লাল রঙের সিঁড়ি বাঁধা সুপ্রশস্ত ঘাট। দুই পাশে উঁচু করা বসার জায়গা। ছুটির দিনগুলোতে ভীড়টা বাড়ে। অন্যান্য দিনেও লোকজনের আনাগোনা কম না। প্রতিদিনের একটি দৃশ্য বেশ পরিচিত, গিটার হাতে কয়েক কিশোরের উচ্ছ্বল গান-বাজনা। সবাই গোল হয়ে গান করে। অনেকে আগ্রহের সঙ্গে শোনে। কেউবা নাক শিটকিয়ে চলে যায়। অস্ফুট স্বরে বলে, ‘পোলাপান সব গোল্লায় গেল। পড়ালেখা বাদ দিয়ে কীসের এত আড্ডা।’ জোড়া জোড়ায় ছেলে-মেয়েরা বসে থাকে। সামনে দিয়ে ওয়াটার টেক্সি গেলেই মোবাইল ফোনটা এগিয়ে ধরে। চলে ভিডিও কিংবা সেলফির প্রতিযোগিতা।
সন্ধ্যার পর হাতিরঝিলের এমন দৃশ্য সাজিদের পরম উপভোগ্য। মনটা বিক্ষিপ্ত হলেই সে চলে আসে এখানে। সারিবদ্ধ সবুজ গাছ-গাছালির সঙ্গে লেকের মিতালি অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে দেয় মনটি। তবে তার মূল আকষর্ণটা আসলে পানির ফোয়ারার মনোজ্ঞ ডিসপ্লে। শুরুর দিকে রাতে এটা হতো দুই দফায়। এখন তা কমে এসেছে একবার। ১০-১৫ মিনিটের ফোয়ারার এই কারসাজি করতে নাকি অনেক খরচ। হাতের ঘড়িটা দেখে সাজিদ। ৯টা বাজতে এখনো ১০ মিনিট বাকি। এরপরই শুরু হবে পানির নান্দনিক কসরত। পুলিশ প্লাজার দিকে আনমনে চেয়ে থাকে সে। এই বুঝি ধড়াম করে শুরু হবে গান, তার সঙ্গে জলের নাচন।
এমনটি ভাবতেই বুকের বাঁ পাশের পুরোনো ব্যথা হঠাৎ চাড়া দিল একবার। ব্যথাটা বেশকিছুদিন ধরে ভোগাচ্ছে তাকে। সাজিদ ভেবে পায় না, কিসের ব্যথা এটা। হার্টের ব্যথা কোথায় হয় তা জানে সে। কিন্তু এ ব্যথা বাম পাজরের নিচে। যা ছড়িয়ে যায় পেট অবধি। শুরুর দিকে এমন ব্যথা খুব একটা পাত্তা দেয়নি সে। কিন্তু সময়ের তালে তালে তা যেন ক্রমশ বাড়ছে। বউ অনেকবার সাজিদকে বলেছে, ভালো ডাক্তার দেখাতে। কিন্তু ডাক্তারের কাছে গেলে তো এলাহী কাণ্ড। এই টেস্ট, সেই টেস্ট; রাজ্যের কারবার। এরচেয়ে বাসার পাশে লোকমান ডাক্তারই তো কত ভালো। ডিগ্রি না থাকলেও কত রোগ সে ভালো করে দেয় হাতের নাড়ি দেখে। কোন টেস্টের বালাই নাই।
ব্যথাটা গ্যাসের। অনুমান করেছিল ড্রাগিস্ট লোকমান ফকির। সে অনুযায়ী বেশকিছু ওষুধও দিয়েছিল তাকে। খেয়েছে, কোন কাজ হয়নি। সময় পেলে ব্যথা ঠিকই জানান দেয়। অদ্ভুত লাগে ব্যথার জায়গায় মাঝে মধ্যে চুলকায়ও। সাজিদের খুব ইচ্ছা হয়, বুকের হাড়গুলো দরজার মতো সরিয়ে চুলকিয়ে দিতে। কিন্তু পারে না। অস্বস্তিতে একাত-ওকাত করে।
এখন আর বুকের ব্যথা নিয়ে বউকে কিছু বলে না সাজিদ। বললেই ভালো ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। আর তাতেই ন্যূনতম হাজার তিনেক টাকার মামলা। টানাটানির সংসারে সেই ব্যয় বাড়িয়ে কী লাভ? চলুক না এভাবেই। মেয়ে একটা সাইকেলের আব্দার করছে কতদিন হলো। সেটাই দিতে পারছে না সে। আজ না কাল, শিশুমনের সঙ্গে এমন কথা দিতে দিতে মনটা অপরাধী হয়ে উঠছে। ইট-পাথরের এই শক্ত শহরটা বড়ই বিস্ময় লাগে তার কাছে। লোকে বলে এই শহরে নাকি টাকা ওড়ে। সাজিদের চোখে ধরা পড়ে না কিছু। বড় বড় বিল্ডিংয়ের ফাঁকে ঠিকমতো নীল আকাশটাই দেখা যায় না!
আজ সকালের কথা মনে পড়তেই চোয়ালটা শক্ত হয়ে যায় সাজিদের। হঠাৎ মাথা ঘুড়ে পরে পায় বউটা। তেল-পানি দিয়ে কোনরকম সুস্থ করে হাফ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু বউয়ের শরীরটা বড্ড দুর্বল। সারাটা দিন কাজের ফাঁকে বউয়ের কথা মনে পড়েছে তার। কী হলো হঠাৎ করে। খুব খারাপ কিছু নাকি অনটনের সংসারে আবারো সুখের কোন সংবাদ? একবার লোকমান ফকিরের সঙ্গে কথা বললে কেমন হয়। কিন্তু তার কাছে যেতেও ভয় তার। কারণ লোকটির প্রতি বউয়ের বিশ্বাস কম। তার অভিযোগ, সে ওষুধ বিক্রেতা, ডাক্তার নয়। সেবা নয়, মুনাফাই তার মূল লক্ষ্য। কাল ভালো কোন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতেই হবে। কোন টালবাহানা চলবে না। এদিকে পকেটের অবস্থা গড়ের মাঠ। ভাবতেই নিজের বুকের ব্যথাটা আবার চাড়া দিয়ে ওঠে। অব্যক্ত কষ্টে গলাটা ধরে আসে সাজিদের। ঢোক গিলতে পারে না। যেন দলা পাকিয়ে আছে সেখানে।
কাল ডাক্তারের কাছে গেলে কী হবে, তা কল্পনা করে সাজিদ। ডাক্তার দেখেই বলবে, হিমমম এই অবস্থা। এই নিন প্রেসক্রিপশন। আপাতত এই ওষুধগুলো খাবেন। আর গোটা তিনেক টেস্ট দিলাম। দ্রুত করিয়ে নিয়ে আসবেন। তিন দিনের মধ্যে আসলে ফ্রি, না হলে রিপোর্ট দেখানোরও ভিজিট লাগবে। সাজিদ এ আমলের ডাক্তারদের কাণ্ডকারখানা দেখে ভেবে কূল পায় না। আরে বাবা, কিসের ডাক্তার হয়েছ তোমরা, টেস্ট ছাড়া রোগ ধরতে পারো না। কী পড়ালেখা করেছ মেডিক্যালে। নাকি বিজনেসের খপ্পড়ে শিকেয় উঠেছে বিবেকবোধ। নচিকেতা তো আর সাধে তোমাদের কসাই বলেনি।
সাজিদের মনে পড়ে শৈশবের কথা। গ্রামের সেই নৃপেন ডাক্তারটা কতই না ভালো ছিল। ভ্রু কুঁচকে নাকের উপর থাকা চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করত, কী সমস্যা? রোগী বলত রোগের বৃত্তান্ত। সব শুনে উপরের তাকে সাজানো ছোট শিশিগুলোতে চোখ আটকে যেত তার। খালি একটা শিশি বেছে নিয়ে কী সব ঢালত সেখানে। এরপর পানি দিয়ে কয়েক ঝাঁকি। ব্যস হয়ে যেত পথ্য। কয়েক ডোজ খেতেই রোগ পালাতো সুরসুর করে। আর এখনকার ডাক্তাররা! দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সাজিদ।
হঠাৎ বিকট শব্দে সম্বিত ফিরে পায় সাজিদ। ধড়াম করে বেজে উঠে হাতিরঝিলের বিশালকৃত্তির সাউন্ড সিস্টেম। ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিব রে…’ গানের সঙ্গে সঙ্গে আলোকিত হয়ে ওঠে পুলিশ প্লাজার সামনের অংশ। শুরু হয় পানির মনোমুগ্ধকর ও শৈল্পিক নাচ। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সাজিদ। সবুজ, হলুদ, বেগুনি কত রঙে, কত ঢঙে পানিগুলো নাচতে থাকে। মাঝে মাঝে পানির একটা লম্বা সারি প্রায় ৮০ ফুট উপরে চলে যায়, যেন আকাশ ছোবে। দর্শনার্থীদের মধ্যে চাপা রোমাঞ্চ খেলা করে। কেউ হাততালি দেয়, কেউবা বলে ‘ওয়াও’। পরক্ষণেই পানির সেই লম্বাকৃতির সারি বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে লেকে। যেন অনাদরে, অবহেলায়।
পানিগুলো ঢেউ খেলে কী দারুণভাবে। কখনো ডানে, কখনো বামে। ঠিক যেন সাজিদের বুকের ব্যথার মতো। রঙিন পানির নাচনগুলোর ছন্দ আছে, কিন্তুর ব্যথার নেই। বরং তাতে জমা কত কষ্ট, কত হাহাকার। সে এক তীব্র যন্ত্রণাময় হৃদয় খচখচ করা অনুভূতি। আধুনিক যুগের মানুষের সংকীর্ণতা ও মমতাহীনতা সাজিদের বুকে বাজে কাঁসার ঘণ্টার মতো।