যুদ্ধ, প্রেম, মৃত্যু

প্রচণ্ড শীতে হাড়ের ভেতর কাঁপুনি ধরে গেছে। আজকের রাতটা এখানেই থাকতে হবে আমাদের। ফরিদ আর আমি-দু’জনেই খুব ক্লান্ত। এগারো মাইল পথ টানা হেঁটেছি।

আমতলীতে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে আমাদের ছোট দলটার বেশ ক্ষয়-ক্ষতি হয়। বাচ্চু শহীদ হয়, ফরিদের বাঁপায়ে গুলি লাগে। কৌশলগত কারণে আমরা পিছিয়ে আসি। শেষমেশ চাঁনপুর গ্রামের গেরস্ত আরশাদ মিয়ার বাড়িতে রাত কাটাতে উঠেছি। আমরা কেউই তার পূর্ব পরিচিত নই। সন্ধ্যা মিলিয়ে যাওয়ায় আর হাঁটার উপায় ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে সড়কের এক পাশে এই বাড়িতে গিয়ে রাতটা থাকার জন্য অনুরোধ করি। যুদ্ধের সময়টা খুব জটিল। সারাদেশেই এর প্রভাব পড়েছে। গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে পাকিস্তানি সৈন্য। আমরা মুক্তিবাহিনীর লোক এই পরিচয় পাওয়ার পর আরশাদ মিয়া দ্বিতীয়বার কিছু ভাবেনি। আপনজনের মতো বাড়ির ভেতরে টেনে নিল আমাদের। ছোট মাছ শিম দিয়ে রান্না করা, পাতলা ডাল আর আলু ভর্তা- এই দিয়ে পেট ভরে দুই বন্ধু রাতের খাবার খেলাম। সারাদিন ভাত খাইনি। মনে হলো আরশাদ মিয়ার ঘরের এই সামান্য খাবার সামান্য নয়, যেন অমৃতের মতো লাগল মুখে। খাওয়া শেষ হতেই ফরিদ চুপচাপ শুয়ে পড়েছে। খুব ক্লান্ত সে। এখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।

আমার চোখে ঘুম আসছে না। সব সময় একটা অজানা ভয় আমাকে তাড়া করে। যদিও নিজের মৃত্যুচিন্তা নিয়ে একদম বিচলিত নই। দেশের জন্য যুদ্ধ করছি। এই অবস্থায় মৃত্যু ছায়ার মতো সঙ্গে আছে। আর দেশের জন্য যদি প্রাণ দিতে পারি তাহলে এর চেয়ে বড় গৌরবের কিছু নেই। মাঝে মাঝে বাবা-মা আর বিলুর জন্য মনটা খুব দুর্বল হয়ে যায়। তারা এখন কোথায় আছে জানি না। শহরের বাড়িতে নেই। হয়তো আরও হাজার পরিবারের মতো শহর ছেড়ে গ্রামের কোনো বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। আসলে যত সহজে যুদ্ধ একজন মানুষকে অন্য একজন মানুষের কাছে আপন করে দেয়, অন্য কোনো বিপদে তা এত দ্রুত হয় না।

আরশাদ মিয়া হুক্কা টানতে টানতে বাড়ির ভেতর থেকে কাছারি ঘরে এলো। তার হুক্কার গরগর শব্দে আমার ভাবনায় ছেদ পড়ল। সে চৌকির এক কোনায় আরাম করে বসল।

– ভাইসাব, শুইয়া পড়েন। শীতের রাইত। এইবার অগ্রাণ মাসেই পৌষ মাসের লাহান শীত পইড়া গেছে।
– হুম। কিন্তু আমার ভাই এত তাড়াতাড়ি ঘুম আসবে না। শীতের রাত তো অনেক লম্বা।
-ঠিকই কইছুন। শীতের রাইত রাইজ্জের লাম্বা। আফনের বন্ধু তো ভালা ঘুম দিছে। নাক ডাকতাছে দেহা যায়।
-সে খুব ক্লান্ত। তাছাড়া বাম পায়ে গুলির জখম আছে।
– সব্বনাশ! আমারে আগে কেরে কইলাইন না? অহন তাইনের কী অবস্থা ভাইসাব?
-আগের চেয়ে অনেকটাই ভালো। ভয়ের কিছু নাই। আপনি ভাই শুয়ে পড়েন। আমরা আপনাকে ঝামেলায় ফেলে দিলাম। কিছু মনে করবেন না।
-ছিঃ, ছিঃ ভাইসাব। কী শরমের কথা। আফনেরা অইলেন মুক্তিবাহিনীর লোক। আফনেরা আমার মায়ের পেটের ভাইয়ের চেয়েও আপন।

এই কথায় আমি আরশাদ মিয়ার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। বুঝতে পারলাম সে কথাটা অন্তর থেকেই বলেছে। হুক্কাটা এক পাশে সরিয়ে রেখে সে আমার হাত চেপে ধরে কান্না জড়ানো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল- ভাইসাব, আর কতদিন লাগব আফনেরার এই দেশটারে স্বাধীন করতে? আমি তার কাঁধে হাত রেখে বললাম, তা তো জানি না ভাই। তবে দেশ স্বাধীন হবেই। আমরা থাকি বা না থাকি। আপনার মতো, আমার মতো লক্ষ মানুষ অস্ত্র হাতে দেশের স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এই হায়েনার দল পরাজিত হবেই।

উঠানের এক কোনায় কুপি বাতি নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে আরশাদ মিয়ার বউ। নরম গলায় দুই-তিন বার ডাক দিল- আবুনির বাপ, আবুনির বাপ। বাড়ির ভিত্রে আওহাইন। বউয়ের ডাকে সাড়া দিয়ে সে বলল, সবুর করো, আইতাছি। আরশাদ মিয়া চলে যাওয়ার সময় তার গায়ে জড়ানো ছেঁড়া, ময়লা কাঁথাটা খুলে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল- আফনেরা শহরের মানুষ। আমি গেরামের সামান্য গরিব গিরস্ত। আমার ঘরে লেপ নাই। আফনেরার এই শীতের রাইতে খুব কষ্ট অইবো ঘুমাইতে। আমার এই ফুইল্লিয়া ক্যাঁতাডা দুই ভাঁজ কইরা রাইতটা কিনুবায় পার কইরা দেইন। আমার চোখের কোনা ভিজে গেল তার এ রকম মমতা আর আন্তরিক কথায়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, আরশাদ মিয়ার মতো সহজ-সরল, প্রকৃত দেশ দরদি মানুষগুলোর জন্যই দেশটাকে দ্রুত স্বাধীন করা দরকার। এই মানুষগুলোর জীবনে স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ খুব দ্রুত এনে দিতে হবে যে কোনো মূল্যে।

শেষ রাতে হঠাৎ করে ফরিদের প্রচণ্ড জ্বর চলে এলো। সারা গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরের তাপে। কেমন যেন অস্থির হয়ে ছটফট করছে। আমি হারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে দিলাম। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। টিনের চালের ওপর গাছের পাতা থেকে টপ টপ করে শিশির ঝরছে। বাঁশঝাড় থেকে কী একটা নাম না জানা পাখি থেকে থেকে ডাকছে। আমার ভেতরে কেউ যেন একটা হাহাকারের সুর বাজাচ্ছে। ফরিদ অস্পষ্ট গলায় বলল- বিলু, বিলু, আমাকে এক গ্লাস পানি দাও। আমি উঠে গিয়ে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে কয়েক ঢোঁক পানি খাইয়ে দিলাম।

ফরিদ আবার বিলুকে ডাকছে। সে জ্বরের ঘোরে চলে গেছে। আমি দরোজা খুলে উঠান পেরিয়ে আরশাদ মিয়াকে ডেকে তুললাম। তার বউও উঠেছে। কলতলা থেকে এক বালতি পানি এনে আরশাদ মিয়া ফরিদের মাথার কাছে রাখল। তারপর তার বউকে বলল, গামছা ভিজাইয়া তাড়াতাড়ি জলপট্টি দেও। জ্বরের তাপে কাঠ ফাইটা যাইতাছে। আমি আবুনির কাছে গেলাম। ঘুম ভাইংগা গেলে কান্দাকাটি করব।

আরশাদ মিয়ার বউ পরম মমতায় ফরিদের মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে। আমি গামছা ভিজিয়ে ফরিদের পা মুছে দিচ্ছি। জ্বরের ঘোর কাটেনি। সে আবারও বিলুকে ডাকছে- বিলু, বিলু, আমাকে তুমি মরতে দিও না। প্লিজ, আমাকে মরতে দিও না। আমি তোমার জন্য হলেও বাঁচতে চাই। তোমার জন্য এই দেশটা স্বাধীন করতে চাই। আমি ফরিদের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, কথা বলিস না। আমি মাথা টিপে দিচ্ছি, তুই ঘুমানোর চেষ্টা কর। বিলু, বাবা-মা তারা সবাই ভালো আছে। তুই একটু ঘুমা। আরশাদ মিয়ার বউ ভিজা গামছা ফরিদের কপালে রেখে আমাকে জিজ্ঞেস করল- ভাইজান, শরমাইয়েন না। আমি আফনের বইনের মতো। আফনেরা আমার ভাই। বিলু আফা কি তাইনের পরিবার? কই আছুইন অহন হেইলা?

আমি কিছুটা থতমত খেয়ে উত্তর দিলাম, ফরিদ আমার খুব কাছের বন্ধু। আমরা ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছি। একসঙ্গে পড়ালেখা করেছি। দেশে যুদ্ধ শুরু হলে একসঙ্গে যুদ্ধে চলে এসেছি। ফরিদের বাবা-মা নেই। আমাদের পরিবারেই সে বেড়ে উঠেছে আমার মা-বাবার স্নেহ আদরে। বিলু হলো আমার একমাত্র ছোট বোন। ফরিদ বিলুকে ভালোবাসে। হয়তো বিলুও আমার বন্ধুকে ভালোবাসে। জ্বরের ঘোরে সে বারবার বিলুকে ডাকছে। বিলুর কথা মনে পড়ছে। দেখলাম, আমার কথায় আরশাদ মিয়ার বউ শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছে। হারিকেনের ঘোলাটে আলোতেও তার ছলছল চোখ স্পষ্ট দেখতে পেলাম।

আমি নিজেকেই জিজ্ঞেস করে জানতে চাইলাম, ফরিদ আর বিলুর প্রেমটা কতদিনের? ওরা নিশ্চয়ই প্রতিদিন একজন আরেকজনকে চিঠি লিখেছে, তারপর যে কোনো একসময় তাদের দেখা হলে টুক করে একজনের হাতে আরেকজন চিঠি গুঁজে দিয়েছে। আমি ভাবছিলাম, এতটুকুন বিলু কত বড় হয়ে গেল! ওর মায়াবতী মুখটা বারবার আমার চোখের সামনে খেলা করছে।

যুদ্ধে চলে আসার আগে ফরিদ নিশ্চয়ই বিলুকে বলে এসেছে দেশ স্বাধীন করেই তোমাকে নিয়ে সংসারী হবো। এ রকম ছন্নছাড়া জীবনের ভার আর বয়ে বেড়াব না। ফরিদের সঙ্গে যদি বিলুর বিয়ে হয় তাহলে আমিই সবচেয়ে বেশি খুশি হবো। কারণ তারা দু’জনেই তো আমার আপন- একজন বোন, আরেকজন বন্ধু। আরশাদ মিয়া ফরিদের মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল ভাইসাব, রাইত শেষ অইতে বেশি দিরং নাই। একটু ফরেই ফজরের আজান দিব। সকাল অইলে আমি একজন ডাক্তর ডাইক্কিয়া আনবাম। এই গেরামের পল্লী চিকিৎসক। তার খুব নামডাক আছে। তার ওষুধে খুব কাম অয়। আমিও তার কথায় কিছুটা হালকা হলাম। কিন্তু ফরিদের জ্বর কমছে না। অস্থিরতা আরও বেড়েছে। খারাপ কিছু ঘটে কি-না কে জানে। মাথার পাশে ব্যাগের ভেতর আমার আর ফরিদের দুটি এলএমজি রাখা আছে। গ্রামের কেউ যদি পাকবাহিনীর কাছে গিয়ে খবর দেয় যে, আরশাদ মিয়ার বাড়িতে দু’জন মুক্তিযোদ্ধা আছে তাহলে আমাদের সঙ্গে আরশাদ মিয়ার পরিবারটাও মৃত্যুর মুখে পড়ে যাবে। আমার আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না। ফজরের আজান পড়েছে। কখন সকাল হবে- সেই অপেক্ষায় আমার ভেতরেও অস্থিরতা বেড়ে গেছে। ইচ্ছে হচ্ছে, বিলুকে যদি ফরিদের সামনে আনতে পারতাম তাহলে হয়তো ফরিদ একদম সুস্থ হয়ে যেত। বিলু, মা-বাবা কোথায় আছে কে জানে! নাকি পাকবাহিনীর গুলি খেয়ে মরে গেছে!

ফরিদের খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আরশাদ মিয়া গেছে এই ভোরবেলায় সেই পল্লী চিকিৎসককে ডেকে আনতে। আমি ফরিদের মুখের কাছে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- বন্ধু, তোর কি খুব কষ্ট হচ্ছে? একটু সহ্য কর। একজন ডাক্তার এখনি চলে আসবে। সে আমার হাতটা চেপে ধরল। কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তাও অস্পষ্ট গলায় বলল আমাকে মাফ করে দিস। বিলুকে শেষ দেখাটা দেখতে পারলাম না বন্ধু। দেশের স্বাধীনতার সূর্যটাও দেখে যেতে পারলাম না। তবে তুই আছিস। তোর হাত দিয়েই দেশ স্বাধীন হবে। আমি তার মুখে হাত নিয়ে বললাম- তুই আর কথা বলিস না। ডাক্তার এলেই তুই সুস্থ হয়ে উঠবি। তারপর আবার আমরা দুই বন্ধু লড়াইয়ে নামব, যুদ্ধে যাব। তোর প্রিয় এলএমজিটা তোর সুস্থ অপেক্ষায় আছে। জয় বাংলা বলে চিৎকার দিয়ে একটা ব্রাশফায়ার করে সব পাকিস্তানি শুয়োরের বাচ্চার বুক ঝাঁঝরা করে দিব।

আমার কথায় ফরিদ ম্লান হাসল। তারপর দুই হাতে আমার মুখটা ধরে বলল, আমার শার্টের পকেটে বিলুকে লেখা একটা চিঠি আছে। দেশ স্বাধীন হবে এটা আমি নিশ্চিত। স্বাধীনতার উপহার হিসেবে এই চিঠিটা তুই বিলুকে দিস। আর তাকে বলিস সে যেন আমার স্মৃতি আঁকড়ে না থাকে। নতুন কাউকে ভালোবেসে, স্বাধীন দেশে নতুন কাউকে বিয়ে করে সুন্দর একটা জীবন শুরু করে। তুই ভালো থাকিস বন্ধু। জয় বাংলা।

ফরিদের কথা থেমে গেছে। তার হাত দুটি নিস্তেজ হয়ে আমার মুখ থেকে ধপ করে বিছানায় পড়ে গেল। আরশাদ মিয়ার বউ বিলাপ করে কাঁদছে। আমি পাথরের মতো শক্ত হয়ে ফরিদের পাশে বসে আছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই, বিলুকে শেষ দেখার আগেই আমার চারপাশ শূন্য করে দিয়ে ফরিদ চলে গেল। আমি ফরিদের এলএমজিটা শক্ত হাতে জাপটে ধরলাম। বিলুকে লেখা শেষ চিঠিটা পরম মমতায় শার্টের পকেটে রেখে দিলাম। যদি পাক-হায়েনার গুলিতে না মরি তাহলে বিলুর হাতে তার ভালোবাসার মানুষটির এই শেষ উপহারটুকু আমাকে তুলে দিতেই হবে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত