যাবজ্জীবন জেল মানে কত বছর?
আমরা বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে শুনে আসি, ইরফান মাস্টারের যাবজ্জীবন হয়; সে কাওয়ানাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তাহের মৃধা হত্যা মামলার আসামি, ফাঁসি তার হয় না, হয় যাবজ্জীবন- নিস্তরঙ্গ এই প্রান্তিক গ্রাম- বাদিহাটির ইরফান মাস্টার- খুন, ফাঁসি, যাবজ্জীবন ইত্যাদি বাদিহাটির নিত্যকার ঘটনা নয়; আর, এরসাথে যদি যুক্ত হয় পরকীয়ার মতো কড়াপাক উপাদান- তা জনে জনে রটে এমন আকার ধারণ করে যে তা সত্যের কতোটা কাছাকাছি, তা আর বোঝার উপায় থাকে না। বাদিহাটি কি পলাশিহাটার চা-খানায়, দেলোয়ারের দইয়ের দোকানে বহু উপলক্ষে আমরা শুনি- তাহের চেয়ারম্যান শুক্রবারের সালিশে চুরির অপরাধে পলাশিহাটা স্কুলের তরুণ বিজ্ঞান শিক্ষক ইরফান আলী মুন্সীর মাথা ন্যাড়া শাস্তি সাব্যস্ত করে! যদিও রটনাকারীদের বিশ্বাস, তাহেরের সুন্দরী-যুবতী স্ত্রী লুৎফার সম্পর্কের পরিণতি এই শাস্তি। দ্বিতীয় দফায় যখন মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয় লুৎফা; রটনাকারীদের জোর গুঞ্জন-গৃহশিক্ষক ইরফান মাস্টারের সাথে এ’সময় গড়ে ওঠা পরকীয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে চেয়ারম্যান ছুতো করে মোবাইল চুরির সালিশ বসায়। ২০০৩ সালের এই ঘটনা- বাদিহাটিতে মোবাইল তখন পর্যন্ত দুর্লভ এক বিষয়- তাহের চেয়ারম্যান ঘোষণা করে-ইরফান মাস্টার তার দামি মোবাইল সেট ঘর থেকে সরিয়ে নেয়, ঘটনার সাক্ষী এক গৃহকর্মী, সেই মোবাইল আবার পাওয়া যায় পলাশিহাটা স্কুুলসংলগ্ন ইরফানের ঘর থেকে!
মুরুব্বীরা আমাদের সামনে এই বিষয়ে কথা বলেন না; তবে আমরা পরম্পরায় শুনে বুঝি, সালিশের এক পর্যায়ে ইরফান মোটা বাঁশের লাঠি তাহের মৃধার মাথায় বসিয়ে দেয়!
এই সমস্ত মুখ চলতি গল্প- ষাটছুঁই তাহের মৃধা এলাকার বিশিষ্ট আইনজীবী শওকত আকন্দের সুন্দরী কন্যা লুৎফাকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে দিশেহারা হয়ে ওঠে; আর এ’কাজে তার প্রধান বাধা ফুলবাড়িয়া স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক শামসুল হক। এ’কান ও’কান হয়ে এলাকার সকলে জানে, শামসুল হক তার ছাত্রী লুৎফাকে পছন্দ করে ও দুই পরিবারের মতে তাদের বিবাহ অনুষ্ঠিত হবে। ঘটনা যখন নিকট ভবিষ্যৎ- ঠিক সেই সময়ে চাঁদজ্বলা এক রাতে শান্ত-স্থির শামসুল হক আকস্মিক উদোম গায়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গারো পাহাড় অভিমুখে সোজা দৌড় দেয়; আমরা পরম্পরায় জানতে পারি, শামসুল হক খারাপ বাতাসে পাগল হয়ে যায় ও পাবনার মানসিক হাসপাতালে স্থানান্তরিত হয়।
এরপর দ্রুত তাহের চেয়ারম্যান লুৎফার বাবার সম্মতিতে লুৎফাকে বিয়ে করে। কোন চাক্ষুষ নাই, তবে দুষ্ট লোকেরা বলে, লুৎফাকে বিয়ে করবার জন্যেই শামসুলকে পাগল বানায় তাহের- অবশ্য লুৎফা সহজে তাহের মৃধাকে বিয়ে করতে রাজি হয় না, প্রথম দফায় মাধ্যমিকে ফেল করবার পর বাবা-মায়ের পীড়াপীড়িতে তাকে রাজি হতে হয়। আর বিয়ের পর দ্বিতীয় দফা মাধ্যমিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবার জন্যে লুৎফার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পায় ইরফান। আর তার কয়েক মাসের মধ্যে ইরফানের সাথে লুৎফার সম্পর্ক নিয়ে নানা সন্দেহ শুরু করে তাহের চেয়ারম্যান।
১৪ বছর জেল খেটে পলাশিহাটা স্কুলের এককালীন বিজ্ঞান শিক্ষক ইরফান আলী মুন্সী ফেরে বাদিহাটিতে।
আমরা- যুবকেরা বড় উৎসুক হয়ে উঠি, ১৪ বছর পর ফিরে নিজের গ্রামে ইরফান মাস্টার পুনরায় কীভাবে নিজেকে সমাজে স্থাপন করে- তা বুঝতে; আমরা আরও উৎসাহী দেখতে যে, তাহের চেয়ারম্যানের স্ত্রী লুৎফা বেগম- যার সাথে ইরফানের পরকীয়ার রটনা এখনও, অন্তত প্রবীণদের স্মৃতিতে তাজা; ইরফান মাস্টার যাবজ্জীবন শেষে লুৎফা বেগমের সামনেই বা কীভাবে দাঁড়ায়! ইতিমধ্যে তাহের চেয়ারম্যানের মৃত্যুর পর নানা হাতঘুরে তাহেরের বিধবা স্ত্রী লুৎফা বেগমই স্বামীর একদার সেই চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত! কাওয়ানাড়া ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান নির্বাচিত চেয়ারম্যান লুৎফা বেগম।
দেলোয়ারের দইয়ের দোকানে আমরা-সদ্য যুবকেরা, বড় সাড়ম্বরে নিজেদের মধ্যে আলাপ জুড়ি, আমাদের মধ্যে সবচেয়ে তুখোড় বাক্যবাগীশ মোখলেস ক্ষণে ক্ষণে হাসতে হাসতে মরে, ‘বাংলা সিনামা একখান দেখুম চউক্ষে এইবার…!’
‘আরে দূরো…যাবজ্জীবন খাইটা মাস্টার সাব আসছে…তোমরা এইগুলা নিয়া তামশা করো বাহে…’ আমাদের একজন বিচক্ষণের মতো বলে।
‘…প্রেমের মরা জলে ডোবে না…। তবে মইরে ভূত হয়’ -কাজিমউদ্দীনের কথায় আমরা বুঝতে পারি, তাহের মৃধা যে পাগল সাব্যস্ত করে শামসুল মাস্টারকে, পাবনা থেকে সে আর ফিরে থিতু হতে পারে নাই, তার কথা বাদিহাটির স্মৃতিতে উজ্জ্বল। দু’মাস পরে পাবনা থেকে ফেরে ঈষৎ সুস্থ শামসুল মাস্টার; তবে ওই পর্যন্তই- আরেক চাঁদজ্বলা রাতে গারো পাহাড় অভিমুখী জঙ্গলের কাছাকাছি শামসুলের মৃতদেহ মেলে; চাক্ষুষ নাই যথারীতি- তবে দুষ্ট লোকেরা বলেই চলে, শামসুল হত্যার দায় তাহের মৃধারই।
আমাদের আড্ডা-মস্করার মধ্যেই একজন, ‘ইরফান মুন্সী আসতেছে’ বলে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, ‘এই যে আমরা সকলে বন্ধু…আর ইনি আমাদের ইরফান স্যার।’ ইরফান মাস্টারের এতো গল্প আমরা শুনে এসেছি; এখন চোখে দেখি- বয়স ৪৫/৪৬- মাঝারি উচ্চতার শক্ত পেটা শরীর, কালো গায়ের রঙ, ছোট করে ছাঁটা চুল, চোখের ভাষা তার শান্ত, মুখজুড়ে শীতল গাম্ভীর্য। চোখে তার ভারী চশমা; ঠিক খুনের মামলায় যাবজ্জীবন খাটা আসামি বলে মনে হয় না তাকে।
‘দেলোয়ার ভাই। চিনছেন?’
লাফ দিয়ে ওঠে দেলোয়ার, ইরফান মুন্সীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে- ‘আপনেরে চিনবো না …মাস্টার সাব! কী কন এইগুলা!’
‘এতো বছর পরে…আপনে সেইরকমই আছেন।… দই দেন….দই খাই। জেলে বইসা আপনের দইয়ের কথা ভাবছি অনেকদিন..।’- আমরা জনাকয়েক যুবক তাকে দেখে দাঁড়াই- এতোক্ষণে ঠাওর হয় তার; বলেন- ‘আরে তুমরা দাঁড়ায় রইছো ক্যান? বসো…বসো…।’
আমরা নিজেদের নাম বলি, তিনি আমাদের প্রত্যেকের পিতার নাম জিজ্ঞেস করেন; তার চোখ দেখে বুঝি- সকলেই তার পরিচিত।
১৪ বছর পরে; পলাশিহাটা স্কুলে ইরফান মাস্টারের বিজ্ঞান শিক্ষকের চাকরি থাকবার কথা নয়, চাকরি নাইও।
পলাশিহাটা স্কুলের নিকটবর্তী তার বসতবাড়ি, আছে আগের মতোই- বছর পাঁচেক আগে বাবা গত হন, মা গেছেন তারও আগে; বাড়িতে ছোটভাই সদরুল আলী মুন্সী সপরিবারে আছে, দুই ছেলেমেয়ে তার, ইরফান মুন্সী বিএসসি, বিএড- লেখাপড়ায় বড়ভাইয়ের মতো হতে পারেনি সদরুল; ফুলবাড়িয়া কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় দুইবার ফেল করে সেখানেই ইতি দিয়ে পলাশিহাটা গ্রামে জুতার দোকান দিয়ে বসে সে। পরিশ্রমী যুবক, বাবার সামান্য জমি আর নিজের ব্যবসা- প্রান্তিক এই গ্রামে মধ্যবিত্ত তাকে বলা যায়। একমাত্র বোন পারুলকেও পাশের গ্রাম কাওয়ানাড়ায় সুপাত্রে পাত্রস্থ করে সে; বলা যায়- বড় ভাই ইরফান মাস্টারের যাবজ্জীবন জেলের সুদীর্ঘ সময়ে সংসারের দেখভাল সদরুল ভালোভাবেই করে।
আমরা বুঝতে পারি, জেল থেকে এতোদিন পর নিজের এলাকা ও বাড়িতে ফিরে বড় ধরনের অনভ্যস্ততা ও অস্বস্তির মধ্যে পড়ে ইরফান মাস্টার।
না, তার ছোটভাই বা ঘনিষ্ঠ স্বজনেরা কেউ তার প্রতি নির্দয় নয় একেবারে, বরং এতোদিন পর ইরফান মাস্টার বাড়িতে ফিরেছে, এই নিয়ে সকলে একটু বেশি যত্নশীল, এটি যেন ইরফানকে আরও সংকুচিত করে। উৎসুক প্রতিবেশীদের প্রশ্নচোখ অবশ্য থাকেই, কানাঘুষো চলে আড়ালে আবডালে; ইরফানের সামনে সকলে একধরনের সল্ফ্ভ্রমপূর্ণ চোখে তাকায়; ইরফান মাস্টার- স্কুলের মাস্টারি ছাড়াও গৃহশিক্ষক হিসেবেও এলাকায় জনপ্রিয় ছিল, আমরা এ-ও জানতে পারি, তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল বাদিহাটিরই আকাদ্দছ ব্যাপারির কন্যা ফজিলার সাথে। ঠিকঠাক করা সেই বিয়ে আর হয় না, ইরফান যায় জেলে, ফজিলার বিয়ে নিয়ে বড় অনিশ্চয়তায় পড়েন তার বাবা-মা; অতঃপর বহু দেনদরবার শেষে তারা কন্যাকে এক বয়স্ক বিপত্নীকের সাথে বিয়ে দেন।
দিন গত হলে সবই স্বাভাবিক হয়- জীবনের এই নিয়ম। ইরফান মাস্টারও বাদিহাটির স্বাভাবিক জীবনের অংশ হয়ে ওঠে অচিরে, তাকে নিয়ে অনেকের প্রশ্ন বা উদ্বেগ নিশ্চিহ্ন হতে সময় লাগে না, ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকলে তাকে নিয়ে আর প্রশ্নচোখে তাকায় না কেউ, আস্তে আস্তে ইরফান মাস্টার আবার বাদিহাটিরই একজন হয়ে ওঠে।
জেলে যাবার আগে শিক্ষক হিসেবে যে পরিচিতি ও সম্মান পেয়ে অভ্যস্ত ইরফান; জেলফেরত ইরফান আর তা না পেয়ে পেয়ে অল্পদিনে তাতেও অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। পলাশিহাটা স্কুলতো দূরে থাক, অন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও খুনের আসামি হিসেবে যাবজ্জীবন দণ্ড ভোগ করা আসামিকে নেবে না; নেয়ও না কেউ ইরফানকে- তবে কাজ তো তাকে করতে হবে!
সদরুলের বুদ্ধিতে ইরফান ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করে; শুরুতে এই নিয়ে ইরফানের বিষম আপত্তি থাকে- ‘কেমনে ঠিকাদারি করি! ব্যবসার কী বুঝি আমি!’
‘আপনের কিছু করতে হবে না। আপনে বৈঠক করবেন, ইঞ্জিনিয়ারদের লগে… লেখাপড়া জানা লোক তারা ভালো পায়। বাকিটা আমরা করে নিবানে…।’
সদরুলের ভাবনায় আসে, আজকাল ব্যাপক রাস্তাঘাট হচ্ছে এলাকায়- বড় ভাই লেখাপড়া জানা মানুষ, ঠিক বুঝে কাজ বের করে আনতে পারবে।
ইরফান মুন্সী পারেও কাজ বের করতে, প্রথমে খানিক অসুবিধা হয় বৈকি- ১৪ বছরের জেলজীবন- সহজ কথা নয়, জেলে থাকা মানে হচ্ছে একটা বিন্দুর মধ্যে বসে থাকা; দিন নাই রাত নাই- সুনির্দিষ্ট চিন্তাহীন; তবে জেলখানাতেও নিজের মতো কিছু কাজ সে জুটিয়ে নিয়েছিল- জেলখানায় যেসব বন্দি লেখাপড়া জানে না, নিজ উদ্যোগে তাদের অক্ষরজ্ঞান দেয়া বা যারা অক্ষরের সাথে পরিচিত, তাদেরকে আরও কিছু বিদ্যার সাথে ক্রমান্বয়ে পরিচিত করা। ময়মনসিংহ জেলখানায় ইরফান মুন্সীর ১৪ বছরের ১০ বছর কাটে, এসময় অন্তত তিনজন জেলার পায় ইরফান- যারা এই কাজে তাকে উৎসাহ দেন, ইরফানের সময় কাটার সাথে সাথে লেখাপড়ার অভ্যাস যেমন থাকে, একই সাথে পত্রিকা পড়ার অভ্যাসও রয়ে যায়। জেলখানায় সে নিয়মিত পত্রিকা পাঠক- এটা সবাই জানতো।
ইরফানের নিজের ধারণা, কাজ করতে করতেই সে কাজের ভেতরের নানা বিষয় বুঝে উঠবে। হয়ও তাই- ঠিকাদারি ব্যবসা এমন কঠিন কোন বিষয় না, টেন্ডার জমা দেয়া- সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজটি নিজের করে নেয়া- সড়ক নির্মাণের কাজ পেতে রীতিমতো কোমর বেঁধে নামে ইরফান- বাদিহাটি-কাওয়ানাড়া ১০ কিলোমিটার বড় রাস্তা তৈরির কাজটি পেলে ছয় মাসে যে বিপুল লাভ তহবিলে জমা হবে, ইরফান হিসাব করে দেখে, এই টাকা মাস্টারি করে উপার্জন করতে তার সারাজীবন লেগে যেতো!
কাওয়ানাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সদয় দৃষ্টি লাগবে এই কাজে, আর সেজন্যে ইরফানকে যেতে হয় লুৎফার দপ্তরে।
আমরা যুবকেরা লক্ষ্য করি, ইরফান মাস্টার আপাদমস্তক ঠিকাদার হয়ে ওঠে, তার আপাত লাজুক হাবভাব অচিরে বদলে যেতে শুরু করে ও যার যার সাথে সম্পর্ক রাখলে কাজ পেতে সুবিধা হবে, সেখানে সে রীতিমতো জমা-খরচ দিয়ে চলে। আমাদের কয়েকজনকে সে তার কাজে অন্তর্ভুক্ত করে, আমরা দেখি- কাজ ছাড়া এই মানুষটা আর কিছু বোঝে না।
০২.
বহুবছর যাবৎ কোন মিথ্যা লাগাতার প্রচার পেলে তা সত্য হয়- লুৎফার সাথে ইরফান মুন্সীর পরকীয়ার জেরে তাহের মৃধা নিহত হয়, এই তথ্য এলাকায় বহু বৎসর প্রচল, সত্য বা মিথ্যা আমরা জানি না।
ইরফান মনে করতে পারে- চলচ্চিত্রের সব দৃশ্যের মতো সকলই তার চোখে মূর্ত ও স্পষ্ট; ১৭ বছর আগে, সে তরুণী লুৎফার গৃহশিক্ষক। পলাশিহাটা স্কুলে থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে, প্রথমবার সে ফেল করে- সায়েন্সই পড়বে সে; তাহের চেয়ারম্যান তাকে সায়েন্সের তিন বিষয় পড়ানোর জন্য গৃহ শিক্ষক নিয়োগ করে।
আমরা জানি না এর পরে কী হয়; কিছুই যদি না হয় তবে খেয়ালের বশে তাহের মৃধা সালিশ বসায় না, এইটুকু আমরা বুঝি।
ইতিমধ্যে আমাদের কতিপয় যুবকের সাথে ইরফান মাস্টারের হৃদ্যতা বাড়ে, ক্রমশ বাড়তেই থাকে। মানুষ এমনই- কোথাও না কোথাও তার হৃদয়ের ঘাট নোঙর ফেলে, জেল জীবনে ১৪ বছর- মুখের কথাতো নয়, জীবন-যৌবন সমস্ত সেখানে গেছে ইরফান মুন্সীর; বহুকাল বাদে খোলা আকাশের মুক্ত হাওয়া তার বুকের দরজাও কিছু খোলে বৈকি; বন্ধুরা সকলে সংসারী, ১৪ বছরের ব্যবধানে তালও কেটে যায়; তাই ইরফান মুন্সীর ভরসা হয়ে উঠি আমরা কয়েকজন যুবক। বয়সের ব্যবধান যেন দিনে দিনে কমে, আমরা তার নিকটবর্তী হই-ঠিকাদারি কাজে জোগানদারি থেকে শুরু করে সন্ধ্যায় দেলোয়ারের দোকান কি তারপর বানাড় নদীর কিনারে আমরা ইরফান মুন্সীর নিয়মিত সঙ্গী হই, বুঝতে পারি- নিজেকে আস্তে আস্তে ইরফান মুন্সী আমাদের একজন করে নিতে চায়। সব সময় না হলেও অধিকাংশ সময় আমাদের ভালোই লাগে, শিক্ষিত মানুষ- আমাদের মতো বেশিরভাগ মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক অনুত্তীর্ণদের সাথে কী সহজে মিশে যায়!
আমাদের যে বৃহৎ যুবক পরিমণ্ডল- তার মধ্যে তিনজন- মেহের, মোখলেস আর আমার সাথে ইরফান মুন্সীর বিশেষ অন্তরঙ্গতা বাড়ে। আমরা মাঝে মাঝে বানাড় নদীর তীরে ঘন আলাপে মাতি; শুরুর দিকে দূরত্ব থাকলেও কখন, কোন ফাঁকে ইরফান মুন্সী আমাদের ভাই হয়ে ওঠে, আমরা খেয়াল করি না-
‘ভাই! জেলে থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়া গেছিল; না?’ আমরা জিজ্ঞেস করি।
‘তা তো ঠিকই। তয় জেলের ভিতরে সময় স্থির হয়া বয়া থাকতো। রাইত-দিনের আনিগুনি নাই জেলের মধ্যে। সব এক জায়গাত। না গেলে বুঝবা না।’ বলে আর মৃদু মৃদু হাসে ইরফান।
ইতিমধ্যে কাওয়ানাড়ার চেয়ারম্যান লুৎফা বেগমের আপিস কামরা বারকয়েক ঘুরে আসে ইরফান মুন্সী। কয়েকবার আমরা তিনজনও যাই তার সাথে। আমি, মেহের আর মোখলেস। দাপুটে নারী লুৎফা- স্বামী তাহের মৃধার মৃত্যুর সময় কতই বা বয়স তার?- ২৮/৩০?- তাহের মৃধার ভাই-ব্রাদাররা চায় চেয়ারম্যান তাদের মধ্য থেকে হবে, ক্ষমতা নেয়ও তারা- কিন্তু লুৎফার সাহস আর বুদ্ধির সাথে পেরে ওঠেনা। লম্বায় মাঝারি, স্বাস্থ্য খানিক বেশি ভালো, এখনও মাথায় ঘন লম্বা কালো চুল- গায়ের রঙ কালো, নিখুঁত- মসৃন ঝকঝকে ত্বক, বোঝা যায়- তারুণ্যে লুৎফা দারুণ আকর্ষনীয় ছিল। এখন বয়স কত তার? ৩৭/৩৮? মুখ-চোখ রোদেপুড়ে রুক্ষ হয়ে গেলেও, বলা যায়- এখনও লুৎফা বেগম দেখবার মতো একজন বটে। বাদিহাটিতে আমরা সবাই জানি, লুৎফা বেগম চেয়ারম্যান হবার পরে আর যখন-তখন হাসে না। হাসলে তাকে বড় নরম আর সুন্দর লাগে।
ইরফান মাস্টারের সাথে লুৎফা বেগমের দপ্তরে বসে লক্ষ্য করি, আমরা তো বটেই, ইরফান মুন্সীর সাথেও কাজের কথা ছাড়া চোখের একটা পাতাও কাঁপে না লুৎফা বেগমের। সোজাসাপ্টা কথা- ‘নিয়মের মধ্যে কাজ করেন। এর বাইরে আমি যামু না। আমার লোকজন আছে, তাদের সাথে কথা কয়া নেন।’…ব্যস…।
শুরুতে অবাক হলেও বুঝতে পারি, লুৎফা বেগম কাউরে বুঝতেই দিতে চায় না যে, একদিন ইরফান মুন্সীরে সে চিনতো বা কিছু!
ইরফান মুন্সীও তাই, চিন-পরিচয়ের মধ্যে না গিয়ে সোজা কাজের কথা বলে-টলে আমাদের নিয়ে চলে আসে।
একদিন দেলোয়ারের দোকান হয়ে আমরা তিনজন বসে আছি বানাড় নদীর টংয়ে, ইরফান মুন্সীর পাশে। আমরা সাহস করে জিজ্ঞেস করেই বসি- ‘ভাই, বলা যাবে- লুৎফা বেগমের সাথে সম্পর্কটা কী ছিল?’
ইরফান মুন্সী মুখ অন্ধকার করে; আমরা ঘাবড়ে যাই- সম্ভবত তার সাথে আমাদের এই প্রশ্নের উত্তর জানবার মতো অন্তরঙ্গতা তখনও তৈরি হয়নি। আমরা নতমুখে নদীর দিকে তাকাই।
নাহ্, আমাদের ধারণা ভুল- ফোস ফোস করে দ্রুত নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে ইরফান মুন্সী বলে, ‘শালার তাহের বুড়া আর কাম পায় নাই। শেষ বয়সে বিয়া করছে!..যা হবার তাই হইছে। হাতের কাছে আর কাউরে না পায়া আমারে ধরছিল লুৎফা!…’
আমরা উৎকণ্ঠার সাথে শুনি।
‘শরীল গরম করবা। নিভাবা না? বউ বয়া থাকবো!’
মেহের, মোখলেস বা আমার সম্পর্কে ইরফান মুন্সির ধারনা স্পষ্ট- এই কথা অন্য কোন কান হবে না। অবশ্য এতো বড় কাহিনী পেটে জমা রাখা সত্যি কঠিন! আমাদের পেট কথার চাপে গুড়গুড় করে! আমরা না বললেই কি; বাতাসেরও বুঝি কান আছে! কথাটা ছড়ায় কীভাবে জানি না, তবে ছড়ায় যে, বুঝতে পারি। আমাদের সামনেই ইরফান মুন্সীর দিকে একদিন গম্ভীর চোখে তাকায় লুৎফা বেগম, সেদিন আমরা যাই ইরফানের সাথে তার দপ্তরে, বড় সড়কের কিছু কাজ এইবার আমাদের চাই।
‘ইরফান মিয়া। মুখের কথার লাগাম যে নাই?’ লুৎফা বেগম আমরা যে তিন যুবক ইরফানের পাশে বসা, তাতে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে ধমকের সুরে বলে।
ইরফানের মাথা নিচু। ধীরে বলে, ‘ কিয়ের লাগাম? আমি আবার কোন্ কথা কইলাম?’
‘আপনে জানেন, আপনে কী কন বা কইতে চান। আমার এতোদিনের কষ্টে গড়া এই চেয়ার, আপনে ফুঁ দিয়া উড়ায় দিবেন!’
‘ছি! ছি!…এইতা কিতা কন! কিয়ের ফুঁ দিমু! ক্যান দিমু?’
‘মুখ সামলান। আরেকবার কিছু কানে আসলা জিব টাইনা ছিঁড়ূম।’ লুৎফা বেগমের চোখ দিয়ে আগুন বেড়োয়।
আমাদের সমুখেই এই কথোপকথন।
আমরা নিশ্চুপ শুনি, আর ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় কাঁপি। এ’ দেখি জমাটি গল্প- খড়সান চেয়ারম্যান লুৎফা বেগম ডরাইছে, তার অতীতের গপ্পের ডালি না হাটে ভাঙ্গে। আমরা অবশ্য মুখ খুলবো না, আমরাতো ইরফান মুন্সীর নিকটজন!
তবে হাটে গল্পের হাঁড়ি ঠিকই ভাঙ্গে। এর-ওর কান হয়ে ফিসফিস ধ্বনি নানা ডালপালায় ছড়ায়।
বড় সড়ক তৈরির কাজ ইরফান মুন্সী পায় না। এক রাতে তার ঘরে আগুন লাগে।
‘বুঝি, বুঝি। সব বুঝি। আমারে এলাকাছাড়া করবার চায়। যে যায় চেয়ারে… সেই পায় আমারে…!’ সুর মিলিয়ে রাগ ঝাড়ে ইরফান- ‘ আমার তো কাজ করতি হবে। ডরাইলে চলবে না।’
ঘরে আগুন লাগবার পর লুৎফার মুখোমুখি হয় তার দপ্তরে ইরফান, এবার সে একলা যায়। আমরা পরবর্তী সন্ধ্যায় তারই মুখে শুনি সেই বয়ান।
লুৎফা সোজা ইরফানকে বলে, ‘আমি চাই না আপনে এলাকায় ঘুরঘুর করেন। পুরান গন্ধ ঠেলে বাইর হোক- চাই না।’
‘আমি কোন গন্ধের মইদ্যে নাই লুৎফা। জেলে জীবন গেল, এখন বাঁচতে তো দিবা…!’
ইরফানের মুখে তুমি সম্বোধনে রাগে ফেটে পড়ে লুৎফা।
‘এলাকার চেয়ারম্যানের লগে কেমনে কথা কইতে হয়, জানেন না! আপনেরে স্কুলে মাস্টারি দিয়া দেই…মাস্টারি করবেন চুপচাপ। আর কোনদিন যেন আমার ত্রিসীমানায় না দেখি।’
‘মাস্টারি আমি করুম না লুৎফা। ঠিকাদারিতে পয়সা আছে। টেকা জমাইতেছি। আমিও পলিটিক্স করুম। আগামী ইলেকশনে দাঁড়ামু আমি ..দেখি… ক্ষমতার দাপট কেমনে এতো বেশি! তাহের মৃধা আমারে যাবজ্জীবন খাটাইলো, তুমি আমারে ইন্দুর মনে কইরা ঢিলাইতেছো!’
…আমরা সন্ধ্যায় এই বয়ান শুনি আর আনন্দিত-উত্তেজিত হয়ে বন্ধুদের কাছে না বলে পারি না ইরফান মাস্টারের বাহাদুরির গল্প- ‘ব্যাডা একখান। মুখের উপরে কয়া দিছে। ইশ…মনে নাই…পুরান কথা! ক্ষেমতা দেখায়!’
আমাদের অবিরাম গল্প চলতে থাকে; আর এর মধ্যেই ইরফান মুন্সী এক চাঁদজ্বলা রাতে নিজের বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা গারো পাহাড় অভিমুখী জঙ্গলের দিকে উদোম গায়ে ঝেড়ে দৌড় দেয়। আমরা বলতে থাকি- হায়, হায়! খারাপ বাতাসে পাগল হয়া গেল ইরফান মুন্সী।
এতোদিন আমরা শুনেছি, শামসুল হক নামের একজন বহু বছর আগে চাঁদজ্বলা রাতে নিজের ঘর থেকে বের হয়ে উদোম গায়ে দৌড় দিয়েছিল; আজ আমরা দেখতে পাই- ইরফান মুন্সী সেই একই কাজ করে।
সব খারাপ বাতাসের দোষ বলে আমাদের বিশ্বাস করতে হয়।