ট্রোজান হর্স

আলো জ্বালবো?

-না, দরকার নেই।

-ঘরের ভেতরে অন্ধকার তাই…

-বললাম তো দরকার নেই।

সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। ঘরের ভেতরে অন্ধকার। যারা কথা বলছে তারা আলো জ্বালেনি। হয়তো প্রয়োজনবোধ করেনি।

-হাসছো কেন?

-হাসি পাচ্ছে।

-সবকিছু তোমার কাছে হাস্যকর মনে হচ্ছে?

-ঠিক জানি না, তবে কিছুটা।

-কেন?

-আমার কথা বলতে ভালো লাগছে না।

-আমি বলতে চাচ্ছি।

-আমি চাই না। এতক্ষণ তো অনেক কথা বললাম। আর ভালো লাগছে না।

-তোমার কি মনে হয় না গত কয়েক ঘণ্টায় যা ঘটল তার একটা এক্সপ্লানেশন প্রয়োজন?

মেয়েটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বাইরে কোন এক চৈত্রসন্ধ্যার উল্টাপাল্টা হাওয়া। জানালার পর্দা নড়ে হাওয়ায়। ঘরের ভেতরে একঝলক আলো। আবার অন্ধকার।

-আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না?

-বললাম তো কথা বলতে ভালো লাগছে না।

-ভালো না লাগলে তো চলবে না। আমার তো অনেক কিছু জানার আছে।

-আমারও তো অনেক কিছু জানার থাকতে পারে।

ধরে নেই, ধরারই বা দরকার কী? ঘরের ভেতরে একজন পুরুষ ও একজন মহিলা কথা বলছে।

-তা পারে। তুমি প্রশ্ন করতে পারো।

-আমার ক্লান্ত লাগছে।

-এড়িয়ে যেতে চাচ্ছ?

-ঘটনাটা কি এড়িয়ে যাওয়ার মতো?

নীরবতা নামে। পাশের বাসায় টিভির আওয়াজ কমিয়ে দিল কেউ। নিচের রাস্তায় সজোরে হর্ন বাজিয়ে একটা গাড়ি চলে গেল। কয়টা বাজে? সাতটা হতে পারে আবার আটটাও। এ ঘরের ভেতরে সময় অনেকক্ষণ ধরে থমকে আছে। বলা যায় এরা সময় নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না।

-কী, এড়িয়ে যাওয়ার মতো?

-আমি তো সে কথা বলিনি।

-তাহলে তো তোমার কিছু বলার আছে নিশ্চয়ই?

-তুমি আমাকে জোর করে কথা বলাবে?

-যদি তাই হয়?

-স্বামীর অধিকার! আজকের পরে সেরকম কোনো অধিকার তোমার আছে?

-এখানে অধিকারের কথা উঠছে কেন? আমার আসলে এই ফ্ল্যাটটা কেনাই…

-ভুল হয়েছে?

-হ্যাঁ, ভুল হয়েছে। ফ্ল্যাট তো আমরা কিনেছিলাম মাঝে মাঝে ভালো না লাগলে এসে একা সময় কাটানোর জন্য। কখনও বন্ধুদের নিয়ে টাইম স্পেন্ট করার জন্য, বাট…

-আমিও তো তাই জানতাম…

-তাহলে?

-তাহলে কী?

-তাহলে আজকে যা ঘটল তা ভুল, আমরা দু’জনেই ভুল করেছি?

সামনের বাসার টিভিতে নিউজ হচ্ছে। জানালার পর্দা আবারও হাওয়ার ধাক্কায় একটা সরে যায়। ঘরের ভেতরে বাইরের আলো একবার ঝাঁপিয়ে পড়েই উধাও। দু’জন মুখোমুখি দুটি চেয়ারে। লিসা কি দীর্ঘশ্বাস ফেলল? ফেলারই তো কথা। এ রকম ঘটনায় মেয়েরাই শেষ পর্যন্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ফেলতে হয়।

-আমরা তো দু’জনেই ম্যাচিউরড পারসন। আমার মনে হয় না এই ঘটনাটা ভুল।

-তাহলে তুমি দিনের পর দিন ইচ্ছা করে এই সম্পর্কটা কন্টিনিউ করেছ! আজকে সকালেও বাসায় যখন আমি জানতে চাইলাম কোথায় যাচ্ছ, তুমি বললে কাজ আছে। দুপুরে ফিরবে না। তোমার কাজটা তাহলে ছিল এই ফ্ল্যাটে ওই লোকটার সঙ্গে মিট করা?

-তুমি আমাকে কী বলেছিলে? ফিরতে দেরি হবে। রাতে পার্টি আছে। তখন তোমারও প্ল্যান ছিল বিকেলে এখানে মেয়েটাকে নিয়ে আসার।

অন্ধকারে পানি ঢালতে গিয়ে গ্লাসটা টেবিলে কাত হয়ে পড়ে। নিঃশব্দ ফ্ল্যাটে ওইটুকু শব্দ বোমা ফাটার মতো আওয়াজ তোলে।

-সরি, গ্লাস পড়ে গেল।

-আমি আসলে তোমাকে ঠিক মেলাতে পারছি না।

-কি, আমি কী?

-তুমি এভাবে একটা লোকের সঙ্গে জড়িয়ে গেলে!

-লোনলিনেস বোঝ?

– লোনলিনেস!

-হ্যাঁ, একাকিত্ব। একটু একটু করে বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যাওয়া। সংসারে সবকিছুর ভেতরে থেকেও সবকিছু থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া…

-সংসারে তুমি একা! বাচ্চারা তাহলে…

-তুমি বুঝবে না। কোনোদিন বোঝার চেষ্টাও করোনি। তোমার কাজ, তোমার মিটিং, ওপরে ওঠার সিঁড়ি খোঁজা, প্রত্যেকদিন একই রুটিন আমাকে একা করে দিয়েছে।

-তাই বিয়ের আঠারো বছর পরে একাকিত্ব কাটাতে তুমি একটা লোকের সঙ্গে রিলেশন তৈরি করে ফেললে। তাকে নিয়ে আমার কেনা ফ্ল্যাটে চলে এলে… এই সময়ের ফ্যাশনেবল লোনলিনেস। রাবিশ…

-তাই যদি বলো, তাহলে তোমারও বোধহয় অন্য মেয়েদের নিয়ে রিল্যাক্স করার অভ্যাসটা তৈরি হয়ে গেছে। আফটার অল প্রত্যেকদিন অনেক চাপের মধ্যে তোমাকে কাজ করতে হয়…ব্যাংককে প্রফিট দিতে হয়, ক্লায়েন্ট ধরতে হয়। তার মধ্যে এই ফুর্তির ব্যাপারটাও বোধ হয় বাধ্যতামূলক?

উত্তেজিত কণ্ঠে কথা বলায় লিসার নিঃশ্বাসের ওঠা-পড়ার শব্দ শোনা যায়। ঘরের ভেতরে নীরবতা নেমে আসে। কয়েক সেকেন্ড পরে নীরবতা খান খান করে দিয়ে দেয়ালের কোন এক কোনায় একটা টিকটিকি ডেকে ওঠে।

-চলো…

-কোথায়?

-বাসায়।

-না…

-না মানে! তুমি বাসায় ফিরবে না?

-যদি না ফিরি?

-ইউ হ্যাভ গন ম্যাড। যা হোক একটা ঘটনা আমাদের মধ্যে ঘটে গেছে; কিন্তু সেজন্য তুমি…

-আজকের ব্যাপারটা যা হোক নয় আমার কাছে। আমার যদি তোমার মুখটা দেখতে আর ভালো না লাগে?

-একই কথা তো আমিও বলতে পারি।

-আমি সেজন্য আগে বললাম। ইঁদুর আর বিড়াল খেলা এক খাঁচায় বসে হয় না। আজ ইঁদুর আর বিড়াল দু’জনেই ধরা পড়ে গেছে… দু’জনেই ধরা পড়ে গেছে।

-এ রকম গল্প-উপন্যাসের ভাষায় আমার সঙ্গে কথা বলবে না। জীবনটা গল্প না। কী ভাবো তুমি? এ রকম একটা রিলেশন তৈরি করে ওই একটা লোকের হাত ধরে তুমি চলে যাবে আর আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখব?

-আজকের পরে আমি কারও হাত ধরেই কোথাও যাবো না। আমি…

কান্নার শব্দ শোনা গেল কী? হ্যাঁ, লিসা কাঁদছে। তারই তো কাঁদার কথা। এ রকম সময় মেয়েরাই কাঁদে। তার পুরুষ সঙ্গী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। রাগ করে। এ রকমটাই ঘটে গল্পে, জীবনেও।

-তুমি এখন আমার সঙ্গে বাসায় যাবে। বাসায় গিয়ে আমরা ভাবব এরপর আমরা কী করব। আচ্ছা, বাচ্চাদের কথা তুমি ভাবছ না!

রাত বোধহয় আরেকটু বাড়ল। অবশ্য ক’টা বাজে তা এরা কেউ খেয়াল করছে না। আশপাশটা বেশ চুপচাপ হয়ে এসেছে। দূরে কোথায় আবার গাড়ির হর্নের আওয়াজ শোনা যায়। ডোর বেলের আওয়াজ ভেসে আসে এই ফ্ল্যাট বাড়িটার কোনো অংশ থেকে। এই ঘরের ভেতরে নৈঃশব্দ্য যেন বাঘ, ধীরে ধীরে চিবিয়ে খায় তার শিকার সময়কে।

-তুমি মা হয়ে একবারও ভাবছ না ওদের কথা?

-ভাবছি।

-ওদের কথা ভেবে আমরা পুরো ব্যাপারটা ভুলে যেতে পারি না?

-মেয়েটির সঙ্গে তোমার কতদিনের সম্পর্ক?

গল্পের পুরুষ চরিত্র সিগারেট ধরায়। কিন্তু এখানে পুরুষটির অভ্যাস নেই ধূমপানের। সে দাঁত দিয়ে নখ কাটে।

-ও ছাড়া আর কেউ তোমার সঙ্গে এই ফ্ল্যাটে এসেছে?

নখ কেটেই যাচ্ছে পুরুষটি।

-দিনের পর দিন অফিসের কলিগদের নিয়ে এখানে…কিসের আশ্বাস দিয়েছ তুমি ওদের, প্রমোশন, সুবিধা, বদলি আটকানো? বলো রওনক, আমি শুনতে চাই।

-তোমাকে আমি বোঝাতে পারব না। আসলে ঘটনাটা কীভাবে যে…

এবার মনে হয় হাসে লিসা। কান্নার গভীর থেকে বের হয়ে এসে হাসে।

-নিজেদের অসততার ব্যাখ্যা পুরুষরা এভাবেই দেয়।

-এই লোকটার সঙ্গে তুমি আগে এখানে এসেছ?

ঘরের ভেতরে আবারও টিকটিকিটা ডেকে ওঠে।

-এসেছি।

-মাই গড… তুমি…

-কী, কোনোদিন ভাবোনি তুমি যা করছ, তোমার স্ত্রীও ঠিক একই কাজ করতে পারে? তুমি আমাকে ঠকিয়ে যাচ্ছ আর আমিও তোমাকে…আজকের বিকেলটা আমাদের নিয়তি ছিল। ফেরার বোধ হয় আর কোনো পথ নেই।

-তোমার বাবা, মাত্র হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছেন, হোয়াট অ্যাবাউট হিম? তুমি এ রকম একটা সিদ্ধান্ত নিলে উনি বাঁচবেন? পাগলামি করো না…

-তুমি এটাকে ভুল বলছ! এটা অন্যায়।

-ঠিক আছে, ধরে নিলাম অন্যায়। বাট একটা গাছকে চাইলেই উপড়ে ফেলা যায়? তার শিকড় অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। চাইলেই পুরো শিকড় তুলে ফেলা যায় না।

পাশের ফ্ল্যাটে আবার ডোর বেলের আওয়াজ। মানুষের হাসির শব্দ শোনা যায়। সশব্দে দরজা বন্ধ হয়। ঘরের ভেতরে নৈঃশব্দ্যের বাঘ সময়কে চিবিয়েই চলেছে।

-তুমি তো এতক্ষণ সবার কথা বললে, কিন্তু আমার কথা একবারও বললে না। আমি ফিরে না গেলে তুমি কী করবে?

-আমি… আমি কী করব?

-বলো কী করবে?

-জানি না… মানে…

আবারও হাসে লিসা।

-তুমি বলতে পারছ না আমাকে ছাড়া তোমার চলবে না। আমি আর কোনোদিন বাড়ি না ফিরলে অনেকের অনেক অসুবিধা হবে; কিন্তু তোমার? তোমার কী হবে?

-তোমাকে আমি বোঝাতে পারছি না। আসলে আমরা সবাই একটা যেমন এই সময়ের মধ্যে বসবাস করি, তেমনি ফিউচার টাইমের মধ্যেও অ্যাকজিস্ট করি। শুধু নিজের জন্য আমাদের বাঁচলে চলে না। অন্যের জন্যও আমাদের…

-তাহলে বাকিটা জীবন আমাদের মুখোশ পরে পার করতে হবে!

-হয়তো।

-হয়তো না রওনক, এটাই সত্যি। আমরা আসলে সবাই জাত অভিনেতা।

ঘরের ভেতরে আবারও চৈত্রসন্ধ্যার হাওয়া ঢোকে পর্দা সরিয়ে। বাইরের আলো আসে, রাতের নানারকম শব্দ আসে। পর্দা নেমে গেলে আবার ঘর অন্ধকার। সময় পার হয়ে যায়। মহিলাটি উঠে দাঁড়ায়।

-ঠিক আছে, চলো।

-তুমি… তুমি যাবে?

-হ্যাঁ। অভিনয়টা করতেই হবে।

অন্ধকার ঘরে দুটো ছায়ামূর্তি উঠে দাঁড়ায়।

-আলো জ্বালব?

-না। দরকার নেই।

…ইদুর আর বিড়াল এক খাঁচায় ধরা পড়ে গেল…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত