ঊর্মিমালা

১.
কুদরত মাছটার দিকে তাকালো। মাছটাও কুদরতের দিকে তাকালো। অন্তত গল্পের শুরুতে তেমনটাই মনে হচ্ছে। কুদরত আর মাছ একে অপরকে দেখছে। মাছটার নাম- তেলাপিয়া। না, কথাটা ঠিক হলো না। তেলাপিয়া তো প্রজাতির নাম। কোটি কোটি তেলাপিয়া আছে। সবাই তেলাপিয়া। অতএব আমাদের এই নির্দিষ্ট তেলাপিয়া মাছটার একটা নাম দেয়া যাক। গল্পের খাতিরেই আপাতত মাছটার নাম দেয়া যাক- ঊর্মিমালা। তেলাপিয়া নদী বা সমুদ্রে থাকে না। শান্ত পুকুরে হয়। ইদানিং চাষের জন্যে বানানো জলাশয়েও হয়। কাজেই ঊর্মি বা ঢেউ সেখানে নেই। কিন্তু এই তেলাপিয়া মাছটার শরীরে ঢেউয়ের ছটা আছে। তাছাড়া, জানা মতে, মাছের নামকরণে আকিকা কিংবা রেজিস্ট্রি টাইপ কিছু লাগে না। কাজেই এই তেলাপিয়া মাছটাকে ‘ঊর্মিমালা’ বলে ডাকা যাক। বিশ্বাস করুন, শুনতে ভালো লাগবে তাতে।

কুদরত প্রাণ ভরে দেখছে ঊর্মিমালাকে, মন ভরে দেখছে। যতোই দেখছে ততোই সে ঊর্মিমালার প্রেমে পড়ে যাচ্ছে।

ঊর্মিমালাকে দেখেই কেমন জিভে পানি এসে যায়। সে একদম যাকে বলে পরিপক্ক একটা মাছ। এমন মাছ তার ভাঁজে ভাঁজে স্বাদ জমিয়ে রাখে। তাঁর তেলতেলে কালচে প্রশস্ত শরীর সমীহ জাগায়। কুদরত আলতো করে, মোলায়েম করে, ঊর্মিমালার শরীরে হাত বোলায়।

ও জনে ঊর্মিমালা ঠিক এক কেজি দু’শ গ্রাম। সাধারণ তেলাপিয়ার চেয়ে চার-পাঁচগুণ আকারে বড়। মাছ না হয়ে মানুষ হলে, ঊর্মিমালাকে ‘মুটকি’ বলা যেতো। কিন্তু মাছের বিবেচনায় এইটাই সবচেয়ে উপযুক্ত আকার। এরচেয়ে বড় হলে মাছটা মোলায়েম থাকতো না, আবার ছোট হলে তেলতেলা হতো না। মাছ, পৃথিবীর পরিস্কারতম প্রাণ, জলের তলায় থাকে সে। মাছের গায়ে হাত বোলালে সাঁতারের একটা অনুভব কুদরতের হাতে লেগে যায়। আবার মাছটাকেও অনুভব করা যায়। স্পর্শ এমন এক অনুভূতি যার আমেজ ও স্মৃতি শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, লেগে থাকে। কুদরত একাগ্রচিত্তে আবার ঊর্মিমালার শরীরে হাত বুলিয়ে নেয়।

কুদরত পরাণ ভরে ঊর্মিমালাকে দেখতে থাকে। ঊর্মিমালাও কুদরতকে দেখতে থাকে। কিন্তু হায় ইতোমধ্যেই ঊর্মিমালা মৃত। তাকে কেনা হয়েছিলো জীবিত। প্রবল শক্তিতে সে তখনও লাফ-ঝাপ করছিলো। সে মাছ সমাজের সুদক্ষ এক্রোব্যাট, কিংবা কে জানে- নর্তকী। কিন্তু ঊর্মিমালা দীর্ঘক্ষণ ডাঙায় থাকায় আপাতত মৃত। তবু তাঁর চোখ খোলা। ঊর্মিমালার খোলা চোখ তাকিয়ে আছে কুদরতের দিকে। যেহেতু সে মৃত তাই সে হয়তো কুদরতকে দেখছে না। কিংবা কে জানে হয়তো দেখতে পাচ্ছে। মৃত্যু যে সব দেখা বন্ধ করে দেয় তা নিয়ে আমরা নিশ্চিত নই। আমাদের কুদরত এমন বিশ্বাস করে যে, ঊর্মিমালা তাকে দেখছে। সে আরেকবার সবিনয়ে ঊর্মিমালার শরীরে মমতার হাত বুলায়।

কুদরত একটা চা-চামচ হাতে তুলে নেয়, মাছের আঁশগুলো তুলতে থাকে। রয়ে যাওয়া দুয়েকটা জিদ্দি আশকে সে আবার আঙুলে খুঁটে খুঁটে তুলতে থাকে। আশ ছাড়ানো একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কাজটা করতে হয়, ধীরে আর সাবধানে। একটি আঁশ রয়ে গেলেও চলবে না। আঁশ তোলার পর ঊর্মিমালাকে কেমন নগ্ন মনে হয়। কুদরত ছবি আঁকতে জানলে মাছটার এক্ষুণি একটা তৈলচিত্র আঁকতো, ‘স্টাডি অফ আ ন্যুড ফিশ’। মাছের আশ আর মুরগির পালক ছড়ানোর পর কুদরত তাদের দিকে তাকাতে অস্বস্তি অনুভব করে। নেহায়েতই ন্যাংটা মেয়ে মানুষগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।

নগ্ন ঊর্মিমালাকে অবিরাম ট্যাপের জলধারায় গোসল করায় কুদরত। যেন এটাই তাঁর জীবনের শেষ গোসল। শেষ কৃত্যানুষ্ঠানের মতো রান্নাঘরে এক ভাবগম্ভীর পরিবেশ তৈরি হয়। কারণ ইতোমধ্যেই কুদরত দুটো মোমবাতি জ্বালিয়ে দেয়। এটা কুদরতের নিজস্ব রিচ্যুয়াল। দিনে বা রাতে যখনই সে মাছ বা মুরগি রাঁধে তখনই সে চারপাশে মোমবাতি জ্বালায়। মাছ মুরগির ক্ষেত্রেই তার এই বিশেষ ব্যবস্থা। কেন এই ব্যবস্থা তা সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারণা নেই।

যাই হোক, আঁশ ছাড়ানো এবং প্রবল ধোয়াধুয়ির ফলেই কালচে ঊর্মিমালাকে এখন বেশ ফর্সা দেখায়। আর কে না জানে, এই ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’র দেশে ফর্সা হওয়া একটা পূঁজি। সেই সব ফেমিনিস্ট কথা না-বলে, সরল করে বলা যায় যে, ঊর্মিমালাকে এখন বিয়ের কনে মনে হচ্ছে।

এই মনে হওয়াটা কিছুক্ষণের মধ্যেই সত্য হতে বাধ্য। কেননা আরেকটু পরেই ঊর্মিমালার সারা শরীরে খুব ভালো করে হলুদ মাখানো হবে। সাথে আদা, লেবুর রস আরো কতো কি! যাকে বলে একেবারে স্পা, মেনিকিউর, পেডিকিউর আরো কী কী যেন…। ঊর্মিমালার গায়ে হলুদের উৎসব উপলক্ষে গান-বাজনার দরকার। কুদরত তার মোবাইলে নুসরাত ফতেহ আলী সাহেবের ‘দামাদম মাস কালান্দার’ কাওয়ালিটা ছাড়ে। ইউটিউবে পুরো ভিডিওটা ১৬ মিনিট ৪৩ সেকেন্ডের। ধরে নেয়া যাক, ১৭ মিনিটের। ঊর্মিমালাকে রেডি করতে কুদরতের সময় লাগবে অবশ্য ১২ মিনিট। বাকী পাঁচ মিনিট বাড়তি সময় হাতে রাখতে হয়। হাতে সময় রাখা ভালো।

কুদরত ঊর্মিমালার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে থাকে। একবার মৃদু করে বলে, স্যরি বেবি। তারপর বড় ছুড়িটা দিয়ে ঊর্মিমালার পেটটা চিরে ফেলে। নাড়ি-ভূড়ি ফেলে দেয়। কানকো পরিষ্কার করে। আবার মিনিট তিনেক ঊর্মিমালাকে ধোয়, ট্যাপের অবিরাম ধারায় ধোয়, যেন ঝরনার জলে স্নান করছে ঊর্মিমালা। এবার ঊর্মিমালার গায়ে ছুড়ি দিয়ে তিনটা তিনটা ছয়টা আচড় কাটে দু’পাশে। এই উল্কিগুলো শুধু শুধু করা নয়। এতে করে মাছের শরীরে যেমন মশলাগুলো ঢুকবে, তেমনি একঘেঁয়ে সমতল শরীরে তিনটা গভীর রেখা দেখা যাবে। এই রেখা, এই ভাঁজের নন্দনতাত্ত্বিক প্রয়োজন আছে।

এবার শুরু হবে আসল কাজ। মশলা মাখানো। মশলা খুবই সামান্য। কিন্তু কে না জানে, সামান্যতেই ঘটে যায় অসামান্য কিছু। দুই চিমটি হলুদ, বড় একটা কলম্বো লেবুর রস, সামান্য আদা-রসুন বাটা আর যথাবিহিত পরিমাণ মতো লবণ- এই হলো ঊর্মিমালাকে সাজানোর উপকরণ। কুদরত প্রথমেই লেবুর রস ঢেলে দেয় ঊর্মিমালার বুকে, পেটে, পিঠে। তারপর তার গায়ে আদা-রসুন বাটার হাল্কা প্রলেপ দেয়। উল্কির মতো ছয়টা গভীর চিরে ফেলা স্থানে ছোট ছোট আদার কুঁচি সাজিয়ে দেয় কুদরত। সবশেষে বরযাত্রীর গায়ে গাদাফুলের পাপড়ির মতো লবণ ছিটায় সে।

মাছ, আদা, রসুন, হলুদ, লেবু- সব কিছুর ঘ্রাণ কুদরতের মনে একটা পুরনো স্মৃতির ঝাপটা এনে দেয়। লীনা, হ্যাঁ, লীনাই হবে সম্ভবত, তার গায়েও এমন ভরাট মাছের ঘ্রাণ পেয়েছিলো সে, সাথে কিছু আদা-লেবুর ঝাঁজ। বিশেষ মুহূর্তে মনে হলো, কিছুটা নুন হলুদও মাখানো ছিলো লীনার শরীরে। কথাটা লীনাকে বলতেই সে ক্ষেপে গেলো। যেন শরীরে মাছ, আদা, লেবু, নুন, হলুদের ঘ্রাণ থাকা খুবই নোংরা ব্যাপার। মেয়েরা জীবন ভর মাছ রাঁধে, কোটে-বাছে, কিন্তু মাছের মাহাত্ম্য বোঝে না!

যাক, মশলা মাখানোর জটিল রসায়নটি শেষ হলো। কেননা, এই রসায়নের কোন কিতাবি পরিমাপ নেই। ঠিক কতটুকু হলুদ, কতটুকু আদা, কতটুকু লেবুর রস, কতটুকু লবণ কোথায় কিভাবে মেশাতে হবে সেখানেই ওস্তাদি। এই ওস্তাদির পর বলা যায় ঊর্মিমালা অনেকটা তৈরি।

একটা গভীর ট্রেতে ঊর্মিমালাকে শুইয়ে দেয় কুদরত। শুয়ে থাকা ঊর্মিমালার শরীরে তুলি দিয়ে অলিভ ওয়েল মেখে দেয় কুদরত। এবার ট্রের চারপাশে আঙুলের আকারে গাজর, আলু, বরবটি কেটে দেয়। ফাঁকে ফাঁকে টুকটুকে লাল চেরি টমেটো দুফাঁক করে বসিয়ে দেয়। সবশেষে এলোপাথারি করে কয়েকটা গাঢ় সবুজ কাঁচামরিচ আর একমুঠো কঁচি সবুজ ধনেপাতা কুচি ছড়িয়ে দেয় কুদরত। লাল গাজর, টমেটো আর সবুজ বরবটি, কাঁচামরিচ, ধনেপাতা মিলেমিশে বেশ একটা লাল সবুজের কম্পোজিশন তৈরি করে। এই আর্টওয়ার্কটাকে এখন কিছুক্ষণ ফ্রিজে রাখতে হবে মাঝারি তাপমাত্রায়। অবশ্যই ঢেকে রাখতে হবে। এতে করে মশলা আর ভেষজ আর সবজির নির্যাসগুলো ঊর্মিমালার সঙ্গে মিশে যাবে ধীরে ধীরে। বেকড ফিশের সবচেয়ে বড় কারিগরি হলো কোথাও তাড়াহুড়া করা যাবে না। আদতে, তাড়াহুড়া সকল ক্ষেত্রেই পরিত্যাজ্য মনে করে কুদরত। সে ট্রে ফ্রিজে ঢুকিয়ে দেয়। তিনঘণ্টা ঊর্মিমালার দেহটা ফ্রিজে শুয়ে থাকবে।

ঊর্মিমালাকে ফ্রিজে রেখে ফতেহ আলি সাহেবের গানটার গলা টিপে দেয় কুদরত। এখন আর এই গানটার দরকার নেই তার। নিজের গা থেকে এপ্রোন খুলে ফেলে। তিনঘণ্টা সময় আছে তার হাতে। যথেষ্ট সময়। এবার নিজেকে সাজানোর পালা। শেভ করা, শাওয়ার নেয়া, এবং ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে ঘণ্টাখানেক ঘুমানো- এই তার কাজ। এই তিনঘণ্টায় মাছটা ম্যারিনেট হবে আর কুদরত নিজেকে তৈরি করে নেবে।

২.
ল্যাকমে আইকনিক কাজল দুই রকম আছে। একটা ২২ ঘণ্টা পর্যন্ত থাকে আরেকটা ১০ ঘণ্টা। মিথিয়া ১০ ঘণ্টারটা কেনে। ২২ ঘণ্টা দীর্ঘস্থায়ী কাজল কেবল সিনেমার নায়িকাদের কাজে লাগতে পারে। সিনেমায় সব কিছুই বেশি বেশি লাগে। মিথিয়ার জন্যে ১০ ঘণ্টা সময়ই অনেক। ল্যাকমের আইকনিক কাজলে ‘আইকনিক’ বানানটা খুব মজার। বড় বড় কোম্পানিগুলো নামকরণেও কতো সেয়ানা! একবাক্যে `Iconic’ না লিখে, তারা লিখেছে `Eye co nic’। এইসব ছোটখাটো ডিটেইল দেখতে তাঁর খুবই ভালো লাগে।

নিজের দুচোখে পরম মমতায় সাজায় মিথিয়া। কাজল দেয়ার সময় হাত হতে হবে সার্জনের মতো পাথর-স্থির, একটু কাঁপলে চলবে না, লাইন আঁকাবাকা হলে চলবে না। শুধু হাত নয়, মনও হবে স্থির, অচঞ্চল। চোখের আকৃতিটাকে নিঁখুত আর গভীর করে তুলে ধরে কাজল। আহ, চোখ এক আশ্চর্য অঙ্গ। কে যেন বলেছিলো, বোধহয়, মওলানা রুমি, তোমার দুটি চোখ কতোই না ছোট, কিন্তু এই ছোট্ট চোখদ্বয় দিয়েই তুমি বিশাল জগত দেখো। কথাটা বেশ মনে ধরেছিলো মিথিয়ার। কথাটা বলেছিলো ফিরোজ। ফিরোজ আদর করার সময় খুব মজার মজার কথা বলতো। ফিরোজই একমাত্র পুরুষ যে তার পুরো শরীর ছুঁয়েছে। ও বলতো- তোমার শরীরের এক ইঞ্চি জায়গাও আমি স্পর্শহীন রাখবো না।

আলাদা করে মিথিয়ার চোখ, নাক, জিভ আর কান পছন্দ করতো ফিরোজ। নাক, কান, জিভ আর চোখে চুমু খেতো ও। বিশেষ করে কানের মধ্যে যখন জিভ বুলাতো…। ফিরোজ বলতো- শোনো খুকি, কান দিয়ে তুমি শোনো, আর জিভ দিয়ে আমি বলি… কানের মধ্যে জিভ… এ হলো সঙ্গমের আসলি রস।

কতো রস যে জানতো লোকটা। এই রসের লোকটা মরলো ধুম করে। কথা নেই, বার্তা নেই, সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে গেলো। পড়েই মরে গেলো!

না, এখন স্মৃতিচারণের সময় নয়। মিথিয়াকে বেরুতে হবে। সে কুদরতকে কথা দিয়েছে ২ ঘণ্টা থাকবে তার ওখানে। একসাথে লাঞ্চ করবে। কুদরত অবশ্য ডিনারের আহ্বান করেছিলো। আহ্বান করলেই সাড়া দিতে হবে এমন কোন কথা নেই। বুদ্ধিমান সে-ই যে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখে সব কিছু। অন্যপক্ষকে সুযোগ দেয়া যায়, কিন্তু নিয়ন্ত্রণটা রাখতে হয় নিজের হাতেই। চোখের কোণায় খোঁচা লেগে যায়। এটা অন্যমনস্কতার ফল। কেন অন্যমনস্ক হচ্ছে মিথিয়া। কুদরতের মতো দু’চারজনের সঙ্গে লাঞ্চ, ডিনার করা তার জন্য কোন ব্যাপারই না। সে চাইলে বরং এদেরকেই খেয়ে ফেলতে পারে- কাঁচা, একদম কাঁচা।

আয়নায় চোখ দুটো দেখে নিজেকেই আদর করতে ইচ্ছা করে মিথিয়ার। চোখটাকে সাজানোর পর মিথিয়া মন দেয় ঠোঁটে। ছেলেরা সাধারণত মেয়েদের তিনদিকে তাকায়, চোখে, ঠোঁটে, বুকে। অতি চালু মাল হলে তাকায় পাছায়। কুদরতের জন্য আপাতত মিথিয়া চোখ আর ঠোঁটেই মনোযোগ দেয়। বাকী দুটোর দিকে আলাদা করে নজর দেয়ার কিছু নেই। ফাজিল পুরুষগুলোর দৃষ্টি থেকে মিথিয়া ইতোমধ্যেই জেনে গেছে, তার ওই সম্পদগুলো বেশ ভালোই।

ঠোঁটের জন্যে মিথিয়ার পছন্দ হলো ম্যাট লিপস্টিক। ম্যাট লিপস্টিকের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো ক্যাটক্যাট করে না, রংটা আলাদা জেল্লা দেয় না। মিথিয়ার বিবেচনায় আলগা জেল্লা সে ঠোঁটেই হোক, বা অন্য কোনোখানে; আদতে অসভ্যতা। কিন্তু ম্যাট লিপস্টিকের সমস্যা হলো এগুলো একটু খরখরা টাইপ। এর সমাধান হলো একসঙ্গে ম্যাট আর মোয়েস্ট একটা লিপস্টিক। ২০১৪-তে কান ফিল্ম ফেস্টিভালে ঐশ্বরিয়া রায় পরেছিলো ল’অরিয়েল প্যারিসের মোয়েস্ট অ্যান্ড ম্যাট লিপস্টিক। সেই থেকে মিথিয়ার পছন্দ এটা। দাম একটু বেশি, কিন্তু নিশ্চয়ই তার ঠোঁটের চেয়ে দামী নয়। এই লিপস্টিকটার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এটা ঠোঁট শুকনাও রাখে না, আবার ভেজাও রাখে না। অনেকটা প্রাকৃতিক রং দেয়। ঠোঁটের উপর হাল্কা পরশের মতো ল’অরিয়েল রয়ে যায় ৬ ঘণ্টা। এর আগে মিথিয়া ঠোঁটে লাগাতো ববি ব্রাউনের ক্রিম ম্যাট লিপস্টিক। এই লিপস্টিকগুলো ছিলো কিসপ্রুফ। মানে হালকা-পাতলা চুমাচুমিতে এই লিপস্টিক যায় না। তবে এর দাম ল’অরিয়েলের চেয়েও বেশি। আর মিথিয়া আজকাল এটা ব্যবহার করে না। অন্তত কুদরতের মতো লোকের জন্য তো করেই না।

কাজল আর লিপস্টিকেই নিজের সব তৎপরতা ব্যবহার করে ফেলে মিথিয়া। পোশাকে আর তেমন মন দেয় না। পোশাক, সে কেবল আবরণ, খসে পড়ে, অথবা ঢেকে রাখে। আবরণটা আরামদায়ক হলেই চলে। হু, রংটা বিষয়। অন্য মেয়েদের মতো মিথিয়া কখনোই ম্যাচিং ম্যাচিং খেলে না। তার খেলাটা হলো কনট্রাস্টের। বৈপরীত্য। যেমন এখন সে পরেছে সাদা স্কার্ট আর কালো টপস। খাঁটি বৈপরীত্য। কালোর সঙ্গে সাদার চেয়ে হলুদ আরো বেশি কনট্রাস্ট করে। কিন্তু সেটা একটু কড়া। কালো জিন্সের সঙ্গে হলুদ টি শার্ট হলে মিথিয়াকে খুব লোভনীয় দেখায়। কিন্তু সাদা-কালোয় একটা সমীহ আছে। ঘড়ি আর জুতাটা লাল পরে সে। সাদা-কালো-লাল মন্দ নয় ব্যাপারটা। কাজল আর লিপস্টিকের সঙ্গেই যেন পোশাকটার একটা চোরাগুপ্তা মিল রেখে ঘর থেকে বের হয় মিথিয়া।

৩.
তেলাপিয়াকে গরিবের মাছ মনে করা হয়। দাম কম বলেই হয়তো। ব্যাপক হারে চাষ হওয়ায় তেলাপিয়ার কৌমার্য কমে গেছে। শিং, মাগুর, পাবদাও চাষ হয়, তবে তাদের খানদানি ভাবটা এখনও তেমন কমেনি, যতোটা তেলাপিয়ার কমেছে। তেলাপিয়া মাছ, সত্যি অর্থে, এ দেশের মানুষ খেতেই শেখেনি। বেগুন-টেগুন দিয়ে ঝোল বানিয়ে এই মাছটার ইজ্জত মেরে দিয়েছে বাঙালি। বাঙালি জানেই না, তেলাপিয়া পৃথিবীর সেরা একটা মাছ, স্বাদের দিক থেকে। তবে তাকে ঝোলে-ঝালে গুলিয়ে ফেললে হবে না। মাছের আদি স্বাদ রাখতে হবে, কম মশলায়, ধীরে ধীরে তেলাপিয়া মাছ তৈরি করলে, জিভে দিয়ে মনে হবে, এ মাছ স্বর্গের দান। তেলাপিয়া মাছ সবচেয়ে ভালো জমে ব্যাকড করলে। যথেষ্ট সব নিয়ে ম্যারিনেট করে, তারপর ধীরে ধীরে ব্যাকড করতে হয় এ মাছ। ওভেন না থাকলে চুলাতেও করা যায়। একটা বড় কোনো পাত্রে পানি দিতে হবে, সেই পানির উপর আরেকটা ছোট পাত্রে মাছটাকে শুইয়ে দিতে হবে। তারপর ফুটন্ত পানির আঁচে সিদ্ধ হবে তেলাপিয়া। না, মোটেও পানির ছোঁয়া মাছের গায়ে লাগানো যাবে না। যে পানিতে মাছের বাস সেই পানি থেকে দূরে রেখে তাকে রান্না করলে স্বাদ সম্পর্কে ধারণাই পাল্টে যাবে। বেকড করতে না-পারলে ভাজিও ভালো। আস্ত তেলাপিয়া ফ্রাইও কম না! কিন্তু তেলাপিয়া, তেলাপিয়া করে কেন ঊর্মিমালাকে অসম্মান করছি। আমাদের কুদরত আজ ঊর্মিমালাকে উৎসর্গ করবে মিথিয়ার জন্যে। মিথিয়া মেয়েটার অনেক অহঙ্কার। অহঙ্কারটা একটু ভাঙতে পারলে মিথিয়া হয়ে উঠবে আরো সুন্দর। অহঙ্কারের একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে, বিনয়েরও সৌন্দর্য আছে- আসলে সব কিছুরই সৌন্দর্য আছে। তবে পরিমাণটা বুঝতে হবে। সৌন্দর্য হলো, লবণের মতো, কম-বেশি হলে পুরোটাই মাটি। কুদরত মিথিয়ার জন্যই ঊর্মিমালাকে সাজিয়েছে। মিথিয়া দেখুক, শিখুক, সৌন্দর্যের চূড়ান্ত রূপ হলো নিবেদন।

নিবেদন অবশ্য মিথিয়াও করে, নিজেকে। কিন্তু সেই নিবেদনে অহঙ্কার আছে, প্রয়োজন আছে, আছে কিছুটা উগ্রতাও। সেইটুকুই ভালো লাগেনি কুদরতের। আদতে কুদরত যে হোটেলের শেফ সেটি থ্রি স্টার। সেখানেই মিথিয়ার নিয়মিত যাতায়াত। নানা পদের লোকের সঙ্গে সে ডিনার করে, মদ্যপান করে, শেষে হোটেলের বিছানায় গড়াগড়ি খায়। এই রকম গড়াগড়ি খাওয়া অনেক মেয়েকেই চাকরির সুবাদে দেখেছে কুদরত, দেখতে হয়। কিন্তু কোনদিন পাত্তা দেয়নি। কিন্তু মিথিয়া একদিন তাকে ডেকে পাঠায়। প্রায় এককেজির রেড স্নাইপারটার দিকে কড়া লাল নখগুলো তুলে বলে- কী রেঁধেছেন এসব, আপনিই কি সেফ! কুদরত যথেষ্ট পেশাদার বলেই সেদিনের ঘটনা বেশিদূর এগোয়নি। সে বিনীত স্বরে বলেছিলো, দুঃখিত ম্যাডাম, আমি এটা বদলে দিচ্ছি।

দ্বিতীয়বারের রেড স্নাইপারটা খেয়ে মিথিয়া বলেছিলো- হু, এটা ভালো হয়েছে, দেখলেন তো, মন দিলে ভালো করা যায়।

জ্বি ম্যাডাম- এর বেশি আর কথা বলেনি কুদরত। কুদরত বুঝেছিলো সেদিনই, মিথিয়ার জিভটা চড়া স্বাদের। সে লবণ বেশি খায়।

তারপর প্রায়শই দেখা হয়েছে। এক ফাঁকে কুদরত তাকে বলে বসে- আমার খুব ইচ্ছা একদিন আপনাকে খাওয়াই।

– সে তো খাওয়ানই।

– না, এভাবে নয়।

– তো, কীভাবে?

– আমার বাসায়।

– তাই?

– জ্বি। শুধু আপনার জন্যই রাঁধবো আমি।

– হঠাৎ?

– এমনি। আপনি কিছু মনে করলে বাদ দিন।

– না। ঠিকাছে।

– তাহলে আগামী বৃহস্পতিবার, ডিনার।

– শুরুতেই ডিনার? নাহ, লাঞ্চ। লাঞ্চ ভালো লাগলে, ডিনারও।

– ওকে ডান।

– কী খাওয়াবেন বললেন না? ম্যানু কই।

– আমার উপর আস্থা রাখুন।

মিথিয়া আস্থা রেখেছে। এই তো ঘণ্টা বেজে ওঠলো। এই তো দরজায় দাঁড়িয়ে আছে মিথিয়া। ঊর্মিমালার মতোই অপূর্ব লাগছে তাকে। সহজ, সরল, সুন্দর।

৪.
– আসুন। অসংখ্য ধন্যবাদ। আসার জন্য।

– এতা ফর্মাল হচ্ছেন কেন? বাহ, আপনার ঘরটা তো খুব গোছানো!

– চলুন, সরাসরি ডাইনিং টেবিলে।

ডাইনিং টেবিলটাকেও যথেষ্ট আদর দিয়ে সাজিয়েছে কুদরত। মেইন কোর্স ঊর্মিমালা। সঙ্গে আছে স্যুপ, ব্রাউন ব্রেড, সালাদ, বাটার ফ্রাইড ভেজিটেবল আর মোহিতো। টেবিলে রূপার মোমদানিতে সোনালী মোমবাতি গলে গলে পড়ছে। একপাশে পিতলের ফুলদানিতে বেগুনি আর গোলাপি রঙের কার্নেশন।

– ক্যান্ডেল লাইট ডিনার দেখেছি, ক্যান্ডেললাইট লাঞ্চ তো দেখিনি?

– আজ দেখুন।

– টেবিলটা ভালো সাজিয়েছেন। এগুলো কী ফুল?

– কার্নেশন।

– ঘ্রাণ নেই?

– সব ফুলের ঘ্রাণ থাকে না। কিছু কিছু ফুল সৃষ্টিকর্তা এমন রঙিলা করেন যে তাদের ঘ্রাণ লাগে না। যেমন, শিমুল।

– ফিলোসফার!

– ইনডিড। রান্না তো জগতের সবচেয়ে বড় ফিলোসফি।

– তাই!

– আর্ট ও সায়েন্সও বলতে পারেন।

– বুঝিয়ে বলুন তো।

– মানুষের ইন্দ্রিয় কয়টা?

– পাঁচটা। কারো কারো ছয়টা থাকে বলে শুনেছি।

– এখন বলুন, আপনি কখন আপনার পাঁচ ইন্দ্রিয় একসাথে ব্যবহার করেন?

– পরীক্ষা দিতে হবে?

– না। নিন, স্যুপটা নিন। পামকিন স্যুপ। মিষ্টি কুমড়ার স্যুপ। সাথে প্রণ দিয়েছি। একটু টক মিষ্টি ঝাল। স্যুপ খেতে খেতে কথা বলি।

– হুম, বেশ টেস্টি। মানে, অন্য রকম। মিষ্টি কুমড়া যে স্যুপ হয় সেটাই জানতাম না। কই, বলুন আপনার রান্নার দর্শন, কলা, ছলার কথা।

– উদাহরণ দিয়ে বলি। ধরুন আজকের মেইন কোর্স, আমি এর নাম দিয়েছি ঊর্মিমালা।

– উর্মিমালা? মাছের নাম!

– না, জাতে ও তেলাপিয়া।

– তেলাপিয়া মাছ আমার ভালো লাগে না। স্যরি।

– আজ লাগবে। গ্যারান্টি। ও এখন আর তেলাপিয়া মাছ নেই। ওকে আমি ঊর্মিমালা বানিয়েছি। ওকে আমি নিজে কেটেছি, বেছেছি, ধুয়েছি। মানে আমার স্পর্শ লেগে আছে ওর গায়ে। তারপর এই যে টমেটো, বরবটি ইত্যাদি দিয়ে সাজিয়েছি, তারমানে, আমার দর্শনেন্দ্রিয় বোধ কাজে লাগিয়েছি ওর ক্ষেত্রে। এরপর লেবু, আদা- এইসব হলো ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের কাজ। বেকড করার ফাঁকে একটু সুরুয়া জিভে নিয়েছি, মানে স্বাদেন্দ্রিয়ও কাজে লাগিয়েছি। আর এই যে সাইড সি হিসেবে দেখছেন ফ্রাইড ভেজিটেবল, ওরা খুব মুচমুচে। বাটার ফ্রাইড। মুখে দিলেই কানে, এমনকি মগজেও বাজবে কুড়মুড়ে সুর। তাহলে কী দাঁড়ালো, ছোঁয়া, দেখা, শোকা, চাখা, শোনা- একদম পাঁচ ইন্দ্রিয়ের ব্যাপার। এখন বলুন, রান্নার মতো আর কোন কাজে পাঁচ ইন্দ্রিয় এতো গভীর করে ব্যবহার করা যায়?

– সেক্সে।

কথাটা সত্য। কিন্তু সত্য কথাটা এতো সরাসরি আর কড়াকড়ি করে না-বললেও বোধহয় হতো। কুদরত একটু লজ্জাই পায়। মিথিয়া খাওয়ায় মনোযোগ দেয়ায় কুদরতের লজ্জাটা দেখতে পায় না।

৫.
কুদরতের প্রতি অবিচার করে না মিথিয়া। কুদরত যেমন পাঁচ ইন্দ্রিয় দিয়ে একান্তভাবে রান্না করেছে মিথিয়াও তেমনি পাঁচ ইন্দ্রিয় ভরে খেয়ে নেয়। রান্না, খাওয়া- এইসব দৈনিক ব্যাপার আজ মিথিয়ার কাছে অন্য রকম মনে হয়। একেকটা খাবারের মধ্যে সে একেক রকম স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ পায়। খেতে খেতে সে স্যুপের সঙ্গীত, সবজির সুর উপভোগ করে। ঢেড়শের মতো আঙুলগুলো দিয়ে ঊর্মিমালাকে চেটেপুটে খায় মিথিয়া। কুদরত দেখে আর দেখে। ঊর্মিমালা আর মিথিয়াকে যুগপৎ তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখে।

– সব ঠিক ঠাক, ম্যাডাম?

– একদম। পাঁচ ইন্দ্রিয় ছুঁয়ে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে পৌঁছে গেছি।

– জয় হোক, সব ইন্দ্রিয়ের।

– হতেই হবে।

লাঞ্চ করতে এলেও মিথিয়া লাঞ্চের পরেও যায় না। তার মনে হয়, ডিনারটাও মন্দ হবে না। তারচেয়েও বড় কথা, কুদরত একটা ডিনার তার কাছে পেতেই পারে। আরও বেশি করে মনে হয়, পাঁচ ইন্দ্রিয়ের এক রকম ব্যবহার নয়, একদিনে দু’রকম ব্যবহারই হওয়া উচিত। অতএব, খাওয়ার পর একটু শোয়া আবশ্যকীয় হয়ে পড়ে।

মিথিয়া ডাইনিং পার হয়ে সোজা কুদরতের বেডরুমে চলে যায়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত