নায়িকা

পান্থপথের মোড়ে যেখানে রাস্তাটা শেষ হয়ে ডান দিকে বাঁক নিয়েছে, সেখানেই সৌরভের সঙ্গে দেখা হলো নাঈমের। দীর্ঘদিনের বিরতির পর। আনুমানিক পঁয়তাল্লিশ বছর তো হবেই। এত বছর পরও নাঈমকে চেনার একমাত্র কারণ হলো, ওর চোখ দুটো। সৌরভ নাঈমের কাঁধে হাত রেখেই বলল, তুই নাঈম না? নাঈম হকচকিয়ে গেল। মানুষকে ঘুরে দেখল। পরনে হালকা বাদামি রঙের চেক শার্ট, কালো প্যান্ট। পায়ে একটা চটি জুতো।

নাঈম আবারও কাঁধ ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, কিরে এখনও চিনতে পারলি না?

নাঈমকে খুব পরিচিত মনে হচ্ছিল; কিন্তু মুখখানা স্মরণে আসছিল না, স্মৃতির মানসপটে বিভিন্ন মুখ স্মরণ করে যাচ্ছিল। কিন্তু কোনোটার সঙ্গে মেলাতে পারছিল না।

কিরে নোয়াখালী কলেজের কথা ভুলে গেলি নাকি?

চট করে নাঈমের মনে পড়ে গেল কলেজ ক্যাম্পাসের কথাগুলো। সৌরভ, হ্যাঁ সৌরভই তো। একমাথা ঝাঁকড়া চুল, ঝকঝকে দাঁত। কী বন্ধুত্ব ছিল তাদের। নোয়াখালী কলেজের কথা বলতেই ছবির মতো একের পর এক দৃশ্য ভেসে উঠতে লাগল। নাঈমের আর দোষ কী- দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর পর দেখা।

সৌরভ বলল, এখন কোথায় থাকিস?

নোয়াখালীতেই।

সেই সোনাপুর মোক্তার বাড়িতেই কি?

ঠিক, ঠিক। তাহলে আমাকে চিনতে পারিসনি কেন?

কতদিন পরে দেখলাম। ভুলেই তো গেছি তোর চেহারা। তুই কি আর আগের মতো আছিস?

কিন্তু তুই তো ঠিকই চিনে নিলি, যাক তোর কাছে হার মানতে হলো।

নাঈম মৃদু হেসে বলল, তুই তো এখন মস্ত লেখক হয়েছিস। নামিদামি লোক, বইয়ের ফ্ল্যাপে সুন্দর পরিপাটি ছবি।

চল এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা না বলে বাড়িতে চল।

কোথায় তোর বাড়ি?

ধানমণ্ডি ছয় নম্বরে।

তুই বাসায় থাকিস কখন?

সকাল ৯টার সময়, এরপরে এলে নাও পেতে পারিস।

ঠিক আছে, ঠিকানা দে কাল সকালে আসব।

নাঈম ঠিকানা লিখে দিল।

পরদিন সকাল ৯টার মধ্যে সৌরভ এসে হাজির। বেল টিপতেই কাজের ছেলে এসে দরজা খুলে দিল।

নাঈম মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এসে ড্রইংরুমে ঢুকল। নাঈম বলল, বাড়ি খুঁজে নিতে সমস্যা হয়নি তো? না সহজ লোকেশন। নামটিও বেশ সুন্দর- সবুজ ভিলা। নিশ্চয়ই তোর দেওয়া নাম?

তা তো বটেই। আজ দুপুরে আমরা একসঙ্গে খাব কিন্তু। সেই কলেজ জীবনে খেয়েছি। আবার আজ এত বছর পর।

ভাবি কোথায়?

ও আপাতত ছেলের কাছে দার্জিলিংয়ে থাকে। মাস তিনেক পর আসবে। মাঝখানের এই দিনগুলোতে আমি কোনো লাইব্রেরি, পত্রিকা অফিস, রাত হলে লেখালেখি- এই করে কাটিয়ে দিচ্ছি।

এরপর দুই বন্ধুতে চুটিয়ে আড্ডা দিতে লাগল। সৌরভ বলল, তোর কলেজ লাইফের ওই নায়িকার খবর কি রে?

কোন নায়িকা?

ওই যাকে নিয়ে একবার একটা গল্প লিখেছিলি। অনেকে বলত তুই নাকি বকুলকে নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলি? বকুলের কথা মনে হতেই চমকে উঠল নাঈম। ভাবতে চেষ্টা করল কিছুক্ষণ। চোখ বুজে ভাবতেই বকুলের মুখখানা ভেসে উঠল। দুধে-আলতা গায়ের রঙ, ঝাঁকড়া চুল, আয়ত কালো চোখ। সুন্দর ফিগার। কলেজে প্রায় শাড়ি পরেই আসত। নাঈম লুকিয়ে ওকে দেখত। বকুল যখন বাসায় ফিরত, তখন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকত। আর তাই কলেজ ম্যাগাজিনে যখন নাঈমের গল্প বের হলো, তখন অনেকেই ভাবল বকুলই নাঈমের এই গল্পের নায়িকা। নাঈমের একজন সিনিয়র ভাই তো বলেই ফেলল, এখনও নাক টিপলে দুধ বেরোয় আর এই বয়সেই এমন প্রেম। গল্পে যাই থাকুক বাস্তবে নাঈমের সঙ্গে বকুলের বাক্যালাপ পর্যন্ত হয়নি।

এর ঠিক মাস তিনেক পরের কথা, নাঈম তখন এইচএসসি ফাইনালের জন্য নিজেকে তৈরি করছিল। একদিন কী একটা নোট করার জন্য লাইব্রেরিতে ঢুকল। হঠাৎ বকুলের মুখোমুখি হয়ে গেল। সেদিনই বকুলের সঙ্গে তার প্রথম আলাপ। সাহস করে বকুলের কাছে এগিয়ে যেতেই সে ঈষৎ হাসল।

নাঈম কিছু বলার আগেই বকুল জিজ্ঞেস করল, আপনি তো সেই গল্প লেখক নাঈম?

হ্যাঁ, মানে চিনতে পেরেছেন? নাঈম ঢোক গিলল।

বকুল হেসে বলল, না চেনার তো কোনো কারণ নেই, এখন কি বাসায় যাবেন?

একটু সহজ হয়ে নাঈম বলল, না, আজ আমার এক বোনের বাড়িতে বেড়াতে যাব। বলে বকুলকে পাল্টা প্রশ্ন করল, আপনি?

আমি? আমি বাসায় যাব। একটা বিশেষ কাজ আছে। হঠাৎ বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব আপনাকে?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই করবেন। নাঈম আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে বলল।

কলেজ ম্যাগাজিনে হঠাৎ আমাকে নিয়ে লিখলেন কেন?

ইয়ে মানে ঠিক আপনাকে উদ্দেশ করে… বকুলের কুঁচকানো ভ্রুযুগলের দিকে তাকিয়ে থতমত খেল নাঈম।

মানে যাই থাকুক, গল্পটা তো সত্যি নয়। বকুল তেমনি শক্ত চোখে তাকিয়ে থাকল। পরক্ষণেই দৃষ্টি নত করে হাস্য ভঙ্গিতে বলল, গল্পটা বেশ সুন্দর হয়েছে এটুকু অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আপনার লেখার হাতটিও বেশ ঝরঝরে। চেষ্টা করলে হয়তো একদিন নামী লেখক হয়েও যেতে পারেন। এরপর দু’জন দু’জনার গন্তব্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

সেই শেষ দেখা। এইচএসসি ফাইনাল দিয়ে নাঈম ঢাকা চলে এলো। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বাংলায় এমএ কমপ্লিট করে বর্তমানে অধ্যাপনা করে যাচ্ছে। সাহিত্য জগতে তার বেশ নামডাক। যে বইটি এখন সৌরভের হাতে, সেটি নাঈমের বিখ্যাত এক বই। প্রায় পাঁচটি সংস্করণ হয়ে গেছে। বইটির পাতা উল্টাতে উল্টাতে সৌরভ বলছিল, তুই যে এত বড় লেখক হবি তা কখনও কি ভেবেছি আমরা?

নাঈম দার্শনিকের ভঙ্গিতে বলল, জীবনটা যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে আমরা তো কেউ তা জানি না।

হ্যাঁ, তা তো বটেই। আমাদের সঙ্গে যে ক্যাবলা ছেলেটা পড়ত- ওই যে বেঞ্চের পেছনে বসে থাকত। সৌরভ হাত উঁচিয়ে বলল, শিহাবকে তোর মনে নেই?

নাঈম চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, হ্যাঁ মনে পড়ছে। সে এখন মস্ত বড় ব্যবসায়ী।

সৌরভ বলল, একবার নোয়াখালী আয়। পুরনো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা হবে। অবশ্য তোর গল্পের সেই নায়িকা এখন আর নোয়াখালী থাকে না।

নাঈম হেসে বলল, কবে যে একটা গল্প লিখেছিলাম সেটা তো সত্যি ছিল না। আর সে কথা মনে করে আজও বসে আছিস।

বিকেল পর্যন্ত দুই বন্ধু চুটিয়ে আড্ডা দেওয়ার পর সৌরভ বাড়ি ফিরে গেল।

এর ঠিক মাসখানেক পর নাঈমের সেই কলেজ জীবনের নস্টালজিয়া মাথায় চেপে বসল। একদিন সকালে ট্রেনে চেপে সৌরভকে জানাল, সে নোয়াখালী আসছে।

নাঈম তো হতবাক, বলিস কী রে। সত্যি তুই আসছিস।

হ্যাঁ, তিন সত্যি।

নাঈম যথাসময়ে স্টেশনে এসে গাড়ি বেড়ার অপেক্ষায় থাকল। ট্রেন বিলম্ব না করে ঠিক সময় স্টেশনে ভিড়ল। গাড়ি থেকে নাঈম নামতে নামতে সৌরভ একেবারে কাছে এসে দাঁড়াল। নাঈম তাকে জোর করে নিজের বাড়ি নিয়ে গেল। নাঈম সৌরভের বাড়ির উদ্দেশে যেতে যেতে দেখল, বাড়ি-ঘর, পথ-ঘাট সব আগের মতোই আছে। শুধু ওদের জীবনটাই বদলে গেছে।

পরদিন সকালে নাঈম সৌরভকে নিয়ে কলেজের উদ্দেশে রওনা হলো। কলেজ বিল্ডিংটা আরেকটু বড় হয়েছে। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও বেড়েছে। নাঈম কলেজে পৌঁছার পর হৈচৈ পড়ে গেল। কারণ সৌরভ আগেই প্রিন্সিপালকে জানিয়ে রেখেছিল, নাঈমের মতো একজন স্বনামধন্য লেখক এই কলেজের ছাত্র ছিল। নাঈমের নাম শুনেই ছেলেমেয়েরা চঞ্চল হয়ে উঠল। ছোটখাটো একটা সভার আয়োজনও আগে থেকেই তারা করে রেখেছিল। সভায় নাঈমের অনেক পাঠক-পাঠিকাও সমবেত হলো, ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকের অনেকেই তার অটোগ্রাফ সংগ্রহ করল। সন্ধ্যার পর দু’বন্ধুতে মিলে একসঙ্গে রাস্তায় হাঁটতে বের হলো। হাঁটতে হাঁটতে বকুলদের বাড়ি চোখে পড়ল। গেটের ফাঁক দিয়ে ভেতরে দেখল, কে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বসে আছেন। একবার মনে হলো ভেতরে ঢুকবে। আবার কী মনে করে ফিরে এলো।

রাতে যখন খেতে বসল, সৌরভ অনুরোধ করল আরও কয়েকদিন থেকে যেতে। নাঈম রাজি হলো না। পরদিন ঢাকায় ফেরার পথে সৌরভ ওর হাতে একটা পত্রিকা গুঁজে দিয়ে বলল, প্রিন্সিপালকে বলে পুরনো ম্যাগাজিনটা বের করে নিয়েছি। গাড়িতে বসে পড়িস। ট্রেনের কামরায় বসে পড়তে গিয়ে নাঈম লজ্জিত হলো। ইস্‌ কী কাঁচা হাতের লেখাই না ছিল। ঢাকায় ফিরে নাঈম পুনরায় কাগজ-কলম নিয়ে বসল। গল্পের বিষয়বস্তু একই, পঁয়তাল্লিশ বছর আগের লেখাকে রি-রাইট করল শুধু।

সম্পাদক সাহেব বেজায় খুশি। কী ব্যাপার, নস্টালজিয়ার গন্ধ পাচ্ছি।

না না, ওসব কিছু না। নতুন আইডিয়া মাথায় এলো তাই। একবার ভাবল সৌরভকে ফোন করে জানাবে। আবার ভাবল সৌরভ বলবে আমাকে নয়, বকুলকে ফোন করে জানিয়ে দে। তাই আর সৌরভকে জানানো হলো না। যথাসময়ে গল্পটি ছাপা হলো। এরই মাসখানেক পর সম্পাদক সাহেবের ঠিকানায় একটি চিঠি এলো।

একি? কার লেখা এ চিঠি? এ যে বকুলের চিঠি। নাঈম দ্রুত খাম খুলে চিঠিটা পড়তে লাগল-

নাঈম,

গত পরশু তোমার ‘নায়িকা’ গল্পটি পুনরায় পড়লাম। বহুল প্রচারিত পত্রিকায় তোমার গল্প পড়ে আশ্চর্য হলাম। কাহিনী একই, বিন্যাস ও বর্ণনা অনেক বেশি সুন্দর ও অর্থবহ। আমি জানতাম তুমি একদিন বড় লেখক হবে। তোমার ঠিকানা জানি না। আমি এখন গুলশান এক নম্বরে থাকি। সময় পেলে বেড়াতে এসো। কলেজ জীবনে ফিরে যাওয়া যাবে।

পুনশ্চঃ একই গল্পের পুনরাবৃত্তি কেন? ভালো থেকো।

ইতি বকুল

নাঈমের সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। নিছক নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়েই গল্পটাকে রি-রাইট করেছে। আর কিছু নয়। কলেজ জীবনের লেখাটাও বকুলকে উদ্দেশ করে লেখা নয়। তার পরও বকুল তাকে যেতে বলেছে। পরদিন সকালেই বকুলের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলো। গুলশান এক নম্বরে পৌঁছেই বাড়ির কাছাকাছি গিয়েই নম্বর মেলাল। কিন্তু ভেতর থেকে গেট বন্ধ। বাড়ির দারোয়ান ছেলেটি এগিয়ে এলো। কাকে চাই?

ম্যাডাম কি বাড়িতে আছেন?

না না, উনার শইলডা বালা না।

কেন, কী হয়েছে?

কী আর অইবো? ঠ্যাংয়ে বিষ ব্যাতা। উটতে বইতে কষ্ট অয়।

ও আচ্ছা। দেখাশোনা করে কে?

কাজের মানুষ আছে।

নাঈম ভাবছিল পঁয়তাল্লিশ বছর আগের তার কথিত গল্পের নায়িকার একি হাল! চলৎশক্তিহীন এক প্রৌঢ়া। এখন শুধু শেষ নিঃশ্বাসের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।

দারোয়ান ছেলেটি বলল, ম্যাডামকে কী দরকার?

না, কোনো দরকার নেই। নাঈম হাঁটতে শুরু করল। হঠাৎ দেখল আঠারো-উনিশ বছরের বকুল দুই বেণি দুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ‘বকুল’। আশ্চর্য- মেয়েটি ফিরে তাকাল। হেসে বলল, আমাকে কিছু বলছেন?

না মানে…

আমার নাম লোপা।

ও আচ্ছা। নাঈম হতবাক হয়ে লোপার দিকে তাকিয়ে রইল। হ্যাঁ, এই তো সেই বকুল। তার কলেজ জীবনের সহপাঠী। মেয়েটি আর পেছন ফিরে চাইল না। নাঈম পনেরো সিরিয়ালের গাড়িতে চড়ে ধানমণ্ডির উদ্দেশে রওনা হলো। ভাবল, কী ভুলই না করেছিল সে। ধানমণ্ডি থেকে গুলশান। বড়জোর এক ঘণ্টার পথ অথচ পঁয়তাল্লিশ বছরের ব্যবধান। এ ব্যবধান অতিক্রম করা যায় না। গভীর হতাশায় মন আচ্ছন্ন হয়ে রইল। নাঈম উপলব্ধি করল জীবন কখনও পেছন ফেরে না। এগিয়ে চলে।

এগিয়ে চলাই যে জীবনের ধর্ম।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত