যাবে যদি লেংটার মেলায়

প্রতি বছরের চৈত্র মাসের সতেরো তারিখে কুমিল্লার বেলতলী এলাকায় লেংটার মেলা বসে। পর্ব চলে সাতদিন। আমাকে খবরটা জানিয়েছিলেন প্রতিবেশী দুলাল ভাণ্ডারী। তার আমন্ত্রণ পেয়ে গত বছর গিয়েছিলাম লেংটার মেলায়। সেখানে যাওয়ার পথে তিনি শুনিয়েছিলেন, লেংটা বাবা সোলেমান শাহের গলায় একখানা গামছা ছাড়া জীবনে দেহে কোনো কাপড়ই চড়াননি। সে জন্যেই তার নামের আগে লেংটা শব্দটা বসানো হয়েছে। তবে তিনি বড় ফকির ছিলেন।

মেলায় ভিতরের চিত্রটা আমার চোখে স্পষ্ট হয়েছিল। চৈত্র মাসের সতেরো তারিখে সোলেমান শাহের জন্মদিন উপলক্ষে বিস্তীর্ণ জায়গাজুড়ে মেলা বসে। তার মাজারের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু চেয়ে নেওয়ার মানসে লাখো লোকের সমাগম ঘটে। হরেক জিনিসপত্র বিক্রির দোকান বসে। তা ছাড়া কোথাও কোনো মানা না থাকায় গঞ্জিকাসেবীরা বাঁধে ছোট ছোট অনেক ডেরা। আছে গানের আসর। চলে জুয়াও। ভণ্ড ফকিরের গতায়তও নজর করা যায়। হঠাৎ হঠাৎ বেশ্যা এবং হিজড়াদের গতিবিধি চোখে পড়ে। প্রথমবারে দুলাল ভাণ্ডারী আস্তানায় ঠাঁই নেওয়ার পর বছর পঁচিশেক বয়সের মহিলা রোকেয়ার সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। আলাপের এক পর্যায়ে জানতে চেয়েছিলাম, মেলায় কেন এলেন?

তার জবাব ছিল, মনের মানুষ খুঁজে পেতে।

লেংটার মেলায় আগতদের প্রায় সবাই সাধারণ মানুষ। শিক্ষিত এবং ভদ্রগোছের লোকজনের চলাফেরা সীমিত। সেই বিচারে রোকেয়া যথেষ্ট পরিশীলিতা। কথায় কথায় তিনি জানিয়েছিলেন, লঞ্চডুবিতে স্বামীকে হারাবার পর দুই দেবরের নিষ্ঠুরতায় এখন পিত্রালয়ে থাকছেন।

রোকেয়ার জীবনে ঘটে যাওয়া ওই দুর্ঘটনায় সমবেদনা বোধ করলেও অবাক মেনেছি তার মুখে মনের মানুষ খুঁজতে আসার কথা শুনে। এই সাক্ষাৎকার স্থায়ী হয়নি। কেননা, তিনি হঠাৎ করেই দুলাল ভাণ্ডারীর আসর ছেড়ে মিলিয়ে গিয়েছিলেন ভিড়ে।

পরের বছর চৈত্র মাসের সতেরো তারিখের বিকেলে অফিসে বসে ভাবলাম, যাই লেংটার মেলায়। সেখানে গিয়ে রোকেয়ার সাক্ষাৎ পেলে জীবনের অন্যরকম কিছু কথোপকথন জমানো যাবে। সময় বুঝে সেদিকে পা বাড়াবার মুহূর্তে এলো বন্ধু সেলিম খানের ফোন। সে বলল, চেয়ারেই থাকো। তোমার সঙ্গে জরুরি আলাপ আছে। আমি এক্ষুনি আসছি।

সেলিম খান আমার কলেজ জীবনের সহপাঠী। পরে কর্মজীবনে প্রবেশ করলেও ঘনিষ্ঠতা বর্তমানেও আছে। জানতাম, কিছুদিন থেকে দাম্পত্য কলহের বোঝা টানতে হচ্ছে তাকে। তবে স্বামী-স্ত্রীর ওই বিবাদের কারণ আমার কাছে স্পষ্ট নয়। ঠিক যে, তার কণ্ঠস্বরে উদ্বেগ ছিল। তাই চিন্তা হলো, সে নিশ্চয়ই সেই কলহের জেরে এখনও ফুড়ছে।

হ্যাঁ, তা-ই দাঁড়াল অবশেষের ফলাফল। কেননা, সেলিম খান এসেই প্রশ্ন করল, চৌধুরী, তুমি কি আমার ছেলেটাকে এনে দিতে পারো?

বললাম, সে কী কথা! তোমার ছেলেকে কে আটকে রেখেছে যে, আমাকে যেতে হবে তাকে আনতে?

ছেলেটাকে আটকে রেখেছে আমার বউ। তাই বাসায় গেলেও ছেলেটাকে সামনে পাওয়ার উপায় নেই।

কেন এই নিষেধ?

আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বউ। তা-ই যদি হয়, তাহলে তো আইন অনুযায়ী ছেলে ছোট হওয়ায় থাকবে মায়ের কাছে।

তোমাদের এই বিবাদ কি মেটার মতো নয় সেলিম?

না চৌধুরী।

ভাবলাম, এসব নিয়ে ফের কোনো প্রশ্ন না তুলে সেলিমকে নিয়ে লেংটার মেলায় গেলে বুঝি কিছুক্ষণের জন্য তার অন্তরের যাতনা ভুলিয়ে রাখা সম্ভব। আহ্বান জানাই, যাবে যদি লেংটার মেলায়, চলো তবে।

সেখানে কি লেংটা মানুষজন আসে?

ধ্যাৎ, তা নয়। আসল ব্যাপার হচ্ছে, পরিধান বলতে লেংটা ফকির সোলেমান শাহ গলায় একখানা গামছা ছাড়া কোনো কাপড়ই রাখতেন না। সে জন্যই তার নামের আগে লেংটা শব্দটা যোগ হয়েছে। সেই কারণেই লেংটার মেলা নাম হয়েছে।

শোনো চৌধুরী, আমি কখনও কোনো মেলায় যাইনি। ইচ্ছা যদি, নিয়ে চলো তবে আমাকে।

পথে নেমে সেলিম খান বলল, গাড়ি নিয়ে এসেছি। চলো তাতে চড়েই লেংটার মেলায় যাই।

জবাব দিলাম, গাড়ি নিয়ে মেঘনা ঘাট পর্যন্ত যাওয়া যাবে। ওখান থেকে ট্রলারে করে পৌঁছতে হবে লেংটার মেলায়।

সমস্যা নেই। ড্রাইভার আছে সঙ্গে। সে আমাদের মেঘনা ঘাটে নামিয়ে দেবে।

গাড়িতে চড়ে সেলিম খান একটা কথাও তুলল না। মেঘনা ঘাটে পৌঁছে ভাড়ায় নেওয়া ট্রলারে উঠে বসলাম আমরা। এরই মধ্যে নেমে আসা সন্ধ্যার অন্ধকারে ঢাকা পড়েছে চরাচর। সেলিম খান বলল, যাচ্ছি যে, সারাক্ষণই শুধু ছেলের মুখ মনে ভাসছে।

তাকে কোনো সান্ত্বনা বাক্য শোনাতে যাই না। বিবেচনা হয়, ব্যর্থতা আর উদ্বেগ বাড়বে। নদী পাড়ি দেওয়ার পুরো সময়টা নীরবতা পালন করি। খেয়াল করি, সেলিম খান ট্রলারের পাটাতনে গা ছেড়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। গন্তব্যে পৌঁছে তাকে জাগিয়ে ঢুকি লেংটার মেলায়। মেলা প্রাঙ্গণের চারদিকে জ্বলছে জেনারেটরচালিত বিদ্যুতের আলো। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই সুযোগ না থাকায় হ্যাজাক, হারিকেন এবং মোমবাতিকে করা হয়েছে অন্ধকার তাড়াবার মাধ্যম। ভিড় ঠেলে চলতে গিয়ে হাঁসফাঁস গলায় সেলিম খান বলে উঠল, লোকজনের ঠেলাঠেলিতে যে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে চৌধুরী।

জবাব দিলাম, মেলা মানেই ভিড়ভাট্টা আর হট্টগোল। তবে একটু সামনে গেলেই স্বস্তিতে বসার জায়গা পাব।

খানিক খোঁজাখুঁজি করতেই পেয়ে গেলাম মাথার ওপর ত্রিপল টানানো দুলাল ভাণ্ডারীর আস্তানা। ওখানে পৌঁছামাত্র তিনি উঠে এসে আমাদের সাদর জানিয়ে বসালেন তার দু’পাশে। বললেন, রাতে খিচুড়ি রান্না হবে। আপনারা খাওয়া-দাওয়া করবেন এখানেই।

জবাব দিলাম, দুলাল ভাই, গ্রহণ করলাম আপনার আমন্ত্রণ।

আসরে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইছিল এক অচেনা গায়ক। সে গাইছে, ‘আইছি লেংটা, যামু লেংটা, মাঝখানে ক্যান গণ্ডগোল…!’

সেই গান শুনে কয়েকজন বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ নাচতে নাচতে জোর গলায় হাঁক জুড়ল, ‘দোহাই বাবা, লেংটা বাবা…!’

দুলাল ভাণ্ডারীর আস্তানায় ঢুকে গা ছাড়ার সুযোগ সত্ত্বেও সেলিম খান স্থির হতে পারল না। সে বলল, চৌধুরী, এসেছি যখন, তখন চলো ভিড় ঠেলে হলেও মেলাটা ঘুরে আসি।

তার ইচ্ছায় নিজেরও সম্মতি মিলল। মন বলছিল, এদিক-ওদিক ঘুরতে নেমে রোকেয়ার সাক্ষাৎ মিলতেও পারে। জায়গায় জায়গায় মাইক লাগিয়ে গান বাজানো হচ্ছে। তাতে কানের স্বস্তি ফুরোতেই বাধ্য। পথে নেমে এগিয়ে চলার এক পর্যায়ে সেলিম খান প্রশ্ন করল, আচ্ছা চৌধুরী, লেংটা বাবার দরবারে মানত করলে কি তা পাওয়া সম্ভব?

আমি শুনেছি, কোনো মৃত লোক জীবিতকে কিছু দেওয়ার সাধ্য ধরেন না। কী জানি! কিন্তু সেই কথা তুললে তার ইচ্ছায় আঁচড় কাটা হবে ভেবে জবাব দিলাম, বাবার মাজারে গিয়ে কিছু চাওয়ার থাকলে চাইতেই পার তুমি।

চলো তো, আমাকে মাজারে নিয়ে চলো।

মাজার প্রাঙ্গণে পৌঁছার পর সেখানকার এক দোকান থেকে আগরবাতি, মোমবাতি আর গোলাপজল কিনল সেলিম খান। সেগুলো নিয়ে খাদেমের হাতে তুলে দিয়ে সে লালসালু কাপড়ে আবৃত সোলেমান শাহের মাজারের সামনে দাঁড়িয়ে কী চাইল- সেই প্রশ্ন করা থেকে বিরত রইলাম আমি। সেখান থেকে বেরিয়ে সে বলল, এসো, ঘুরে দেখি মেলাটা।

তারপর মাজার প্রাঙ্গণ পেরিয়ে যেদিকে দু’চোখ ধায়ের মতো করেই এগিয়ে যাচ্ছিল সেলিম খান। আমি তার সঙ্গী। পা বাড়াবার পাশাপাশি এদিক-ওদিক তাকিয়ে রোকেয়াকে খুঁজে ফিরি। মাজারের চারদিকজুড়ে গৃহস্থের বসতভিটা। সেসব বাড়িঘরের বারান্দা-উঠানেও জমেছে দলের পর দল। এলাকার কিছু জমিজমা আর পুকুর পাড়ের অবস্থাও তথৈবচ। চলতে চলতে আমরা একটা কবরস্থান ডিঙোবার সময় কানে এলো মেয়েমানুষের গুঙিয়ে ওঠার আওয়াজ। সঙ্গে প্রবল হট্টগোল। সঙ্গী প্রশ্ন তুলল, কী ব্যাপার চৌধুরী, কী হচ্ছে ওখানে?

ঘটনাস্থলে পৌঁছতেই স্পষ্ট হলো বিষয়টা। কয়েকজন পুরুষের কবলে হেস্তনেস্ত হওয়া এক নারীর চিৎকারই আমরা শুনেছিলাম। সবার মাঝে ঢুকে মেয়েটিকে ছিনিয়ে আনল সেলিম। তাকে নিয়ে আমরা ঢুকলাম মিষ্টির দোকানে। বয়কে দই আর রসগোল্লা দেওয়ার অর্ডার দিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সেলিম খান জিজ্ঞেস করল, কী নাম তোমার?

ছায়রা।

বাড়ি কোথায়?

দৌলতদিয়া ঘাটের মাইয়া আমি।

জানি সেখানে একটি পতিতালয় আছে। ধরে নিই, মেয়েটি বেশি পয়সা কামাতে এখানে এসেছে। সুযোগ বুঝে ঝোপ-জঙ্গলের আড়ালে একদঙ্গল পুরুষের টানাটানি শুরু হয়।

ছায়রা প্রশ্ন করে, আপনেরা দুইজনে কী দোস্ত?

সেলিম মাথা নেড়ে সায় জানায়, ঠিক ধরেছ।

আপনেরা যদি সময়মতোন ওইদিকে না যাইতেন, তাইলে হকুনের পালে আমারে ছিঁড়া খাইত।

ছায়রার ডান হাত নিজের মুঠোয় তুলে নিয়ে সেলিম খান প্রশ্ন করে, তুমি আমার বন্ধু হবে?

মেলার আলো-ছায়াতে মেয়েটির চোখে-মুখে চিন্তার নানা আঁকিবুঁকি খেয়াল করে আসছিলাম। আমাদের সাহচর্যে তা ধুয়ে-মুছে যাচ্ছিল। তবে সেলিম খানের অমন জিজ্ঞাসায় ছায়রা খিলখিলিয়ে হাসে, ওমা, আমি কেডা যে, আপনের বন্ধু হইতে যাই?

মিষ্টির দোকান থেকে বেরিয়ে ফের ভিড়ে মিশে গেলাম আমরা। দিনের চেয়ে রাতের মেলা বেশি জমজমাট। চারপাশে হরেক দোকানপাট, গানের আসর, গঞ্জিকাসেবী আর জুয়াড়িদের জটলা। আমার মনে শুধু রোকেয়ার মুখ। সেলিম খান জানতে চায়, কে কে আছে তোমার?

কেউ না।

সে কী কথা! কেউ নেই মানে?

ছায়রা উত্তর করল, আমার মায়-বাবায় মরছে কবেই। বড় বোনডা জামাইয়ের ঘর লইলেও নিখোঁজে পড়ল। আমি পেডে এক পোলা ধরলেও ছয় মাস বাঁচে নাই। জামাই আমারে তালাক দিয়া আরেক মাইয়ালোক ধরছে।

ছায়রার দীর্ঘশ্বাসে কথা হারাই। অনুভব করি, একই কারণে সেলিম খান নিশ্চুপ। হাঁটতে হাঁটতে আমরা দাঁড়ায়। একটা গানের আসরের সামনে পৌঁছে ছায়রা বলল, আসেন, গান হুনি।

গেরুয়া বসন পরা মাঝবয়েসী এক গায়ক ধরেছেন হাছন রাজার গান। তিনি গাইছেন, ‘দয়াল কানাই, দয়াল কানাই রে/পার করে দাও কাঙ্গালীরে/ভবসিন্ধু পার হইবার পয়সাকড়ি নাই/দয়া করি পার করি দাও বাড়ী চলে যাই।’

বাদ্যযন্ত্রীরা বাজাচ্ছে হারমোনিয়াম, ঢোল, বাঁশি, দোতারা এবং খঞ্জনি। গায়কের কণ্ঠ তরঙ্গায়িত হচ্ছে।

অনেক নারী-পুরুষ জুড়েছে উন্মাতাল নাচ। ছায়রা ছুটে গিয়ে যোগ দিয়েছে ওই নাচে। সেলিম খান আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, চৌধুরী, মেয়েটার ভবিষ্যৎ কিছু ভেবেছ?

সঙ্গীর জিজ্ঞাসায় উত্তর মেলাতে না পেরে নিরুপায় চাহনি মেলে দিলাম আকাশের দিকে। অগণন নক্ষত্র সেখানে। অতীতে আকাশের গায়ে নক্ষত্রের এমন সমারোহ কখনও দেখিনি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত