ঠান্ডা যুদ্ধ

এই গ্রামটি আমাকে ক্রমশ অসুস্থ করে তুলছিল। এপ্রিলের ভূমিকম্পের সেই ভয়াবহতা আমাকে ওই গ্রাম থেকে সরে আসতে বাধ্য করেছে। প্রিয়তমা স্ত্রী আর পাঁচ বছরের সন্তানকে হারিয়েছি। আজ এখানে তীব্র শীত পড়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় গরম কাপড়ের ব্যবস্থা করতে আর ভূমিকম্প প্রতিরোধক বাড়ি তৈরি করতে আর কতটা সময় নেবে এ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই।

সূর্যটা কুয়াশা চাদরে ঢাকা পড়েছে। আমি একটা উঁচু পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছি, চারদিকে সবুজ আর সবুজ। কিন্তু আমার মনে ঘন কালো অন্ধকার। এই উপত্যকাটি এক সময় ভীষণ সুন্দর ছিলো, কিন্তু এখন আর আগের মতো নেই। এখানকার বেশিরভাগ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত। হিরোশিমা আর নাগাসাকির কথা মনে করে কেঁপে উঠলাম।

দু’জন বয়োজ্যেষ্ঠ লোক গ্রামবাসীকে বলেছিল আসন্ন বিশ বছরে আসা ধ্বংসযজ্ঞের কথা। কিন্তু শুধুমাত্র মাতাল হবার কারণে তাদের কথা কেউ বিশ্বাস করেনি। কিন্তু আজ তাদের কথাই সত্যি হলো।

আমি ক্ষুধার্ত। কিন্ত আমি আসলে বুঝতে পারছি না এভাবে পেটপুরে খাওয়ার আদৌ কোনো অর্থ আছে কি না। আপনি কি কখনও তাবুতে থেকেছেন? আমিও থাকিনি। কিন্তু থাকতে দেখেছি। বিদেশী পর্যটক এসে এই একই জায়গায় এসে তাবু খাটিয়ে থেকেছেন। এখন আমরা নিজেরাই নিজেদের দেশে ভিনদেশী হয়ে গিয়েছি। এখন আমরা আমাদের পরিচিত মানুষদের কাছে অপরিচিত হয়ে গিয়েছি। আমরা এখন যেন নির্বাসিত, বহিরাগত।

এখন আমি আর শহুরে মানুষদেরকেও দোষারোপ করার প্রয়োজন বোধ করি না। তারা কানঢাকা টুপি আর রীতিসিদ্ধ পোশাক পরে দলবেঁধে আসে। আমি তাদের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না। আমি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। আমি আসলে এই শিক্ষা ব্যবস্থা বুঝে উঠতে পারিনি। এটা আমার জন্য খুবই কঠিন ছিলো। অবাক হয়ে যাই কী করে শহুরে মানুষগুলো স্কুল পাস করে। তারা কীভাবে- কী শিক্ষা অর্জন করে আর তারপর কী করে এই সুন্দর দেশটাকে ছেড়ে চলে যায়? হয়তো শিক্ষিত হওয়ার এটাই মানে। আমি খুশি যে আমি পড়াশোনা করিনি।

আমি কাতার গিয়েছিলাম এবং সেখানে একটা কারখানাতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছি। কিছু টাকা জমিয়ে পাঠিয়েছি একটা বাড়ি বানানোর জন্য। ওই বাড়িটা আমার বন্ধু ভূমিকম্পে হারিয়েছিল। এটা খুব হৃদয় বিদারক! প্রাকৃতিক দূর্যোগ কাউকেই ছাড়ে না। আমাদের দুর্নীতিবাজ অফিসার তার নিজের দামী বাড়ির ভিতরেই এই ভূমিকম্পে প্রাণ হারিয়েছেন। কেউ কি ভাবতে পেরেছিল তার এমন মৃত্যুর কথা? কেউ পারেনি। এমনকি সে নিজেও না।

আমার মনে হয়, দিন দিন আমার মানবিকতা বোধ কমে যাচ্ছে। ইদানীং আমি অনুভূতিহীন হয়ে যাচ্ছি। আমার স্ত্রী আর সন্তানের স্মৃতিগুলো দমন করা বা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছি। আমি তাদের মৃতদেহ সমাহিত বা শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে পারিনি। প্রথমে ভূমিকম্পে আমার বাড়ি ভেঙ্গে পড়লো, তারপর ভূমিধ্বসে আমার বাড়ি তলিয়ে গেলো। এ ঘটনা ঘটার সময় আমি মাঠে কৃষিকাজে ব্যস্ত ছিলাম। আমি চোখের সামনে এসব ঘটতে দেখেছি। আমার সাত বছরের মেয়ে দৌড়ে এসে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল। সে কিছু বলতে পারছিল না, শুধু বেঘোরে কাঁদছিল। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, আর আমার অবিশ্বাস্য চোখ বেয়ে জল ঝরছিল।

শহুরে মানুষগুলো এখনও আসে মিথ্যা আশ্বাস আর বাড়ির নকশা নিয়ে। তাদের হাসিও নির্দয় যেন। যদিও তাদের মধ্যে কেউ কেউ হৃদয়বান বলে মনে হয়। গত সপ্তাহে কিছু তরুণ আমাদের গ্রামে এসেছিল কম্বল দিতে। আর কিছু মানুষ আসে বক্তৃতা দেয়, ১০০০ রুপি দেয়, তারপর আমাদের কিছু কাল্পনিক ঘরবাড়ির নকশা দেখিয়ে চলে যায়। আমার মনে হয় আমি একটা কাল্পনিক দেশে বসবাস করি, যে দেশে কল্পনা করা, চিন্তা করার স্বাধীনতা আছে। কিন্তু সে কল্পনা বা চিন্তা কখনও বাস্তবায়িত হবে না।

আজকে প্রচণ্ড শীত। আমি জানি না কেনো। হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমাদের ওপর রাগান্বিত। যদিও আমি দেখতে পাচ্ছি কুয়াশায় সূর্য ঢেকে গিয়েছে। তারপরও আমার মনে হয় তাদের রাগান্বিত হওয়াটাই মূল কারণ। আপনি জানেন যে, আমি এক অশিক্ষিত লোক, তাই এসব বৈজ্ঞানিক ব্যাপার আমি কমই বুঝি। আমি একমাত্র আমার তাবু নিয়ে চিন্তিত। আমার তাবু খুবই ছোট। যেখানে আমি আমার আদরের ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে থাকি। আমার একটা রেডিও আছে যেটা এক শহুরে লোক আমাকে দিয়েছিল। আমি মাঝে মাঝে রেডিওতে খবর শুনি, এর খুব সামান্যই বুঝতে পারি। দেশের নেতারা কিছুই করছেন না। অথচ তারা প্রচুর পরিমাণে টাকা পাচ্ছেন। আমি অবাক হই- কোথায় যাচ্ছে এই টাকা? আমি অবাক হই- মানুষ কী করে এতোটা লোভী আর খারাপ হতে পারে। এটা সত্যি, মানুষ শুধু নিজের কথাই চিন্তা করে এবং আমাকেও একই কাজ করতে হবে।

আজকে কিছুটা ঝড়ো ঠান্ডা বাতাস বইছে। মাটিতে তুষার জমতে শুরু করেছে তাবুর দিকে ধীরে ধীরে শীত এগিয়ে আসছে। একটা মাত্র কম্বল জড়িয়ে আমি আর আমার মেয়ে থাকার চেষ্টা করছি। আমরা আমাদের জীর্ণ কাপড় পরে আছি তাও শীত লাগছে। সৌভাগ্যক্রমে শহুরে লোকগুলি আমার মেয়েকে দেখে অতিরিক্ত একটা কম্বল দিয়েছিলো। এখন এটা আমাকে খুঁজতে হবে। আমার ধারণা কম্বলটা চুরি হয়ে গেছে। আমি অবাক হই- কে এটা চুরি করলো?

মধ্যরাতে আমি মানুষের কান্না শুনতে পাই। প্রতিনিয়ত এই একই ঘটনা দেখতে আমার আর ভালো লাগে না, তাই আমি ঘুমানোর চেষ্টা করি। কান্না জোরালো হলে আমি তাবুর বাইরে যাই। দেখতে পাই একটা পরিবার একটি মৃত দেহের পাশে বসে কাঁদছে। আমি কাছে গিয়ে দেখি একজন বৃদ্ধ প্রচণ্ড শীতে মারা গেছে। আমার খারাপ লাগছিল, ভয়ে কেঁপে উঠি। আমি তাবুতে ফিরে যাই। আমার মেয়ে গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। আমার মেয়ে আমার রাজকন্যা। আমি ঘুমানোর চেষ্টা করি। আর তাবুর বাইরে সেই পরিবারের শোকের মাতম চলতে থাকে।

আজকে সুন্দর একটা দিন। তাবুর বাইরে গিয়ে দেখি আমার মেয়ে হাসছে, খেলছে, গাইছে। এটা আসলেই খুবই সুন্দর একটা জায়গা। হঠাৎ করে দেখি আমার চারদিকে অনেক মানুষ, এবং এখন আর শীত নেই। তারা খুবই বিশুদ্ধ, উদ্ভাসিত। কোথায় আছি আমি? আমার তাবু দেখার জন্য আমি পিছনে ফিরে তাকালাম, সেখানে কোনো তাবু ছিলো না। সেই মৃত বৃদ্ধকে চোখে পড়লো। কাছে এসে জড়িয়ে ধরলো। কানে কানে বলল, ‘যা কিছু হয় ভালোর জন্য হয়।’

আমি বুঝতে পারলাম না সে কি বলতে চাচ্ছে। আমাদের এই দুঃখের শহরে কি এতো ভালো? সে হয়তো পাগল হয়ে গেছে।

এই জায়গাটা সুন্দর! কিন্তু সেই উপত্যকা আমি আর দেখতে পাচ্ছি না। হঠাৎ দেখি, আমার স্ত্রী আর ছেলে এগিয়ে আসছে। মেয়েটাও দৌড়ে আসছে আমার কাছে। আনন্দে সবাইকে জড়িয়ে ধরলাম। দারুণ খুশি লাগছে! একটা ছোট্ট কিন্তু সুন্দর পরিবার। এখন আর শীত লাগছে না। এই জায়গাটা খুবই প্রাণবন্ত। এখানকার ঘ্রাণও সুন্দর। আমরা ওই বৃদ্ধের সাথে প্রাণোচ্ছ্বল শহরের দিকে হাঁটছি।

ওই বৃদ্ধের মৃত্যুর কথা শুনে পরদিন শহরের লোকজন সিন্ধু পালচৌক গ্রামে এলো। একজন শহুরে লোক জিজ্ঞাসা করলো, ‘এটা কীভাবে ঘটলো?’ গ্রামবাসীদের একজন উত্তর দিলো, ‘শীত ছাড়া আর কি হতে পারে?’ শহুরে লোকটা আবার প্রশ্ন করলো, ‘একজনই নাকি আরও কেউ আছে?’ একজন গ্রামবাসী কাঁপছিল। সে জবাব দিলো, ‘আছে। আরেকজন বৃদ্ধ ও তার মেয়ে।’

‘কোথায়?’, শহুরে লোকটি জানতে চাইলো। ‘ওই তাবুটা দেখতে পাচ্ছেন?’, একজন বলল। শহুরে লোকটি এগিয়ে গেলো তাবুর দিকে। তাবু তুলে দেখলো, স্ত্রী-ছেলে হারানো লোকটি তার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়েছে। চিরতরে।

লেখক পরিচিতি: নেপালে ইংরেজিভাষী এই সময়ের তরুণ গল্পকারদের মধ্যে অন্যতম অরুণ বুধাথোকি। তিনি গল্প, উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা লিখেও খ্যাতি পেয়েছেন। বর্তমানে ‘কাঠমাণ্ডু ট্রিবিউন’র প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। শিক্ষাগত কারণে থেকেছেন ভারতের হায়দরাবাদে। উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন ইংল্যান্ডে। এরই মধ্যে ৬টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নেপালের জাতীয় দৈনিকগুলোতে নিয়মিত কলাম লিখে থাকেন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত