চট্টগ্রাম শহর তখন বুনো গন্ধমাখা এক নিস্তরঙ্গ জনপদ। আন্দরকিল্লা থেকে বটতলী, ওদিকে চৌমুহনী হয়ে বাদামতলী- এই তো শহর। সাবএরিয়া হয়ে একটু এগোলোই জলমগ্ন নিম্নাঞ্চল; লোকে বলে বগার বিল, এদিকে বাদামতলী ক্রস করলেই তরমুজের ক্ষেত, একেবারে দইজ্যা পর্যন্ত। ধরেন তখন স্টিল মিল কিংবা ভাটিয়ারী কিংবা অক্সিজেন- অনেক দূরের পথ। সবুজ সবুজ কিছু ‘শহর এলাকা’ লেখা বাস বিচ্ছিন্ন জনপদগুলোকে জুড়ে দিত নিউ মার্কেটের সঙ্গে। শহরের পাশ দিয়ে শিরদাঁড়ার মতো বয়ে যাওয়া স্রোতস্বিনী কর্ণফুলী তখনও নির্মল, নিস্কণ্টক। ছোট ছোট সাম্পানে করে লোকজন চলে আসত সদরঘাট। হাঁটুর ওপর লুঙ্গি তুলে শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের গান গাইতে গাইতে যেত রিয়াজউদ্দিন বাজার। কেউ বা বক্সিরহাট। সেই তখনকার গল্প বলছি। আলকরণ কিংবা হেম সেন লেনে গেলে একটা আমুদে বাতাস খেলত চারদিকে। তাতে শেফালী ঘোষের সুর, আদিরসাত্মক গল্প আর খিস্তিখেউড় মিলেমিশে একটা ককটেল হয়ে যেত। হাজারী লেনে গেলে নাকে আসত চম্পাফুলের গন্ধঅলা ধূপের মৌতাত। ফিশারি ঘাটে তখন জলের দামে রূপচাঁদা মেলে। শাপলা মাছ মিলত অঢেল। আর ছিল কাছিম। সদরঘাটের মুখে নিয়ে আসত জাইল্যারা। গোলাপ সিংহ রোডের পুরনো বাড়িগুলোর নকশা তখনও অটুট। অলকানন্দা আর মাধবীলতা ঢেকে রাখত পাড়াটাকে। সতীশচন্দ্র রোডের ইট সলিঙের পথে বাদামি মেমরা স্কার্ট পরে ঘুরে বেড়াত নিঃসংকোচে। সঙ্গে রোমশ কুকুর।
আমরা তখন পাহাড়তলী থাকি। বড়ো বড়ো রেইনট্রি আর জিলাপি পাহাড় কুঁজো হয়ে আগলে রেখেছে আমাদের আঙিনাটুকু। অনুচ্চ পাহাড় আর বৃক্ষের নিবিড় বুনটের ফাঁকে ফাঁকে বাসাবাড়ি। দিনের বেলাও কোনো কোনো এলাকা গাছের ছায়ায় অন্ধকার হয়ে থাকত। পাহাড়ের ঢালে ঢালে শটিবন। দূর থেকে মনে হয় হলুদের ক্ষেত। শহরের লোকজন খুব একটা এদিকে আসত না। আমাদেরও যাওয়া পড়ত না ওদিকে। মাত্র দু’কিলোমিটার দূরেই বটতলী। অথচ লোকজন সেখানে যাওয়ার আগে বলত, ‘শহরে যাচ্ছি’। কোনো একটা সান্টার ইঞ্জিনের ক্যাবে উঠে রাজা জর্দায় পান খেতে খেতে পৌঁছে যেত বড় স্টেশন। শেষ পিকটা বুকিং অফিসের বারান্দায় ফেলে পা মেলত বাইশ মহল্লার গোরস্থানের দিকে। পাহাড়তলীতে তখন শহুরে হাওয়াটা আরও বিলম্বিত। এবং অনভিপ্রেত। রাত হলেই দুমদাম মঞ্চের কালো পর্দা ফেলে ঘুমিয়ে পড়ত পাড়াটা। দূরে দূরে রেল বিট দিয়ে বানানো ল্যাম্পপোস্টগুলো জন্ডিসে ঝিমিয়ে পড়া আলো ছড়িয়ে যতটা জায়গা পারত ভৌতিক করে তুলত। এর ফাঁকে ফাঁকে কিছু বেকার যুবক আমছিলার চাকু হাতে দাঁড়িয়ে পড়ত অন্ধকারে। রিকশা থামিয়ে হাতিয়ে নিত পলিথিনে মোড়ানো টাকার পুঁটলি কিংবা কারও গায়ের অলঙ্কার। হতাশা তখন রাতের আকাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে বেড়ায়। আমাদের টিলার ওপর চারচালার বাংলো বাড়িটা তখন ফিলামেন্ট বাল্ক্বের হলুদ আলোয় দূর থেকে লাইটহাউসের মতো দেখাত। হাসনাহেনা আর গন্ধরাজের গন্ধে তখন ছোট ছোট সাপের বাচ্চা এসে শুয়ে থাকত রাস্তায়।
আজ দূর থেকে দেখে মনে হয় কত বৈচিত্র্যে ভরপুর ছিল সে জীবন। কিন্তু তখন ভীষণ গৎবাঁধা মনে হতো। মনে হতো একই দৃশ্য বারবার ফিরে আসছে। একই চিত্রপটে যেন আটকা পড়ে আছি আমরা দিনের পর দিন। তার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে শরতের মেঘ, শীতের কুয়াশা, শ্রাবণের ধারা। সব শেষে যেই ছবি সেই রয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা ভীষণ অসহ্য লাগত মাঝে মাঝে।
ব্যাপারটা বোধহয় রাখাল বাবুকেও আক্রান্ত করত। তিনি আসতেন সন্ধ্যার পর পর। যখন সজারু কিংবা বাঘডাস বেরোত খাবারের সন্ধানে। আলোর মার্বেল জ্বলত অন্ধকারের ঝোপে। বেপুথে বাদুড় ইলেকট্রিকের তারে ঝুলে পড়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাত। দ্বাদশীর চাঁদের মুখে উড়ত মেঘের ধুলো।
দরজায় এসে খুটখুট করতেন। আমরা দৌড়ে বের হতাম। জাদু করে দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতেন নাবিস্কো লজেন্স।
বাবার তখন খবরের কাগজে হাত। নলিনীর মালায় বোমা, রাজীব গান্ধী নিহত। কিংবা শুকতারার রাতে জগন্নাথ হলের ছাদ ধসে পড়া। কিংবা শাতিল আরবের উষ্ণ ঘটনাপ্রবাহ।
রাখাল বাবু ছিলেন ছোটখাটো মানুষ। বারো বছরেই আমি তার নাগাল পেয়েছিলাম। পুরনো পিতলের তৈজসের মতো গায়ের রঙ। মুখটা এতই মসৃণ, সবসময় মনে হয় সরষের তেল ঝরে পড়ছে। ছোট ছোট চোখ, চাপানো নাক। দু’পাটিতে একটাও দাঁত ছিল না। তাই কথা বলতে গেলে ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠত হাপরের মতো।
বাবা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেন নলিনী কিংবা শাতিল আরব হাতে করে। রাখাল বাবু তখন উদাস হয়ে বলতেন, কী পড়েন?
বাবা নিউজের খুঁটিনাটি নিয়ে পর্যবেক্ষণ জানাতেন। রাখাল বাবু উঁচু সিলিংয়ের দিকে তাকাতেন। ভারী মুগুরের চেহারার একটা ফ্যান ঘুরত মাথার ওপর। হলুদ সিলিংয়ে বয়সের ছাপ। কী যেন খুঁজতেন তিনি। তার পর বুকের ভেতরে জমানো বাতাস ছেড়ে বলতেন, সবই তো পুরনো গল্প। নতুন কোনো গল্প নেই?
শুরু হতো নকশাল নিধনের গল্প। তখন তিনি কলকাতায়। যুদ্ধের পর কিছুদিন ছিলেন সে শহরে। সেই হাহাকার, সেই আর্তনাদ, সেই উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি তিনি দেখেছেন। সে গল্পই তিনি করতেন। তারপর উপসংহার টানতেন এভাবে- সেই ইন্দিরাও তো বাঁচল না… আজ ছেলেটাও…
হয়তো কোনো একদিন ঢাকায় সমাবেশে গুলি চালানোর খবর নিয়ে আলোচনা ওঠে। তিনি সেই নিরাসক্ত কণ্ঠ নিয়ে বলেন, সবই তো পুরনো গল্প। নতুন কোনো গল্প নেই-
সেই আইয়ুবশাহি, সেই ইপিআর, সেই বিহারিদের মিছিল… গল্পের ঐরাবত ওড়ে আমাদের বাংলোর চালার ওপর। এর মধ্যে ঝুম বৃষ্টি। ঝিঁঝির আওয়াজ ছাপিয়ে যায় ব্যাঙের কোরাসে। আর্দ্র হয়ে ওঠে বাতাস। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাখাল কাকার গলা চড়ে। আবেগে বেতফলের মতো ছোট ছোট দুটো চোখ জ্বলে ওঠে। মসৃণ কপোলে ঠিকরে পড়ে বাল্ক্বের আলো। আমরা পাশের রুমে বসে উৎকর্ণ হয়ে থাকি। হাতে পরিবেশ পরিচিতি বই। কিন্তু পড়ার পরিবেশ একবারেই নেই মনের ভেতরে। এখন রাখাল কাকা না জানি কোন নতুন গল্প ফেঁদে বসেন। সেই গল্প বাংলা ইংরেজি ভূগোল বিজ্ঞান পড়ার চেয়ে জরুরি।
… এই তো এই পথ দিয়ে গাড়িটা গিয়েছিল। সোজা। তারপর থামল গিয়ে পাহাড়তলী স্টেশনের সামনে। আবার মোড় নিল…
হাতের মুদ্রায় তিনি দেখিয়ে দেন গাড়ির গতিপথ। যেন টাইম মেশিনে চেপে তিনি দেখে এসেছেন ১৯৩২ সাল। প্রীতিলতার গাড়ির পেছনেই ছুটেছিল তার দুটো চোখ। পুরনো ঘটনাটা তাই নিখুঁতভাবে বলে যাচ্ছেন তিনি। ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ। তারপর পালিয়ে যাওয়ার সময় গুপ্তঘাতকের গুলিতে আহত হওয়া। শেষমেশ স্বেচ্ছামৃত্যুর কোলে মাথা রেখে দেওয়া। এর পর তিনি একটা আবুল বিড়ি ধরাতেন। খুব উদাস হয়ে বলতেন, এ রকম কোনো নতুন গল্প আছে বাবু, থাকলে বলেন তো-
বাবা পত্রিকার পাতা উল্টান। উল্টান স্মৃতির খোড়ল। সব শূন্য। একটাও নতুন গল্প নেই। তখন নতুন গল্প বলতে নূরজাহানকে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করেছে কারা। তার ওপর প্রতিদিনই থাকছে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। মনির-খুকুর পরকীয়া-
… হাজার বছরের পুরনো গল্পটাই তো আবার ছাপা হয়েছে বাবু, আরেকটা আবুল বিড়ি ধরাতে ধরাতে তিনি বলেন। আমরা মনে মনে ভাবি, লোকটার নতুন গল্পের এত নেশা!
রাখাল কাকার গল্প ফুরায় না। কোনো একসময় জাহাজে খালাসির কাজ করেছিলেন। চীনাদের জাহাজ। চীনারা এতই কৃপণ, বিড়ি জ্বালানোর জন্য আগুন চাইলে দিত না। জাহাজ বন্দরে নোঙর করলে মাল খালাসের কাজ ছিল তার। এভাবেই একদিন দেখে নিয়েছিলেন রেফ্রিজারেটরে চামড়া ছিলা কুকুরের সারি। পরদিন চাকরি ছেড়ে চাক্তাই বাজারে কাজ নেন। তখন জাহাজ থেকে মাল খালাস হয়ে চাক্তাই খাল দিয়ে সওদাগরি নৌকায় চলে যেত বহদ্দারহাট। ষোলশহরেও নাকি ছিল খালপাড়ের বিশাল বাজার।
রাখাল কাকার কণ্ঠে আফসোসের ঐকতান, নতুন কোনো গল্প নেই। মানুষের হিংস্রতার শিকার হচ্ছে প্রকৃতি। আগে মানুষ অত শক্তিবান ছিল না, তাই ক্ষতি করত কম। হিংস্রতা ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ রূপ পেয়েছে। এ আর নতুন কি?
আমরা যেদিন রঙিন টিভি কিনলাম, সেদিনই টুইন টাওয়ারে হামলা হলো। আগুনের রঙ কত বৈচিত্র্যময় হয়, টিভির পর্দায় আমরা দেখলাম। দেখলাম কলাগাছের মতো শততলা উঁচু দালানের ভেঙে পড়া।
রাখাল কাকার সেই নিরাসক্ত মুখ। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে জতুগৃহের গল্প বলেন। চায়ের কাপটা টেবিলে ঠক করে রেখে বলেন, যে বানায় সেই পোড়ায়। কিন্তু যাকে পোড়ানোর সে পোড়ে না। এ আর নতুন কী?
দেয়ালের টিকটিকি কথা বলে ওঠে। রাখাল কাকার ছিল মাছ ধরার শখ। মাছ শিকারের মৌসুমে তিনশ’ টাকা দিয়ে টিকিট কিনে নিতেন সারা মাসের জন্য। অবশ্য তিনি তখন বেতনই পেতেন এগারোশ’। সারারাত জেগে থাকতেন বড়শি হাতে। একটা নয়, চার-পাঁচটা বড়শি একসঙ্গে। একটাতে শিবের মন্ত্র পড়ে রাখা। আরেকটায় মোহছেন আউলিয়ার তাবিজ। লাল সুতো প্যাঁচানোও একটা থাকত। না, মন্ত্র বা তাবিজের গুণে মাছ এসে ধরা দেবে সে আশা তার নেই। মাঝরাতে জোড়া ঢেবার ওপর দিয়ে হেঁটে আসা আকাশসমান সাদা নারীটা যেন তার পানে ছুটে না আসে, এই তার কামনা।
মাছ ধরার মৌসুমে তার আসা-যাওয়া কমে আসত। তখন তিনি ব্যস্ত থাকতেন পিঁপড়ের ডিম আর খৈল ভুসি সংগ্রহ। আমাদের কাজ ছিল বাগানের মাটি খুঁজে কেঁচো বের করে আনা। সেই কেঁচো বড়শির মাথায় গেঁথে ছুড়ে মারতেন দীঘির জলে। সে অপরূপ দৃশ্য দেখার জন্য আমরা দলবেঁধে যেতাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার পর একটা আধা কেজি বা পৌনে এক কেজি রুই ধরা পড়ত। কিংবা বাউশ। কিন্তু পাশের শিকারিদের বড়শিতে দেদার দুই-তিন কেজি ওজনের মাছ ধরা পড়ত। রহস্যভেদ করতে গিয়ে আমরা আরও রহস্যের ভেতরে ডুবে যেতাম। সব ঘটনা দীঘির পাড়ে বলা বারণ। তবে জাদুর একটা খেলা আছে। সেই খেলায় মাছ এসে ধরা দেয়। এরা বড়শি তো লোক দেখানোর জন্য নিয়ে বসে আছে। ওরা চাইলে আপনা থেকে মাছ খলুইতে এসে ঢুকে যাবে। শুনে ভয়ে বুকটা কেঁপে ওঠে। ভীরু ভীরু চোখে চারপাশে তাকাই। পাশের শিকারিরা ফ্ল্যাক্স থেকে চা বের করে খায়। না জানি, চা-টাও জাদুর কি-না।
একবার রাখাল কাকা ধরে ফেললেন সাড়ে তিন কেজি ওজনের মাছ। ঘটা করে নিমন্ত্রণ করলেন সবাইকে। কাকি ছিলেন পৃথুলা। কিন্তু দুধে আলতা গায়ের রঙ। তারও দু’পাটিতে দাঁতের সংকট ছিল। তবে কাকার মতো নয়। তিনি বড় আদর করে আমাদের খাইয়েছিলেন। এত ঝাল খাওয়ার অভ্যাস আমার ছিল না। ঝালে চারদিক অন্ধকার দেখেছিলাম। তবে মাছটা ছিল সুস্বাদু।
মাছ শিকারের মৌসুম শেষ হলে তিনি নতুন গল্প নিয়ে ফিরতেন সন্ধ্যার আড্ডায়। কিন্তু কই, নতুন কোনো গল্প নয়। সেই গত বছরও বলেছিলেন পাহাড়তলী স্টেশন পার হওয়ার সময় তিনি পেছন থেকে ডাক শুনেছিলেন। তখনও ঠিক করে ভোর হয়নি। রাতের আঁধার কেটে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে সূর্য। কে দেবে তাকে ডাকে? পেছন না ফিরে তিনি রুদ্ধশ্বাসে ছোটেন। বাসায় যখন পৌঁছান গায়ে তখন বাদাম ফোটার তাপ।
মাঝে মাঝে বাবাকে বড় আশ্চর্য মানুষ মনে হতো। একই গল্প বছরের পর বছর শুনে যাচ্ছেন তিনি। কোনো বিরক্তি নেই। বলতেন না নতুন কোনো গল্প শোনাতে। আচ্ছা, উনি কি পুরনো গল্পের নেশায় পড়ে গেছেন? গল্পও কি নেশা ধরায়? ধরায় নিশ্চয়ই। নইলে দিনের পর দিন পুরনো খবর ছাপিয়ে পত্রিকার পাতা ভরে কেন পত্রিকাঅলারা। আর লোকজনও বা গাঁটের পয়সা খরচ করে সেটা কেনে কেন?
এভাবে গল্পে গল্পে দেড়টি যুগ কেটে গেল। বাবার চাকরি শেষ হলো। রেল কলোনি ছেড়ে আমাদের ঠিকানা হলো ফ্ল্যাট বাড়িতে। বুড়ো বয়সে সংসার চালাতে বাবা টিউশনি করেন। হাইপ্রেশার চেপে রেখে হাসিমুখে বাচ্চাদের টেনস পড়ান। আচ্ছা, এটা কি কোনো নতুন গল্প নয়? রাখাল কাকা এলে জিজ্ঞেস করা যেত।
এভাবে কাটল আরও অনেক দিন। আমাদের চাকরিবাকরি হলো। দিদির বিয়ে। সংসার। বাবার ধরা পড়ল কিডনির জটিলতা। আগের রোগভোগ তো আছেই। বাবা আর একা চলতে-ফিরতে পারেন না। একদিন পে অফিসে গিয়েছিলাম বাবাকে নিয়ে। বাবা কোন ভিড় থেকে রাখাল কাকাকে খুঁজে বের করলেন। অশক্তের চূড়ান্ত সীমায় চলে গেছেন তিনি। সেই মসৃণ গাল দুটো থুবড়ে গেছে। শরীর শীর্ণকায়। ছোট ছেলে আর ছেলের বউ ধরে নিয়ে এসেছে। বাবাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন। বললেন, এই দেখাই শেষ দেখা বাবু। ভালো থাকবেন।
কথাটা শুনে আমি চমকে গেলাম। উনি কি আমার বাবার মৃত্যুসংবাদ দিয়ে গেলেন? আবার অন্য মন বলে উঠল, তা হতে যাবে কেন, বাবা এখনও শক্ত। কারও সাহায্য ছাড়াই হাঁটতে পারেন। হয়তো কাকা নিজের শরীরের কথা ভেবে বলেছেন।
ঠিক পরের মাসে বাবা মারা গেলেন। রাখাল কাকা এখনও আছেন। মনে মনে রাগ হয়, জীবনের শেষ দেখাতে তিনি বাবাকে নতুন একটা খবর শুনিয়ে গেলেন। একেবারে নতুন। কি ভয়ঙ্কর লোকটা! আবার মনে মনে ভাবি, এর আর নতুন কি। জন্ম-মৃত্যুর অমোঘ চক্রে আমরা বাঁধা। জন্মের পর মৃত্যু, মৃত্যুর পর জন্ম। কিছুদিন হয় আমার একটা ছেলে হয়েছে। সে আসন করে বসলে পেছন থেকে ঠিক বাবার মতো দেখায়। আচ্ছা, এটা কি নতুন কোনো গল্প?