এসেছিলেন ঠিক। কিন্তু এমন কোনো আলাপ হয় নাই। উনি জিজ্ঞেস করেছেন আমরা এনেছি কি-না। আমরা আমাদের উত্তর দিয়েছি।
কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার হিসেবে তো আপনারই ওনাকে বলার কথা ডায়েরি করা।
– আপনি বেশি প্রশ্ন করছেন। আমি রাখলাম। আর তার বউকেও আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করব। মোসাদ্দেক স্বীকার করেছে- সে ইয়াবা চালান আনতে কক্সবাজার গেছে লোকজন নিয়ে। এখানে তার স্ত্রীও জড়িত কি-না সেটাও আমরা খতিয়ে দেখব।
৮.
থানায় একঝলক দেখেছে মোসাদ্দেককে। তার স্বামী। সবার অনেক প্রশ্ন। অনেক কিছু জানার আগ্রহ। দুই চারজন সাংবাদিক এসে ওসির সঙ্গে কথা বলছেন। কিন্তু জিনিয়া ওসিকে একটাই প্রশ্ন করতে চেয়েছিল। সে চেয়েছিল জিজ্ঞেস করতে, স্যার লোকটা তো নির্দোষ আপনারাও জানেন। কিন্তু তবুও কেন এমন এক বিপদে ফেললেন? এই প্রশ্ন করার কোনো সুযোগই পেল না জিনিয়া।
মোসাদ্দেককে আদালতে নেওয়ার জন্য গাড়িতে ওঠার সময় দু’জনের চোখাচোখি হলো। জিনিয়া মোসাদ্দেকের চোখ পড়তে পারত। সেদিন কেন যেন মোসাদ্দেকের চোখও পড়তে পারেনি জিনিয়া। তার শুধু মনে হলো মোসাদ্দেকের চোখ ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। ভাষাহীন একজোড়া নির্বাক চোখ দেখেছিল জিনিয়া।
৯.
তার এক সপ্তাহ পর এক রাতে সাজেদের বউ চিৎকার দিতে দিতে ফোন দিল জিনিয়াকে। হাঁপাতে হাঁপাতে কথাই বলতে পারছিল না।
শেষমেশ বলল জিনিয়াকে।
ভাবি- ভাবি সাজেদকে এইমাত্র কারা যেন তুলে নিয়ে গেল। ভাবি, আমি কী করব? ভাবি, আমার সাজেদকে কেন ধরে নিয়ে গেল।
জিনিয়া কেন যেন আতঙ্কবোধ করল না। যেন এক অনিবার্য নিয়তি ঘরে ঘরে হানা দেবে। যেন জিনিয়া জানত একদিন তার মতোই অনেক জিনিয়ার জন্ম হবে। যারা শুধু প্রশ্ন করবে, কেন ধরে নিয়ে গেল?
জিনিয়া শুধু বলল, ভাবি আমি আসছি।
তখন অনেক রাত। আকাশে চাঁদ নেই। তাই কেমন যেন একটা গুমোট অন্ধকার চারদিকে ছড়িয়ে আছে। কোথাও কোথাও সোডিয়ামের রোড লাইটগুলো অন্ধকার ভেদ করছে। জিনিয়া একটা সিএনজি নিয়ে রওনা দেয় সাজেদদের বাসার দিকে।
একটা ঠাণ্ডা বাতাস জিনিয়ার গায়ে লাগে। জিনিয়ার মোসাদ্দেকের কথা মনে পড়ে।
মোসাদ্দেক একবার বলেছিল, আমি যদি আগে মরি তুমি শক্ত থেকো। জিনিয়া ভাবে। জিনিয়া ভেবেই চলে। সিএনজি এগিয়ে যায় সাজেদদের বাসার দিকে।
এরপর কত কী হলো। দুই দিন পর সাজেদকে কোর্টে আনা হলো। অভিযোগ দেখানো হলো, কোনো এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিল সাজেদ। সেই ব্যবসায়ী মানহানি মামলা ঠুকে দিয়েছেন সাজেদের বিরুদ্ধে।
আপনারা যখন টিভি দেখেন, অফিস যান কিংবা ঘুমান, কিংবা সিনেমা দেখেন- তখন সাজেদের জন্য ফেসবুকে ব্যাপক তোলপাড় চলে। বাকস্বাধীনতা হরণ হচ্ছে শিরোনামে পত্রিকায় নিউজ হয়, রাস্তায় মানববন্ধন হয়, সভা-সেমিনার হয়। কত কত সুশীল সমাজের মানুষ সরকার বরাবর সাজেদের মুক্তির জন্য প্রতিবাদলিপিও দেয়।
জিনিয়া এসব দেখে আর প্রতিদিন তার শোরুমে চাকরিতে যায়। ভাগ্যিস, চাকরিটা সুরক্ষিত আছে এখনও। তার টিক-টক জীবনে নতুন সংযোজন সপ্তাহে একদিন মোসাদ্দেককে দেখতে কারাগারের ফটকে হাজির হওয়া। কখনও হয় দেখা, কখনও হয় না।
মোসাদ্দেকের সঙ্গে কেন এমন করা হলো? এই প্রশ্নটাই একদিন জিনিয়া ভুলে যায়। ভুলে যায় মোসাদ্দেকও।
দু’জনেই অপেক্ষা করে একদিন মামলা শেষ হবে, সাজা শেষ হবে। তারপর মোসাদ্দেক তার স্বপ্নবাক্সটি আবার খুলবে। আবার তাদের বিধ্বস্ত নগরটি রঙিন হয়ে উঠবে।