জমানো কথা, নারী অথবা রাখাল বালকের

সেই রাখাল বালকটির কথা মনে আছে? যে তার রাজার হত্যাকাণ্ডটি দেখে ফেলেছিল আর দৌড়ে করিন্থনগরে ফিরে নগরবাসীকে সে সংবাদটি দিতে গিয়ে দেখেছিল, সে হত্যাকারীটিই ইতোসময়ে সে রাজ্যের রাজা হয়ে বসে আছে!

সে রাখাল বালকটি তার কথাটি গিলে ফেলেছিল। আর পেটে সে কথাটি নিয়ে চলে গিয়েছিল দূরের পাহাড়ে। পেটে কথা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সে নির্মম দিনগুলোর কথা আমরা নিশ্চয়ই কল্পনা করতে পারি।

গসপেলে লেখা আছে, পশুপাখিদের কথা বুঝতে পারতেন নবী সলেমন। সিরিয়ার রানী সাবহ্‌’র রূপের গল্প তাঁকে বর্ণনা করেছিল ছালছাবিল পাখি- সে গল্প আমরা জানি। আর কী কী কথা বলেছিল অন্য অন্য পাখি তা সব কি জানি? সেসব না বলা কথা নিয়ে চলে গেছেন নবী সলেমন। নোবেল বিজয়ী জাপানি সাহিত্যিক কেনজাবুরোওয়ে জানাচ্ছেন, তার পুত্র বাকপ্রতিবন্ধী ছিল। সে মানুষের ভাষায় যোগাযোগ করতে পারত না। তার সাত বছর বয়সে তিনি তাঁকে যখন গ্রামে বেড়াতে নিয়ে গেলেন, তখন সে ঝোপের ভেতর থেকে ডেকে ওঠা একটি পাখির ডাক শুনে সে নকল করল আর পিতা, লেখক পিতা বুঝতে পারলেন, তার পুত্রের মনে জমানো কথা আছে। আর পুত্রটি তারপর সেসব কথা সঙ্গীতের ভেতর দিয়ে বলতে শুরু করল। আর পিতা বুঝতে পারলেন, পুত্র যে সুরগুলো সৃষ্টি করছে মূলত পাখির সুরকে অনুকরণ করে। শৈশবের সে সুরগুলোর ভেতর ছিল শিশুর চঞ্চলতা, তারপর ক্রমশ সে সুর মানুষের, মানুষের ভাষায় কথা বলতে না পারার বেদনায় ভারি হয়ে উঠেছিল।

মানুষ কথা বলে। নানা মাধ্যমে বলে, নানাভাবে বলে। অবশ্য বিজ্ঞানের সাধুরা অনেক তথ্য আবিস্কার ইতিমধ্যে করছেন। তারা বলছেন, কথা শুধু মানুষই বলে না। অন্যরাও বলে। পিঁপড়া তো বটেই, গাছ, মৌমাছি এমনকি ক্ষুদ্রতম ফাঙ্গাশ তারাও কথা বলে, বার্তা বিনিময় করে। অর্থাৎ জীবজগতে যাদেরই প্রাণ আছে সে হোক প্রাণী বা উদ্ভিদ, তারা কথা বলে। যোগাযোগ করে। আরও বিপদের কথা হচ্ছে, এখন যন্ত্রও কথা তথা বার্তা বিনিময় করতে শুরু করছে। মোবাইল অন্য মোবাইলের ব্লুটুথ, ইলেকট্রনিক কার্ডের ভাষা কার্ড রিডার বুঝতে পারছে।

প্রশ্ন জাগছে- কথা বলতে আমরা কী বুঝি? কথা প্রথমত বার্তা। কমিউনিকেশন। এটা ভারবালও হতে পারে, নন ভারভালও হতে পারে। এই যে ধানের একটি চারা আক্রান্ত হলে সে কম্পন প্রেরণ করে পাশের চারারে, এটা কথা। রানী মৌমাছি সেক্স অনুভব করলে ফেরোম্যান ছড়ায়, সৈনিকটি মধুর সন্ধান পেলে চাকের সামনে জা্যমিতিক নক্সা তৈরি করে, এগুলো কথা। চোখ টিপে কথা বলে আমাদের রহস্যময়ীরা, মুখে তো বলেই, কান ঝালাপালা। অবশ্য ধর্মকথা শোনা দরকার। পবিত্র বাইবেল বলতেছে, কথা বলার সময় যে নারী চক্ষু দ্বারা ইঙ্গিত করে, পায়ের নখ দ্বারা মাটি খুঁড়ে- তার সঙ্গ পরিত্যাগ করো। কেননা, সে বিবাদকে খুলিয়া দেয়। আমরার ভাগ্য ভালা যে টিএসসিতে মাটি খোঁড়ার সুযোগ নাই। মাবুদে কতই না পলিসি করে আমরারে নিরাপদ রাখছেন।

সৃষ্টিজগতের সবকিছু কথা বলছে। আমরা সব কথা উদ্ধারের তরিকা এখনো জানি না। আমাদের প্রজাতিসমূহের বিভিন্নটা তার একটি কারণ হতে পারে। কিন্তু সবকিছুই কথা বলে চলেছে। বাইবেলে যে নারীর পা মাটিতে খুঁড়ে কথা বলার কথা বলা হয়েছে সেও কথা বলেছে- দেহ ভাষায়। বুঝে নেয়ার দায়িত্ব গ্রাহকের। হ্যাঁ, তাতে বিবাদের দরোজাও খুলে যেতে পারে। কথা না বুঝলে তো ঝামেলা, কখনো কখনো আরো তীব্রতর হতে পারে। প্রকৃতির উপর অত্যাচার করলে আপাত বোবা প্রকৃতিও প্রতিশোধ নেয়। এই যে আমরা এই দেশে দেখছি- বনজঙ্গল উজাড় করার ফলে বাড়ছে তাপমাত্রা, খালবিল খেয়ে ফেলার পর এখনো ডুবছে মানুষ বন্যায়, জলাবদ্ধতায়। জনবিজ্ঞানে মেলথাসের একটা সূত্র আছে যে, জনসংখ্যা বেড়ে গেলে প্রকৃতি নিজেই মারী মহামারী তৈরি করে ভারসাম্য তৈরি করে। প্রকৃতির কিছু কিছু কথা আমরা মানুষরা না বুঝলেও কিছু কিছু প্রাণী টের পায়। যেমন- ভূমিকম্পের আগাম বারতা টের পায় গর্তে বাস করা প্রাণীরা।

এ তো গেলো দুই ভিন্ন প্রজাতি বা মাধ্যমের কথা বোঝা না বোঝার মামলা। আমরা একই প্রজাতির মানুষই কি মানুষের কথা বুঝতে পারি? বুঝতে পারি না। প্রথমত, ভাষার ভিন্নতার কারণ। গ্রামে গল্প বলে- আবদে আবদে বলে গেলা যাদুর পরাণি। গল্পটা মর্মান্তিক। ছেলে পড়তে গেছে দূরে কোথাও। যে ভাষায় সে শিখেছে বিদ্যা সেখানে পানির প্রতিশব্দ আব। গ্রামে ফিরে এসে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে মাকে বলেছে আব দে, আব দে। বেচারি মাতা বুঝেনি যাদুর কথার মানে। ফলে বিদ্যার কারণেই পানি না পেয়ে গেছে যাদুর প্রাণ। একই জাতির ভাষার মধ্যেও আছে পানি আর জলের তফাৎ। আর দুই জাতির ভাষার তফাতে তো নানা ঝামেলা হতে পারে। অবশ্য প্রশ্ন থেকে যায়, একই মানব সম্প্রদায়ের ভাষা ভিন্ন ভিন্ন কেনে? পুরাণকথা তার জবারের জন্য আমাদের আরেকটি গল্প বলছে। বলছে- আদিতে মানুষ একই ভাষাভাষী ছিল। কিন্তু তারা একদিন ঠিক করলো ঈশ্বরকে ছোঁয়ার জন্য আকাশ সমান একটি ঢিবি বানাবে। তারা আকাশছোঁয়া ঢিবি বানাতে শুরু করলো একদা। ঈশ্বর করলেন একটি সহজ চালাকি। তিনি তাদের প্রত্যেকের ভাষা বদলে দিলেন। তখন তারা আর একজন আরেকজনের কথা বুঝতে পারলো না। ফলে তাদের পক্ষে এই যৌথ শ্রমের ঢিবিটি বানানো সম্ভব আর হলো না। আর তারা একজন আরেকজনের কথা না বুঝতে পেরে একেক জন একেক দিকে চলে গেল। আর তা থেকেই তৈরি হলো নানা ভাষা আর জাতির।

অবশ্য একজন আরেকজনের কথা বুঝতে না পারলে ঢিবি কেন কোনো কিছুই বানানো সম্ভব নয়। পাকিস্তান রাষ্ট্র তার প্রমাণ। এক পক্ষ আরেক পক্ষের ভাষা বুঝতে পারেনি। বুঝতে পারেনি মনের কথা। ফলে রাষ্ট্রটি আর টেকেনি। আর ভাঙনের সূচনাটি হয়েছিল ভাষারই প্রশ্নে।

কথা না বুঝলে রাষ্ট্র, সংসার, প্রেম- টেকে না কিছুই। কথাকে কেন্দ্র করেই ঘটে যেতে পারে তুলকালাম কাণ্ড। এমনকি খুনোখুনি। অনেক সময় জিহ্বা হয়ে উঠতে পারে তরোয়ালের চেয়েও তীব্র তরবারি। আবার কথায় ভিজতে পারে চিড়ে, গলতে পারে সুন্দরী নারীর মন। কথার প্রেমে পড়ে মানুষ দিয়ে দিতে পারে ধন, যৌবন, প্রাণ। সুতরাং কথা বলতে পারা আর কথা বুঝতে পারা এক অতুলনীয় দক্ষতা।

আর নিজ সম্প্রদায়ের বাইরের কথা বুঝতে পারলে তো কথাই নেই। আপনি যদি আপনার মাতৃভাষার কথার বাইরে অন্য ভাষার কথাও বুঝতে পারেন তাহলে খুলে যেতে পারে আপনার নতুন সম্ভাবনার দ্বার। ব্রিটিশ আমলের ইংরেজদের কথা একটু বুঝতে পারার ফলে অনেকেই হয়ে উঠেছিলেন ধনপতি। কথা বুঝাতেই চেষ্টা করেছেন তারা প্রাণপণে। বলেছেন, মাই লর্ড, কাঁচি ইজ ওয়ান কাইন্ড অব দা স, হুজ ইজ খাঁজ কাটা খাঁজ কাটা। ইংরেজি না হোক- তারা তো নিজের ভাগ্য বদলেছিলেন এই ভাঙা ভাষারই বদৌলতে।

এ তো গেল কথা বলার যন্ত্রণার কথা। আর কথা না বলার যন্ত্রণা? ঠাকুর বলছিলেন, আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল শুধাইল না কেউ আমারে! মানুষকে শুধালেও যে সব কথা বলে ফেলবে, এমন না। কেউ যখন বলে, আমার কিছু বলার নাই বা বলে ভালো থাইকো- তখন আমরা বুঝতে পারি তার আসলে অনেক জমানো কথা আছে। মানুষ অনেক সময় সব কথা বলতে পারে না। তাই বলে সব কথা হারিয়ে যায় না। জমানো থাকে তাদের মনের গহনে। মনোবিদ্যা বলছে, সে মানুষের মনের তিনটি স্তর আছে। ইদ ইগো আর সুপার ইগো। ইদ পর্যায়ে মানুষ সঙ্গত অসঙ্গত সবকিছুই ভাবতে পারে। ইগো সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর সুপার ইগো হচ্ছে সামাজিক সত্তা। সেটি প্রকাশ করা যাবে কিনা সেটা সে নিয়ন্ত্রণ করে। সে বলে দেয় যে এটি প্রকাশ্যে সমাজে এখন বা কখনোই বলা যাবে না। তাই বলে মানুষের সে কথাটি মন থেকে হারিয়ে যায় না। সেটি জমা থাকে। চলে যায় গহনে অবচেতন স্তরে। তারপর সে অবচেতন স্তরে জমানো কথাগুলো মানুষের আচরণে চিন্তায় নানাভাবে প্রভাব ফেলতে থাকে। নানা মনোদৈহিক সমস্যারও সৃষ্টি করে। কিন্তু আখেরে মানুষ জমিয়ে রাখা সবকথা লুকিয়েও রাখতে পারে না। অনুকূল পবিবেশে প্রভাবক পেলে বলে ফেলে। তখনও অর্থ অনর্থ দুটোই ঘটে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা মি টু আন্দোলনে নারীদের জমানো কথা শুনতে পাচ্ছি। সে নিয়ে তর্ক-বিতর্ক তুলকালাম কাণ্ডও ঘটে যাচ্ছে। পতন ঘটছে অনেক রথী-মহারথীর।

আবার মানুষকে অনেক সময় জমানো কথা জোর করে বলতে বাধ্যও করা হয়। লেখার শুরুতে যে রাখাল বালকটির কথা বলেছিলাম, তাকে পাহাড় থেকে ধরে আনা হয়েছিল। জোর করে বলতে বাধ্য করা হয়েছিল তার জমানো কথাগুলো বলতে। এতে বলতে বাধ্য করা রাজারই সকরুণ পতন ঘটেছিল।

রথী-মহারথী বা রাজার পতন ঘটে ঘটুক। তবু মানুষ জমানো কথাগুলো বলুক, নির্ভয়ে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত