বোবা প্রেম

অলঙ্কার মোড়ে হঠাৎ সাথীর সাথে দেখা। এক বছর সাত মাস সতের দিন পর দেখা। সাথে বয়স্ক একজন পুরুষ, সম্ভবত সাথীর বাবা। যেভাবেই হোক আজ সাথীর সাথে কথা বলতেই হবে। কিন্তু সমস্যা হলো হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে, হাতের তালু ঘামছে। আগেও সাথীকে দেখলে এমন হতো, তবে আজকের অবস্থা বেশি খারাপ। সাহসের কোনো ওষুধ থাকলে ভালো হতো।

সাথীর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল সব মিলে দুই মাস চৌদ্দ দিনের, অথচ কখনো কথা হয়নি। যার সাথে সম্পর্কের দিন তারিখ আমার মুখস্থ অথচ কোনদিন কথা হয়নি- একটু অদ্ভুত তাই না। কেন কথা হয়নি? বলছি- তখন আমি হালিশহর আর্টিলারি কলেজের খণ্ডকালীন ইংরেজি শিক্ষক। খণ্ডকালীন মানে বেকারও না আবার আর্থিক অবস্থাও সুবিধার না। একে তো পকেটের অবস্থা ভালো না তার উপর ব্যাচেলর। বুঝতেই পারছেন বাসা পাওয়া সহজ কর্ম ছিল না। কিছু বাড়ির মালিক বেকারদের এই অচল অবস্থার সুযোগ নিয়ে বাড়ির টপ ফ্লোর উচ্চ ভাড়ায় মেস হিসেবে ব্যাচেলরদের ভাড়া দিতো। আমিও ছয়তলার উপর এ জাতীয় একটা মেসে থাকতাম, ডি-ব্লকে। আমাদের বিল্ডিং এর পাশেই ছিল ঝাঁ চকচকে ১০তলা বিল্ডিং। এই বাড়ির ছয়তলাতেই প্রথম দেখি সাথীকে।

কলেজ আর টিউশনি বাদ দিলে আমার বাকি সময় কাটতো পড়ার টেবিলে। যাদের উঁচুস্তরের মামা চাচা নাই পড়া ছাড়া তাদের আর কি গতি আছে বলেন! যাইহোক মূল কথায় আসি- প্রতিদিনের মত সেদিনও বিকালে পড়ার টেবিলে বসলাম। সামনের ১০তলা বিল্ডিংয়ের মালিককে কিছুক্ষণ গালিগালাজ করে (পয়সাওয়ালা লোকদের মনে মনে গালিগালাজ করা আমার পুরানো স্বভাব) বইয়ের দিকে চোখ দেব, তখনই ঘটে গেল আমার জীবনের এই অদ্ভুত ঘটনাটা। হলুদ জামা পরা একটা মেয়েকে দেখলাম ওপাশের জানালার ধারে। বয়স খুব বেশি হলে ষোল কি সতের হবে। চেহারা হুমায়ুন আহমেদের গল্পের নায়িকাদের মতো, কোনো খুঁত নেই। হুমায়ুন আহমেদ হলে বলতো হলুদ পরী। আমার অবশ্য এসব জ্বিন-পরীতে বিশ্বাস নেই। আমার কাছে এই মেয়ে ভয়ঙ্কর সুন্দর এক মানবী। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আমার হুঁশ ফিরল। এই মেয়ে যদি ওই বাড়ির মালিকের মেয়ে-টেয়ে হয়ে থাকে তাহলে আর এই বাসায় থাকা লাগবে না। সাধের খণ্ডকালীন চাকরিটাও থাকে কিনা সন্দেহ। কিন্তু অজানা কোনো কারণে চোখ ফেরাতেও পারছিলাম না। সাতপাঁচ না ভেবে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ালাম। জবাবে মাথা নাড়িয়ে হাসল সে। এই হাসির বর্ণনা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। কবি-সাহিত্যিকরা হয়তো পারতেন। সংক্ষেপে বলতে পারি এই হাসির জন্য আমার মত ভিতু লোকও গ্লাডিয়েটরের যুদ্ধে নেমে পড়তে পারে।

দু-একদিন পর সাহস করে তার নাম জিজ্ঞেস করলাম কাগজে লিখে। মেয়েটার কাছে হয়তো কাগজ ছিল না। সে ইশারায় কিছু একটা বলল। কী যে বলল আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক তা ধরতে ব্যর্থ। একবার এক হাত দিয়ে অন্যহাত টানে তো আরেকবার বালিশ হাতের নিচে নিয়ে টানে। মনে হয়, এই মেয়ের নাম টানাটানি। নাহ তা কি করে সম্ভব! টানাটানি কি কারো নাম হতে পারে নাকি। পরক্ষণেই মনে হলো- হলেও হতে পারে। আজকাল বাবা-মা নিজের সন্তানের নাম আনকমন করতে গিয়ে কিনা করছে।

লিখে জিজ্ঞেস করলাম তোমার নাম কি টানাটানি? মুখ অন্ধকারে করে মেয়ে চলে গেল। যদিও ওই মুহূর্তে আমার মন খারাপ করা উচিত, কিন্তু আমার কেমন যেন স্বস্তি লাগছিল। যাক কোনো টানাটানি নামের মেয়ের সাথে আমার প্রেম হচ্ছে না।

ঘণ্টাখানেক পর ওই জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি জানালায় একটা কাগজ ঝুলছে। তাতে চরম বিশ্রী হাতের লিখায় লিখা- ‘আমার নাম টানাটানি না, সাথী… আপনি খুব খারাপ… আপনার সাথে কথা নাই। আহারে কত চমৎকার একটা মেয়ে, অথচ লিখা এতো খারাপ! মেয়েটাকে হাতের লিখার কিছু টিপস দিতে পারলে ভালো হতো।

সপ্তাহখানেক এভাবেই চলতে লাগল। সাথী কথা নাই বললেও রোজ বিকালে জানালার পাশে বসে থাকতো। আমিও বিসিএস, ব্যাংক জব এসব চিন্তা সপ্তম আসমানে জমা দিয়ে আর্ট পেপারে নানান হাবিজাবি কথা লিখে জানালায় ঝুলাতে লাগলাম। এর মধ্যে হলো কি একদিন সাথীকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসলাম। আবার মুখ অন্ধকার করে চলে গেল সাথী। প্রতিদিন বিকেলে পড়ার টেবিলে বসি কিন্তু সাথীর দেখা নাই। নাহ! এত তাড়াতাড়ি প্রস্তাব দেয়া ঠিক হয়নি। আরো কিছুদিন সময় নেয়া দরকার ছিল। এখন তার বাবাকে না বললেই হয়। অবশ্য সে ওই বাড়ির মালিকের মেয়ে কিনা তাও জানা হয়নি। না হলেও কি, অন্তত ভাড়াটিয়া তো হবেই। বাড়িওয়ালা জানতে পারলে তো আর এমনি এমনি ছেড়ে দিবে! দুশ্চিন্তায় আমার ঘুম আসে না। পড়ার টেবিল জানালার পাশ থেকে সরিয়ে অন্য পাশে নিয়ে আসলাম। সামনে বিসিএস পরীক্ষা, এইসব বা…র প্রেমের টাইম নাই। পড়তে হবে, অনেক পড়া বাকি।

সেদিন ছিল পয়লা রমজান। মাগরিবের আজান শোনার জন্য জানালা খুলে দেখি সাথী গালে হাত দিয়ে জানালার পাশে বসে আছে । মনে হয় ঘুমুচ্ছে। মহোদয়, সে মুহূর্তের অনুভূতি লেখার সাধ্য আমার নাই। আজানের কথা ভুলে কতক্ষণ যে দাঁড়িয়েছিলাম জানা নাই। মেসমেটের ডাকাডাকিতে ইফতার নিয়ে চলে আসলাম। জানালার পাশে দাঁড়িয়েই করলাম প্রথম রোজার ইফতার। ঘণ্টাখানেক পর সাথী মুখ তুলে বসল। আমি তখনো জানালার পাশে দাঁড়িয়ে। সন্ধ্যার আবছা আলো আর ঘরের উজ্জ্বল আলো মিলে এক অতিপ্রাকৃতিক অবস্থা। সাথীকে আর মানবী মনে হচ্ছে না। সত্যিই মনে হয় পরী-টরি বলে কিছু আছে। সাথী অপলক আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, তার চোখ ছিল ভেজা। আহারে! এই দু’ফোটা জল রুখতে আমি মহারাষ্ট্রে গরু জবাই দিতে পারি, হিটলারের গ্যাস চেম্বারে বসে থাকতে পারব অনন্তকাল।

পুরো রমজানের ইফতার সেহেরি জানালার পাশেই করলাম। পড়াশোনা এবার পাতালে। কোনো খোঁজ-খবর নাই। ঈদের দুই দিন আগে বাড়ি যাব বলে ঠিক করলাম। এই প্রথম বাড়ি যাওয়ার আগে আমার মন খারাপ। বিকালে সাথীর কাছে বিদায় নিলাম। ফিরলাম ঈদের দু’দিন পর। কিন্তু সাথীর দেখা নাই। চার দিন পর তার দেখা পেলাম। মহোদয়, এই চার দিন ছিল আমার কাছে চারশ’ বছর।

কুরবানির ঈদের আগ পর্যন্ত প্রতিদিন দেখা হতো। সাথীকে বেশ কয়েকবার বাইরে দেখা করতে বললেও সে রাজি হয়নি। বুঝেনই তো- অল্প বয়সের মেয়ে তার উপর পরিবার রক্ষণশীল। বড়দের নজরের বাইরে যাওয়া অসম্ভব। তারপরেও সে সাহস করে বলল, ঈদের চার দিন পর দেখা করবে। স্থান ঈদের দু’দিন পর বলবে। মহোদয়, এতো খুশি মনে হয় বিসিএসে অ্যাডমিন ক্যাডার পেলেও হতে পারতাম না। যথারীতি ঈদের দু’দিন আগে বাড়ি যাব। বিকালে সাথী থেকে বিদায় নিতে জানালায় দাঁড়ালাম। কিন্তু সাথীকে কেমন যেন অস্থির দেখাচ্ছিল। সে ইশারায় কিছু একটা বলার চেষ্টায় ছিল। কিন্তু আমার গাড়ি ধরার তাড়া। আর এমনিতেই তো ঈদের পর দেখা হচ্ছেই। আমি আর দাঁড়ালাম না।

ঈদের দু’দিন পর ফিরে আসলাম। কিন্তু সাথীর দেখা নাই। একদিন, দুদিন এভাবে এক সপ্তাহ সাথীর দেখা নাই। আমার কিছুই ভালো লাগে না। সবসময় অস্থির লাগে। শেষমেশ ঠিক করলাম সাথীর বাসায় যাব। যা হবে হোক। বাসা ছাড়তে হলে ছাড়ব। চাকরি গেলে যাবে। সাথীর বাসার গেটে আমার মেসের আগের বুয়ার সাথে দেখা। জানলাম উনি এই বিল্ডিংয়ের পাঁচতলা থেকে সাততলা পর্যন্ত প্রতিটি ঘরেই কাজ করে। যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক সাথীর বাসায় গিয়ে কোনো অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে না। আমি আর দেরি করলাম না। সাথীর কথা জিজ্ঞেস করলাম। মহোদয়, উত্তর শুনে আমার উপর দিয়ে সুনামি বয়ে গেল।

নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় বুয়া যা বলল তার তরজমা অনেকটা এই রকম- সাথীর পরিবার আর এখানে থাকে না। ঈদের আগে মেস বাড়ির কোন এক লাফাঙ্গা ছেলের সাথে প্রেম করার সময় তার মায়ের কাছে ধরা পড়ে। ঈদের একদিন আগেই তারা বাসা পরিবর্তন করে। যাওয়ার সময় মেয়েটা প্রচণ্ড কান্নাকাটি করছিল। শেষে বুয়া গলা নামিয়ে বলে- মনে হয় মেয়েটা পোয়াতি ছিল, নাহলে এতো কাঁদবে কেন। হায়! আমি যদি বুয়াকে বলতে পারতাম ওই লাফাঙ্গা প্রেমিক তার কণ্ঠই কোনদিন শুনেনি, পোয়াতি করা তো অনেক দূরের কথা।

মহোদয়, আজ কিন্তু সাথীর কণ্ঠ শুনেছি। কোনো পাখির মতো তার কণ্ঠ না, মানুষের মতোই। আমি কবি হলে তার কণ্ঠ নিয়েই দিস্তার পর দিস্তা লিখতে পারতাম। আফসোস আমি কবি না! বুকে সাহস নিয়ে সাথীর সামনে গেলাম। আমাকে দেখে মেয়েটা ভেবাচেকা খেয়ে গেল। কিছু বলার আগেই একটা অল্প বয়স্ক পুরুষ এসে হাত ধরে টেনে গাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সাথী শান্তভাবে বলল, হাত ছাড়েন আমি গাড়িতে উঠতে পারব। এটাই ছিল সাথীর কণ্ঠে প্রথম এবং শেষবার কোনো কথা শোনা। পাশে দাঁড়ানো বয়স্ক লোককে বললাম আপনার মেয়েকে অন্য একটা লোক টেনে গাড়িতে তুলছে আর আপনি দাঁড়িয়ে দেখছেন। লোকটা ভদ্রভাবেই উত্তর দিলো- সাথী আমার মেয়ে না পুত্রবধূ। আর ওই ছেলে তার হাজবেন্ড। সবসময় আমার ছেলে তাকে ধরে গাড়িতে তোলে, তবে জানি না আজ কেন সে এমন করছে। মহোদয়, ওই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল আমার পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। কেউ যেন হ্যামার পেটাচ্ছে আমার মাথায়। ভদ্রলোক আস্তে আস্তে গাড়ির দিকে পা বাড়াল। আমি শেষবারের মতো সাথীকে দেখলাম, মুখ থমথমে চোখ ভেজা…।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত