এক্কা দোক্কা তেক্কা আর এই চার। চারের বাম দিকের ঘরে খেলসি, এই এখন এই যে ডান দিকের ঘরে চারা পরসে। ডান দিকে খেলব এখন।
-কী মিথ্যা কথা! এত মিথ্যা কথা বলো কেন বুড়ি? তখনো তো ডান দিকের ঘরে খেললা। এখন বাম দিকের ঘরে খেলার কথা।
-এই, তুই ডান-বাম চিনস? যা, বাপ মারে ক’ ডান-বাম চিনাইতে। সারাক্ষণ তো তারা মোবাইলে কী ঘাঁটে! পোলাপানরে আদব শিখাইবে কখন!
-এই, তুমি আমার বাবা-মাকে নিয়ে কথা বলবা না। ফালতু খুন্তি বুড়ি।
-আর যদি খুন্তি কইসোস তো খুন্তি দিয়েই তোরা বাইরামু। বদ। ভাগ।
চলছে এমন করেই। হয় তো এমন করেই চলবে। বুড়ি, ওরফে জমিলার মা, ওরফে রতনের নানি। অনুমানে বেঁধে দেয়া এক বয়সে রয়ে যাওয়া এক অঞ্চলের বটগাছ, মাটির সাথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেমন গেঁথে থাকে, বুড়িও তাই। বহুদিন ধরে ছিল, বহুদিন ধরে আছে। অনুমান বলে, বয়স অনেক, সাদা তুলোর মতন ফোলা ফোলা চুল আর টিকটিটির লেজের মতন চিকন বেণীর আগাটুকু বলে দেয় তার অনেক বয়স। শুকনো বরইয়ের মতন কুঁচকে যাওয়া শরীরের রেখা বলে, তার বয়স অনেক।
পাঁচতলা আধুনিক দালানে তার বাস। সুসজ্জিত আধুনিক ঠাণ্ডা মার্বেল পাথরের মেঝেওয়ালা ফ্ল্যাটগুলোতে নয়। ছাদের কোণে, সিঁড়িঘরের মুখে যে ছোট্ট অর্ধেক একটি ঘর আছে, সেখানে বুড়ির বাস। কতদিন ধরে থাকে কে জানে! কেউ মনে রাখেনি। পাঁচ বছর, দশ বছর কিংবা সাত বছর? কে জানে! যেমন কেউ মনে রাখেনি তার নাম। বুড়িরও কি মনে আছে তার নাম?
ছুটির দিনগুলোতে এ দালানের এ-বাসা ও-বাসার বাচ্চা-কাচ্চাদের সাথে সে খেলে এক্কা দোক্কা। তিন তলায় মহসিন সাহেব থাকেন। এ বিল্ডিংয়ের ডাক্তার সাহেব। গভীর রাতে চেম্ব্বার শেষ করে যখন সে বাড়ি ফেরে, গেটের মুখে প্রায়ই বসে থাকে বুড়ি। মহসিন সাহেবের রুপোলি গাড়ি গেটে ঢুকবে, তার অপেক্ষায়।
-কী বুড়িমা, কী বিষয়?
-হাঁটুতে বিষ।
আমি বুঝি না? হাঁটুব্যথা তো এক্কা দোক্কা খেলো কেমন করে তুমি? তখন কি ব্যথা হয় না?
বুড়ি নিরুত্তর।
মহসিন সাহেব প্রতিবার বুড়িকে বলে, সকালে আমি বের হওয়ার আগে বাসায় এসো, ওষুধ দিয়ে দেব।
দু-তিন মাস পরই বুড়ির পায়ে ব্যথার নালিশ। আর এক্কা দোক্কা খেলবার সময় ব্যথা কি যায়, সে উত্তরও বুড়ি কাউকে দেবার প্রয়োজন বোধ করে না।
অগত্যা চলতে থাকে এক্কা দোক্কা খেলা বুড়ির পায়ে ব্যথা, এবং এ দালানের নিত্যদিনের বৈচিত্র্যহীন ঘটনা। বাচ্চা-কাচ্চারা খেলার চেয়ে আগ্রহী খেলাবিষয়ক অন্যান্য ঘটনায়। এই বুড়ি কেমন করে জীর্ণ-শীর্ণ রগ বের করা খসখসে দু’পায়ে ভর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এক্কা দোক্কার এ-ঘর ও-ঘর পার করে। কেমন করে চুরি করে জিতে যেতে চায় বুড়ি। বুড়ি ভারি চোর!
এই আজ যেমন। চার নম্ব্বর ঘরে দুটো দাগ। ডান দিকের ঘরের খেলা শেষ করে ফিরে এসে যখন ইটের চারাটি ছুড়ে মারল নিশানা মতন, সেটি বামের ঘরে না যেয়ে পড়ল আবার ডানের ঘরে। মিথ্যুক বুড়ি চালবাজি করে আবার ডান দিকের ঘরে খেলতে চাচ্ছিল। এই নিয়েই আজকের ঝগড়া। খেলা শেষের প্রতিবারের এই নিয়মমাফিক ঝগড়া যেন খেলার এক অংশ। বুড়িকে যদি ‘খুন্তি বুড়ি’ বলে ডাকা হয় তো ব্যস। বিনোদনে ভরপুর এক ঝগড়া শুরু হয়। বাচ্চাগুলো খেলার শেষের এই অংশের জন্যই অপেক্ষা করে বেশি।
বুড়িকে আড়ালে সবাই ডাকে খুনখুনে বুড়ি। চারতলার নাবিহার তিন বছরের ভাই নাবিল। প্রতি ঘরে যে নিয়ম। খেতে না চাইলে, নিয়ম না মানলে জুজু বুড়ির ভয়। মা বলে, ুনা খেলে রেখে আসব ওই খুনখুনে বুড়ির কাছে। নাবিহা ঠিক মানে বোঝে না খুনখুনে শব্দটির। নিজের মতো ছোট্ট করে ডাকে ‘খুন্তি বুড়ি’। আর নাবিহাকে দেখে অন্য বাচ্চা-কাচ্চারাও শিখেছে ‘খুন্তি বুড়ি’। কাউকে রাগিয়ে দেবার মতন আদি বিনোদন যে আর নেই, তা তো শিশুরাও বোঝে। তাই চলে রাগিয়ে দেওয়া, রেগে যাওয়ার খেলা। এ খেলা খেলতে খেলতে যখন উভয় পক্ষ ক্ষান্ত দেয়, আকাশে তখন সূর্যের কুসুমরঙা লাল আভা। পশ্চিম পাশের মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান। আজকের মতন ফিরে যায় সবাই, যে যার ঘরে। বুড়ি ফিরে যায় তার অর্ধেক ঘরে।
অর্ধেক ঘরের এক গল্প আছে। সিঁড়িঘর তৈরির পর সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই বাম দিকের কোনার এক বড় অংশ খালি পড়ে ছিল। সেখানে অর্ধেক দেয়াল তুলে তৈরি হলো অর্ধেক ঘর। পুরো দালানের অব্যবহূত মালপত্র, ফেলে দেওয়া বাক্সপেটরার ঘর ছিল। বুড়ি ওরফে জমিলার মা ওরফে রতনের নানি সেই কবে মনে না করতে পারা সময়ে যখন এ দালানের মূল দরজার পাশে সিঁড়িঘরে গা-ভর্তি জ্বর আর খুশখুশে কাশি নিয়ে থাকা শুরু করল, ঠাণ্ডা মার্বেল পাথরের ফ্ল্যাটগুলোতে থাকা মানুষদের বিবেক খচখচ করে উঠল। কারও মনে পড়ল মায়ের কথা, কারও বা নিজের ভবিষ্যতের কথা। বহু আলাপ-আলোচনার পর, বুড়ির ঠাঁই হলো ফেলে দেওয়া বাক্সপেটরার অর্ধেক ঘরটিতে। নিজের মতন সাজিয়ে-গুছিয়ে, ফেলে দেওয়া জিনিস থেকে তুলে নেওয়া প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে বুড়ি আধখানা ঘরটি বানিয়ে ফেলল নিজের ঘর।
জমিলা তার মেয়ে। মরেছে সেই কবে! জমিলার ছেলে রতন তখন ছোট। রতন এখন কই, বুড়ি জানে না। জানবার উপায়ও সে জানে না। বুড়ির স্বামী কত কত বছর আগে মরেছে, বুড়ির আর সে চেহারাও মনে পড়ে না। যেমন মনে পড়ে না নিজের ফেলে আসা নাম। বুড়ির বাস বর্তমানকে ঘিরে। তিনবেলা খাওয়া জোটে; এ-বাড়ি ও-বাড়িতে। কারও বাড়ির ময়লা ফেলে দিয়ে আসে তো, কারও বাড়িতে যেয়ে কয়টা থালাবাসন ধুয়ে দিয়ে আসে। তার বদলে খাওয়া, অল্প খুচরো টাকা পায়। বকশিস পায় উৎসব-পার্বণে, ঈদে-চাঁদে। প্রতি ঈদে একটি শাড়ি পায় এ দালানের মালিক সমিতির পক্ষ থেকে। বৃষ্টি এলে ভিজতে হয় না। পাকা ছাদের নিচে তার ঘর। একটা কাঁথা, মোটা কম্ব্বল আর হাতপাখা আছে। আর আছে সবুজ রঙের মুখ-বন্ধ এক মাঝারি টিনের ট্রাঙ্ক। বেঁচে থাকার জন্য আর কিছু লাগে বা লাগতে পারে, তা অবশ্য বুড়ির জানা নেই। মাঝেসাঝে পাঁচতলার ডানদিকের ফ্ল্যাটে রাতে খেতে ডাক দেয় তাকে। বদলে রাতের থালা-বাসন ধুয়েমুছে যখন ফিরতে যায়, বসার ঘরে তখন তারা মন দিয়ে টিভি দেখছে। নাটক। অন্য ভাষার। কিন্তু দেখতে ভারি সুন্দর! কিছু বুঝতে হয় না। এমনি তাকিয়ে থাকলেও চোখের আরাম।
বাড়ির মেয়ে সুইটি ডাকে-
-কী খালা, দেখবা নাকি নাটক? হিন্দি বুঝো? বসো। রান্নাঘর থেকে টুল নিয়ে আসো।
টুলে বসে মন দিয়ে সে নাটক দেখে। কত রঙ, কত আয়োজন! রাতে ফিরে যখন তার আধখানা ঘরে ঘুমুতে আসে, চোখে তখন সে রঙের ঘোর। এমন করেই শেষ হয় তার নিত্যদিন।
এ দালানের সবাই বুড়ির কাছের। দিনে দিনে তাদের গল্প জেনেছে, কষ্ট জেনেছে। কতদিন তাদের ওপর রাগ হয়, কষ্ট হয়। ভুলে যায়। এমন জানা আর ভুলে যাওয়ার মাঝে, সব বাসিন্দাদের জন্যই তার মায়া। দোতলার নতুন বৌটার নাকি প্লেনে প্লেনে ঘোরার চাকরি। একই রকম শাড়ি, পরিপাটি চুল আঁচড়ে বৌটা যখন ছোট্ট এক স্যুটকেস হাতে দু’দিনের জন্য বিদেশ যায়, প্রতি সপ্তাহে, বুড়ি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। অকারণে চোখ ভেজে। ফিরে আসবে জেনেও। বৌটা সুন্দর করে হেসে হাত নেড়ে যখন বর আর শাশুড়ির কাছ থেকে বিদায় নেয়, বুড়ি তাকিয়ে দেখে। কী সুন্দর হাসি যে মেয়েটার!
কিন্তু প্রত্যেক মানুষের জীবনে সব প্রিয়র চেয়েও একজন প্রিয় থাকে। কাছের থেকেও কাছের। বুড়ির সে প্রিয়র চেয়ে প্রিয়জন হলো সুইটি। যার সাথে সে প্রায়ই রাতে বিদেশি নাটক দেখে। সুইটিকে বুড়ি ডাকে ‘মনা’ বলে। অতো কঠিন বিদেশি নাম তো তার মনে থাকে না। মনাকে তার ভারি পছন্দ। মনার চুল কেমন বিদেশিদের মতন এলোমেলো করে কাটা! চুলের আগের রঙ গোলাপি। একদম কড়া গোলাপি।
-তোমার চুলের এমন রঙ কেন?
-সুন্দর না, খালা? রঙ করসি। এইটা ফ্যাশন।
চুল গোলাপি করে কেউ? এইটা কোন দেশি নিয়ম?
-হুঁ, চলো তোমাকেও করে দিই। তোমার চুলে করে দিলে তোমাকে লাগবে পুরা ক্যান্ডিফ্লসের মতন।
ওইসব আমি চিনি না মনা।
-হাওয়াই মিঠাই চিনো? ওই রকম লাগবে। করবা?
সুইটির সাথে বুড়ির এমন ধরনেরই খাতির। বুড়ি যদি আবার জন্মাতো, তাহলে সে এমন হতে চাইতো। সুইটির মতন। যাকে সে মনা বলে ডাকে। যে দেখতে একদম বিদেশিদের মতন। সুইটিই একজন, যে বুড়ির আগের জীবনের গল্প শুনতে চায়। গাছ পাড়া আম দিয়ে, পাটি পাতা, রোদে বিছানো আমসত্ত্ব তৈরির গল্প, কোমর ছড়ানো চুলে খেজুর বেণী বাঁধার গল্প, শীতের সকালে পুকুরে প্রায় ডুবতে বসা, বেশ ওঠা এক ছেড়া, পুরনো হলদে হয়ে যাওয়া সময়ের গল্প। সে গল্প সব সময় হয়ে ওঠে না। আসা-যাওয়ার পথে যখন টুকরো সময় মেলে, তখন গল্প হয়।
এ-বাড়িতে ও-বাড়িতে ঘুরে, এ-কাজ ও-কাজ করে যে সময় বাঁচে, বুড়ি তার আধখানা ঘরে কাটায়। ভাঁজ করা কাঁথা আবারও ভাঁজ করে রাখে। সাদা-নীল চেক কাপড়ের চৌকির চাদর, হাত দিয়ে টেনে টেনে সমান করে। আধখানা ঘর যেন ছবির মতন পরিপাটি।
নিচের তালার মূল গেটের পাশে, দারোয়ানদের ঘরের পাশে একটি ছোট রান্নাঘর। যেদিন কোনো বাসা থেকে ভালো খাওয়া জোটে না, খুচরো টাকা দিয়ে বাজার থেকে এটা-সেটা এনে রান্না করে। কলমি শাক কিংবা দুটো উচ্ছে, ডাল। কখনো দারোয়ান, কেয়ারটেকারদের রান্নাও করে দেয়। বদলে সেই বেলার খাওয়া জোটে। আর ছাদের কোণে যে ছোট্ট টয়লেট আছে, সেখানে এক কোণে, তার কাপড় ধোয়া, গোসল-ওজুর কাজ সারে। এমন করেই কাটছে দিন।
শুধু সবুজ রঙের ট্রাঙ্কটি কখনো খুলতে দেখা যায় না। কে জানে, কী থাকে ভেতরে!
এক্কা দোক্কা খেলতে এলে নাবিহা মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে, ভেতরে কী?
-পেত্নী থাকে গো পেত্নী। শাকচুন্নি। দেখবা?
নাবিহা মুখ বাঁকিয়ে এক্কা দোক্কার চারা খোঁজে, ফুলের টবগুলোর আশেপাশে।
আজকালকার পোলাপান, বোঝে বেশি। ভয় কম। আদবও। মনা মানে সুইটিই একটু অন্যরকম। বুড়িকে বিশ্বাস করে, বুড়ির কথা শোনে। নিজের কত কথা বলে! বুড়ি শোনে। সব বোঝে না যদিও।
প্রায় প্রতি রাতের মতন আজও বুড়ি মনাদের বাড়িতে গেল এঁটো থালাবাসন ধুতে। দুপুরের জমে থাকা থালাবাসন। তার বদলে বুড়ির জন্য একটা পুরনো আইসক্রিমের বাক্সে রাখা আছে কালকে রাতের রান্না করা খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ। এখন কেউ বাসায় নাই। কোথায় এক বিয়ে খেতে গেছে। বাড়িতে মনার বড় ভাই আছে, সে যায়নি। অসামাজিক ধরনের। মনার মতন মন বড় মানুষ না। দরজা খুলে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেছে। কাজ সেরে যখন বলল, বাপ আমার কাজ শেষ, দরজা আটকাও; টেলিভিশন থেকে ভেসে আসা ভিনদেশি গানের ফাঁক থেকে হালকা আওয়াজ ভেসে আসে, ুখালা তুমি দরজা ভিড়ায় দিয়ে যাও। আমি এসে আটকে দিচ্ছি।
বুড়ি দরজা খুলে বের হওয়ার মুখেই ফিরে আসে মনা আর তার বাপ-মা। সুগন্ধ আর রঙে ভরা সাজগোজ তাদের। বিয়েবাড়ি ফেরত।
মনার মা প্রশ্ন করতে ভালোবাসে। বুড়ি কাজ সেরে বের হচ্ছে দেখেও প্রশ্ন করে,
কী, বের হচ্ছ?
বুড়ি মাথা নাড়ে- হ্যাঁ।
থালাবাটি সব ধুয়ে পানি ঝরাইস?
খালি প্রশ্ন, অহেতুক প্রশ্ন। এ কাজ সে প্রতিদিনই করে। তাহলে কেন অযথা একই কথা বারবার? আর আজকে বুড়ির ফিরে যাওয়ার তাগিদ অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশি। ভেতরে অস্থিরতা কাজ করছে। মনা ততক্ষণে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে নিজ ঘরের দিকে চলে গেছে। মনার বাপও।
মনার মায়ের প্রশ্ন আর শেষ হয় না।
দরজা দিয়ে ঢুকে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়ায়। আবার প্রশ্ন-
খাওয়া নিয়েছ? খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ? ইলিশ মাছের যে দাম! ভাবলাম, এক টুকরা বেঁচেছে, তোমাকে দিই…।
আহা, বুড়ি যেন ইলিশ মাছ আর খায়নি! মামার বংশ জেলে ছিল। মামার বাড়ি গেলে কত রকম মাছ মুফতে খেতো! এসব ওষুধ দেওয়া মাছের সাথে সেই মাছের স্বাদের তুলনা! কী স্বাদ ছিল! যেন মাখনের টুকরা! বুড়ি কোনো কথার উত্তর দেয় না। ভিতরে আজ ফেরবার অস্থিরতা।
কোন বাক্সে খাওয়া নিলা, দেখি? এমনি কাজের সময় বাক্স খুঁজে পাই না।
আঁচল দিয়ে ঢেকে রাখা আইসক্রিমের বাক্স বের করে দেখায় বুড়ি। খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ। আর ভাগ্য অপ্রসন্ন হলে যা হয় আর কি, আঁচলের তলে লুকিয়ে রাখা সেই বিশেষ চারকোনা বাক্সের জিনিসটাও সেই সময় ধপ করে মাটিতে পড়ে যায়।
এইটা কী, এইটা কী? দেখি দেখি?
-আপনের না, আমার জিনিস।
-অরে দাঁড়াও দাঁড়াও, তোমার জিনিস মানে!
বুড়ির আর পথ থাকে না। মাটি থেকে খপ করে সেই বিশেষ বাক্স তোলে মনার মা।
একি! এ তো দামি পারফিউম। তুমি কই পেলা? এটা তোমার?
হালকা মাথা নাড়ে বুড়ি। হ্যাঁ বা না-এর মাঝামাঝি এক মাথা নাড়া।
এই ব্র্যান্ড পারফিউম তোমার? মস্করা করো বুড়ি তুমি?
চিৎকারে বাড়ির সবাই সামনে এসে দাঁড়ায়। বুড়ি মুখ তুলে কারও দিকে তাকাতে পারে না। ভীষণ লজ্জা লাগে। বয়স হলে চোখের কোণে পানি টলটল করে অল্পতেই। চোখ জ্বলে।
কার পারফিউম এটা? সুইটির বাপ যে বিদেশ থেকে পারফিউমগুলা আনল, গিফট দেওয়ার জন্য, ওইখানের থেকে নেওয়া না?
সুইটি ওরফে মনার বাপ হালকা মাথা নাড়ে। হ্যাঁ, ওইটাই তো মনে হচ্ছে। কী লজ্জা!
ছি, তোমাকে বিশ্বাস করে ঘর খুলে যাই, আর তুমি আমাদের বেডরুম থেকে জিনিস চুরি করলা? তাও এটা ছেলেদের পারফিউম? তুমি বুড়ি বেটি পারফিউম নিয়ে করবা কী?
লজ্জা সামলাতে যেয়ে মাথার ঘোমটা সরে যায়। দিন যেদিন খারাপ হয়, ভালো কিছুর সেদিন দেখা পাওয়া মুশকিল। নাইলে গত এক সপ্তাহ ধরে লুকিয়ে রাখা, গোলাপি বেণী থেকে আজকেই ঘোমটা সরল?
-তোমার চুলের রঙ এমন কেন? তু-তুমি চুলে রঙ করসো? গোলাপি? এই গোলাপি রঙ কই পেলা? হায় হায়! এইটা সুইটির হেয়ার ডাই না? তুমি ওর ঘর থেকে চুলের রঙ নিয়েছ?
বুড়ির ঢোক গিলতেও অস্বস্তি হয়। কথা আসে না মুখে। মাথা নিচু করে বেরিয়ে যায়। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে শোনে মনার মায়ের চিৎকারচ্ কালকে আমি মালিক সমিতিকে বলে বুড়িকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করব। আর না। অনেক সহ্য করসি। চোর বুড়ি!
একেকটা সময় আসে, যখন কত কী বলার থাকে, কিছু বলা হয় না। বা কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। তার টিকটিকির মতন বেণীর লেজটুকুতে গোলাপি রঙ মনা লাগিয়ে দিয়েছিল। নিজের চুলে লাগানোর পর যে রঙ বেঁচে ছিল, তার থেকে। এক সাদা বাক্স থেকে বুড়ির চুলে সাদা স্নো-ক্রিমের মতন কী একটা লাগিয়ে দিয়েছিল, একটা চ্যাপ্টা তুলি দিয়ে। তারপর কায়দা-কানুন করে কী সব দিয়ে চুল ধুতে হলো। চুলের রঙ হয়ে গেল গোলাপি। একদম হাওয়াই মিঠাই রঙ। লজ্জায় মাথায় ঘোমটা দিয়ে থাকে পাছে কেউ দেখে ফেলে। ঘরের কোণ যে ছোট গোল যায়গা আছে, দুপুরে বসে তাতে গোলাপি টিকটিকির লেজের মতন বেণী দেখে আর অবাক হয়। নিজের চুলের গোলাপি রঙ দেখে দেখে। ঠিক যেন হাওয়াই মিঠাই।
কিন্তু কোনো বলা হলো না মনার মাকে। অপরাধ প্রমাণ হবার পর, তার চোখের পলক পর্যন্ত অপরাধী হয়ে যায়। ভালোটুকু সব ধুয়ে যায়, হারিয়ে যায়। কিছুই বলার থাকে না তখন আর। কেউ বিশ্বাস করে না তখন তার নিরপরাধ সত্তাকে।
এমন অস্বস্তির সময়ে গলা দিয়ে খাওয়া নামতে চায় না। ইলিশ মাছ তার খুব প্রিয়। আসার সময়ে খাবার কৌটাটা নির্লজ্জের মতন নিয়ে এসেছে। থেমে থেমে ঠাণ্ডা খিচুড়ি আর ইলিশ মাছের ঝোল খেলো বুড়ি। ভাসমান, সম্ব্বলহীন মানুষের অপমানবোধ হালকা হয় বা হালকা করে নিতে হয়। নইলে বেঁচে থাকা দায়। সেই হালকা অপমানবোধের খচখচানিতে, নাকি ফেলে আসা ভালো জীবনের সুই ফোঁটা কষ্টে রাতে ঘুম আসতে চায় না। ধীরে ধীরে, এ সময় আর সে সময়ের ভাবনার জোড়াতালিতে এক সময় চোখ বন্ধ হয়।
ঘুম ভাঙে সুবেহ সাদিকে। বুড়ি উঠে বসে অভ্যাসমতো। ওজু করতে যাবে ছাদে। বুড়ির চোখ পড়ে সবুজ টিনের ট্রাঙ্কে। মুখ বন্ধ সবুজ ট্রাঙ্ক। খুলে দেয় মনের ভেতর গুমোট শঙ্কার বন্ধ দরজা।
সূর্য ওঠে। বুড়ি বসে থাকে উবু হয়ে ছাদের এক কোণায়। বুড়ির বেণীর রঙ গোলাপি। ক্যাটকেটে। হাওয়াই মিঠাই একদম। বুড়ি কাশফুলের মতন দোলে। দুলতে থাকে। বুড়ি জানে, তার কোথাও যাওয়া হবে না। বুড়ি জানে, কেউ তাকে আজ বলবে না, এ ঘর ছেড়ে চলে যেতে।
কারণ সবুজ ট্রাঙ্ক।
মনার পরামর্শ অনুযায়ী সুগন্ধির বাক্স তুলে নিয়েছিল মনার ঘরের বিছানা থেকে। মনার প্রয়োজনেই। মনার বিশেষ একজনের জন্য রাখা। বাসায় এই বাক্স দেখলে মনার দজ্জাল মা ঝামেলা করবে। মনা যখন ঘরে থাকে না তখন তার মা ঘরের আনাচে কানাচে তল্লাশি চালায়, গোয়েন্দাগিরি করে। মনার এক বিশেষ বন্ধু আছে। বয়ফ্রেন্ড না কী যেন নাম! বুড়ির সেই সময়ে যেমন ছিল হালিম মোল্লা। বুড়ির গ্রামের মানুষ। বুড়ির মনের মানুষ। তেমনই। সামনে কী এক বিশেষ দিনে এই সুগন্ধি দেবে ওই বিশেষ জনকে। ততদিন পর্যন্ত বুড়ির ট্রাঙ্কে লুকিয়ে রাখবার কথা।
মনা বলেছিল, আমার বিছানায় নীল কাগজে মোড়ানো। রেখে গেলাম বিয়েতে যাওয়ার আগে। কাজ সেরে যাওয়ার সময় তুমি নিয়ে যেও, সবুজ ট্রাঙ্কে রেখে দেবে। কেউ যেন না জানে! মা আমাকে মেরে ফেলবে জানতে পারলে। আমি সময় মতন এসে তোমার থেকে নেব।
তা আনতে আর পারল কই! মনার মা কেড়ে রেখে দিল। তবে হ্যাঁ, সে কাউকে বলেনি আসল কথা। কথা হলো আমানত। সে আমানতের খেয়ানত করেনি।
যেমন করেনি সবুজ ট্রাঙ্কখানা। যেখানে লুকিয়ে আছে এ দালানের সব লুকিয়ে রাখা গোপন, সামনে আসতে না দেওয়া সত্যগুলো। বুড়ি তাদের পাহারাদার। সে কাউকে ফেরায় না। সময়ে সময়ে ঠাণ্ডা মার্বেল পাথরের বসতে থাকা মানুষগুলো বুড়ির কাছে এসে যখন জমা রাখে তাদের লুকিয়ে রাখা সত্যগুলো; বুড়ি কাউকে ফেরায় না। সযত্নে জমা রাখে সবুজ ট্রাঙ্কে। ভালো করে তালাবদ্ধ করে রাখে এ দালানের মানুষদের লুকানো জীবনের হিসাবনিকাশ। কারও লুকিয়ে কেনা জমির দলিল, কারও সুগন্ধির বাক্স। কারও পুরনো লুকানো ডায়েরি। যে ডায়েরি এ দালানের কোনো মানুষের মার্বেল পাথরের জীবনের হিসাবনিকাশের পাতা সম্পূর্ণ ওলোটপালোট করে দিতে পারে। সব জমা আছে এ সবুজ ট্রাঙ্কে। মনার মায়ের গল্পও।
এক সময় পুরনো ফেলে দেওয়া জিনিসে ঠাসা আধখানা ঘর; সময়ে হয়ে উঠেছে বুড়ির ঘর। মার্বেল পাথরের মেঝের ঘরে থাকা মানুষদের সত্য জমানোর ঘর। সুগন্ধি আর রঙের সাজপোশাকের বাইরে যে সাদা-কালো সত্য, তা জমা রাখার এমন নিশ্চিত সস্তা ব্যাংক তারা আর পাবে না। কেউ আসবে না তাকে তাড়িয়ে দিতে। জীবনে টিকে থাকার এই সাধারণ হিসাব বুড়ি জানে। একদম যেন এক্কা দোক্কা তেক্কা। খেলায় টিকে থাকতে গেলে ঠিক সময়ে ঠিক ঘরে কায়দা করে ঘুঁটি ফেলতে হয়। বেশি ভারীও নয়, পাতলাও নয়। ঠিকঠাক। ঘুঁটি ঠিক থাকলে নিশানা ঠিক থাকে। টিকে থাকা যায় অনেকক্ষণ। আর এই দালানে টিকে থাকার ঘুঁটির উৎস বুড়ির জানা। সেই সবুজ ট্রাঙ্ক।
আজ ছুটির দিন। এক্কা দোক্কা খেলার দিন। ছাদের এঁকে রাখা এক্কা দোক্কার ছক। উঠে দাঁড়িয়ে ছকের দিকে এগিয়ে যায় বুড়ি; গোলাপি বেণীর বুড়ি, খুন্তি বুড়ি, ওরফে জমিলার মা ওরফে রতনের নানি। হালকা হয়ে যাওয়া খেলার ছক, ইটের টুকরো দিয়ে ঘষে ঘষে গাঢ় করে। উঠে দাঁড়ায়। শীর্ণ রগ বেরুনো সরু পায়ে খেলা শুরু করে- এক্কা দোক্কা তেক্কা।