স্বর্গের ফুল

স্বর্গের ফুল
আমার মেয়েটা দুই বছর পর থেকেই আমার পাশে ঘুমায়। আগে আমাদের মাঝখানে ঘুমাতো। এখন আমি মা মেয়ের মাঝখানে ঘুমাই। মেয়ে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত ওর দিকে ফিরে শুতে হয়। ওর মায়ের দিকে তো ফিরতেই পারি না। ওর মা যদি আমার গায়ে হাত দেয়। ঠেলেঠুলে ফেলে দেয় হাত। সারা রাত ঘুমের মধ্যেই অনেক বার আমার মুখে হাত দিয়ে দেখে দাড়ি আছে কিনা। যদি দাড়ি না পায় তারমানে ওর পাশে ওর মা। সাথে সাথে কান্না। ওর মা আছে বিশাল জ্বালায়। মেয়ে জেগে থাকা অবস্থায় আমার কাছেও ঘেষতে পারে না।
গতকাল রাতে আমার অনেক জ্বর ছিল। তাই বউকে বললাম মেয়ে ঘুমালে ওর পাশে নিয়ে যেতে। কিন্তু রাত আড়াইটার দিকে মেয়ে সাইরেন বাজিয়ে দিলো। আমার মেয়ের কান্নার গলা মাশাআল্লাহ্। ওর মায়ের চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলার যোগাড়। ওর মা কোনো রকমে হাসতে হাসতে চুল ছাড়িয়ে মেয়েকে বলল, ‘আমার কি দোষ মা? আমাকে মারিস কেন? তোর বাবাইকে মার। তোর বাবাই তোকে আমার পাশে তোকে আনতে বলেছে।’
মেয়ে কি আর এসব শোনার মানুষ। ওর মাকে পারে না মেরে ভর্তা বানাতে। আমার গায়ে তখনো জ্বর অনেক। তাও
মেয়েকে আমার পাশে শোয়ালাম। মেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। আহ্লাদী মেয়েটা আমাকে ছাড়া থাকে না। অফিস থেকে আসলেই মেয়েই আগে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় কলিংবেলের শব্দে। মেয়ের বয়স এখন সাড়ে তিন বছর। সারাদিন কুটকুট করে কথা বলে। জিগ্যেস করলাম, ‘মায়ের পাশে শুলে কি হয় মামনী?’ মেয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলে, ‘আম্মু তো পতা। আমাকে আদর দে না।’
‘আহারে আমার মেয়েটাকে আদর দে না। কিন্তু তোমার আম্মু তো তোমাকে এত্তোগুলা ভালবাসে।’ ‘আম্মু আমাকে আজ তক্কেত দি আক্কিরিম দে নাই। আম্মু পতা।’ বউ বলল, ‘দেখছো তোমার মেয়ে কি মিথ্যা কথা বলে। ওকে বিকালে চকলেট দিয়ে আইসক্রিম খেতে দিয়েছি। আর এখন কি কুটনামি করছে এই গেদা বয়সেই।’ বললাম, ‘তোমারই তো মেয়ে। তোমার মতোই তো হবে।’ বলা বাকি কিন্তু বউ পিছন থেকে জোরে একটা ঘুষি দিলো পিঠে। সাথে আরেকটা চিমটি দিয়ে বলল, ‘থাকো তোমরা বাপ বেটি এক সাথে। আমি কে? আমি তো কেউ না।’ পিছন ফিরে দেখি বউ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে আছে।
একে তো শরীরে জ্বর। তার উপরে একদিকে বউ আরেক দিকে মেয়ের অভিমান। এই দুই অভিমানীকে নিয়ে কি যে করি। কিন্তু তাও বউয়ের দিকে ফেরার উপায় নেই। মেয়ে চিল্লাবে তাহলে। মেয়ের এক অভ্যাস হলো কিটক্যাট চকলেট আইসক্রিমে লাগিয়ে খাওয়া। কিন্তু মেয়ের আবার ঠাণ্ডা লেগে যায়। তাই বউ কম দেয়। তাও মেয়ের দিকেই আমাকে সাপোর্ট দিতে হয়। নয়তো মেয়ের অভিমান সহজে আর ভাঙ্গানো যাবে না। মেয়েকে বুকে নিয়ে ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকাল বেলা ঘুম ভাঙতেই দেখি শরীর ঝরঝরে। বউ আর মেয়ে কেউ বিছানায় নেই। ওরা অনেক ভোরে ঘুম থেকে কি করে যেন উঠে যায়। শরীরে কোথাও জ্বরের ছিটে ফোটা নাই। আমার এতো তাড়াতাড়ি জ্বর সারে না। মেয়ে হওয়ার পরে এই প্রথম জ্বর হলো আমার। আর অদ্ভুত ভাবে খেয়াল করলাম, মেয়ের জন্যই জ্বর গায়েব হয়ে গিয়েছে। বিছানায় শুয়ে অন্য রুম থেকে মা মেয়ের কথা শুনছি। এমনিতে মা মেয়ের ভীষণ ভাব। কিন্তু আমি যদি থাকি তাহলে ওর মাকে পাত্তাও দেয় না।
বিয়ের আগে ভাবতাম কিভাবে সংসার করবো। আমি তো সংসারী মানুষ না। কিন্তু বউ আমাকে এমন ভাবে সংসারে বেধে ফেলেছে; এখন এই সংসারই আমার কাছে জীবনের কাছে পাওয়া একটা উপহার মনে হয়। আর সবচেয়ে সেরা উপহার আমার বউ আমাকে দিয়েছে। আমার মেয়ে। ওকে বুকে নিলে সারা দুনিয়ার সব কষ্টই বিলীন হয়ে যায়। আর জ্বর? সেতো মামুলি ব্যাপার মাত্র। যার বুকে স্বর্গের ফুল ঘুমায় তার শরীরে কি আর জ্বর থাকতে পারে বেশিক্ষণ?
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত