ভানুমতির গ্রাম

‘দাদা ভানুমতির গ্রামটা কোনদিকে পড়বে বলতে পারবেন?’

‘ভানুমতির গ্রাম? শুনিনি দাদা। নামটা সঠিক শুনেছেন তো?’

‘হ্যাঁ দাদা…এদিকেই আসেপাশে কোথাও আছে শুনেছি।’

‘তাহলে জানিনা…সামনে জিজ্ঞেস করে দেখুন কেউ জানে কি না!’

‘দাদা ভানুমতির গ্রামটা কোনদিকে পড়বে বলতে পারবেন?’

‘ভানুমতির গ্রাম! এদিকে তো কোনো ভানুমতির গ্রাম নেই।’

অবশেষে গোটা বিশেক মানুষকে এভাবে জিজ্ঞেস করার পর হতাশ হয়ে বসেই পড়লাম খাঁদুর ভারতসেরা চায়ের দোকানে–এমনটাই নাম দেওয়া ছিল দোকানটির। সাথে আমি আর প্লাবন। হঠাৎ করেই এখানেই আসা।

সপ্তাহ তিনেক আগের কথা। বর্ধমান থেকে বাড়ি ফিরছি শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে। দরজার কাছের বার্থেই বসেছিলাম, এমন সময় এক সুন্দর টানটান গলায় এক গান ভেসে এল… সখী দিলাম ষোলোইয়ানা…আ আ…প্রাণ পাখি উড়ে যেতে চায় আর ধৈর্য মানে না…’। আমি উঠে গিয়েই দেখি দরজার কাছে নীল রঙ গায়ে মেখে রাম সেজে পিঠে তীর ধনুক নিয়ে বসে আছে এক মাঝ বয়সি লোক। আপন মনে গান গেয়ে যাচ্ছে। আমি শুনতে থাকি। অবশেষে তার গান থামলে আমি বলি–‘ভীষণ সুন্দর গলা তো আপনার!’ লোকটি একবার পিছনে ঘুরে তাকায় এক মুখ হাসি নিয়ে। ‘কোথা থেকে আসা হয়?’ আমি জিজ্ঞেস করি। ‘আজ্ঞে আমি বীরভূম থেকেই আইছি।’ লোকটি আবার বাইরের দিকে চেয়ে গান করতে শুরু করে। আমিও চুপচাপ শুনতে থাকি। ‘আমি গান শিইখাছিলাম বাদশা বাজিগরের কাছে।’ গান শেষ হতেই নিজেই বলতে থাকে লোকটি। ‘নাম শুনেছেন?’ জিজ্ঞেস করে লোকটি। ‘না। আসলে বাউল ফকিরদের সম্বন্ধে আমার কোনো ধরণা নেই তেমন।’

‘উনি বাউল না। উনি বাজিগর। তবে ভীষণ সুন্দর গানও গায়তে পারতেন। যদিও রুজকার খেল দেখিয়েই করতেন। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তিনি গান করতেন।’

‘বাজিগর?’

‘গ্রামে গ্রামে গিয়ে ভানুমতির খেল দেখাতেন। বড্ড পটু হাত তাঁর।’

‘ওই হাতের খেলা, না?’

‘জাদুর খেলা। বাজির খেলা। বছর পনের আগের পরিচয়। আমাদের গিরামে খিলা দিখাতে আইছিলেন। গুরুর বয়স তখন উনেক। আমি তাঁকে গুরুই বলি। তালে তাল পেয়ে আমিও তাঁর সাথে তাল জুড়ে দিই। ভানুমতির গিরামে থ্যাকতেন। এই ভৌরোপীর সাজ তাঁর কাছ থিকেই শিখা।’

‘ভানুমতির গ্রাম?’ নামটা টোকা দেয় কানের পর্দায়।

‘হ। কোপায় নদীর পাড়ে ছোট্ট একটি গিরাম–যেন সইরগ।’

‘আপনি গেছেন?’

‘হ। একবারই যাইছি গুরুর সাথে। অত সুন্দর গিরাম কুথাও দেখিনি এর আগে। উখানে ঘরে ঘরে জাদু, ঘরে ঘরে জাদুগর।’

‘এখনো আছে গ্রামটি?’

‘তা জানিনে বাপু… ওটি লাভপুর যাওয়ার আগে যে কোপায় নদী তার পাড় বরাবর যাইছিলাম বটে–সে আল পেরিয়ে পেরিয়ে অনেকখানি রাস্তা। গুটা গিরামটাই গাছ দিয়ে ঘিরা–কেউ উর ক্ষতি করতে পারে না।’

‘এখন আর যাওয়া যায়না না? এখন তো আর দেখিও না জাদুখেলা। ছোটো থাকতে দেখেছিলাম বেশ কয়েকবার।’

‘মন সৎ হওয়া চাই, তবে যেয়ে ও গিরাম খুঁজা পাবেন। বাদশাজি বলতেন ও গিরামে কখনো চোর ডাকাত পড়েনা–তারা খুঁজেই পেত না গিরামটা। শুধু মন সৎ হওয়া চায়। উ গিরাম জাদুর গিরাম। অত সহজে ধরা দেবে না আপনাকে।’

ট্রেন ততক্ষণে গুসকরা ঢুকল। ‘চলি বাবু। এ জনমে থাকলে আবার দিখা হবে।’ আমি তার হাতে দশ টাকার একটা নোট তুলে দিই। লোকটি একটি প্রণাম করে টাকাটিকে কোমরের কোঁচরে বেঁধে নেমে যায় স্টেশনে। এগিয়ে যায় ভিক্ষা করতে করতে।

ভানুমতির খেল খুব বেশি একটা দেখিনি বললেই চলে। খুবই কম। গ্রামের দিকে তখন, মনে পড়ে, এক লোক আসত থাল বাজিয়ে–‘ভানুমতির খেল দেখেগা–ভানুমতির খেল দেখেগা’–সাথে দুটো বাচ্চা রঙ-বেরঙের কাপড় পড়ে। বাচ্চাদুটোর হাতে ডুগডুগি–কাঁধে দড়ি আর মাঝারি মাপের তিনটি রিঙ। আর সাথে সাথে জড়ো হয়ে যেত পাড়াময় লোক। আমিও ছুটে যেতাম সে ডাক শুনে। লোকটির কাঁধে বড়ো একটি ঝোলা তা থেকে বেরিয়ে আসে নানা সরঞ্জাম। আমাদের আর উৎসাহের শেষ থাকেনা। সে কী হরেকরকম খেল! কখনো হাতের জিনিস ঝপ করে উধাও তো আবার পলক ফেলতেই চোখের সামনে হাজির–কোমর দুলিয়ে একটার পর একটা রিঙ নাচানো–রিঙের ভিতরেই ভোল খেয়ে যাওয়া–সবই যেন অবাক করা অবিশ্বাস্য কাণ্ড। তবু বিস্ময়ের বাঁধ ভাঙত যখন দেখতাম বাচ্চা মেয়েটি একটা দড়ির উপর দিয়ে কী অপূর্বভাবে সমানতালে হেঁটে যাচ্ছে, আবার বাজিগরটি তার ঝোলা থেকে একটার পর একটা চাকু বের করে সটাসট ছুঁড়ছে গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির দিকে আর কী সুন্দর ভাবে একটার পর একটা চাকু তার পাশে গিয়ে গাঁথছে তাকে এক বিন্দুও আঘাত না করে। সবই নজরকারা সব খেলা। খেলার সাথে সাথে চলত গান বাজিগরের মুখে।

ভাবতেই ভাবতেই একটা চিন্তা খেলে গেল মনে। প্লাবনকে ফোন করলাম। ‘একটা অদ্ভুত গ্রামের সন্ধান পেয়েছি কিন্তু। যাওয়া যাক তাহলে একদিন?’

‘কি গ্রাম?’ প্লাবন জিজ্ঞেস করে।

‘ভানুমতির গ্রাম। একটা শর্ট বানালে কেমন হয়?’

‘দারুণ তো! চল যাওয়া যাক একদিন।’

শেষমেশ দুসপ্তাহ থেকে তিন সপ্তাহ গড়াতে আমরা রওনা দিলাম লাভপুরের দিকে–প্লাবনের গাড়িতে। কিন্তু কেউই আর খোঁজ দিতে পারেনা। কেউই শোনেনি এমন কোনো গ্রামের কথা। জাদু তো আর হয় না এখনকার দিনে।

খাঁদুর ভারতসেরা চায়ের দোকান থেকে উঠতেই দোকানে বসে থাকা এক লোক হাতে চায়ের ভাঁড় নিয়ে বলে–‘আপনারা একবার লাঘাটার দিকে দেখতে পারেন। এক সোজা রাস্তা চলে গিয়েছে ডানদিক বেয়ে।’ অতএব তাই করলাম। লাঘাটার কাছে আসতেই সোজা একটা পাকা রাস্তা চলে গিয়েছে ডানদিকে। গাড়ি ঘোরানো হলো সেদিকে। দুপাশে দোকান আর বসতি। সবুজ মুছে যায়নি এখনো এদিক থেকে। সারি সারি অসংখ্য গাছ এখনো যেন আগলে রেখেছে মানুষকে। কিছুটা এগোতেই একটাতে মাথার মোড়। লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা এক মাঝ বয়সী লোককে জিজ্ঞেস করলাম আবার–‘দাদা, এই ভানুমতির গ্রামটা কোনদিকে পড়বে বলতে পারবেন?’

‘ভানুমতির গ্রাম?’ ওনার যে জানা নেই তা বোঝায় যায় স্পষ্টত তার ভ্রুর ভাঁজে।

‘ওই জাদু খেলা দেখায়–বাজি খেলে।’ আমি বলি।

‘আচ্ছা। একটা গ্রাম আছে। এই ডানদিকের রাস্তা ধরে সোজা চলে যান।’ ডান দিক দিয়ে কেটে যাওয়া এক লালমাটির রাস্তার দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেন। ‘আগে এদিকে বাজিগররা থাকত–খেলা দেখাত –এখন আর কেউ থাকে বলে মনে হয় না। এই মোড়াম রাস্তাটা ধরে সোজা চলে যান।’

‘আচ্ছা। ধন্যবাদ দাদা অসংখ্য।’ বলেই আমরাও এগোলাম সেই দিকে। দুপাশে সারি সারি নাম না জানা অসংখ্য গাছ–মাঝে মাঝেই মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি তালগাছ। কিছুটা এগোতেই এক অর্জুন গাছের জঙ্গল। দূরে চলে গেছে কাটোয়া থেকে আমোদপুর যাওয়ার রেল লাইন। অর্জুনের বন পেরোতেই এক বিশালাকার ধানের মিল–পাশেই তৈরি হচ্ছে আরো এক কারখানা। পুঁজিবাদী দানবের হাত থেকে রক্ষা পায়নি এ গ্রামও–নরম মাটির বুক ফুঁড়ে বেরিয়েছে শক্ত কংক্রিট দেওয়াল। দিগন্ত বিস্তৃত ধানের জমি পেরিয়ে শুরু হয় কাঁচাপাকা মাটির বাড়ি–ফাঁকে ফাঁকেই মাথা উঁচিয়ে দোতলা-তিনতলা কংক্রিট দালান। গ্রাম বলতে আমি যা বুঝেছি–আমি যা দেখেছি–এ তা নয়।

গ্রাম বলতে দেখেছি পুকুরের ধারে বিক্ষিপ্ত বিক্ষিপ্ত মাটির ঘর–খড়ের চাল- যেখানে মানুষের কথা কে ছাপিয়ে উঠত গবাদি পশু ডাক–পাখিদের কলরব। রাত যতটাই গভীর ও নিশ্চুপ, সকাল ততটাই যেন সতেজ, স্বচ্ছল ও স্বতস্ফুর্ত। এখানে সন্ধ্যে নেমে আসে ঝুপ করে, টের পাওয়ার আগেই, আর ভোরের আলো ফোটে প্রভাতের কলতানে। সকাল হতেই উঠোনে উঠোনে কাজ শুরু হয়ে যেত–অথচ কারো যেন কোনো তাড়া নেই, নেই শহুরে দৌড়ঝাঁপ, থাকে শুধু অদ্ভুত এক প্রশান্তি–এক ঘুম ঘুম ভাব। ঘুম ভাঙতেই দাদুদের জমি পেরিয়ে দূরের ধান মিল থেকে ভেসে আসা গন্ধ কপাটে টোকা দিত। আমি আগ্নেয়গিরি দেখিনি, তবে, সেই ধান মিল থেকে বেরোনো আকাসভেদী ধোঁয়া আমার কাছে আগ্নেয়গিরি দেখার উৎসাহের চেয়ে কিছু কম ছিলনা। ঘরের উপরের কোঠা থেকে দেখা যেত দূরে অজয়ের উঁচু বাঁধ–তখন প্রতিবছরই বন্যা হতো–আর ক্ষীণ রেখায় দেখা যেত ইংরেজ আমলের সেই লাল ব্রিজ। তখন একটাই রেল ব্রিজ ছিল অজয় নদীর উপর। মাঝে মাঝে রেল দেখার জন্য চালার উপর চেপে বসে থাকতাম–এক রাশ কালো ধোঁয়ায় আকাশের বুকে দাগ কাটতে কাটতে মন্থর গতিতে এগিয়ে যেত সরু রেখার মতো এক ট্রেন।

মোড়ামের চওড়া রাস্তা শেষ হতেই গাড়ি নেমে পড়ে মেঠো রাস্তায়–দুপাশের সারিসারি ধান ক্ষেত আর পদ্ম ডোবায় এখনো সভ্যতার নজর লাগেনি–প্রকৃতি এখনো তাকে মায়ের আঁচলে বাঁধা ছেড়া টাকার মতই লুকিয়ে রেখেছে সযত্নে। কাঁপতে থাকা পাতার মতো দূরে ভেসে আসে হরিনামের শব্দ। এক শবযাত্রা-শৈশবে দেখা দূরের সেই ট্রেনের মতই এগিয়ে আসে আমাদের দিকে মন্থর গতিতে–যেভাবে মৃত্যু এগিয়ে আসে। নাইটেঙ্গেলের মধুর ডাকে যেমন বিষণ্ণতা লুকিয়ে থাকে, ফুল আর ধুপের সুগন্ধে তেমনই বিষাদ ছড়িয়ে পাশ কাটিয়ে যায় মৃত্যুর মিছিল। গাড়ি এগানোর আর উপায় নেই দেখে আমরা নেমে পড়ি। মৃতের সাথে তার অন্তিম যাত্রায় সাথে যাব কি যাব না এই দ্বন্দ্বে হাঁটতে থাকা সবার পিছু পড়ে যাওয়া লোকটিকে শেষমেশ জিজ্ঞেস করি–‘ভানুমতির গ্রামটা কি এদিকেই?’ লোকটি কিছুক্ষণ নির্লিপ্তভাবে আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে–‘সুজা ওই যে গাছগুলা দিখছেন ওর পিছনেই।’ আরও কিছু একটা বলবে বলেই হয়তো মুখ খুলতেই যাচ্ছিল, কী খেয়াল আসে সে অনেক পিছনে পড়ে গেছে। তাই আর বাক্য ব্যয় না করে সোজা হাঁটা লাগাই শবযাত্রার পিছনে–সজোরে।

লোকটির দেখানো দূরের সেই গাছগুলোর কাছে যেতেই দেখতে পাই ছোট একটা পাড়া–অনেকটাই প্রায় গাছ দিয়ে ঘেরা। ঢোকার মুখেই সারি সারি গাছ মাথার উপর চাঁদোয়া বিছিয়েছে–প্রশস্ত করেছে গ্রামের ফটক স্বাগত জানানোর অভিপ্রায়ে। সামনেই একটি ছোট্ট মাটির দোকান। বসে থাকা লোকটিকে জজ্ঞেস করি–‘এটা কি ভানুমতির গ্রাম?’

‘হাঁ, তবে এটি অনেক পুরানো নাম। এ গিরামটিকে এখন বলে শীতল।’

‘আচ্ছা। এখন নাম বদলে শীতল হয়েছে?’

‘হাঁ। কাউকে খুঁজছেন বুঝি?’

‘হ্যাঁ। ওই জাদুখেলা দেখায়–শুনেছি আপনারা সবাই জাদুখেলা দেখাতে পারেন।’

‘না না।’ লোকটি একটু হেসে বলে–‘উরা বাজিগর–বাজিগররা খেল দেখাতো। তবে এখন আর দেখায় না। এ উদেরই গিরাম ছিল আগে। এখনো আছে উরা–সব একসাথেই থাকে।’

‘আচ্ছা। পাড়ার কোনদিকটাই থাকে ওরা বলতে পারবেন?’

লোকটি সামনে দিয়ে পেরিয়ে যাওয়া একটা ছেলেকে হাঁক দেয় – ‘এ ছটু–এদের নি যা, তদের বাড়ি দেখবে বলচে।’ লোকটি আমাদের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে–‘উদের সাথে যান। উরা বাজিগরদের ছেলে।’

ছেলেটির পিছু পিছু আমরাও এগোতে থাকি। মাটির রাস্তায় তখনো ছিটিয়ে পড়ে সেই শবযাত্রার খই। কিছুদূর এগোতেই কিছু সারি সারি লাগোয়া মাটির ঘর–পিছনেই ধানের ক্ষেত। বোঝায় যায় পাড়ার শেষ প্রান্ত। ছেলেটির ডাকে ঘর থেকে দুই মাঝবয়সি লোক বেরিয়ে আসে–বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে–সাথে সাথে হৈ হৈ করে জুড়ে যায় গোটা পাঁচেক বাচ্চা ছেলেমেয়ে। লোকটি খুব বিনম্রতার সাথেই জিজ্ঞেস করেন–‘আপনারা? কিছু কইছেন?’

‘হ্যাঁ। আপনারাই কি ওই বাজিগর–ভানুমতির খেল দেখান? আমরা কলকাতা থেকে আসছি আপনাদের এই গ্রামের উপর নিরীক্ষণ করতে।’

‘আচ্ছা। হাঁ আমরা সবাই বাজিগর। তবে আমরা আর কেউ উই খেল দিখাই না। আমাদের দাদাঠাকুররা দেখাতেন।’

‘কী নাম আপনার?’

‘আমার নাম সনাতন বাজিগর।’

‘আর দেখান না কেন?’

‘আর কেউ শিখিনি। আমার দাদুরা দেখাতেন। তাদের কাছ থিকে আমার বাপ কাকারাও খুব একটা শিখেনি তো আমরাই বা কি করে শিখব? আমারা কেউ শিখিনি–আমাদের ছিলারাও কেউ শিখেনি। একমাত্র আমার জেঠাই শিখেছিলেন। উর খুব নামডাকও ছিল। খেল দেখিই বেরাত। বাদশা বাজিগর।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, উনি এখনো খেলা দেখান?’

‘না। জিঠা মারা গিছে তিন মাস হলো।’

‘যাহ্‌। আপনারা কেউই আর খেলা জানেন না? কেউই না? একজনও না? কিন্তু আপনাদের নাম তো এখনো বাজিগর।’

‘না। খিলা দিখিয়ে আর পয়সা হতো না–আমাদের কেউ কেউ এখন ভিক্ষে করে ভৈরুপী সেজে নানা জাগায়। আমি আর ভাই ভাগের জমি চাষ করি। আর ছিলারা তো কেউ থাকেই না ইখানে। সব চিন্নাই গিছে লেবার খাটতে, সেই পুজোর সুময় আসবে। বাদশা জিঠাই শেষ লোক ছিলেন খিলা জানতেন।’

‘খেলার সরঞ্জামগুলো দেখানো যেতে পারে?’

‘সেসবও আর কিচ্ছু নেই। জিঠা আরবার বিছানায় পড়লে খেল দিখানোর কাঁসা পেতলের জিনিসগুলা বিচে দেইচি। বাকি কিছু হারিই গেছে।’

‘আর কোনো চিহ্নই নেই তারমানে?’

‘না। বাদশা জিঠাই শেষলোক ছিলেন।’

গ্রাম থেকে বেরোনোর পথে তখনও মাটিতে পড়ে থাকা খইগুলো ধুলো মাখছিল–মিশে যাচ্ছিল ধুলোর সাথে–যেভাবে মেশে নামের পর নাম, গ্রামের পর গ্রাম আর শত পরিচয়। ভানুমতির খেল নামটিও হয়তো মুছে যাবে একদিন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত