তারা জাগিয়া আছে

নিস্তব্ধতার বাইরেও যদি কোনো শব্দহীনতা থাকে, অচেতনতার বাইরেও যদি থাকে কোনো চেতনাহীন অনুভব, এই পরিবেশ ঠিক তাই। এখানে আলোর নিশানা নেই, যদিও ছিটেফোঁটা কিছু এখানে সেখানে পড়ে, সেগুলোর ভেতরে কোনো উত্তাপ নেই, নৈঃশব্দ্য সে উত্তাপ গ্রাস করে ফেলে অচিরেই। রাতের বেলা হাজারো তারার নিচে ঘুমিয়ে থাকে তারা। আকাশে পূর্ণিমা হলে দিগন্ত বেয়ে যে সঙ্গীতের ধারা আগে বয়ে যেত, এখন আর সেসব কিছু হয় না। এখন সবকিছু চুপচাপ এক নিরক্ত শবদেহের ভেতরে যেন আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে।

ভেজামাটির ওপর দিয়ে বুকে হেঁটে চলে যায় সরীসৃপ। লাউডগা সাপ হিল হিল করে ঝোলে হিজলের ডালে। নিস্তব্ধ মরা ডোবায় একটা মাছরাঙা বুড়ো হয়ে বসে থাকে অনাদিকাল। ঝরাপাতার পচা গন্ধ বড় সতর্কতার সঙ্গে পার হয়ে যায় চৌহদ্দি। কবরের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকে তারা। বেদনার রঙ চোখে দেখা যায় না; শুধু একজন মা যখন কাছে এসে দাঁড়ায় তার ছেঁড়া মলিন কাপড়ে, তার শুকনো জলছাড়া চোখে, তার অপুষ্টিতে ভোগা রুগ্‌ণ শরীরে, বঞ্চনার তার দিয়ে বাঁধা তার আশাহীন জীবনে, যা কবরের শীতলতাকেও লজ্জা দেয়, তখন কোথায় যেন খল খল করে ওঠে বাতাস। মায়ের শুকনো চোখে জ্বলে ওঠে আগুন। মলিন বসনে টালমাটাল করে ওঠে ক্ষোভ। শীর্ণ দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মা ছড়িয়ে দেয় কবরের দু’পাশে।

মা বজ্রকণ্ঠে বলে, ‘মেলেটারি আমার পাঁচ পোলারে নিছে। কিন্তু তারা তো মরে নাই, তারা জাগিয়া আছে। তারা জাগিয়া আছে।’

২২. ১২. ২০১১, ঢাকা

২. এই পথে সে চলে গিয়েছিল

প্রায়ই সে দাঁড়িয়ে থাকে। বিশেষ করে সন্ধ্যাবেলাটা। তখন চারপাশে ক্রমশ নেমে আসে অচেনা সব ছায়া। আকাশটার অবয়ব দেখা যায় কি যায় না। বাঁশবনের ভেতর থেকে নতুন একটা শব্দ ওঠে। মালেকার যেন মনে হয়- প্রতিদিন নতুন নতুন শব্দ বাঁশবাগানের ভেতর দিয়ে ছুটে আসে, সেই শব্দগুলো মালেকার ভেতরটা কাঁপিয়ে দিয়ে যায় মাঝে মাঝে। তার মনে হয় হয়তো এই শব্দের পর পরই ভেসে আসবে তার গলা- হেই মালিকা, হেই।

সন্ধ্যার পাতলা অন্ধকারে মালেকা চেয়ে থাকে বাঁশ বাগানের দিকে। ভেতরে সরু পায়ে চলার পথ দিয়েই সে একদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে তাকে বড় ঘন এবং নিবিড়ভাবে চুমো খেয়ে চলে গিয়েছিল। কানে কানে বলেছিল, যুদ্ধ শ্যাষে ফিইরা আইসা তরে আমি সুখ দিমু। এখন তবে যাই?

সেই ‘যাই’ শব্দটার ভেতরে বাঁশবাগানের লম্বা শোঁ শোঁ শব্দ যেন শুনতে পেয়েছিল মালেকা। চোখের জলে ভেসে গিয়ে স্বামীর বুকে একটুক্ষণের জন্য মুখ লুকিয়ে তার শরীরের গন্ধ নাকে নিয়ে বলেছিল, আইচ্ছা।

তো মালেকা যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তার স্বামীর ঘরে ফেরার অপেক্ষায় থাকে। রোজ সন্ধ্যায় বাঁশবাগানের অচেনা শব্দদের বুকে ধারণ করতে করতে সে দাঁড়িয়ে থাকে।

একসময় রাত গভীর হয়। মালেকার বিধবা ননদ এসে হাত টেনে ধরে তার। রোজ এমনভাবেই হাত ধরে টানে তার ননদ।

ভাবিজান গো, ভিতরে আয়েন। মানুষজন খারাপ কথা কয়।

বলুক। তর ভাইজান এই পথে ফিরবে বইলা গেছিল।

আজ বিশ বছর হইয়া গেলগা ভাবিজান। আজ বিশ বচ্ছর যুদ্ধ শ্যাষ হইছে। শুকনো গলায় বলে ওঠে ননদ।

হউক শ্যাষ, সে কুনোদিন কথার বরখেলাপ করে নাই, তুই ভিত্‌রে যা- বলে ওঠে মালেকা। আর তার কথায় সায় দিয়ে যেন চরাচরজুড়ে, বাঁশবনজুড়ে, শটিবনজুড়ে,হেতাল, বনতুলসী আর ধুন্দুলের ঝোঁপঝাড় জুড়ে শোঁ শোঁ শব্দ ওঠে, যেন মানুষের বুকের মত শ্বাস ছেড়ে তারা বলে ওঠে – ঠিক, ঠিক, সে কুনোদিন কথার বরখেলাপ করে নাই!

২২.৮.২০১৪ লন্ডন

৩. পারুবিবি প্রতিশোধ নিতে জানে

রোজ রাতে লোকটি এই পথ দিয়ে লোকালয়ের দিকে যায়। সঙ্গে তার কয়েকজন সাগরেদ থাকে। এই লোকটি এপ্রিলের ত্রিশ তারিখে পারুবিবির বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে খুবলে খেয়েছিল তার ছোট ছেলেটির চোখের সামনে। সেই থেকে ছেলেটি তার সুস্থ ব্যবহার কাকে বলে ভুলে গেছে। সে ঘাড়গোঁজ করে বাঁশবনের ভেতরে ঝিম মেরে পড়ে থাকে। এগারো বছরের ছেলে এই বয়সেই যুদ্ধের দোজখ দেখে সেরেছে। পারুবিবি ছেলের চোখের দিকে আর তাকাতে পারে না। তাকাতে গেলে তার চোখ অন্ধ হয়ে যায়। আর সেই অন্ধ চোখের কোনা দিয়ে রক্ত ঝরে পড়ে। তবু সে তার ছেলের জন্য, শাশুড়ির জন্য রোজ সংসার করে। সংসার করতে হয়। কারণ তার স্বামী বিদেশে।

আর পারুবিবি তার ছেলে এবং শাশুড়ি মাকে দেশের গভীরে পাঠিয়ে দিয়েছে। তবে সে নিজে যায়নি। কারণ সে প্রতিশোধ না নিয়ে যাবে না। সে সন্ধ্যা থেকে এই বাঁশঝাড়ের আড়ালে। সে জানে তার ভাগ্যে কী লেখা আছে। আর জানে বলে তার ভয় আর নেই। কারণ যা হবে, যা তার মতো রমণীদের জীবনে হচ্ছে, কতদিন হবে তা কেউ আর বলতে পারে না, তা নিয়ে তার আর মাথাব্যথাও নেই। কিন্তু তার ছেলের চোখের সামনে যে হারামি নির্লজ্জভাবে তাকে অবমাননা করেছে, তার প্রতিশোধ পারুবিবি নেবে।

সকলে জানে পারুবিবি খুব তেজি একজন মেয়ে। ছেলেবেলা থেকে পারুবিবি তেজি। সেদিন, সেই কালনিশা রাতে যে ঘটনা পারুবিবির জীবনে ঘটেছিল, সেদিন পারুবিবি মনে মনে বা শরীরে শরীরে একেবারে প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু আজ সে প্রস্তুত।

রাত গভীর হচ্ছে। আরও গভীর। পারুবিবির সারা শরীরে মশার কামড়। রক্তাক্ত এবং ক্ষতবিক্ষত পারুবিবি মশার কামড়ে। ছোট্ট একটা মশা সেও কত শক্তিশালী সুযোগ হাতে পেলে। আর পারুবিবি তো মানুষ বা এখন সে আর মানুষও নয়, মানুষের চেয়ে আরও ভয়াবহ কিছু। মানুষের জীবনের ভয় থাকে। পারুবিবির তা আর নেই। এখন তার চোখের সামনে তার ছেলে আছে। আর তার ছেলের ইজ্জত আছে।

পারুবিবি তার ছেলেকে দূরে নিরাপদ জায়গায় পাঠাবার আগে বলেছে- তুই যা বাজান, তর বাপে ফিইরা আসবে একদিন। তারে কইস, মা তর বদলা নিয়া পৃথিবী ছাড়ছে। মাথা উঁচা কইরা চলবি বাজান।

তারপর তো এই, পারুবিবি সন্ধ্যা থেকে আজ ঝোপের আড়ালে। এই দেশ নদীনালা, হাওর-বাঁওড়ের দেশ। এই দেশ ঝোপঝাড়, জঙ্গল, বাদাবনের দেশ। এই দেশে পাপ করে নিস্তার পাওয়া এতই সোজা?

রাত গভীর। রাতজাগা পাখি দু’বার করে ডেকে সেরেছে। রাজাকারটা তার সাগরেদ সঙ্গে নিয়ে ফিরছে। আজ তার গলায় হিন্দি গান- জিয়াবেকারার হ্যায়, দিলমে বাহার হ্যায়। তার পা টলছে। তার সাগরেদদের পা আরও বেশি।

এদিকে পারুবিবিও প্রস্তুত। আজ সারাদিন ধরে সে হেঁসোয় শান দিয়েছে। হেঁসোর এখন এমন অবস্থা যে, কিছু নিধন না করলেই নয়।

৪. সে দাঁড়িয়ে থাকে

সে দু’পা জড়ো করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার খালি পা বেয়ে পিঁপড়েগুলো ওঠে আর নামে। সে জীবিত তবু তার পা বেয়ে পিঁপড়েগুলো ওঠে আর নামে। তাকে মারা হবে একটু পরে। কারণ তার হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা হয়েছে। হাত বাঁধা না থাকলেও তার পালাবার উপায় নেই। তার শরীরের জোড়াগুলো একটা করে ভাঙা হয়েছে। শুধু এক হাঁটু আর দুই গোড়ালির জোড়া এখনও অক্ষত আছে। চারপাশে হানাদার বাহিনীর টহল। এখান থেকে কোনোক্রমেই আর জীবিত অবস্থায় উদ্ধার পাওয়ার উপায় নেই। তার পাশে যারা মৃত তারা পড়ে আছে। তাদের শরীরে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। তার চোখের সামনেই জমাট বেঁধে গেছে রক্ত। প্রথম গুলিতে মারা গেছে রণজিৎ। সে মরার সময় জয়বাংলা বলে মরেছে। দ্বিতীয় গুলিতে মারা গেছে সবুর, সে মরার সময় লাইলাহা বলে মরেছে, তৃতীয় গুলিতে মারা গেছে লোকমান আলি, গঞ্জে তার চায়ের দোকান ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের চা খাওয়াতে খাওয়াতে একদিন সেও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু তার জন্য দুটো গুলি খরচ করতে হয়েছে। তার দশাসই শরীর এক গুলি খেয়ে মরতে চায়নি। তাই দুটো গুলি। মরার সময় কোনো কলেমা, দরুদ বা জয়বাংলা বলেনি। তবু মরেছে। শুধু পাকিস্তানি সৈন্যটি দুটো গুলি খরচ করার সময় বিরক্ত হয়ে বলেছে- খতরনাক জান হ্যায় ইস সালেকো। হাম লোগকো বহুত পসিনা ছুটায়া।

তা ঠিক। মরার আগে চায়ের দোকানদার লোকমান তাদের মিলিটারির দু’জন অফিসারকে মেরে ফেলে তবে ধরা পড়েছে। মিশন তাদের সাকসেসফুল ছিল বলা যায়। কিন্তু ঠিক সময়ে হটে না আসাতে ধরা পড়তে হয়েছে। জীবন্তই ধরা পড়েছিল তিন দিন আগে। কিন্তু তাদের সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলা হয়নি। এই তিন দিন দলেমুচড়ে ছেঁচড়ে চামড়া ছিলে তারপর মারা হয়েছে, তাও ব্রাশফায়ার করে নয়। একটা একটা করে মারা হয়েছে। একজনের সামনে আরেকজনকে।

এখন বাকি আছে শুধু সে। তাকে এখনও মারেনি। আর কেন যে মারেনি, সেটাও তার কাছে বোধগম্য নয়। এতক্ষণে মরে গিয়ে তারও রক্ত মাটিতে পড়ে জমাট বেঁধে যেতে পারত। এ মুহূর্তে আশ্চর্যের ব্যাপার, তার মনে কোনো দুঃখ বা হতাশা বা বিলাপ নেই। বাবা-মা বা ছোট ভাইবোন কারও কথা মনে পড়ছে না। এমনকি তার পা বেয়ে যে বিষ পিঁপড়েগুলো একভাবে উঠছে এবং নামছে একজন মৃতের শরীরে যেভাবে ওঠে নামে, তারও শরীরে সেভাবে উঠছে-নামছে কিন্তু তার কোনো অনুভূতি নেই। বিষপিঁপড়ের কামড়ে তার পাগুলো ফুলে গেছে, এখনও যাচ্ছে, কিন্তু সেদিকে তার কোনো লক্ষ্যও নেই। সে শুধু ভাবছে কখন সে তার সঙ্গীদের শামিল হবে। কখন তার রক্ত জমাট বাঁধবে- এসব যুদ্ধ-সময়ে গড়ে ওঠা বন্ধুদের মতো। এই বন্ধুত্ব রক্তের রাখী হাতে বেঁধে গড়া হয়েছে। ঝড়ে, জলে, জঙ্গলে, মশার কামড়ে, অমাবস্যার রাতে হাওরের পানিতে ডুবে থেকে, বিগত ছয় মাস ধরে এই বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে, পৃথিবীর বন্ধনের চেয়ে এই বন্ধনের মায়া অনেক বেশি, অনেক প্রগাঢ়।

কিন্তু না, তাকে মারা হচ্ছে না। তাকে শুধু দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে তার মৃত বন্ধুদের রক্ত জমাট বাঁধা চোখে তাকিয়ে দেখতে। এটাও এক ধরনের নিষ্ঠুরতা। এক বড় ধরনের জিঘাংসা।

এমন সময় একজন সৈন্য তার কাছে এগিয়ে এলো। হাতের পিস্তল তাক করে ধরে এগিয়ে এলো। এতক্ষণ তার কোনো সিনিয়র অফিসারের সঙ্গে কথা বলছিল সে। আর বলার সময় মাঝে মাঝেই তার দিকে তাকাচ্ছিল। কথা বলা শেষে সে এগিয়ে এলো তার দিকে। পেছনে দাঁড়িয়ে হাতের বাঁধন খুলতে খুলতে মুখ খিস্তি করে সে বলে উঠল- গো।

কোথায়? অবাক হয়ে বলে উঠল সে। তার গলার স্বর অস্ম্ফুট। শোনা যায় কি যায় না। শরীরে শক্তি নেই।

গো টু জাহান্নাম- বলে উঠল সৈন্যটি। তার পরপরই বলে উঠল, ইউ হ্যাভ বিন অর্ডারড টু বি রিলিজড। ইউ আর ফ্রি।

তার কথা শুনে সরাসরি সৈন্যটির চোখের দিকে তাকাল সে। ঠাট্টা কি-না বুঝে দেখার চেষ্টা করল। ঠাট্টা নয় বুঝে সে চোখ নামিয়ে রক্ত-কাদায় মাখা তার সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে দেখল- রণজিৎ, সবুর, লোকমান আলি। তাকিয়ে দেখল তার পা বেয়ে ওঠানামা করা পিঁপড়েগুলোর দিকে। তারপর অস্ম্ফুটস্বরে বলল- নো।

হোয়াট? বলে উঠল সৈন্যটি।

আর উত্তরে সে বলল- নো, নো, নো।

তখনও তার গলার স্বর অস্ম্ফুট হয়েই থাকল। কিন্তু এই অস্ম্ফুটতা ছিল সমুদ্রের গর্জনের চেয়েও শক্তিশালী।

২২.৮.২০১৪ লন্ডন

৫. আমার চাচিমা

আমার চাচিমা সকাল থেকে আমাদের রান্নাঘরের বারান্দায় উবু হয়ে বসে আছেন। তিনি বারান্দার কাঠের চুলোর আগুনে তোড়জোড় করে রান্না হতে থাকা খাসির মাংসের টগবগে ঝোলের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তার ইচ্ছে মাংস চুলো থেকে রান্না হয়ে নামলে তিনি চারটি মোটা চালের গরম ভাত মাংসের ঝোল দিয়ে মাখিয়ে খাবেন। কতকাল তিনি মাংসের ঝোল দিয়ে ভাত মাখিয়ে খাননি- এ কথা তিনি একটু আগেই মাকে বলছিলেন। আমি উঠোনে বসে মাটির হাঁড়িকুড়ি নিয়ে খেলতে বসে কথাটা কানে শুনেছিলাম।

সেই থেকে আমিও মনে মনে যেন উদগ্রীব হয়ে বসেছিলাম- কখন আমার মায়ের মাংস রান্না হবে আর আমার চাচিমা গরম ভাতের সঙ্গে মাংসের ঝোল মাখিয়ে ভাত খাবেন।

এই চাচিমা আমার আপন চাচিমা ছিলেন না। এমনকি দূরসম্পর্কের চাচিমাও নয়। তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের ভিটেছাড়া মানুষ। বিরাট এক বড়লোকের স্ত্রী ছিলেন। এমনই বড়লোক যে, তার ছেলেমেয়েরা দার্জিলিংয়ের স্কুলে লেখাপড়া করত, সেখানে স্কুলের ছুটিতে বাবা- মায়ের সঙ্গে দার্জিলিংয়ে ঘুরে বেড়াতো, ঘোড়ায় চড়তো, পাখি শিকার করতো। দেশ ভাগের পর মাঝে মাঝেই রায়ট বাধতে লাগল পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিবঙ্গজুড়ে, তখন কলকাতার সম্পত্তি পাল্টপাল্টি করে পূর্ব পাকিস্তানে এসে তার শিক্ষিত এবং অতিশয় সজ্জন স্বামী দেখলেন যে, দালালরা তাকে ভীষণ ঠকিয়েছে। নাক হারিয়ে তিনি এদেশে পেয়েছেন নরুন। তখন আর কিছু করার নেই, শুধু হতাশ হয়ে চুপ করে বসে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া। তা ছাড়া নিশ্চয় আমাদের দেশের মানুষ এবং তাদের ব্যবহার তাকে একেবারেই সুখ দিতে পারেনি। তাই পূর্ববঙ্গ পাড়ি দিয়েই নিশ্চুপকে সঙ্গী করে মৃত্যুর হাত ধরে চলে গেলেন পরপারে। তারপর তার ছেলেমেয়েদের কী হলো? যা সবার ভাগ্যে এরপর হয় তাদেরও তাই হলো। কেউ আত্মহত্যা করল, কেউ জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেল। কেউ তাদের চেয়ে অনেক নিম্নস্তরের মানুষের সঙ্গে বিয়ে বসে ঘর ছাড়ল।

কিন্তু তাদের চরিত্রের মধুরতা এবং সুষমা কোনোদিন তাদের ছেড়ে গেল না।

আমি ছোট হলেও আমার সংবেদনশীল মন তাদের প্রতি, বিশেষ করে বিধবা চাচিমার প্রতি খুবই সচেতন ছিল। আমি কোনোদিন তিনি কোনো আদেশ করলে তা পালন না করে থাকিনি।

সেই চাচিমা কালের গহ্বরে পড়ে একটা ছেঁড়া ত্যানা কাপড়ে শরীর ঢেকে আমাদের বাড়িতে এসে আমার মায়ের রান্নাঘরে উবু হয়ে বসে আছেন মাংসের ঝোল দিয়ে ভাত খাবেন বলে। মাংস তখনও আমার মায়ের রান্নাঘরের চুলোয় টগবগ করে ফুটছে।

কিন্তু মাংস যেন আর রান্না হয় না। চাচিমা ঘণ্টা দু’ঘণ্টা যেন ঝুল ধরে বসে আছেন মাংসের ঝোল আর ভাত খাওয়ার জন্য। মাংস চেয়ে খাওয়ার মতো সাহস বা সল্ফ্ভ্রমহীনতা তিনি এখনও অর্জন করতে পারেননি। আর তাই শুধু মাংসের ঝোল। আর তাই শুধু ঝোল দিয়ে গরম চারটি ভাত।

কিন্তু মাংস রান্না হয় না, হয় না, হয় না।

আমার মা শুধু বলেন- আরে বসেন, বসেন, ধৈর্য ধরেন। মাংস রান্না হলেই আপনাকে খেতে দেব। চুলো থেকে নামিয়েই খেতে দেব। ভাত তো আগেই রান্না করা হয়েছে।

কিন্তু সেই মাংসটা আর রান্না হয় না, হয় না, হয় না।

সময় বয়ে যায়, সময়ের অনন্তকাল ধরে বয়ে যায়, নদীর ঢেউ একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে সবেগে ধাবিত হয়, কিন্তু আমার মায়ের যেন আর মাংস রান্না হয় না।

আর আমার চাচিমারও যেন অপেক্ষার শেষ হয় না।

আমার চোখ দিয়ে অশ্রুর বান ছোটে। কিন্তু আমি ছোট্ট মানুষ।

২২. ৮. ২০১৪ লন্ডন

৬. অপেক্ষা

আমি বড় রাস্তার ধারে একটা গলিপথের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছি। আমি তার পথের দিকে তাকিয়ে আছি। এই পথ দিয়ে সে রোজ কলেজে যায়। আর আমি স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ি। আমার স্কুল ১১টায়। তার কলেজ সকাল ৯টায়। তাই তাকে একপলক দেখার জন্য আমি গলির ভেতরে অপেক্ষায় থাকি। এক ঘণ্টা দু-ঘণ্টা ধরে অপেক্ষায় থাকি। জানি সে ঠিক তার সময় মতোই বাড়ি ছেড়ে বেরোবে। কলেজ বসার আধঘণ্টা আগে সে বাড়ি ছেড়ে বেরোবে। কলেজ তার হাঁটাপথের ভেতরে পড়ে। আমিও মনে মনে উদগ্রীব হয়ে আছি কবে আমি স্কুল ফাইনাল দিয়ে কলেজে ভর্তি হবো। তখন হয়তো তাকে রোজ চোখে দেখতে পাবো। হয়ত কথাও বলতে পারবো। হয়ত সে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বিশেষ একটা হাসিও দিতে পারবে। কিন্তু তার সময় এখনও আসেনি। এখনও স্কুলের শেষ প্রান্তে পৌঁছতে আমার আরও এক বছর দেরি আছে। এ-ক-ব-ছ-র! সে কতদিন, কত মাস। আমার এদিকে তো সময় নড়তে চায় না।

না, সে জানে না, তাকে একপলক চোখে দেখার জন্য আমি রোজ গলির ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকি। গলির মোড়ে দাঁড়াতে সাহস হয় না। পাড়ার লোকেরা আবার শ্যেন চোখে পাড়ার মেয়েদের পাহারায় রাখে। যেন অন্য বাড়ির মেয়ে বখে গেলে তাদের ভারি মাথাব্যথা! কিন্তু তবু তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে আমি গলির ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকি। সে বড় রাস্তা দিয়ে বই বা একটা খাতা হাতে ধরে রাস্তা পেরিয়ে চলে যায়। তখন আমি যেন খুব একটা অন্যমনস্ক হয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়াই। পেছন থেকে তার চলে যাওয়া দেখি। বিশেষ ভঙ্গিতে তার হাঁটাচলা দেখি। আমি তাকে মনে মনে ভীষণ ভালোবাসি। কীভাবে এই ভালোবাসার সূত্রপাত হলো আমি জানি না। কিন্তু তাকে কিছুদিন ধরে আমি বিশেষ একটা চোখে দেখতে শুরু করেছি। সে লেখাপড়ায় ভীষণ ভালো। খেলাধুলায় চৌকস। তাকে পাড়ার অনেক মেয়ে মনে মনে কামনা করে আমি জানি। কিন্তু আমার মতো কেউ নয়। আমার মতো নির্লজ্জ আর কেউ নয়। আমি আমার গোপন ভালোবাসাটিকে আর গোপন রাখতে পারছি না। গোপনীয়তা সব যেন ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। অন্তত আমার যেন মনে হচ্ছে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে।

সেদিন যেন কী একটা হলো। আমি গলির ভেতরে দাঁড়িয়ে আছি। তাকে দেখবো বলে দাঁড়িয়ে আছি। একপলক দেখবো বলে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখি সে বড় রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সোজা আমাদের গলির ভেতরে ঢুকে পড়ল। তার হাতে একটা বই। আমি তো তাকে এভাবে গলিতে ঢুকতে দেখে ভয়ে, আতঙ্কে, আনন্দে রোমঞ্চিত হতে হতে ঘামতে থাকি। আর সে ক্রমাগত আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। আমাদের ক্লাসের বানু বলে যদি কাউকে মন দিয়ে ডাকা হয়, তাহলে সে পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, সাড়া দেবেই। আমার যেন সেই মুহূর্তে বানুর কথা মনে হয়। আজ স্কুলে বানুর সঙ্গে দেখা হলে কথাটা তাকে বলতে হবে।

সে ক্রমশ এগিয়ে এলো আমার কাছ্‌ে। তার দীর্ঘ চুল, মায়াময় চোখ আর স্বপ্নের মতো বাহু দুটি বাড়িয়ে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। বলল- খুকি, এদিকে এসো তো!

খুকি? আমি খুকি? আমি নিস্পন্দ হয়ে তাকিয়ে থাকি তার দিকে। সে আমার আরও কাছে এসে বলে- পারুল তোমার চাচাতো বোন না? সে ঠিক কোন বাড়িটাতে থাকে আমাকে বলতে পারো, লক্ষ্মী?

আমি পাথর হয়ে যাই। আমি পাথর চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকি।

২২. ৮. ২০১৪ লন্ডন

৭. সেই মেয়েটি

আজ কতদিন হয়ে গেল তার কথা ভুলতে পারেন না সালেহা খাতুন। একদিন খুলনার গহিন এক গাঙের ধারে মেয়েটির সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। পরনে তার বাচ্চা মেয়েদের মতো ঘাঘরা। পায়ে চোস্ত পাজামা। সালেহাকে দেখে এগিয়ে এলো কাছে। তিনি তার মুখের দিকে একটু কৌতূহলী হয়ে তাকাতেই বলল- আমি, আন্টি একজন কলগার্ল। তাই আমার পোশাক দেখে হয়ত আপনি অবাক হচ্ছেন। কিন্তু সমুদ্রগামী নাবিকরা আমাকে এই ড্রেসে দেখতে পছন্দ করে।

সালেহা তার কথা শুনে মনে মনে অপ্রতিভ হয়ে ‘তাই’ শব্দটি মাত্র উচ্চারণ করতে পারলেন। উচ্চারণ করতে করতে স্তম্ভিত হলেন। কত সহজে মেয়েটি নিজের সামাজিক পরিচয় দিল। সামাজিক নাকি অসামাজিক? এটাও ভাবলেন। তারপর ভাবলেন, তার মানে সমুদ্রগামী নাবিকদের মনের ভেতরেও রোমন্টিকতা বন্দরে বন্দরে ঝাঁপ দিয়ে এসে পড়ে।

মেয়েটির কোমল মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনে মাতৃস্নেহ জেগে উঠল। তিনি মেয়েটির হাত ধরে বললেন, তোমার খুব কষ্ট হয় এই জীবন যাপন করতে, তাই না?

তার প্রশ্ন শুনে একমুহূর্তের জন্য মনে হলো মেয়েটির চোখে ঝাঁপিয়ে এলো জল। কিন্তু তা মুহূর্তমাত্র।

সে হেসে ঘাড় দুলিয়ে বলল- প্রথম প্রথম হতো। এখন আর হয় না। নিজের আপন চাচার হাতে নষ্ট হওয়ার পর আমার মনেও আর কোনো কষ্ট নেই, অপরাধবোধ নেই। কিসের জন্য কষ্ট, কিসের জন্য আপরাধবোধ? এ জীবনও অনেক সুন্দর। পুরুষ মানুষের মনের দুবর্লতা একবার টের পেয়ে গেলে জীবনে আর কিসের ভয়? তা ছাড়া… কথাটা অসমাপ্ত রেখে সে চুপ করে গেল।

আমি বললাম, আর তা ছাড়া মানে?

মেয়েটি বলল- আর তা ছাড়া নাবিকদের সঙ্গে রাত কাটাতে বেশ ভালো লাগে। কত দূর দূর দেশের মানুষ তারা। যেন রহস্যে ঘেরা তাদের শরীর। তাদের শরীরে অচেনা সমুদ্রের অচেনা সব শ্যাওলার গন্ধ। শামুক, গুগলি, শাঁখের গন্ধ। আমিও যেন তাদের সঙ্গে মিশে মনে মনে পৃথিবীর বন্দরে বন্দরে ঘুরে বেড়াই, যেসব জায়গায় আমি জীবনেও যেতে পারব না। তাদের একেকজনের মুখের বুলি ভিন্ন, ভাবভঙ্গি ভিন্ন, চেহারা চালচলন ভিন্ন, শুধু একটা জায়গায় তাদের সবার মিল। পৃথিবীর সব পুরুষের ভেতরে এক জায়গায় ভীষণ মিল, আর তা হলো- তাদের ভেতরে যখন কামভাব আসে, এক মুহূর্ত দেরি করতে পারে না। ছিঁড়ে-ছুটে একাকার করে আমাদের। এক্কেবারে শিশুর মতো। শিশুর যেমন দুধ খাওয়ার বাসনা হলে পাগলের মতো করে, যতক্ষণ না মায়ের বুকের বোঁটায় মুখ রাখতে না পারছে, ততক্ষণ যেমন অস্থির-চঞ্চল হয়ে থাকে, তারপর বোঁটায় মুখ লাগানো মাত্র পাগলের মতো চুষতে থাকে, চুষতে চুষতে দুধের বোঁটায় ঘা করে দেয়, যন্ত্রণা দেয়, ঠিক তেমনি। আমার গর্ভে একটা শিশু জন্মেছিল। মাত্র কয়েক মাস সে বেঁচে ছিল, তার ভেতরেই আমি সব বুঝে গিয়েছি!

তার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন সালেহা খাতুন। তার পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে যায়। তবে তিনি পাতালে প্রবেশ করেন না। পায়ের পুরনো মাটি সরে গিয়ে তিনি অনুভব করেন নতুন মাটি সেখানে আশ্রয় নিচ্ছে। নতুন বোধ, নতুন উপলব্ধি। তবে বড় ভীতকর সে উপলব্ধি। সালেহা আর কিছু প্রশ্ন করতে সাহস পান না।

অপার এই জীবনের রহস্য কে কীভাবে খুঁজে পায়, তার কতটুকু তিনি জানেন?

২২.৮.২০১৪ লন্ডন

৮. রোজ রাতে

রোজ রাতে আমার এ বাড়িতে ঘুমাতে ভয় লাগে। রাত হলেই ভয় লাগে। রাত যাতে না আসে আমি তার জন্য প্রার্থনা করি রোজ। কিন্তু রোজ রোজই রাত আসে। আমার স্বামী বর্তমানে পলাতক। সে এদেশের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আর এদেশে রাজনীতি করতে গেলে মাঝে মাঝেই পলাতক হতে হয়। এর আগে বহুবার সে পলাতক হয়েছে। তখন আমার এত ভয় লাগেনি। কিন্তু এবারই প্রথম আমার ভয় লাগছে।
(অসমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত