কেউ কথা বলে না

এই গল্পটা দু’জনের। প্রমা এবং নাসিরের। দু’জনের গল্প হলেও আরও একটি কিংবা দুটি চরিত্র হাজির হতে পারে। যদিও এই মুহূর্তে বলা মুশকিল কে আসবেন গল্পে। গল্পের প্রধান চরিত্র প্রমা ও নাসির। প্রমার আগে নাসিরের কথা বলি। পুরো নাম নাসির উদ্দিন। সে এই শহরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মানে তো বোঝেন। কাজ বেশি পয়সা কম। সারাদিন বসদের ঝাড়ি। অমানসিক পরিশ্রম। তার ওপর একটু ভুল হলেই যেকোনো মুহূর্তে চলে যাবে চাকরি। এমনই নিরাপত্তাহীনভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে নাসির। ওর স্ত্রী সাঈদা সুলতানা প্রমা একজন শিক্ষিত গৃহিনী। আপনারা যাকে ইংরেজিতে বলেন হাউজওয়াইফ।

আপনি প্রশ্ন করতে পারেন,প্রমাকে শিক্ষিত বলেও কেন তাকে হাউজওয়াইফ বানালাম। এই ব্যাখ্যা আমার কাছেও নেই। কারণ নাসির বিয়ের সময় একজন শিক্ষিত মেয়েকেই খুঁজেছিল। তবে বউ চাকরিজীবী হবে কিনা সেটা অবশ্য নাসির কখনো ভেবে দেখেনি। যদিও প্রমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়েছে চাকরি করতে। কিন্তু ‘সংসার গুছিয়ে নেই’— এই চিন্তায় বিয়ের তিন বছর চলে গেলো। এখনও প্রমার সংসার গোছানো হয়নি।

প্রমা গত দুই বছর ধরে অবশ্য চাকরি চায় না। সে মা হতে চায়। কিন্তু নাসির তাতে রাজি হয় না। নাসির নিজেকে আরও গুছিয়ে নিতে চায়, ক্যারিয়ারকে গুছিয়ে তারপর সন্তান নিতে চায়। বিয়ের ৩ বছর পরও আশ্চর্য রকমভাবে দুইজন কিছুই গোছাতে পারেনি।

কিছু গোছাতে না পারলেও তারা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আসলে সিদ্ধান্তটি নেয় প্রমা। আর স্বামী হিসেবে নাসির তাতে নীরব সায় দেয়। তাদের সিদ্ধান্তটি হলো, দু’জন দু’জনার সঙ্গে কথা বলবে না। কেন এই সিদ্ধান্ত? বলবো। সেজন্য তো কিছু ঘটনা আপনাদের জানতে হবে। এই মুহূর্তে গল্পে একজনকে আনা যেতে পারে। সেই একজন হলাম আমি। আমার নাম রহিম। আমি প্রমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। তবে তাদের বিয়ের পর প্রমার চেয়ে নাসির হয়ে গেছে আমার আরও কাছের বন্ধু। প্রমা নিজের সংসারের কথা আমার সঙ্গে এখন আর শেয়ার করে না। কিন্তু নাসির করে।

আমার সম্পর্কে আরও কিছু জানানোর দরকার আছে। আমি আর প্রমা কলেজ জীবনের বন্ধু। আমি যখন কলেজে পড়তাম, তখন মনে মনে প্রমার প্রেমে পড়েছিলাম। তারপর যখন বন্ধু হলাম। তখন প্রেমটা কখন উড়ে চলে গেলো টেরই পেলাম না। প্রমা জানতো,আমি তাকে পছন্দ করি। কিন্তু এই বিষয়ে সে কখনো আমাকে জিজ্ঞেস করেনি। আমাদের অন্য বন্ধুরা প্রমাকে হয়তো কখন জানিয়েছেও। তখন প্রমা তাদের কী বলেছিল তা আমার রাডারে কখনও ধরা দেয়নি। আমরা একসঙ্গে বড় হলাম। কিন্তু প্রেম-ট্রেম নিয়ে কখনো আলাপ হয়নি প্রমার সঙ্গে। আমিও প্রমাকে পাওয়ার কোনো তীব্র আকাঙ্ক্ষা এই হৃদয়ে অনুভব করিনি। তাই ওই কলেজ জীবনে গোপনে প্রেমে পড়ার গল্পটা অনেকটা অধরাই রয়ে গেলো।

আমরা যখন বড় হলাম,তখন একদিন প্রমাই ফোন দিয়ে জানালো তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। সত্যি বলতে সেদিন হৃদয়ে একটি চাপ অনুভব করেছিলাম ঠিকই,কিন্তু তা হৃদয়েই চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছিলাম। কেউ জানেনি। প্রমার স্বামী নাসির উদ্দিন কখনো-সখনো টের পেতো। মাঝে মাঝে দুষ্টামি করে আমাকে বলতো, ‘তোমার ডার্লিং প্রমাতো মিয়া একটা পিস’। আমি বুঝতাম নাসির এক গভীর তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি দিত আমার দিকে। আমি মাথায় নেইনি।

বিয়ের পর প্রমা যখন দেখলো,আমার সঙ্গে নাসিরের বন্ধুত্ব ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে। তখন প্রমা আমার সঙ্গে ধীরে ধীরে কথা কমিয়ে দিল। দেখা গেলো আমি তাদের বাসায় গেলাম,ড্রয়িং রুমে অনেকক্ষণ আমি আর নাসির গল্প করছি। প্রমা হয়তো দুই কাপ চা আর বিস্কুট নিয়ে এলো। আমার দিকে তাকিয়ে হাসি দিল। কিন্তু কথা বললো না।

এভাবে আস্তে আস্তে আমার আর প্রমার মাঝে এক নিস্তব্ধতা নেমে এলো। কখনো কখনো মনে হতো প্রমার সঙ্গে আমার দূরত্ব তৈরি করা ছিল নাসিরের এক সূক্ষ্ম চাল। যা প্রমা বুঝতো, আমি হয়তো বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকতাম। প্রমা শেষ কবে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কেমন আছিস?’ আমি মনে করতে পারি না। শেষ কবে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল,‘বিয়ে করবি না?’ মনে করতে পারি না। ঠিক কবে থেকে এক তীব্র নীরবতা আমাদের সম্পর্কে জায়গা করে নিল সেটাও মনে করতে পারি না।

২.

যাইহোক,গল্পটা ছিল প্রমা এবং নাসিরের। আমি হলাম থার্ড পার্সন। তৃতীয় একজন মানুষ। নাসিরের কাছ থেকেই ঘটনা শুনলাম। প্রমা বলেছে,সে আর নাসিরের সঙ্গে কথা বলবে না। আমার সঙ্গেও প্রমা কথা বলে না। কেন বলে না,এই কথা প্রমা কখনও আমাকে জানায়নি। কিন্তু নাসির তো তার স্বামী। তাকে জানিয়েছে। তাদের সংসারে দু’জনই তো মানুষ। আর কেউ নেই। তবুও তারা কথা বলে না। কথা না বলার সিদ্ধান্ত হলো নিয়মিত ঝগড়ার কারণে। তাদের শুধু ঝগড়া হয়। কিছু থেকে কিছু হলেই ঝগড়া হয়।

নাসির আমাকে বলে, ‘ধরো আমি ঘরে ঢুকলাম জুতা পরে। তোমার ডার্লিং বান্ধবী বলবেন,জুতা পরে ঘরে ঢুকবা না। আরে মিয়া,আমার ঘর। আমি জুতা পইরা ঢুকমু নাকি খড়ম পইরা ঢুকমু এটা আমার ব্যাপার। তোমার বান্ধবীর কী? আমি এই কথা বললেই কয়, পরিষ্কার তো আমাকেই করতে হয়। আরে শালা! পরিষ্কার কী তুমি করো নাকি? করে তো বুয়া। তার বেতনটাও তো আমি দেই,নাকি? ঘর যদি অপরিষ্কারই না হয়, তাহলে আর বুয়া রাখছো কেন পরিষ্কারের জন্য?’

নাসিরের এই কথা শুনে অন্তত আমি বুঝতাম প্রমা প্রচণ্ড অপমানিত বোধ করতো। আমি নাসিরকে বলতে পারতাম না। শুনে যেতাম। কারণ আমার কাজ শোনা,আমি তো থার্ড পার্সন। নাসির আরও বলতো,‘একদিন ফোন দিয়া বলল,অফিস থেকে আসার টাইমে আইসক্রিম নিয়া আইসো। আমি অফিস থেকে আসার টাইমে আইসক্রিম আনতে ভুইলা গেলাম। সে তো মহা খেপা। কেন আমি ভুললাম। আরে! অফিসের কাজ মাথায় রাখবো নাকি বউয়ের আইসক্রিম মাথায় রাখবো? তুমিই বলো। এই নিয়া এমন এক কথা শুনাইয়া দেয়,যে মেজাজটা গরম হইয়া যায়। এমন গরম হয় যে আমিও কথা শুনাইয়া দেই। আর তখন মনে করো লাইগা যায় ঝগড়া। এসব ঢংয়ের টাইম আছে কও?’

আমি এসব শুনে যেতাম। কখনও নাসিরকে বোঝানোর চেষ্টা করি নাই। কী লাভ? এটা তাদের সংসারের বিষয়। আমি হলাম থার্ড পার্সন। আর তাছাড়া সে বউয়ের অভিমান বোঝে না। যে বোঝে না, তাকে বোঝাতে যাবো কিভাবে। আফটার অল সে তো আমাকে প্রমার ব্যর্থ প্রেমিক মনে করে। নাসির আরও ঘটনা বলে যায়,‘হঠাৎ করে আমার বাইরে খেতে ইচ্ছা হলো। কিন্তু ম্যাডাম তো রান্না করে ফেলেছেন। আমি বললাম,চলো আজকে বাইরে খাই। ওরে বাবা একদম কড়মড় করে বলা শুরু করবে, এতক্ষণ আমি কষ্ট করে রান্না করলাম,তুমি তো কিছু বললে না। এখন কেন হুট করে বাইরে খাওয়ার কথা বলছো। আরে ভাই,বাইরে আমি একা খাইতে চাই নাই। তোমাকে নিয়াই খাইতে চাইলাম,এটাতে চেতার কি হইলো? এখন আমি কিছু বললেই শুরু হয়ে গেলো লঙ্কাকাণ্ড’।

তো,এমন ছোটখাটো বিষয়ে ঝগড়া হতে হতে একসময় প্রমা ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ওঠে। দু’জনের সঙ্গে দু’জনের স্বাভাবিক কোনো কথাই আর হয় না। যখন হবে— কেউ খোঁচাবে, আর সেটার উত্তর দিতে গিয়ে আরেকজন খেপে উঠবে। এই বিষয়টাকে বন্ধ করতেই প্রমার সিদ্ধান্ত কথা না বলা। এই কথা বন্ধ হয়ে গেলেই দু’জনের মধ্যে আর ঝামেলা থাকে না। তাই তারা কেউ কারও সঙ্গে আর কথা বলে না। এবার গল্প থেকে আমি মানে রহিমকে বের হওয়া জরুরি। একটু ওপর থেকে প্রমা-নাসিরকে দেখতে হবে। তাদের দুজনকেই তো আমাদের বুঝতে হবে।

৩.

প্রমা সারাদিন ভাবলো। এভাবে প্রতিদিন ঝগড়া করে কীভাবে এই সংসারে সে থাকবে? এই গ্লানি, বঞ্চনা, অবহেলা আর কতকাল সে সয়ে বেড়াবে? নাসিরতো তাকে একটু বোঝার কোনো চেষ্টাই করে না। তাই বাধ্য হয়েই একটা পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিল, সে আর নাসিরের সঙ্গে কথা বলবে না। এই সিদ্ধান্ত নাসিরকে সে জানিয়ে দেবে। যেহেতু কথা হলেই দু’জনের ঝগড়া হয়। কেউ কাউকে বুঝতে চায় না। সেহেতু কথা বন্ধ করাই তো শ্রেয়। কারণ বোবার কোনো শত্রু থাকে না, তারা তো ক্রমেই ঝগড়া করতে করতে একে অন্যের শত্রুতে পরিণত হচ্ছে। সেদিন রাতে নাসির যখন ঘরে এলো। তখন রাতের খাবার খাওয়ার সময় প্রমা প্রথম জানালো নাসিরকে। বললো, ‘দেখো, যেহেতু আমাদের শুধু ঝগড়া হচ্ছে। শেষ কবে আমরা স্বাভাবিক কথা বলতে পেরেছি মনে পড়ে না। ভালো হয় যদি আমরা কথা বলা বন্ধ রাখি। তুমি তোমার মতো থাকবে। আমি আমার মতো থাকবো।’

একথা বলার সময় প্রমার খুব কান্না পাচ্ছিল। এই শূন্য জগতের একটা মায়াময় অধ্যায় যেন প্রমা বিসর্জন দিয়ে ফেললো। এমন একটা অনুভূতি তাকে আঁকড়ে ধরছিল। কেন যেন বুকটা হাহাকার করছিল। নাসির শুধু প্রমার কথাগুলো শুনলো। কিছুই বললো না! দু’জন বিছানায় পাশাপাশি। দুপাশে দু’জন মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে। নাসিরের নাক ডাকার আওয়াজ আসে। প্রমার বুক ফেটে কান্না আসে। আশ্চর্য! এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একটা কথাও বললো না নাসির! কেন এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ঝগড়া করলো না? কেন বললো না, ‘কথা বলবো না কেন? তাহলে সংসার করার মানে কী?’ কেন বললো না,‘এত ঢং করে আমি সংসার করতে পারবো না?’

কেন রেগে গেলো না? তাহলে তো এই নীরবতার মেঘটা নেমে আসতো না। একই বিছানায় দু’জন মানুষের মাঝে একটা বিভৎস নীরবতার পাহাড় তৈরি হতো না। নাসিরের ওপর রাগে অভিমানে ক্ষোভে মুষড়ে পড়ে প্রমা। এভাবেই কথা বলা বন্ধ করে দু’মাস চলে গেলো। নাসির ঘুম থেকে উঠে অফিস যায়। অফিস থেকে এসে খেয়ে দেয়ে চুপচাপ টিভি দেখে। তারপর ঘুমিয়ে যায়। কথা হয় না। কখনো কখনো প্রমার খুব ইচ্ছা হয় নাসিরকে জড়িয়ে ধরতে।

যেহেতু তাদের কথা হয় না,সেহেতু জড়িয়ে ধরাও হয়ে ওঠে না। শুধু প্রমার না। নাসিরেও ইচ্ছা হয়। নাসিরও পারে না। কারণ প্রমা তাকে কথা বলতে মানা করেছে। এভাবে জড়িয়ে ধরলে প্রমা আবার কীভাবে নেয়,বলা যায় না। তাই নাসিরও দূরে দূরে থাকে। প্রমা খুব চায় কোনো এক রাতে ভুল করে নাসির প্রমার কাছে আসবে। চুমু খাবে ঠোঁটে। আলতো করে জড়িয়ে ধরবে। আদরে আদরে ভাসিয়ে দেবে প্রমাকে।

এমনটা নাসিরও ভাবে। একরাতে বিছানায় প্রমা নাসিরকে টান দিয়ে কাছে নেবে। অভিমানি রাগী কণ্ঠে বলবে, ‘অসভ্য লোক কথা বলিস না কেন?’ বলেই চুমু খাবে। নাসিরও আদরে আদরে ভরিয়ে দেবে প্রমাকে। দু’জনের মন, শরীর পড়ে রইলো একে অন্যের ওপর। কিন্তু যেহেতু মুখ বন্ধ। সেহেতু সব দরজা বন্ধ হয়ে রইলো। প্রমা আটকে আছে কারণ সিদ্ধান্তটি তার। নাসির আটকে আছে কারণ সিদ্ধান্ত প্রমার। অথচ মেয়েদের অভিমান ভাঙাতে হয় পুরুষকেই,তা নাসির বোঝে না। মেয়েরা তো অভিমানে অনেক কিছুই বলে ফেলে। এসব কি নাসির বোঝে না? নাসির তো প্রমার কারণেই আটকে আছে। মেয়েরা হুট করে রাগের মাথায় কিছু বলে ফেলল। তারপর পুরুষেরও তো অভিমান হয়। এটা এক নিমিষেই মেটানো যায়। শুধু প্রমা একবার, একটু যদি ডেকে বসে— নাসির। তাহলেই নাসির দৌড়ে যাবে প্রমার কাছে। জড়িয়ে ধরে বলবে, ‘এতদিন ডাকলি না কেন? তুই খারাপ’। এই নীরবতা ভাঙার অপেক্ষা দু’জন মানুষের দিন যায়, রাত যায়। কথা বলা হয় না। দু’জন শুধু কথা বন্ধ নয়, শরীরে-শরীরে মিলনও তো বন্ধ। এটাকেও তো সামলাতে হচ্ছে দু’জনকেই। যত ঝগড়া হতো আগে,ঠিকই রাতে সব মান-অভিমান ভেঙে চুরমার হতো দু’জনের মিলনে। যখন নাসির প্রমার ওপর উঠে যেতো। প্রমা চুমু খেতো আর বলতো,প্লিজ আমাকে বেশি আদর করো। আরও আরও আদর করো…

নাসির তখন আদর করেই যেত। একসময় চলন্ত ঘোড়ায় রুপান্তরিত হতো নাসির। এসব তাড়না তাদের দু’জনকেই তাড়িয়ে বেড়ায়। দু’জনেই অপেক্ষা করে সেই একদিনের,যেদিন আবার দু’জন কথা বলবে। কিন্তু কেউ শেষ পর্যন্ত কথা বলে না। একদিন সকালে প্রমার খুব শরীর খারাপ। নাসির আগের মতোই ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে নিজের নাস্তা নিজে বানিয়ে খেয়ে বের হয়ে চলে গেলো। প্রমার সেদিন বুক ফেটে কান্না পাচ্ছিল। সেদিন সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলছিল,কেন আমি এমন সিদ্ধান্ত নিলাম? আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তুমি কি বুঝো না? এভাবে কি থাকা যায়? আর কত এভাবে এক ছাদের নিচে দুজন মানুষ কথা না বলে থাকবো। আর কত?

এই কথা প্রমা বলতে বলতে বিছানায় শুয়ে পড়ে। তার শরীর খুব দুর্বল হয়ে আসে। একসময় প্রমা সিদ্ধান্ত নেয় সবকিছু ভুলে সে নাসিরকে ফোন দিয়ে বলবে, তার আজ শরীর খুব খারাপ লাগছে। যেন অফিস থেকে তাড়াতাড়ি আসে। প্রমা ফোন হাতে নেয়। এমন সময় আবার তার অভিমান ফিরে আসে। না! সে কেন নাসিরকে একথা বলবে? নাসির তো তখন হেসে দেবে। প্রমার অভিমান হেরে যাবে। নাসির একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে বসবে, পারো না তো ঢংয়ের ডিসিশন নিলা কেন? এটা তো প্রমার সহ্য হবে না, আরও কষ্ট পাবে। তাই আর তার ফোনে প্রেস করা হলো না। আজও তাদের কথা হলো না।

নাসির যখন অফিস গেলো,জানতে পারলো তার প্রমোশন হয়েছে। সামনের মাসে বেতন বাড়বে ১০ হাজার টাকা। নাসির খুশিতে আত্মহারা। ভাবছিল প্রমাকে ফোন দিয়ে এই সুসংবাদটা জানাবে। কিন্তু নাসিরও আটকে গেলো। তারও মনে হলো, প্রমার এই সিদ্ধান্তটা যে ভুল এটা প্রমাকেই বুঝতে হবে। সে কেন আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাবে? নাসির আর প্রমাকে ফোন দিতে পারলো না। তাই প্রমোশনের বিষয়টি নিয়েও কথা হলো না দু’জনের।

সেদিন রাতে নাসির ঘরে আসলো। কলিংবেল দিলে দরজা খুলে দিল প্রমা। প্রমা আবার বিছানায় শুয়ে পড়লো। নাসির খেয়াল করলো,ঘরকে যেভাবে সকালে রেখে গেছে,সেভাবেই আছে। বুয়া কি আসেনি? রান্নাও হয়নি আজ। গতকালের খাবার ফ্রিজেই আছে। নাসির ওভেনে খাবার গরম করে খেলো। নাসির খুব চাচ্ছিল প্রমাকে জিজ্ঞেস করবে, ‘কী হলো খাওনি সারাদিন?’ দু’একবার ভাবলো, জিজ্ঞেস করবে। নাসির খাওয়া শেষ করে বেড রুমে গেল। ভাবলো প্রমাকে জিজ্ঞেস করবে। ঘরে একটা অসুখ অসুখ গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। নাসির বোঝে প্রমার খুব শরীর খারাপ। একবার ইচ্ছে করছিল কপালটা ছুঁয়ে দেখবে। কিন্তু তবুও সে পারে না। সে বিছানায় বসে থাকে অনেকক্ষণ। সব দেয়াল ভেঙে দিতে হচ্ছে হয়। ইচ্ছে হয় প্রমাকে আগলে ধরতে। শরীরের একটা তাপ এসে লাগে নাসিরের গায়ে। বুঝে প্রমার জ্বর। তবুও নাসির বসে থাকে। ভাবতে থাকে, একটু কি ধরা যাবে প্রমাকে?

প্রমাও টের পায় নাসির বসে আছে। প্রমা ভাবতে থাকে নিশ্চয়ই নাসির এখনই তাকে জড়িয়ে ধরবে। মনের অসুখে কাবু হয়ে জ্বর চলে এসেছে প্রমার। এটা কি নাসির বোঝে না? প্রমা চোখ বন্ধ করে অনুভব করে কোনো এক হাত এসে তার কপালে ছোঁয়। তারপর গালে কপালে চুমু খায়। অনুভব করে একটি হাত শাড়ীর ফাঁক গলে প্রমার পেটে স্পর্শ করে। প্রমা কেঁপে ওঠে। এসবই অলীক ভাবনা,অসুখের কল্পনা। এমন কিছুই হয় না। আরও কষ্ট হয় প্রমার। চোখ জোর করে বন্ধ করে রাখে। অপেক্ষা করে ঘুমের। তারপর মনের তাড়নাকে দু’জনই মাটি চাপা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সে রাতেও কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না।

৪.

সে রাতে যে দু’জন ঘুমিয়ে গেলো। সকালে যথারীতি চলে গেলো নাসির। তার তো প্রমোশন হয়েছে। যাওয়ার আগে তার প্রমোশন লেটারটা ডাইনিং টেবিলে রেখে গেছে। প্রমা যেন দেখতে পায়। প্রমা ঠিকই দেখেছিল। এবং আনন্দে তার জ্বর মনে হয় কমেই গেলো।

সে টয়লেটে ঢুকে একটা গোসল দিলো। চিন্তা করে রাখলো,আজ নাসিরের জন্য সে বিরিয়ানি রান্না করবে। নাসিরের বিরিয়ানি খুব পছন্দ। এবং সে অসম্ভবভাবে সাজবে। নাসির প্রায়ই বলতো,তোমাকে নীল শাড়িতে অসম্ভব সুন্দর লাগে।

তাই প্রমা নীল শাড়িটাও বের করে রাখলো। আজ সে সাজবে। নাসিরের পছন্দের নীল শাড়িটা পরবে। নাসির আসলে,জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদবে। কিন্তু ‘কথা না বলা’র বিষয়ে কিছুই বলবে না। ভুলেই যাবে সে। নাসিরও নিশ্চয়ই বিস্মিত হবে। তারপর দু’জন আবার অনেক অনেক অনেক কথা বলবে। গত দুই মাসে অনেক কথা জমে গেছে,অনেক ঝগড়া করবে এখন থেকে। ঝগড়া হোক হবে,কথা বলা ছাড়া এক ঘরে থাকা যে সম্ভব না,তা-তো প্রমাণিত।

৫.

এবার গল্পে রহিমকে আবার আনতে হবে। তাই এবার আমি এসে পড়লাম। কারণ এখন আমি ছাড়া গল্পের শেষটা কেউ বলতে পারবে না। ওটা বলার জন্য কারও না কারও কথা তো বলতে হবে। আমি এবার চেষ্টা করি প্রমার সঙ্গে কথা বলে গল্পে সবার নীরবতা ভাঙতে পারি কিনা। এছাড়াও নসিব নামে একটি চরিত্রও অল্প কিছুক্ষণের জন্য হাজির হবে। নসিব হলো নাসিরের ছোট ভাই। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

আমাদের দু’জনেরই আসা জরুরি। কারণ আমি এবং নসিব দু’জনই এখন হাসপাতালে। আমি যখন অফিসের পথে ছিলাম তখন নাসিরের ফোন থেকে আমার কাছে একটা ফোন আসে। নাসির নাকি রাস্তা পার হতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করেছে। নাসিরের ডায়েল লিস্টে প্রথম নম্বরটি আমার ছিল। কারণ গত সন্ধ্যায় নাসির আমাকে ফোন দিয়ে আজকে বাসায় দাওয়াত দিয়েছিল। বলেছিল,‘আমার প্রমোশন হয়েছে। এটা তো সেলিব্রেট করতে হবে,নাকি! তোমার বান্ধবী তো আমার সঙ্গে কথাই বলে না। বউয়ের সঙ্গে কথা না বলে কি থাকা যায় বলো? ভাবলাম অনেক হয়েছে। এবার এটা বন্ধ করতে হবে। ওর এই অভিমানটা আমাকেই ভাঙতে হবে। চলে এসো। প্রমাকে সারপ্রাইজ দেব আমরা দুজনে’।

তো,ডায়েল লিস্টে সর্বশেষ কলটা আমাকে করার কারণে,লোকজন আমাকে কল দিল। আমি ঢাকা মেডিক্যালে গেলাম,গিয়ে নসিবকে ফোন দিলাম। ভাগ্যিস ওর নম্বরটা আমার কাছে ছিল। আমি হাসপাতালে গিয়ে দেখি রক্তাক্ত নাসির। আসলে সে আর নেই। নিথরভাবে পড়ে আছে। বেচারা সুযোগও নাকি দেয়নি। একদম স্পট ডেড। ওর পরনে ছিল কালোসাদা রঙের চেক শার্ট আর জিন্স। পায়ে শু। শু দুটো আটুট আছে। জিন্সে হালকা রক্তের ছাপ আছে। কিন্তু শার্টটা পুরো লাল টকটকে। রক্তের একটা গন্ধও তৈরি হয়, সেই গন্ধটাও নাকে আসে।

আমি নাসিরের নিথর দেহটা দেখে ভাবছিলাম,এই পৃথিবীতে মানুষের জীবন বোধহয় সবচেয়ে সস্তা। এত সস্তা যে তার সারাজীবনের একটা স্বপ্ন মুহূর্তে নিভে যাবে। আর ফিরবে না কিছু,কিছুই ফেরানো যাবে না। মানুষই বোধহয় একমাত্র প্রাণী যার মৃত্যুর কোনো কারণ থাকে না,কিন্তু মরে যাওয়ার পর কান্নার অনেক কারণ তৈরি হয়। আমি ভাবছিলাম,আসলে প্রমাকে কীভাবে জানাবো? প্রমা তো আমার সঙ্গেও কথা বলে না। জানা হলো না কেন কথা বলে না। আমারও তো অভিমান আছে। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমি একটা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে রওনা দেই নাসির-প্রমার বাসায়। আমি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসা। পেছনে নাসির। কথা বলবে না আর।

নাসিরের ছোট ভাই নসিবকে আমি আগেই বাসায় পাঠাই প্রমাকে খবরটা দেয়ার জন্য। যখন অ্যাম্বুলেন্স বাসার সামনে গিয়ে থামে। তখন দেখি নসিব নিচে দাঁড়িয়ে। ছেলেটা অঝোরে কাঁদছে,তাকে থামানো মুশকিল। মৃত্যু কতটা করুণ তা তো এই ছেলে বোঝে। সে তো বাবা-মা সব হারিয়েছে। তবুও মাথার ওপর একমাত্র ছায়া একটা বড় ভাই তার শেষ আশ্রয় ছিল। এটা হয়তো বেচারা মানতেই পারছে না।

নসিব গাড়িটা দেখে দৌড়ে আসে। অ্যাম্বুলেন্সের গায়ে মাথা ঠেকিয়ে বলে, ‘ভাইয়া উঠো ভাইয়া,তোমাকে ছাড়া আমার কী হবে,ভাই প্লিজ উঠো’। আমি ভেবে উঠতে পারি না,আসলে আমার কী করা উচিত। আমি তার মাথায় হাতটা রাখি। সে আমাকে জড়িয়ে ধরে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,‘ভাবীকে তো কিছুই বলতে পারিনি ভাইয়া। ভাবী রান্না করছে। ভাইয়ার ফেভারেট বিরিয়ানি,আমি কীভাবে বলবো… আমি নিচে চলে এসেছি…’

আমি শুধু বললাম, ‘এখন শক্ত হওয়ার সময় নসিব। কেঁদো না,তোমাদের আত্মীয়-স্বজনদের খবর দাও। এটা ফ্রিজিং গাড়ি, অনেকক্ষণ রাখতে পারবে’। তারপর আমি গেটের দিকে এগিয়ে যাই। আমি ওপরে যাই না। বাড়ির দারোয়ানকে ওপরে পাঠাই। প্রমা একটা নীল শাড়ি পড়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসে। আমাকে এবং অ্যাম্বুলেন্স দেখে প্রমার মনে কোনো প্রশ্ন তৈরি হয় না। প্রমা কিছু জানতেও চায় না। আমি দরজাটা খুলে দিলে প্রমা একটু উঁকি দিয়ে দেখে। নাসিরকে দেখা যায় না। সাদা কাপড়ে তাকে ঢেকে রাখা হয়েছে।

প্রমা তারপর কি যেন ভাবে। কী ভাবে কে জানে। উপরে তাকায়। হয়তো আকাশ দেখে। তখন আকাশে একটা পাখিও উড়ে যায় না,আকাশও যেন কোনো কথা বলে না,নির্বাক নীল হয়ে তাকিয়ে থাকে। প্রমা আমার দিকেও তাকায় না। আমি প্রমার চোখের দিকে তাকাই। এক অদ্ভুত শূন্যতা চোখে,যেন শুকিয়ে কাঠ হওয়া কোনো মরুভূমি তৈরি হয়েছে। কোনো পানি নেই। আমি-নসিব-প্রমা এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকি। আরও থাকে দারোয়ান,অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার। আশ্চর্য! তখনও কেউ কারো সঙ্গে কথা বলে না। এক মগ্ন নিস্তব্ধতা যেন আমাদের গ্রাস করে। আমরা কেউ কোনো কথা বলতে পারি না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত