মোহ শব্দটির সঙ্গে একটা নেতিবাচক অনুভূতি জড়িয়ে আছে। মোহ মানেই ক্ষণস্থায়ী কিছু একটা, ক্ষতিকর এবং অগভীর কিছু- এ রকমই মনে হয় আমাদের। হয়তো সে জন্যই মোহমুক্তিকে ইতিবাচক এবং আনন্দময় ঘটনা হিসেবে দেখা হয়। অবশ্য সব সময় ব্যাপারটা নেতিবাচক নাও হতে পারে। মোহ থেকেও জন্ম নিতে পারে গভীর ভালোবাসা, অতল প্রেম।
এক বন্ধুর কথা বলি। অনেক দিন আগের কথা। আমরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ূয়া তরুণ তুর্কির দল। প্রবল উচ্ছ্বাসে উড়ে বেড়াই, ঘুরে বেড়াই। তো, আমার বন্ধুটি প্রায়ই এসে একেকজন তরুণীর রূপ-গুণ বর্ণনা করতে থাকে এবং ঘোষণা দেয়, সে মেয়েটির প্রেমে পড়েছে। আমরা হেসে উড়িয়ে দিই, কখনো-কখনো আমার সঙ্গে তুমুল তর্কও লেগে যায়। আমি বলি, এগুলো তোর প্রেম নয়, মোহ। ক্ষণস্থায়ী মোহ। দু’দিনেই কেটে যাবে। সে স্বীকার করে না, প্রেম হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে। তবে দু’দিন পর না হলেও দু-সপ্তাহ বা দু-মাস পর যখন আরেকটি মেয়ের কথা শোনা যায় তার মুখে, তখন বুঝতে বাকি থাকে না- ওটা মোহই ছিল; প্রেম নয়। মোহ দ্রুত কেটে যায়, এটাই মোহর বৈশিষ্ট্য। অবশ্য প্রেমেরও মৃত্যু ঘটে, অহরহই ঘটে, তবে এত দ্রুত নয়। মোহের অবসান কোনো ক্ষত রেখে যায় না হৃদয়ে, বরং মোহমুক্তি যেন বন্দিদশা থেকে মুক্তির আনন্দ দেয়। কিন্তু প্রেমের মৃত্যু দীর্ঘস্থায়ী, এমনকি, কখনো-কখনো চিরকালীন ক্ষত রেখে যায়। তো, আমার বন্ধুটির গল্প এখনো শেষ হয়নি। অনেক মেয়ের নাম-পরিচয় ওর মুখে শুনতে শুনতে বিশেষ একজনের নামও শুনেছিলাম আমরা, এবং যথারীতি ধরেই নিয়েছিলাম- এও দুদিনের মোহ। যথাসময়ে কেটে যাবে। কিন্তু আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, এই ‘মোহ’ কাটছে না। তাহলে কি এটা প্রেমের দিকে টার্ন নিল? ব্যাপারটা আমাদের ভাবিয়ে তুললো একদিনের এক ঘটনায়। চারুকলার সামনে দাঁড়িয়ে-বসে আড্ডা দিচ্ছি বন্ধুরা। তখন ঢাকা শহর এত ব্যস্ত ছিল না, গাড়ির সংখ্যা ছিল খুবই কম, ক্যাম্পাসে গাড়ি প্রায় ঢুকতোই না, রিকশাই ছিল প্রধান বাহন। তো আমাদের সামনে দিয়েই অনেক রিকশা যাচ্ছে-আসছে, ওদিকে আমাদের মনোযোগই নেই। আমরা তো নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, আড্ডায় মশগুল। হঠাৎ করে আমার সেই বন্ধুটি বলে উঠলো :
এই দেখেছিস, নাহার (ছদ্মনাম) গেল।
কোথায় গেল, কখন গেল?
ওই তো, ওই রিকশায়।
রিকশার হুড তো ওঠানো। তুই দেখলি কীভাবে?
পা দেখেছি।
কী দেখেছিস?
পা। ওর পা দেখে চিনেছি। স্যান্ডেলটাও চেনা।
চাপা ছাড়িস না। তুই পা দেখে মানুষ চিনতে পারিস?
সবাইকে পারি না। ওকে পারি। ওর সবকিছু আমার মুখস্থ।
কৌতুককর মনে হলেও ব্যাপারটা আমরা সিরিয়াসলি নিলাম। আরো দুটো রিকশা নিয়ে পিছু নিলাম আগের রিকশাটির। এবং অবাক ব্যাপার, রিকশাটি গিয়ে থামলো কার্জন হলে, এবং সেখান থেকে নেমে দাঁড়ালো নাহার। আমরাও একটু পরই পৌঁছে গেলাম সেখানে। নাহারের সঙ্গে কথা বললাম, আমরা যে চারুকলার সামনে আড্ডা দিচ্ছিলাম, ও সেটা দেখেছে কি-না জিজ্ঞেস করলাম। না দেখেনি ও। ওদিক দিয়েই এসেছে, কিন্তু আমাদেরকে দেখতে পায়নি। ও আমাদের দেখেনি, আমরাও দেখিনি ওকে, কিন্তু যে দেখার সে ঠিকই দেখেছে।
আমরা আর ব্যাপারটা নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করলাম না বন্ধুটির সঙ্গে। এ যে নিছক মোহ নয়, আরো বেশি কিছু, এটুকু না বোঝার মতো বোকা ছিলাম না আমরা। ধীরে ধীরে সেটি যে গভীর প্রেমের দিকে ছুটে চলেছে, তাও আন্দাজ করতে পারছিলাম। আরেকটি ঘটনায় সেটি খুব ভালোভাবে বোঝা গেল। আমার সেই বন্ধুটি কবিতা লিখতো। শখ করে লেখা নয়, ঘোরগ্রস্ত লেখা। তো, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রায় শেষদিকে একটা বই বের করার পরিকল্পনা করলো ও। আমরা সবাই আনন্দিত। উৎসাহে কমতি নেই আমাদের। একজন প্রকাশকের সঙ্গে কথা বললাম, তিনিও শর্ত সাপেক্ষে রাজি হলেন। আমরা তখন উত্তেজনায় কাঁপছি। আমাদের কোনো বন্ধুর প্রথম বই বেরুচ্ছে, দুশো বই বিক্রি করা কোনো ব্যাপার নাকি? কিন্তু সব তো হলো, বইয়ের নাম কী হবে? বন্ধুটি শর্ত দিলো- বইটির নামের মধ্যে ওই মেয়েটির নাম থাকতে হবে! মহা ঝামেলা। কারো নামের সঙ্গে মিলিয়ে কবিতার বইয়ের নামকরণ করা যায় নাকি? তাও আবার মেয়েটির নাম দুটো আরবি শব্দের সমন্বয়ে গড়া! কিন্তু বন্ধুটি নাছোড়বান্দা। ওর নাম না থাকলে বই-ই বের হবে না! অতঃপর বাধ্য হয়েই মেয়েটির কাছে যেতে হলো, জেনে নিতে হলো ওর নামের অর্থ। অবশ্য আমাদের আসল উদ্দেশ্য আমরা বললাম না তাকে। মেয়েটি সরল বিশ্বাসে, হাসিমুখে, নিজের নামের অর্থ জানালো আমাদের। তারপর অনেক ভেবেচিন্তে ওর নামের বাংলা অর্থের সঙ্গে মিলিয়ে কবিতার বইয়ের নামকরণ করা হলো।
সেটিই ছিল আমার বন্ধুটির প্রথম বই এবং শেষ বইও বটে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, আমার বন্ধুটি কখনোই সরাসরি তার প্রেমের কথা বলেনি মেয়েটিকে। ওকে নিয়ে কবিতা লিখেছে, ওর নামে রেখেছে প্রথম কবিতা-বইয়ের নাম, ওকে আপাদমস্তক মুখস্থ করেছে; ওর প্রতিটি মুখভঙ্গি, ওর সশব্দ এবং নিঃশব্দ হাসি, ওর হাঁটা-চলা-ফেরা- সবকিছুই গভীরভাবে চিনে নিয়েছিল সে, তবু বলেনি। আমরা অনেকবার চেষ্টা করেছি ওদেরকে মিলিয়ে দিতে, কিন্তু কিছুতেই ওকে দিয়ে প্রেমের কথা বলানো যায়নি। মেয়েটি সবই জানতো। আমরাই জানিয়েছি। অথচ সে-ও উদ্যোগী হয়ে কিছু জানতে চায়নি আমার বন্ধুটির কাছে। এর অনেকদিন পর যখন জেনেছিলাম, মেয়েটি আরেকটি ছেলের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েছে, আমরা বেশ দুঃখ পেয়েছিলাম। ওদের এই অদ্ভুত প্রেমের মৃত্যু ঘটে তখনই। আমার বন্ধুটি দেশ ছেড়ে চলে যায় সারাজীবনের জন্য। গত কুড়ি বছরে বন্ধুটি মাত্র একবার এসেছিল দেশে, বেড়াতে। তখনও ওর কাছে মেয়েটির কথা শুনেছি। ওদের প্রেম হয়নি, বন্ধুটির প্রেম ছিল নিতান্তই একতরফা, অথচ তার ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে সে জীবনভর।
কে বলেছে মোহ থেকে প্রেম হয় না?
অবশ্য মোহ ব্যাপারটা শুধু প্রেমের সঙ্গেই সম্পর্কিত নয়। কত রকম মোহ থাকে মানুষের! অর্থ-সম্পদের মোহ, খ্যাতির মোহ, ক্ষমতার মোহ, রূপ ও সৌন্দর্যের মোহ। এর মধ্যে সবচেয়ে আগ্রাসী, সম্ভবত, রূপের মোহ আর টাকার মোহ। একবার যদি কেউ টাকার মোহে পড়ে, সেখান থেকে আর বেরুতেই পারে না। আমাদের দেশে এমন অনেক সম্পদশালী মানুষ আছেন, যাদের টাকার কোনো হিসাব-নিকাশ নেই। তবু তাদের আরো চাই, আরো চাই, চাওয়ার আর শেষ নেই তাদের। এবং এর জন্য করতে পারেন না এমন কোনো কাজও নেই। চুরি-ডাকাতি থেকে শুরু করে খুন পর্যন্ত করতে পারেন তারা! কী ভয়াবহ ব্যাপার, ভেবে দেখুন। শুধু টাকা বা ধন-সম্পদের মোহে নয়, খ্যাতির মোহেও অনেক অনৈতিক কাজ করে মানুষ। সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে ল্যাং মারে, লাথি মারে, কনুইয়ের গুঁতো মারে, আরো কত কিছু যে করে তারা! ক্ষমতার মোহও মারাত্মক। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিদ্যমান বিরোধ-বিসংবাদ, হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি-কাড়াকাড়ি দেখেই বোঝা যায়, ক্ষমতার মোহ কত নগ্নরূপ ধারণ করতে পারে! এদের কাজকর্মের মধ্যে মানুষের জন্য কল্যাণচিন্তা নেই, আছে ক্ষমতা ভোগ করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা। আবার কিছু মানুষ আছেন, যারা রূপের মোহে ঘুরপাক খেতে খেতেই জীবন পার করে দেন।
মোহই; প্রেম নয়। আর সে জন্যই, যে রূপসীকে স্বর্ণখ ভেবে পাওয়ার জন্য জীবনপণ করছেন তিনি, তাকেই একবার পাওয়ার পর ‘নিতান্ত মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর।’ যদি মোহ না হয়ে প্রেম হতো, তাহলে শতবার পাওয়ার পরও তাকে স্বর্ণখ ই মনে হতো, মাটির মনে হতো না। কিন্তু হায়! রূপসীরাও প্রেমিকের চেয়ে বেশি ভালোবাসে স্তাবকদের, ক্ষণস্থায়ী মোহগ্রস্তদের!
এদের বাইরে আবার এমন কিছু মানুষ আছেন যারা নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মোহে ডুবে থাকেন। অবশ্য ওটা মোহ নাকি প্রেম, আমি ঠিক নিশ্চিত হতে পারিনি। এ রকম একজন মানুষের গল্প বলি। তার নাম ইমরান। কুয়াকাকাটার সমুদ্রসৈকতে তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আমাদের। মোটরসাইকেলে চড়িয়ে পর্যটকদের সৈকত দেখান ইমরান, আর অদ্ভুত এক ভাষায় গল্প করেন- নদী ও সমুদ্রের গল্প, বনভূমির গল্প, সৈকত আর সমুদ্রপাড়ের মানুষদের গল্প। এই তার পেশা। সাগরপাড়ের মানুষ তিনি, তার সবকিছুতেই মিশে আছে সমুদ্র, সৈকত আর বনভূমির জন্য অপার ভালোবাসা। নদী, সাগর, গাছপালা কিংবা মানুষ- সবকিছুকেই তিনি সম্মানসূচক ‘আপনি’ সম্বোধন করেন।
ইমরানের সঙ্গে পরিচয় ছিল না আমাদের, থাকার কথাও নয়। আমরা তিন বন্ধু সপরিবারে গিয়েছি ওখানে, সঙ্গে স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা, ফলে কেবল বন্ধুরা মিলে দুরন্তপনার সুযোগ নেই। সমুদ্রতীরে গোমড়ামুখে বসে ছিলাম; লঞ্চে উঠে কোথাও যাবো-কি-যাবো না এই দোলাচলে দুলতে দুলতে। তখনই ইমরান এলেন। আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে প্রস্তাব দিলেন, মোটরবাইকে চড়িয়ে তিনি এবং তার বন্ধুরা আমাদেরকে পুরো সমুদ্রসৈকত ঘুরিয়ে আনতে চান। এ-বেলায় লাল কাঁকড়ার চর, শুঁটকি পল্লী, লেবুর বন, আন্ধারমানিক নদীর মোহনা, ফাতরার চরের এপার এবং সুন্দরবনের কিছু অংশ। আর বিকেলে গঙ্গামতির চরে যাওয়ার পথে ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের কিছু অংশ, তারপর সুন্দরবনের ভেতরে ঢুকে যাওয়া ক্যানেল পার হয়ে গঙ্গামতির চরে গিয়ে সূর্যাস্ত দর্শন, তারপর সেখান থেকে বৌদ্ধ মন্দির আর রাখাইন পল্লী। সিদ্ধান্ত নিতে সংশয় জাগলো না। যে রকম লোভনীয় ভঙ্গিতে তিনি উপস্থাপন করলেন ভ্রমণ-পরিকল্পনা, তার সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোটা যে আনন্দদায়ক হবে, তাতে আর সন্দেহ কী?
যেমনটি ভেবেছিলাম, সত্যিই তাই হলো। সদা হাস্যমুখর, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর, অসাধারণ বর্ণনাভঙ্গি যা প্রায়ই কবিতার কাছ ঘেঁষে যায়, ছবি তোলায় দারুণ পটু, খোলামেলা মনের এক দারুণ যুবক ইমরান। আমাদের যে বয়স হয়ে যাচ্ছে, সে-কথা তিনি ভুলিয়েই দিলেন। নানা ভঙ্গিতে ছবি তুললেন, এমনকি তিন বন্ধুকে লাফ দিতে বললেন আমাদের উড়ন্ত ভঙ্গির ছবি তুলবেন বলে। এবং কী আশ্চর্য, আমরা সেটি করলামও! কে বলবে যে আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এত ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে চলি! ইমরান শুধু নিজেই হাস্যোজ্জ্বল নন, তার সঙ্গের সবাইকে তিনি সেই আনন্দমুখরতা উপহার দেন।
ঘুরতে ঘুরতে একসময় তিনি বললেন- ওই যে দেখছেন স্যার, ওটা হলো মোহনা। আন্ধারমানিক নদীর মোহনা। আসার পথে একটা বড় নদী দেখেছেন না? তিনিই এখানে এসে মিশেছেন সাগরের সাথে। যদি সন্ধ্যার পর এখানে আসতেন, দেখতে পেতেন- অন্ধকারে এখানে মানিক জ্বলে।
ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম- মানিক জ্বলে মানে কী?
মানে… মানে হলো, জোনাক জ্বলে।
কিন্তু নিজের শব্দচয়নে নিজেই সন্তুষ্ট হলেন না তিনি- মানিক আর জোনাক নিশ্চয়ই এক জিনিস নয়! জোনাক তো পোকা মাত্র! মানিকও কি তাই? না, তা নয়। বুঝিয়ে বললেন তিনি- আঙুল তুলে দেখিয়ে জানালেন, যেখানে এসে নদীটা সাগরে মিশেছে, তার আশেপাশে ছোট ছোট ঢেউ ওঠে। তার ফলে ফেনা তৈরি হয়, একটু অন্য ধরনের ফেনা, অনেকটা বুদবুদের মতো, অন্ধকারে এই ফেনাগুলোই ঝিকিমিকি জ্বলে।
কি জানি! হয়তো সত্যিই আলো জ্বলে এখানে, অজস্র বাতির মতো। কেন জ্বলে, কে জানে!
ইমরানের বর্ণনাগুলো ও রকমই। যেমন, বিকেলে, সৈকত ধরে গঙ্গামতির চরে যেতে যেতে, সাগরের পাড় ঘেঁষে এক জায়গায় অনেকটি গাছের গোড়া দেখিয়ে বললেন- এইখানে উনারা ছিলেন!
উনারা! কাদের কথা বলছেন?
গাছেরা ছিলেন!
ও! কী হলো ওদের?
সিডর ঝড় এসে ভেঙে দিয়ে গেছেন। দ্যাখেন স্যার, সাগরের পানি এসে আছড়ে পড়ছে উনাদের গায়ে, উনারা ক্ষয়ে যাচ্ছেন!
আবার সুন্দরবনের পূর্বাংশ পার হয়ে যখন যাচ্ছি, ইমরান খুব যত্ন করে গাছের শিকড়গুলো দেখালেন, বোঝালেন কেন এগুলোকে ম্যানগ্রোভ বলা হয়। তারপর আরেকটু এগিয়ে বললেন- এটা কিন্তু রূপালি দ্বীপ।
রূপালি দ্বীপ মানে?
মানে, ভাসমান দ্বীপ। অস্থায়ী। জোয়ারে ডুবে যায়, ভাটায় জেগে ওঠে।
কই! দেখে তো তা মনে হচ্ছে না!
মনে হবে না তো, স্যার! এখন তো অন্য ব্যাপার ঘটে গেছে।
কী রকম?
এই যে খালের মতো দেখছেন, এটা কিন্তু সাগর ছিল। জেলেরা এখানে বাঁধ দিয়েছিলেন পানি আটকে নদী তৈরি করবেন বলে। বাঁধ দেখে সাগর ফিরে গেলেন, উপহার দিয়ে গেলেন এই দ্বীপ। এটা এখন আর জোয়ারে ডোবে না।
এইসব অদ্ভুত কথাবার্তা শুনতে শুনতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো যখন, ইমরানের কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে এলো এক অদ্ভুত বাক্য- অন্যরকম লাগছে না, স্যার? ওই যে সকালে ওদিকে গেলাম, সেটা একরকম; এখন এদিকে এলাম, এটা অন্যরকম। একেক জায়গার ‘রচনা’ একেক রকম, তাই না?
‘রচনা’ শব্দটি কানে এবং বুকে গিয়ে বাজলো। হ্যাঁ, তা তো বটেই। জগতের একেক জায়গার ‘রচনা’ একেক রকম। প্রকৃতি বড়ো যত্ন করে ‘রচনা’ করেছে এইসব, সবকিছু। সত্যি বলতে কি, এইসব ‘রচনা’ দেখবার জন্যও চোখ লাগে। ইমরানের মতো চোখ, যে চোখের দৃষ্টি তৈরি হয় হৃদয় দিয়ে।
ইমরানের মতো মানুষদের সঙ্গে বারবার দেখা হয়ে যায় আমার, তাদের সান্নিধ্যে প্রীতি ও মমতায় ভরে ওঠে মন, হিংসা-বিদ্বেষ-ঘৃণা-ক্রোধ দূর হয়ে যায়। মনে হয়, জীবনকে আরেকবার নতুন করে ফিরে দেখা যায়, প্রেম ও মমতা নিয়ে, প্রীতি ও ভালোবাসা নিয়ে। মনে হয়, হাজারটা সংকট এলেও এই দেশ কিছুতেই পরাজিত হবে না। পুরো দেশটিই যেন এক মোহনা, যার আনাচে-কানাচে জ্বলছে অজস্র মানিক, মানুষের রূপ নিয়ে।
ইমরান কি মোহগ্রস্ত মানুষ? নাকি ঘোরগ্রস্ত? নাকি প্রেমিক সে এই দেশের?