খেয়া নামের গ্রামটি

ভুয়া কোম্পানি খুলে, ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কয়েক কোটি টাকা ঋণ নিয়ে কোম্পানিকে দেউলিয়া ঘোষণা করে হাসিব আর শরীফ অর্থ লোপাটের মাধ্যমে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠতে চাইলেও রাষ্ট্র উলটা খড়গহস্ত হয়ে উঠল। পুলিশ তাদের গ্রেফতারে মরিয়া হয়ে উঠলে দুজন নিরাপদ আশ্রয়ে একসঙ্গে পালানোর পথ খুঁজতে সন্ধ্যায় একখানে মিলল। শরীফ ফিসফিস করে বলল,

অনেক টাকা ঢেলেও তো কাজ হচ্ছে না। দেশের বাইরে যাওয়ার রাস্তাটাও বন্ধ। এখন? হাসিবের কোনো ভাবান্তর নেই। সে যেন সব পরিকল্পনা করেই রেখেছে। নির্বিকার কণ্ঠে সে বলল,

গ্রামে চলে যাব। আমরা ধর্মের অন্তরাল নেব। তবে তার জন্য কিছু টাকা খরচ করতে হবে।

এখন বলেন, ধর্মের অন্তরালে কীভাবে কাজটা করবেন?

এ-দেশে কোনোরকমে একবার অনেক টাকার মালিক হয়ে গেলে আপনি রাষ্ট্রের ধরাছোঁয়ার বাইরের একজন ব্যক্তি হয়ে উঠবেন। এ-দেশে ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে ব্যবহার করে যে-কোনো স্বার্থ উদ্ধার করা সম্ভব।

কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব?

ধানম–তে একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি আছেন। আমাদের উপজেলার ভেতরেই তার গ্রাম। খেয়াগ্রামের লোকদের নিয়ে ধর্মকর্মের অন্তরালে তার একটা উদ্দেশ্য আছে।

কবির উদ্দিন সরকার?

চেনেন তাকে?

না, কিন্তু তার কথা তো শোনা যায়। কিন্তু ব্যবসাটা কী তার?

তা কেউ জানে না। এই সেই দেশ যেখানে মগ্নতা ছাড়া ভালোবাসা, এমনকি তপস্যা ছাড়া জ্ঞানী লোক বলে খ্যাতি অর্জন – সবই সম্ভব। দ্যাখেন, কবির উদ্দিন সরকারের না আছে কোনো ইন্ডাস্ট্রি, না আছে বড় কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান; কিন্তু বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত সম্পদশালী লোক তিনি। তার ছেলেমেয়েরা কেউ এ-দেশে থাকে না। তিন স্ত্রীর নামে বাড়ি আছে দুবাই, ব্যাংকক, টোকিও আর মালয়েশিয়ায়।

কিন্তু তার এত অর্থ এলো কোত্থেকে?

স্বৈরশাসনের আমলে ট্রেন-বাস এবং সিনেমা হলের বস্ন্যাক টিকেট থেকে চাঁদাবাজির হাটে তার হাতেখড়ি। একসময় কালোবাজারি বনে যান। শেয়ার মার্কেট কেলেংকারির কালে দেশের স্বনামধন্য ব্যবসায়ীর পার্টনার হয়ে জনগণের সব টাকা লোপাট করেছেন। নিজের অতীতের পাপ মুছতে, পরকালের শান্তি কিনতে এখন ধর্মের সেবক হয়েছেন। অন্তরালে আসলে তার অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। গ্রামে মাদ্রাসা করেছেন, মসজিদণ্ডহেফাজতখানা তৈরি করেছেন। তিনি ভবিষ্যতের ভোটব্যাংক বাড়িয়ে নিচ্ছেন। সেই সূত্রে তিনি খেয়াগ্রামে একটা ইসলামিক গবেষণাকেন্দ্র স্থাপনের চিন্তা-ভাবনা করছেন। আমরা তার দোসর হয়ে যাব।

তাহলে বাঁচা যাবে?

নির্বাচনে তিনি নিশ্চিত জিতে যাবেন। আমরা তাকে নির্বাচনে জেতাতে কাজ করব। বিনিময়ে প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখানোর নিশ্চয়তা চাইব।

সুতরাং, কথামতো কবির উদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে তারা তাদের পরিকল্পনার কথা বলতেই তিনি খুশি হয়ে উঠলেন। নির্বাচনে জেতার জন্য আধুনিক আর শিক্ষেত মানুষ তার খুব দরকার।

গ্রামটির নাম খেয়াগ্রাম। কেউ কেউ বলে কেয়াগ্রাম। এই গ্রামেরই কবির উদ্দিন সরকার গ্রামের মানুষের কাছে এক সূর্যসন্তান। কেন গ্রামটির নাম খেয়া অথবা কেয়া সে-ইতিহাস জানার প্রয়োজন গ্রামের মানুষ, বিশেষত উঠতি বয়সী তরুণরা খুব একটা বোধ করে না। এই গ্রামের শেষ প্রান্তে কোনো এককালে নদী এসে মিশে ছিল। তার কিনারে নৌকা বাঁধা থাকত। গ্রামের সেই ফাঁকা প্রান্তে, রাস্তার পাশে অসংখ্য নারিকেল, খেজুর আর তালগাছ ছিল। আর ছিল ঝোপঝাড় আর তার ভেতর ফুটে থাকত প্রচুর কাঞ্চন, কৃষ্ণচূড়া আর কেতকী ফুল।

ছবির মতো সুন্দর লাগত গ্রামশেষের ছোট্ট নদীর এই প্রান্ত। কোনো মেঘলা অথবা বৃষ্টির দিনে নদীর অন্যপ্রান্ত থেকে ঘরেফেরা মানুষগুলো নিজেদের ছবির মতো গ্রামকে দেখত রূপকথার এক আনন্দপুরী হিসেবে। এ-প্রান্ত থেকেই কাজ আর সওদা কিনে মানুষগুলো উন্মুখ হয়ে ঘরে ফিরত তাদের মামুলি তবু আশা এবং উত্তাপে পূর্ণ দিন-রাতের কাছে, তাদের প্রিয় গ্রামবাসীর সুনিবিড় বন্ধনের মাঝে। সেই নস্টালজিয়া থেকেই গ্রামের আদি নাম ‘শিবপুর’ মুছে গিয়ে তাদের ডাকা প্রিয় খেয়াঘাট আর কেয়াফুলের নামে এই গ্রামের নাম হয়েছে খেয়া আর কেয়াগ্রাম।

এক যুগেরও অধিক সময় ধরে কবির উদ্দিনের প্রচেষ্টায় ধর্মীয় অনুভবের প্রভাব বিসত্মৃত হয়েছে এই গ্রামের মানুষের অন্তর্লোকে। গ্রামের মানুষের জন্য এখন গ্রামের এই নাম আলাদা কোনো দ্যোতনা অথবা আবেগের পরিচায়ক নয়। কলমিলতা আর কচুরিপানা ফুল চিনলেও নদীর প্রান্তরজুড়ে ফুটে থাকা এসব ফুলের নাম যে কেয়া অথবা কেতকী, জারুল, কৃষ্ণচূড়া অথবা কাঞ্চন তা তারা জানে না। জানে না জীবনানন্দ নামের এক বাঙালি কবির হৃদয়ে বাংলার অনিন্দ্যসুন্দর প্রান্তর কি অমৃতরূপী বিষ ঢেলে দিয়েছিল যে, তার উচ্চারণে জারুল, কৃষ্ণচূড়ার বর্ণময় শাখা আজো আলো জ্বালে বাংলার মাঠে। শিমুলের লাল টুকটুকে রং পোড়ায় বসন্তের শন-শন হাওয়াকে। তার চেয়ে ফেকাহ শাস্ত্রের হারুত-মারুতের গল্প এখন তাদের বেশি চেনা। দোজখের আজাব নিজ চোখে তারা এত স্পষ্ট দেখতে পায় যে, জীবনানন্দের মতো কবিকুলকে দোজখের জ্বালানির কয়লা অথবা খড়ি হয়ে তারা বরং জ্বলতে দেখে। কেয়া আর খেয়া, স্নান আর গান – এসব শব্দের মাঝে এক ধরনের পাপকেই তারা দেখে। আবাবিল শব্দের ইতিহাস তারা জানলেও তাদের কেউ নাগ-নাগেশ্বর শব্দ মনে করিয়ে দিলে এটাকে কোনো হিন্দু পুরাণের চরিত্র মনে করে তারা নিশ্চিত ‘নাউজুবিল্লাহ’ উচ্চারণ করবে।

পাপ-পুণ্যের নিক্তি হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো খেয়াগ্রামের মানুষ ভুলেই গেছে যে, কোনো এককালে এই গ্রামবাসীর প্রাণের উত্তাপ এমন ছিল যে, ভর বর্ষার তুমুল বৃষ্টিতে সারারাত অথবা শীতের পূর্বাহ্ণে শুকিয়ে আসা খাল-বিল অথবা কোনো জলাশয়ে মাছ ধরার মতো সামান্য ঘটনা তাদের কাছে কেমন উৎসবের আমেজে ভরপুর ছিল। না, এখন সেসব হওয়ার কোনো জো নেই। কোনো নারী যদি কোনো পুরুষের দিকে তাকিয়ে হাসে তাহলে পাপ-পুণ্যের নিক্তি হাতে ঘোরা মানুষদের খেয়াগ্রাম এখন টলমল করে পাপের দিকে ঝুঁকে যায়।

শীত এলেই, অগ্রহায়ণের ধান কাটাশেষে মাঠে মাঠে রাখালদের ভুলকা ভাত খাওয়ার সংস্কৃতি গত হয়েছে অনেক আগেই। এই গ্রামে ঘটা করে এখন যা পালিত হয়, তা হলো ইসলামি জলসা। কিন্তু এই জলসার সময়ও অসভ্য বাঙালি তাদের সেই পুরনো রক্তের দোষে ওয়াজ-নসিহত শোনার চেয়ে মেলা নিয়ে মেতে ওঠে। হরেকরকম মিঠাই-মিষ্টি, বাচ্চাদের হাজারো খেলনার পাশাপাশি নাগরদোলাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় ব্যাপক জনসমাগম। বাদাম, বুটভাজা আর গুড়ের জিলাপির ম-ম গন্ধে গ্রামের ধানকাটা মাঠটা ভরপুর হয়ে ওঠে। দূরদূরান্ত থেকে জামাইরা আসে শ্বশুরবাড়িতে। গৃহস্থরা মেয়েদের নাইওরকে উজ্জীবিত করতে ভাগে গরু জবাই দেয়। টাটকা মাংসের সঙ্গে মশলা মিশে ঝোলের ভুরভুরে গন্ধ ফুরফুরে আর চাঙ্গা করে তোলে ভোজনরসিকদের জিহবার সঙ্গে তার উদরপূর্তির সব স্মৃতিলোক।

বিত্তশালীদের বাড়ির মহান অতিথি হয়ে সের সের গরুর মাংসের সঙ্গে ওয়াজকারীর দল তাদের পুকুরের সবচেয়ে বড় মাছগুলোর মাথা ভক্ষণ করে তৃপ্তির ঢেকুরের সঙ্গে খাদ্যের সুঘ্রাণকে ধবধবে পাঞ্জাবির আতরে ছড়িয়ে দিতে দিতে এই গরুখেকো অসভ্য বাঙালি যে মানুষ হবে না তার ভবিষ্যদ্বাণী করেন। এবং তাদের প্রজ্ঞাবান বাণীর পক্ষে রাতে বক্তৃতা করতে গিয়ে প্রমাণ হিসেবে মাহফিলের বিশাল প্যান্ডেলের ভেতর যে মাত্র তেরোজন বৃদ্ধের সঙ্গে মাদ্রাসার ছাত্র আর হেফাজতখানার মোয়াল্লেম ছাড়া আর কেউ নেই – তার চাক্ষুষ প্রমাণ দিয়ে প্রথমেই নিজের জ্ঞান জাহির করেন।

কবির উদ্দিন সরকার শেষবার যখন গ্রামে এসেছিলেন তার পনেরো দিন পর গ্রামবাসী একটা দারুণ খবরে উজ্জীবিত হয়ে উঠল। ঢাকা থেকে দুজন ধনাঢ্য আর পরহেজগার ব্যক্তি তাদের গ্রামকেই ইসলামের তীর্থ মনে করে তা প্রসারের খেদমতে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ দিয়ে ইসলামিক গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য এগিয়ে এসেছেন। তাদের আগমনে হেফাজতখানার মোত্তাকিম কাশেম কবির উদ্দিনের গুণগান গাইতে বলল, মাশাল্লাহ, এমন ক্ষণজন্মা পুরুষ এ-দেশে আর জন্মায়নি, ভাইজান। আর কত-শত বছরে এমন একজন সন্তান এ-দেশ পাবে তা কে কবার পারে, কন?

এ-কথা শুনে হাসিব তার হাসি আটকাতে গিয়ে দুইবারই আড়াই ফোঁটা করে মোট পাঁচ ফোঁটা পেশাবের নিষ্ক্রান্তিকে অনেক চেষ্টাতেও তার তলদেশে থামাতে পারল না। ভাগ্যিস তা তার আন্ডারওয়্যারের সামনে একটা বৃত্ত তৈরি করা ছাড়া পাজামা ভিজিয়ে দিলো না। সে মনে মনে কলকাতা হারবালসহ বাংলার সমস্ত হোমিও ডাক্তারের গোষ্ঠী উদ্ধার করল। সব শালা মোনাফেক আর ভ-।

দুই
কোনো এককালে অগ্রহায়ণের শুকিয়ে আসা খালে-বিলে ধরা এবং জিইয়ে রাখা কই-মাগুর-শিং-বোয়াল আর শৌল মাছ দিয়ে খেয়াগ্রামের ঘরে ঘরে ভরা ডাবরগুলোর জলে মাছের প্রচ- হুটোপুটি যেমন তাদের সমৃদ্ধির নিয়ামক ছিল, তেমনি এই গ্রামে হাসিব আর শরীফের দুদিন অবস্থানে এবং হাতভরা দানে আশার-ভরসার হাতছানি তাদের মনে সুখের দোলাচল হয়ে খেলা করল। মাসে মাসে ক্রমেই তাদের আসা-যাওয়া বেড়ে গেল। তাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে কবির উদ্দিন সরকার আসেন। কবির উদ্দিনের রক্তে কী এক দোষ। শত কোটি টাকার মালিক, তারপরও কারো কাছ থেকে চাঁদা পেলে কেন তার এত ভালো লাগে তিনি জানেন না। মাত্র এক লাখ টাকা নগদ পেয়ে আর বাকি লাখ লাখ টাকার আশ্বাস পেয়ে তার সেই পুরনো চাঁদাবাজ আত্মা বাকবাকম শুরু করেছে। শরীফ আর হাসিবের জন্য তার বাড়ির মেহমানখানা বরাদ্দ হওয়ার পাশাপাশি দফায় দফায় দেশি মোরগ আর খালের বোয়াল-মাগুরের ঝোল দিয়ে বাসমতী চালের ভাতও জুটছে।

কবির উদ্দিন গ্রামে এলে কস্ত্তরি নামের বাইশ-তেইশ বছরের এক শ্যামবর্ণ তরুণী রান্না করে দেয়। কস্ত্তরি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে নয়। কিন্তু নবম শ্রেণির পাঠ শেষ করতে না করতেই কোত্থেকে খোকন নামে শহরে চাকরি করা এক ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের আগে ছেলেটা জানাল যে, তার নিজের বাবা-মা কেউ নেই। এতিম ছেলেকে একমাত্র মেয়ের জামাই হিসেবে পেয়ে কস্ত্তরির বাবা-মা খুব খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু বিয়ের পর কয়েক মাস ছেলেটা ঘরজামাই থেকে একদিন লাপাত্তা হয়ে গেল বলে কস্ত্তরির কপাল পুড়ল। লজ্জায় কস্ত্তরি বিদ্যালয়ের চৌকাঠে আর পা রাখল না। কলেজের ছাত্রদের খুব প্রিয় শিক্ষক এবং প্রগতিশীল চেতনার তামিম হাসান অনেক গুণে গুণান্বিত কস্ত্তরিকে বিদ্যালয়ে ফেরানোর জন্য অনেক চেষ্টাও করেছেন। কাজ হয়নি। মেয়েটার পোড়া কপালে যেন ভালো কিছু জোটে সেই আশাতেই তার বাবা-মা কস্ত্তরিকে কবির উদ্দিন গ্রামে এলে তাকে রান্না করে দেওয়ার জন্য রাজি করিয়েছেন। নিজের একটা বিয়ে হলে কস্ত্তরিও এখন বেঁচে যায় – এ-আশায় তার সর্বোচ্চ চেষ্টা রান্নাতেই ঢেলে দেয়।

মেয়েটা রান্নায় কী অমৃত ঢালে যে, তার ঢলঢল যৌবনের লাবণ্য যেন মিশে থাকে তার রান্না করা খাদ্যের স্বাদে। শরীফ আর হাসিব ছেলে দুটোকে কাজে লাগিয়ে কবির উদ্দিনের মনের গোপন বাসনা পূরণের আশা জেগে জেগে উঠছে। তিনি এই বলে কস্ত্তরির মা-বাবার আশা বাড়িয়ে দিলেন যে, শরীফ বিয়ে না করলেও সমস্যা নেই। তাদের অধীনে কত ছেলেই তো চাকরি-বাকরি করে। কস্ত্তরির একটা জামাই তারা জুটিয়েও দিতে পারে। এতবড় মানি লোকের মান রাখার জন্য শুধু নয়, মেয়েটার একটা সদ্গতি হবে এমন আশায় কস্ত্তরির বাবা-মা মেয়েকে পাঠিয়েছে রান্নার জন্য।

রাতে শরীফ আর হাসিব কবির উদ্দিনের খাসকামরায় খোশগল্পে মেতে ওঠে। হাসিব কৌশলে ব্যাংক লোন সংক্রান্ত জালিয়াতির প্রসঙ্গ ওঠালে কবির উদ্দিন বলে, ‘লোন কইরো না বাপ। তবে লোন নিলে নিবা শত কোটি য্যানো তা আর ফেরত … মানে ওটা করবেই মেরে দেওয়ার জন্য। এই দেশের ব্যাংক সুদি কারবারের কারখানা, ওগোরে টাকা মেরে দিলে ছওয়াব হইব…।’ হাসিব আমতা আমতা করে বলে, ইয়ে চাচা, মানে আমিও তাই মনে করি। কিন্তু বড় মামা-চাচা না থাকলে তো বিপদ। কবির উদ্দিন সোফায় শরীর এলিয়ে প্রায় শুয়ে পড়েছিলেন। হাসিবের কথায় তিনি লাফিয়ে উঠলেন। বললেন, তোমরা নিতে চাও তো মামা, চাচা লাগবে না রে বাপ। এই কবির উদ্দিন তোমাদের বাপ হয়ে থাকবে। কিন্তু শর্ত একটাই – তার দশ না হলেও অন্তত পাঁচ ভাগ দিবা আমাক। দেখতেছই তো আল্লাহর রাস্তায় কি মহাযজ্ঞ শুরু করছি। এই পারের কাম তো শ্যাষ, এখন পরপারের পুঁজি করা লাগবে না?

তিন
হাসিব সবসময় আসতে না পারলেও শরীফ খেয়াগ্রামে প্রায় স্থায়ী আসন গাড়ল। গ্রামের মানুষের মনে নতুন আশা জাগে। ইসলামিক কেন্দ্রের কাজ বুঝি এবার শুরু হলো। তাদের বেকারত্ব ঘোচার স্বপ্নটা চাঙ্গা হয়ে ওঠে। কিন্তু তার কোনো অগ্রগতিই হয় না। তবে কস্ত্তরির রান্নার অগ্রগতির সঙ্গে শরীফ মেয়েটার সঙ্গে একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টায় বেশ সাফল্য পায়।

আহা, কস্ত্তরির জন্য হৃদয় কাঁদে শরীফের। এত লতানো দেহের, খুব সম্ভবত পদ্মিনী নারীকে কোন আহম্মক স্বামী ছেড়ে গেছে? সে এলেই শরীফ বারবার পানি খাওয়ার উছিলায় রান্নাঘরে যায়। চোখে চোখে ভাবালুতা ছড়িয়ে তাকায় কস্ত্তরির চোখে। কাজল অাঁকা চোখের হরিণীকন্যা চকিত তার চোখ নামিয়ে নেয়। মেয়েটা তার লাজুক অভিব্যক্তি লুকাতে গিয়ে নিজেকে আরো যেন মেলে ধরে শরীফের চোখে। সে তার লোলুপ আর গুন্ডা চোখদুটো ঘোরাতে থাকে কস্ত্তরির বুকে, তার সরু কোমরটার নিচে ছোট তবু ভারী নিতম্বে।

শরীফ গোপনে আরো কিছু টাকা কবির উদ্দিনের হাতে দিলো এবং তা হাসিবকে না জানানোর জন্য অনুরোধ করল। কবির উদ্দিনের কাছে প্রিয়পাত্র হওয়ার অভিপ্রায় থেকে শুধু নয়, কস্ত্তরির ওপর অবাধ নিয়ন্ত্রণ নিতেই শরীফ এ-কাজ করল। খেয়াগ্রামে তার এই অবস্থান পাকাপোক্ত করতে সে কবির উদ্দিনকে সংসদ নির্বাচনে জেতানোর জন্য আগাম করণীয় এবং প্রস্ত্ততির কথা বলল। ইসলামিক গবেষণা কেন্দ্রকে ভোটের ট্রাম্পকার্ড করার পরামর্শ দিয়ে বলল,

আপনাকে জেতানোর জন্য আমি মাঠে থাকব। কিন্তু আপনি গ্রামবাসীকে শুধু বলবেন, নির্বাচনে জিতলেই খেয়াগ্রামে ইসলামিক গবেষণা কেন্দ্রের কাজ শুরু হবে। যেখানে এই সমগ্র এলাকার অসংখ্য শিক্ষেত ছেলেমেয়ে কাজের সুযোগ পাবে…

আগের রাতে কস্ত্তরিকে দেখার আশা শরীফের বিফলে গেছে। পরদিন পূর্বাহ্ণেও তার দেখা নেই। মেহমানখানার জানালা দিয়ে শরীফ তীর্থের কাকের মতো চেয়ে থাকল কস্ত্তরির আগমন প্রত্যাশায়। এবার আসার সময় সে ঢাকা থেকে তার জন্য শাড়ি এনেছে। এনেছে পেস্ট-ব্রাশ, ক্রিম আর ডাভের মধুর গন্ধমাখা বডি লোশন। সে-লোশনের দারুণ গন্ধটুকুর সঙ্গে কস্ত্তরির বাদামি বর্ণের উজ্জ্বল শ্যামাঙ্গের ঘ্রাণটাকে কল্পনা করে পাগল হয়ে যায়। শহুরে মেয়েদের চটকদার কথা, সুন্দর কারে দামি রেস্টুরেন্টে নিলে তো পটানো যায়। এই ধর্মীয় আবহে আর গ্রাম্য-সংস্কৃতিতে বড় হওয়া মেয়েটাকে কী করে বাগে নেওয়া যায় তা সে কল্পনা করে কিছুতেই কূলকিনারা করতে পারে না। মেয়েটার মুখে হাসি থাকলেও চোখ মোটেও সায় দেয় না।

না, সে ব্যর্থ হবে না বলেই পণ করল। বাইরে পাতলা আর ছোট এক বাঁশবাগানশেষে একটা পুকুর। পুকুরপাড়ে আম-জামের গাছের ভেতর উঁকি দিচ্ছে জবা আর মাইকের মতো অজানা অসংখ্য হলুদ ফুল। নির্জন পাড়ের ছায়া মাড়িয়ে একটা অবয়বকে এগিয়ে আসতে দেখে শরীফের হৃৎস্পন্দন দ্রম্নততর হলো। কস্ত্তরি! হ্যাঁ সে আসছে। মেয়েটার কাছে নিজেকে বড় একলা প্রমাণ করার জন্য সে জানালায় উদাস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকল। কস্ত্তরি দরজায় টোকা দিয়ে দরজায় দাঁড়িয়েই জিজ্ঞাসা করল,

আজ কী রান্দি, কন তো? কই মাছ আর দেশি মোরগের ঝোল করি? আপনার তো খুবই পছন্দের। শরীফ উলটা ঘুরে অসহায় ভঙ্গিমার অভিনয়কে দারুণ রপ্ত করে বলল,

মা ছাড়া এতদিন পর একমাত্র তুমিই আমার পছন্দটা বুঝলে। কিন্তু আমি তোমাকে ঝামেলা দিতে চাই না। একটা কিছু করো।

কস্ত্তরি চলে যাচ্ছিল। শরীফের কপালে নয়, তার চোখগুলো যেন জিহবায় বসানো। একদৃষ্টিতে চকচকে কামনায় ভেজা জিহবায় বসানো চোখে মেয়েটার পেছনটা সে দেখার চেয়ে চাটলই বেশি। তাকে থামাতে সে কস্ত্তরিকে ডাকল, কস্ত্তরি? কস্ত্তরি থেমে অর্ধ ঘুরে বলল, কন?

তোমার এত সুন্দর নামটা কে রেখেছে, বলো তো? কস্ত্তরি এবার পুরো ঘুরে শরীফের চোখে চোখ রেখে তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন করল,

ভাবি আপনার পছন্দ জানে না? শরীফ যেন কেঁদে দেবে। এবং সত্যিই তার চোখে তেমন অভিব্যক্তি দেখে কস্ত্তরির বড় মায়া হলো। শরীফ রুমাল দিয়ে চোখ মোছার ভান করে বলল,

আমার বউ-ভাগ্য! আমার পছন্দ তো পরের কথা, তালাক হয়নি তবু সেই মেয়ে অন্য একজনকে ভালোবেসে… থাক এসব। বলে কী হবে বলো? ঢাকায় আমার আর ভালো লাগে না, কস্ত্তরি। তুমি যে যত্ন করে আমাকে রান্না করে খাওয়াও সেইটুকু ভালোবাসার মানুষ এই দুনিয়াতে আমার আর কেউ নেই। মা না থাকলে তার আসলে কিছু থাকে না।

খেয়াগ্রামে শান্তি আর উপদেশ বাণীর চরম ডামাডোলে সারাক্ষণ দোজখ, জাহান্নাম-বেহেশত আর পাপ-পুণ্যের হিসাব মেলাতে ব্যস্ত আর উদ্বিগ্ন নারীকুল তবু তাদের অন্তরকে এই খেয়াগ্রামের বেতসলতা, মহুয়া, বসন্ত কোকিলের কুহুকুহু তান এবং তার নির্জন অন্ধকারের স্মৃতিলোক দিয়ে যেন মুড়িয়ে রেখেছে বলে তার ভেতর থেকে বাঙালির নারীর সহজাত মমত্ব এখনো হারিয়ে যায়নি। সেজন্যই এই দুঃখিত পুরুষের জন্য ছলছল করে উঠল কস্ত্তরির নারীহৃদয়,

হায়, হায়… মাইয়্যা মানুষ এত খারাপ হয়। স্বামী ফেলে… ছি ছি…

সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছা। বউ চলে গেল বলেই না মনের দুঃখে বাউল হলাম…

বাউল কই? আপনি না পরহেজগার হইছেন।

বৃদ্ধদের জন্য ব্যবহৃত বিশেষণ মেয়েটা তার উদ্দেশেই ব্যবহার করল বলে শরীফের রাগের সীমানা তার ধৈর্যের চৌহদ্দি অতিক্রম করছিল। নিজেকে সংযত করে তবু সে বলল,

ওপরে ওপরে মুক্তি খুঁজি। আমার ভেতরটা বাউল। বউ না গেলে তোমার সঙ্গে আমার দেখা কি আর হতো, না তোমার হাতে রান্না খাবারের…। আহা! আল্লাহ তোমার এই হাত দুটোতে কী জাদু মেখে দিয়েছে।

কস্ত্তরির হৃদয় পানির স্রোত হয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। একটু যত্নের জন্য মানুষটা কত কাঙাল। শরীফ তখন কস্ত্তরির বাদামি বর্ণের লাবণ্য ঢলঢল হাতদুটো নিজের হাতে নিয়ে বলছে,

কী লেখা আছে তোমার হাতে দেখি…

আমার হাতে কী লেখা কন তো? দ্যাখেন, কোনো হুজুরের সঙ্গে আমার নি আবার বিয়া আল্লাহয় লিখ্যা রাখছে কিনা? কস্ত্তরির কথায় শরীফের খুব হাসি পেল,

ক্যান। হুজুররা খারাপ নাকি?

কে যে খারাপ আর কে যে ভালো, মেয়েমানুষরা তার কি হদিস পায়?

তাহলে?

ওরে বাবা। বছর বছর বাচ্চা বিয়াতে পারুম না। জন্মনিয়ন্ত্রণ নিষেধ। মাগো, দোলন চাচির কী অবস্থা। পাঁচ বছরেই চার বাচ্চা। আরো না জানি…

এ তো খুশির খবর…

হুম, খুশির খবর! আপনি একটা বিয়ান না। দেখব নি। দ্যাখেন, হাতটা দ্যাখেন, হুজুরের সঙ্গে বিয়া লেখা থাকলে গলায় দড়ি দিয়া মরব।

এই খেপা কস্ত্তরিকে খুব ভালো লাগল শরীফের। সে লাই পেয়ে হাত দেখার চেয়ে তার তালুর উষ্ণতা আর তালুর অপর পৃষ্ঠের স্পর্শের অনুভূতি নিতে নিতে বলল,

তোমার স্বামী নাই, আমার বউ নাই। আমরা দুজনই একই পথের পথিক। কিন্তু যখন আমি তোমার রান্না করা দারুণ স্বাদের খাবার খাই, মনে হয় তোমার মতো একজন গরিব ঘরের মেয়েকে আমার বিয়ে করা উচিত ছিল। পুরুষ মানুষ কতদিন এভাবে একা থাকতে পারে?

তাইলে বিয়া করেন… বলে এক টানে হাত দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের ভঙ্গিতে রান্নাঘরের দিকে হাঁটা শুরু করল। কিছুক্ষণ পর সেখানে শরীফ এসে বলল,

এই যে এগুলান তোমার জন্য?

কী অগলান।

তুমি বাড়িতে গিয়ে দেখো। কিন্তু কস্ত্তরি ব্যাগের ভেতর উঁকি দিয়ে এক নজর দেখে নিয়ে বলল,

বাড়িতে জিজ্ঞাসা করলে?

বলবে, সাহেব দিয়েছে। আর হ্যাঁ, এই জিনিসটা কাউকে দেখাবে না। লুকিয়ে লুকিয়ে ব্যবহার করবে।

এটা কি ছোট টেলিভিশন? ওই যে, কবির দাদা যেটা ব্যবহার করে?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। কবির চাচার এটা আছে। এটার নাম ট্যাব। রান্নার ঝামেলা শেষ হোক, তোমাকে আমি শিখিয়ে দেব।

রান্না শেষ করে কস্ত্তরি ঘর্মাক্ত অবস্থায় খাবার টেবিল গুছিয়ে উত্তেজনার বশে বলল,

কন দেখি এটা কীভাবে চালাতে হয়?

একা একা খেতে আর ভালো লাগে না। এতগুলো খাবার একা খাওয়া যায়? তুমি বসো না, আমার সঙ্গে। খেতে খেতে তোমাকে শেখাই।

নাউজুবিল্লাহ। কবির দাদা জানলে খুন করবে না?

আরে, কবির সাহেব আমার জন্য পাগল। বসো তো। শরীফ একটানে নিজের পাশের চেয়ারে কস্ত্তরিকে বসাল,

আহা, কস্ত্তরি… মানুষে মানুষে কিসের এত তফাত। আর তোমার মতো সুন্দরী নারীর তো বড় ঘরেই বিয়ে হবে, তাই না? এসো বসো, আমার পাশে বসো…

কস্ত্তরির পাতে নিজে খাবার উঠিয়ে দিয়ে নিজে খাবার না নিয়ে শরীফ তাকে ট্যাব বোঝানো শুরু করল। প্রথমেই সেটা কীভাবে চার্জ দিতে হয় তার কৌশল শেখাতে গেলে কস্ত্তরি বলল,

ওসব পারি। মোবাইলের মতোনই তো।

হ্যাঁ, ঠিক।

ভিডিও ফাইলে অসংখ্য হিন্দি আর ইংরেজি গানের অন্তরালে শরীর দেখানো নাচের মহরত। আছে অ্যাডাল্ট মুভি ফাইল। নবম শ্রেণি পাশ কস্ত্তরি এসব ভালোভাবেই পড়তে পারে। শরীফ হিন্দি আইটেম গানের ফাইল খুলে তার ভিডিও ছেড়ে এবার খাবার তুলে নিল। মেয়ে হয়েও এই গানে নারীর বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি দেখে কস্ত্তরি দ্বিগুণ ঘামতে থাকল। চুলার খড়ির আগুনও তার ঘামকে লোমকূপের অন্তস্তলের ঘামকে এভাবে টেনে আনতে পারেনি। সে ঢোক গিলে বলল,

এখন আমি আসি।

সে কি, খাও।

খাবার নিয়ে যাচ্ছি। যে উত্তেজনায় কস্ত্তরি নামের নিরীহ মেয়েটা ট্যাব চালানোর কৌশল শিখতে চেয়েছিল, ততোধিক উত্তেজনায় সে তার হৃৎস্পন্দনকে থামাতে মরিয়া হয়ে উঠল। ব্যাগে নেওয়ার বদলে শাড়ির গিঁটে নাভির কাছে সে বস্ত্তটা লুকিয়ে ফেলল। বাসায় গিয়ে সবার আগে সে জিনিসটা তার বিছানার নিচে লুকিয়ে ফেলল। নাওয়া-খাওয়া শেষ করে তড়িঘড়ি সে নিজের ঘরে ঢুকে খিল তুলে সন্তর্পণে ট্যাবটা বের করল। একটা একটা করে ভিডিওর কনটেন্ট দেখতে দেখতে তার হৃৎস্পন্দন দ্রম্নততর হলো। কয়েকশো গিগাবাইটের বেশিরভাগই শরীফ ভরে রেখেছে পর্নোগ্রাফিতে। মায়ের ধমক খেয়ে রাতের খাবার খেতে এলেও কস্ত্তরির খাবারে মন নেই। টানটান চোখের কোলে ভরাট স্বাস্থ্যটুকু কয়েক ঘণ্টায় উধাও হয়ে সেখানে কালির টোপলা কেন তৈরি হয়েছে কস্ত্তরির মা তা না বুঝে প্রশ্ন করল,

তোর শরীর খারাপ?

না, তার শরীর খারাপ নয়। তবে তার প্রচ- বিবমিষা। খাওয়ার মাঝখানে মেয়েটা জীবনে এই প্রথম বমি করল। তার মা অবাক হয়ে তাকে প্রশ্ন করল,

সাহেব কি লম্পট টাইপের না কি?

না, তেমন কিছু নয়। শরীফ বড় পরহেজগার মানুষ – এই সামাজিক সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে কস্ত্তরি শুধু তরকারি খেয়ে ঘরে ঢুকল।

চার
যে-উত্তেজনায় কস্ত্তরির রাত কাটল, একই উত্তেজনায় শুরু হলো তার দিন। ধক্-ধক্ বুকের প্রান্তর সামলাতে সামলাতে সে কবির উদ্দিনের বাড়ির পথ ধরল। তারপর শরীফের সঙ্গে দেখা না করে চুপচাপ রান্নাঘরে আপনমনে কাজ শুরু করল। শরীফ আড়াল থেকে তাকে ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করল। যেমন একটা বিড়াল ইঁদুরের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে। সে খেয়াল করল, কস্ত্তরি যেন এক রাতেই একটু শুকিয়ে গেছে। তার চোখের কোণে একটু কালি জমে তাকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলছে। সে এবার বাঘ হয়ে হরিণ শিকারের নেশায় পেছন থেকে কস্ত্তরিকে জাপটে ধরল। কস্ত্তরি খুব বাধা না দিয়ে সারারাতের নিজের হৃৎপি– ডেকে যাওয়া সাগরের অবারিত ঢেউকে আস্তরিত ফেনা হতে দিলো। শরীফ তাকে টেনে বিছানায় নিয়ে এলো। বাইরে থেকে শ্যামাঙ্গ হলেও কস্ত্তরির ত্বক কী অসাধারণ। যেন রোদের আলো পেলেই তার নিখুঁত শরীর তা প্রতিফলিত করে চিকচিক করে উঠবে। মেয়েটার একটু ঘামভেজা ত্বকের গন্ধ শরীফকে হায়েনা করে তুলল। কিন্তু শরীফ অস্থির হাতে কস্ত্তরির অন্তর্বাস আর শাড়ির প্যাঁচ খুলতে যেতেই কস্ত্তরি বাধা দিলো। এক লাথিতে সে শরীফকে সরিয়ে লাফ দিয়ে বিছানার প্রান্তে বসে বলল,

আমার শরীর পেতে হলে কথা দিতে হবে।

কী কথা?

আমি অত গরিব ঘরের মেয়ে নই। কবির দাদার কথায় এখানে শুধু আপনাকে রান্না করে দেই। এসব করে আমাকে বিয়া না করলে বঁটি দিয়ে আপনার গলা কাটব।

শরীফ হাসল। সে জানে মিথ্যা আশ্বাস আর প্রতিশ্রম্নতিতেই চলছে বিশ্ব। কস্ত্তরির বঁটির চেয়ে এখন মিথ্যা ছলনার চাকু অনেক বেশি ধারালো। জোর করে ধর্ষণের কায়দাগুলো সে মেয়েটার ওপর ফলাতে যাচ্ছে না, এই তার বাপের সাতজন্মের ভাগ্য। তার কিছু ভাবাভাবির অত সময় কই? শরীফ পুনরায় কস্ত্তরির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার শরীরটা নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বলল,

খালি বিয়ে? এ-অঞ্চলের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান হবে তোমার-আমার বিয়েতে। ভয় নাই, জন্মনিয়ন্ত্রণে আমার বিশ্বাস আছে।

ভালো চাকুরে বলে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে গ্রামের সবচেয়ে আকর্ষণীয় মেয়েটাকে বিয়ে করেছিল খোকন নামের এক পাষ-। জেলা শহরে নিজের যে অফিস খোকন কস্ত্তরির বাবা-মা আর আত্মীয়দের দেখিয়েছিল লোকটা লাপাত্তা হওয়ার পর সেই অফিসে কবির উদ্দিন নিজে যোগাযোগ করলে তারা বিস্ময়ের সঙ্গে জানিয়েছে খোকন নামে কোনো ছেলেকে তারা তো চেনেই না, তাকে কোনোদিন তারা দেখেওনি। এমনকি যে ঠিকানা সে কাবিননামায় দেখিয়েছিল, পুরো কুমিল্লা অঞ্চলে ওই নামে কোনো গ্রাম নেই। খোকন নামের ওই যুবকের ছবি দেখালে অফিসের লোকজন একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বলল, ছেলেটাকে তারা বেশ কিছুদিন এদিকে ঘুরঘুর করতে দেখেছে। পরে তার নামে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লে সে ভেগেছে। অনেকের ধারণা ছেলেটা স্মাগলিংয়ের সঙ্গে জড়িত। তারপর থেকে খোকনকে নিজের স্বামী বলে পরিচয় দেওয়ার ইচ্ছা তো নেই-ই, কস্ত্তরি তাকে সাক্ষাতে একবার পেলে খুন করার ব্রত নিয়ে বসে ছিল। তার আগে সে নিজেই খুন হয়ে গেল। শরীফ শান্ত হলে, শাড়ি পরতে পরতে এই গ্রামের মোমেনার পরিণতির কথা তার মনে পড়ল। কস্ত্তরি বলল,

যদি কেউ জানে? জেনে যায়?

কবির উদ্দিনের এই দুর্গে কী হয় তা কার পক্ষে জানা সম্ভব? এটা কি মোমেনার বেড়া দিয়ে বানানো ঘর যে বাইরে থেকে উঁকি দিলেই সব দেখা যায়?

যা-হোক, আমাকে আপনি বিয়ে না করা পর্যন্ত আমি আর আসব না। এত পাপ করবার পারব না।

আরে পাগল, বেহেশতে কি এত পাপ-পুণ্যের হিসাব করতে হয়। কবির উদ্দিন চাচা শহর আর গ্রামে এই দুনিয়ার বেহেশত বানিয়ে রাখছে কি দোজখের ওম নেওয়ার জন্য। বেহেশতের হুরদের মোমিন বান্দারা ভোগ করবে না? আর তুমি তো বেহেশতের পাখি। তোমার আবার পাপ কিসের?

না, অত কিছু জানি না। আমি আর আসতে পারব না। তাইলে বিয়া করেন না ক্যান…?

আহা, তার জন্য গ্রামে একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে না? ঢাকা থেকে এসে এখনই বিয়েতে মাতলে লোকজন কী ভাববে? হাজার হোক, আসছি তো নেক কামে…

এইটা কি নেক কাম?

যেদিন তোমাকে বিয়ে করব, সেদিন থেকে এইসব সুদে-আসলে নেক কাম হিসাবেই গণনা করা হবে।

না, তা-ও। আর হবে না, কইলাম…

কিন্তু মাসিকের দিনগুলো বাদে প্রতিদিন একই কথা, সেই বিয়ের আশ্বাস নিয়ে কস্ত্তরিকে শরীফের শয্যাসঙ্গী হতে হলো। প্রথম কর্মের বিনিময়ে যে আশা নিয়ে স্বপ্ন তৈরি হয় তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পরের অপকর্মে লিপ্ত হতে নিজের ভেতরকে প্রতিনিয়ত সায় দিয়ে যেতে হয়। একবার সেই স্বপ্ন পূরণ হলে সামাজিক ধারণার সেই পাপকে বিলুপ্ত করার বাসনায় কস্ত্তরিকে বারবার কামনাকে জাগিয়ে তুলতে হলো। এই কাজ চক্রাকারে চলতেই থাকল এবং সবকিছু যখন স্নিগ্ধ আর শান্ত, কস্ত্তরি যখন পুনরায় নিজেকে শাড়িতে ঢাকছে তখন একই কথার পুনরাবৃত্তি বারবার তাকে করে যেতেই হলো,

এরপর আপনি বিয়ে না করা পর্যন্ত আমি আর সত্যিই আসব না।

কিন্তু কস্ত্তরি না এলে শরীফ না খেয়ে অনশনে মরে যাওয়ার হুমকি দেয়। ব্যস! খেয়াগ্রামের প্রকৃতি দিয়ে গড়া কস্ত্তরির নরম কোমল মনন সেই হুমকি সামলানোর জন্য মোটেও প্রস্ত্তত নয় বলে বারবার নিজের আশা আর হতাশার কাছে এই ফিরে ফিরে আসা। এখান থেকে সে মুক্তি চায় বলে ট্যাবটা সে ফেরত দিয়েছে শরীফকে। বস্ত্তটা পাপের দিকে টেনে তা শুধু তার অন্তর আর আত্মাকে বিষাক্তই করে তোলে। খেয়াগ্রামের নদীর দিকটার খোলা প্রান্তরে গিয়ে বুকভরে শ্বাস নিতে চায় সে। একটা বিকেল, একটা গোধূলি আর দূর পুব আকাশে থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ দেখে সে যেভাবে ঘনায়মান রাতটার কাছে নিজের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি আর স্বপ্নের কাছে, চুলার পাড়ে পিঠা তৈরিরত মায়ের মুখে ঝলসে ওঠা লালচে মুখের আভায় লুকানো জীবনের গভীর আনন্দের কাছে ফিরে যেত, এই ট্যাবের ভেতরের জগৎ কত তাড়াতাড়ি তার সবকিছু লুণ্ঠন করে নিল।

পাঁচ
এই ক-মাসে শরীফ কবির উদ্দিনের প্রচার সম্পাদক আর প্রায় ব্যক্তিগত সহযোগীতে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যে কবির উদ্দিনের কয়েক কোটি টাকার নির্বাচনী খরচের বাজেট থেকে ভালো একটা অংক সে নয়-ছয় করেছে। কস্ত্তরি আজকাল তাকে বিয়ের আলটিমেটাম দিচ্ছে। প্রথমবার সে শরীফের পরামর্শে গর্ভপাত করলেও এবার মেয়েটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এত সাবধান হয়েও কীভাবে যে দ্বিতীয়বারের মতো ঘাপলা হলো! এর জন্য সে নিজেকেই গালি দেয়। কস্ত্তরি তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, শরীফ তাকে বিয়ে না করলে সে সব গোপন তথ্য ফাঁস করে দেবে। নির্বাচনের কথা বলে সে মেয়েটাকে সামলে চলে,

এই সময় আমাদের সম্পর্ক জানাজানি হলে ভোটে চাচাকে নির্ঘাত হারতে হবে। কস্ত্তরি ফোঁস করে ওঠে,

আমার পেটে আবার বাচ্চা এসেছে। পেট বড় হয়ে গেলে সবাই এমনিতেই জেনে যাবে, তখন?

নির্বাচনের আর মাত্র এক মাস পনেরো দিন বাকি। তারপর চাচাকে প্রস্তাবটা দেওয়া সমীচীন হবে, বোঝো না? আর তিনি নিশ্চিত জিতে যাচ্ছেন। তার জয়ের আনন্দে আমরা…

আগাম দিনের স্বপ্ন দেখিয়ে তখনই সে কস্ত্তরির আনন্দ-লহরির মধ্যে ঘুরে আসার সুযোগ পায়। পরিস্থিতি এমন হয় যে, কস্ত্তরি স্বপ্নহীনতার ভয় পেলেই তাকে আশ্বস্ত করে একই সুযোগ বারবার গ্রহণের সুবর্ণ সময়কে সে কাজে লাগায়। লোলুপতার সঙ্গে প্রতারণা যাদের চরিত্রের অংশ তারা বুঝি এমন স্বপ্ন দেখিয়েই মানুষকে সর্বস্বান্ত করে! সেই দিনই শরীফ কস্ত্তরির শিক্ষক তামিমকে ডাকল। সন্ধ্যায় তাকে ঘরে এনে বলল,

তামিম আমি একা এত দায়িত্ব নিয়ে পেরে উঠছি না, ভাই। চাচার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আপনাকে এই সময় ছুটি নিয়ে রাত-দিন কাজ করতে হবে। এখানে আপনি আমার সঙ্গে থাকবেন। কস্ত্তরি আমাদের রান্না করে খাওয়াবে। মেয়েটার রূপের মতোই তার হাতের রান্না। আর আপনি তো তার খুব প্রিয় মানুষ।

শরীফকে দেখলেই কেমন ঘেন্নায় গা রি-রি করে ওঠে তামিমের। মনে হয়, এই লোকটা কস্ত্তরির সর্বনাশ করছে। তবু আজ তাকে ‘ভাই’ বলে ডাকায় তামিম তার ঘৃণাবোধকে সহনশীল হতে বলল। শরীফকে সে বলল, মানুষ হিসেবে কস্ত্তরির সঙ্গে তেমন পরিচিত নই। তবে হ্যাঁ, আমি তার শিক্ষক হিসেবে প্রিয় হতে পারি। কিন্তু শরীফ সাহেব, আমি এখানে রাত কাটাতে পারব না। বাড়িতে আমার অসুস্থ মা-বাবা আছে।

ভাই রে, যে মানুষটা আপনাকে নিজের প্রতিষ্ঠিত কলেজে শিক্ষক বানিয়ে মর্যাদা দিলো, তার জন্য একটু কৃতজ্ঞ হোন ভাই। আমি একা আর পারি না। আপনার মা-বাবা কি আমার মা-বাবা নন, বলেন?

তামিম এই কথায় গলে গেল। না, নিজেকে সে ধিক্কার দিলো, মানুষ সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে সে আর আগাম ধারণা পোষণ করবে না।

এরপর থেকে তামিম আর কস্ত্তরিকে একা বাসায় রেখে শরীফ সন্ধ্যায় হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। সে এলে এশার পর হেফাজতখানার কাশেম আর কলেজ শাখার এক ছাত্রনেতার সঙ্গে এই সময়টায় আড্ডা দেয় নির্বাচনের কৌশল নিয়ে। ফাঁকে ফাঁকে সে এটাও জানায় যে, কস্ত্তরি আর তামিম রাতের খাবার নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে। তাদের খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে সবকিছু ধুয়ে তুলে রেখে তারপর সে যাবে। এই কথা বলে শরীফ ফেরার তাড়া দেখিয়েও নতুন প্রসঙ্গ তোলে। এক ফাঁকে বলে,

অবশ্য, আমার মতো একজন বয়সী মানুষের আসেত্ম-ধীরে ফেরাই ভালো। ওদের খারাপ সময় কাটে না মনে হয়। কস্ত্তরি তো তামিম বলতে অজ্ঞান। হবেই তো, এত মেধা আর সরলতা ছেলেটার মধ্যে! তবে কস্ত্তরির এই পরিণতির জন্য তামিমের কষ্টটা আমাদের সবার চেয়ে বেশি। নির্বাচন শেষ হোক। দেখি, মেয়েটার একটা সুব্যবস্থা করা যায় কিনা।

নির্বাচন সম্পন্ন হয়েও যায়। সামান্য ভোটের ব্যবধানে কবির উদ্দিন তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে হারিয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন। দলের সমর্থনপুষ্ট মার্কা নিয়ে যে তার এই বিজয় শরীফ তা জানলেও ধর্মীয় অনুভবসম্পন্ন গ্রামের মানুষের কাছে এই বিজয়টুকু আল্লাহর রহমত ছাড়া আর কী? এই অনুভূতিতে যে আনন্দ যোগ হলো তাতে ধর্মের বিজয় নিশান উড়তে থাকল পতপত। এই বিজয়োল্লাসের মুহূর্তটুকুর জন্যই শরীফ অপেক্ষা করছিল। কিন্তু বিজয়ের খবর পাওয়ামাত্র কস্ত্তরি অস্থির হয়ে উঠল। শরীফকে এক ফাঁকে চা দেওয়ার ছলে সে একটু আড়ালে ডেকে এনে বলল,

চাচাক কন। আপনি বলতে না পারলে আমিই তুলি কথাটা…

চুপ! কী করতে হবে তা আমি জানি।

কস্ত্তরি চুপ হয়ে গেল। সন্ধ্যায় চা আর মানুষের হলাহলে শরীফই তখন নেতৃত্বের ভূমিকায়। খুশির তোড়ে কবির উদ্দিন সরকারের দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। রুমাল দিয়ে তিনি মাঝে মাঝে চোখ মুছছেন। আনন্দ তার কণ্ঠনালি ছাপিয়ে উপচে পড়ছে চোখ-মুখ বেয়ে। কয়েকজন কবির উদ্দিনকে বাতাস করছে। গ্রামের মানুষদের মধ্যে তাকে খুশি করার প্রতিযোগিতাটা অদৃশ্য হয়েও তা ঝরে পড়ছে এই সান্ধ্য-বলয়ে। শরীফ বলল,

সবাই শোনেন, সরকারিভাবে সংসদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত আমরা বিজয়োল্লাস করব না।

কবির উদ্দিন সরকারের হৃদয় হাহাকার করে উঠল। এই ছেলেটা তার জন্য কত কিছু করল! বিনিময়ে তাকে কিছু দেওয়া দরকার। না, তিনি শপথ নিয়ে এসে তার জন্য নিশ্চয়ই কিছু একটা করবেন। কিন্তু তার আগেই তিনি ছেলেটার বিবেচনা বোধ দেখে পুনরায় আপস্নুত হলেন। শরীফ বলল,

এই নির্বাচনের পেছনে সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে কে কাজ করেছে বলেন তো, চাচা।

কে? কার কথা বলিচ্ছ, বাপ।

কস্ত্তরি। মেয়েটা কত কত গণ্যমান্য ব্যক্তিকে রান্না করে খাইয়েছে। আর এটাও সত্যি, ওর রান্নার লোভে আমি এই গ্রামে টিকে গেছি… মেয়েটাকে বড় একটা পুরস্কার দেওয়া দরকার।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, একদম খাঁটি সত্য। সেই রাতেই কবির উদ্দিন কস্ত্তরিকে পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক দেওয়ার সময় খেয়াল করলেন মেয়েটা তাকে কিছু একটা বলতে চায়। কিন্তু শরীফের দিকে তাকিয়ে সে কিছু বলতে না পারলেও দ্রম্নতপদে বাইরে গিয়ে কাঁঠালগাছতলায় বমি করল। কবির উদ্দিন বাইরে এসে বাল্বের মৃদু আলোয় দেখলেন, বাম হাত দিয়ে গাছের ছোট্ট এক ডাল ধরে মেয়েটা ভেতর থেকে উগলে আসা বিবমিষা নিয়ন্ত্রণের জন্য কসরত করছে। শরীফ ইশারায় কবির উদ্দিনকে ডেকে বাড়ির বাইরে নিয়ে বলল,

চাচা, আমি মেয়েটাকে টাকার চেয়েও বড় একটা পুরস্কার দেওয়ার অনুরোধ করতে চাইছিলাম…

কী বাপ, তুমি কও তো। তুমি যা কবা, আমি তা-ই করব।

মাসদেড়েক ধরে তামিম এই বাড়িতে থাকে। সে-ও আপনার নির্বাচনে বৈতরণী পার করার জন্য নিজের সন্তানের মতো খেটেছে। বোঝেনই তো, বেচারা কস্ত্তরির খুবই পছন্দের মানুষ। রাত-বেরাতে আমাকে বাইরে ঘুরতে হয়েছে। ফিরে এসে দেখেছি দুজন আমাকে রাতে খাওয়ানোর নামে খোশগল্প করে… মনে হয় দুজনের মধ্যে একটু বোঝাপড়া… কবির উদ্দিন তার মুখের কথা কেড়ে নিলেন,

ওহ, এই কথা। তা তো ভালো। তামিমের সঙ্গে মানাবেও দারুণ। যাই-ই বলো, কস্ত্তরির মতো এত সুন্দর মেয়ে ঢাকাতেও চোখে খুব একটা পড়ে না। কী কও?

হ্যাঁ, আমি তো অন্যকিছু পরিকল্পনাও করেছিলাম। এত সুন্দর রান্না, আর সে তো…

আরে বেটা, তুমি কস্ত্তরিকে চাইলে আর কেউ তাক কি আর পায়। দাঁড়াও…

না, চাচা। কস্ত্তরি মনে হয় প্রেগন্যান্ট…

কত বড় বাইনচোত, তুমি এতদিন থাকলা কিছু হলো না আর সে এসে দেড় মাসে কস্ত্তরিকে পোয়াতি করে দিলো? তাই তো সে বমি করতেছে…

আসলে চাচা, আমার মতো একজন বয়সী পুরুষের চেয়ে তামিমকে তার ভালো লাগবে এই-ই স্বাভাবিক। আর আল্লাহ আমার কপালে কি কোনো সৌভাগ্য লিখে রেখেছে? কথাগুলো বলতে গিয়ে শরীফ কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। শরীফের কষ্টে কবির উদ্দিনের হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। একজন সাধারণ মানুষের মনস্তত্ত্বের অলিগলির সামান্য ভ-ামিটুকু ধরতে পারার সামর্থ্য না থাকলেও সংসদে বসে বাঙালি জাতির আগামী দিনের যিনি দর্শন নির্ধারণ করবেন সেই কবির উদ্দিন বললেন,

কী? ওই হারামজাদা হুজুর হওয়ার পরও এই আকাম… ওক তাইলে শাসিত্ম পাইতে হবে।

আমি সেজন্য আপনার হাতে-পায়ে ধরি চাচা, আপনি ওদের ক্ষমা করে বিয়ের ব্যবস্থা করবেন – এই পুরস্কারই চাইছিলাম। কবির উদ্দিন বিস্মিত স্বরে বললেন,

তুমি মানুষ না ফেরেশতা রে বাপ? ঠিক আছে যা বলছ তাই-ই হবে।

বলে মাঝে মাঝে লোকদেখানো নামাজ পড়লেও লোকচক্ষুর আড়ালে কোনোদিন নামাজের ধারেকাছে না ঘেঁষা শরীফ বলেই চলল,

আপনার যেন জয় হয়, সেজন্য প্রতিদিন তাহাজ্জদের নামাজে আল্লাহর হাত-পা ধরে খুব কানছি চাচা।

কবির উদ্দিন ঢাকা চলে যাওয়ার পর তামিম এই কয়দিনে শরীফের আদ্যোপান্ত পরিকল্পনা সব জেনে গেল।

তামিমের অনুসন্ধিৎসু চরিত্রের কারণে সে ইতোমধ্যে অনেক তথ্য জেনেছে। যে শরীফকে কবির উদ্দিন এত সাধু ভাবছেন, সে কস্ত্তরিকে বিয়ের প্রলোভন দেওয়ায় মেয়েটা এখন গর্ভবতী। না, এর একটা সুরাহা দরকার।

এক সপ্তাহ পর সাংসদ হিসেবে শপথ পাঠের পর কবির উদ্দিন ফিরে এলেন। এবার আনন্দ-উচ্ছ্বাস বড় মাত্রা পেয়েছে। তিনি ধর্ম প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন। এ-খবরে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা বাদণ্ডমাগরিব এমন একজন মহাপ্রাণ ব্যক্তিকে ধর্মের রক্ষাকবচ করে পেয়ে বিশেষ শুকরিয়া মোনাজাত করল। মসজিদেই দুটো কথা বলার জন্য শরীফ কবির উদ্দিনের অনুমতি নিল। শরীফের নারীলোলুপতা সহ্য করতে না পেরে পাশের গোধূলি গ্রামের সুদর্শন লেখক প্রতীকের কাছে তার স্ত্রী জয়িতা চলে গেছে বলে, মনে মনে প্রতীককে শাসিত্ম দেওয়ার নীলনকশা পাকিয়ে রেখেছে শরীফ। লেখকের বিরাট বাগানবাড়িটা থেকে তাকে তাড়িয়ে সেটাও দখলে নেওয়ার বাসনাকে সে অনেক কষ্টে এতদিন দমিয়ে রেখেছে। আজ সে গ্রামবাসীকে জানাল,

এ-অঞ্চলের জনগণের কাছে প্রগতি আর তারুণ্যের কথা বলে এক ভ- লম্পট লুকিয়ে আছে। তার নাম প্রতীক। প্রতীকের কারণে আগামী নির্বাচনে কবির উদ্দিন চাচা তো জিতবেই না, এ-অঞ্চল থেকে ধর্ম-কর্ম উঠে গিয়ে তরুণ-তরুণীরা অবাধ যৌনাচারের লাইসেন্স পেয়ে যাবে। সেই পরিস্থিতি কি আপনারা দেখতে চান? সবাই তাতে উত্তেজিত হয়ে উঠল। কবির উদ্দিন এবার বিরক্ত হয়ে মাত্র প্রাপ্তক্ষমতার দম্ভে বলে বসলেন,

সামান্য এক প্রতীকরে নিয়া এত প্যাঁচাল ক্যান। ওকে দেশছাড়া করতে কী করতে হবে, করো। কয় কোটি টাকা লাগবে, কোন আদালত ম্যানেজ করা লাগবে, করব। শরীফ বলল,

আমি আমার দেওয়া প্রতিটা কথা রেখেছি। এই কথাও রাখব, চাচা। শোনেন প্রিয় মুসলিস্নবৃন্দ, জিহাদ আল্লাহর নির্দেশ। সঙ্গে ধর্ম প্রতিমন্ত্রীও তা পালনের আদেশ দিলেন। এখন বলেন, আমার সঙ্গে কে কে এই জালেমকে শায়েস্তা করতে যেতে রাজি?

সবাই তীব্র তেজিকণ্ঠে এবং সমস্বরে নিজেদের হাত তুলল। তারা তাদের ধর্মকে, সমাজকে কলুষিত হতে দেবে না। প্রকাশ্যে অন্যের স্ত্রীকে নিয়ে গিয়ে নিজের বাগানবাড়িতে দিনের পর দিন যে জালেম এই পাপে বিশ্বকে হাবিয়া দোজখ বানাচ্ছে তাকে শায়েস্তা করার দায়িত্ব তাদেরই। তারা স্বয়ং ধর্মমন্ত্রীর গ্রামের বাসিন্দা।

ছয়
এমন পরিস্থিতি দেখে তামিম উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। মসজিদের বাইরে এসে কবির উদ্দিনের কাছে গিয়ে বলল,

স্যার, আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল…

তুমি কী বলবা সেটা কি মনে করো আমার অজানা? তামিম অনুনয় করে বলল,

আমি একটু আড়ালে আপনাকে কিছু বলতে চাই।

জানি তো, বাবা। শরীফ সবই বলছে। কম বয়স, ভুল করেছ। ক্ষমা করেছি। এখন সবাই জেনে যাওয়ার আগে বিয়েটা করে ফেল। তামিম চোখে অন্ধকার দেখল। তার পায়ের নিচের মাটি যেন সরে গেল। সে হাতজোড় করে বলল,

স্যার বিশ্বাস করুন, শরীফ সাহেব সব বানিয়ে বলেছে। প্রতীক সাহেব তার স্ত্রীকে নিয়ে বাস করলে তিনি আইনের আশ্রয় নেবেন। তা না করে তিনি কেন গ্রামের মানুষদের দিয়ে এই কাজ করাতে চাইছেন? আর কস্ত্তরিকে মনে হয় …

অন্ধকারের ভেতর কখন শরীফ এসেছে তামিম টেরই পায়নি। ঠিক সেই সময় সে তামিমের গালে কষে একটা চড় মেরে বলল,

শালা বেইমান! তোর মতো বেইমানের জন্য আমি চাচার এত হাত-পায়ে ধরলাম? চাচা, এখন সত্যি কথাটা বলি। এই তামিমই সেই জন, এই গ্রাম থেকে যার একটামাত্র ভোট গেছে ওই বিধর্মীদের বাক্সে। সে আসলে প্রতীকের চর হয়ে গোপনে কাজ করছে এখানে। এই গ্রামকে সে নাটকের মঞ্চ বানাইছে…

কবির উদ্দিন তামিমের ব্যাপারে এই কথাগুলো বিশ্বাস করেন না। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর এই উপলব্ধি তার হয়েছে যে, রাজনীতির মঞ্চে স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে বিশ্বাসকে পায়ে মাড়িয়ে স্বার্থসিদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে হয়। এই সিদ্ধির নিয়ামক তো তামিম নয়; শরীফ। সুতরাং কবির উদ্দিন হাত তুলে শরীফকে থামালেন। তামিমের উদ্দেশে বললেন,

যে একবার বেইমানি করে সে বারবার বেইমানি করবে। মেয়েটারে পোয়াতি বানাইয়া এখন পালাতে চাও? তা হবে না। এই কাশেম আর কলিমুদ্দিনরে ডাক। কস্ত্তরির বিয়া পড়ায়া দেওয়ার তারিখ ঠিক করি। ধর্মের কাম আগে ঘর থেকে শুরু করি – বলে তিনি তামিমের দিকে আর মনোযোগ না দিয়ে হনহন করে শরীফের সঙ্গে বাড়ির পথে পা বাড়ালেন। যেতে যেতে শরীফ বিজ্ঞের মতো বলল,

কস্ত্তরির ব্যাপারটা এখনই কাউকে কিছু জানানোর দরকার নাই। দু-তিনদিনের মধ্যে আগে কাজটা সেরে নিই। এটা নিয়ে গ্রামে আবার ফিসফিসানি শুরু হলে তামিম জল ঘোলা করতে পারে।

এদিকে তামিম আর কস্ত্তরির অবৈধ সম্পর্কের কথা প্রকাশ হলো সেই রাতেই। তাতেই যেন খেয়াগ্রামের বাতাসে আগুন হয়ে খবরটা ছড়িয়ে পড়ল। ঘুমের স্থান দখল করল ফিসফিস-কানাকানিতে। বলা বাহুল্য, এই খবর কস্ত্তরির কাছেও পৌঁছল যে, তামিমের সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্কের কারণে কবির উদ্দিনের আদেশে মোমেনার মতো তাকে ভাগ্য বরণ না করে উলটা তামিমের সঙ্গে আগামীকাল বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে বলে গ্রামের অনেক নারী-পুরুষ তাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত। ক্যান, তারা কস্ত্তরির মতো এমন অকাম করলে মন্ত্রী কি পারমিশন দিত? অনেকে এই রাতের অন্ধকারে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পুকুরপাড়ে একে অন্যের কাছে এই বলে মন্তব্য করল যে,

মনে হয় কস্ত্তরির প্যাট কোবরুদ্দিনই বানাইছে… না হলে ওই শালা এই কতা ক্যান কয়?

না, শরীফের মতো প্রতারক আর নষ্ট মানুষের ছোবলে বিক্ষত মন আর এই পচা শরীর নিয়ে কস্ত্তরি একজন জ্ঞানী মানুষের স্ত্রীর তকমা নিয়ে বাঁচতে চায় না। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই, তামিম স্যারের মুখোমুখি হওয়ার আগেই সে তার প্রাণটাকে নিস্পন্দন করে ফেলতে চায়। সবার চোখের আড়ালে হালচষা জমির মাঝখান দিয়ে, আমবাগানকে ডানে ফেলে ‘ডাইমিক্রন’ নামক কীটনাশক নিয়ে কস্ত্তরি নির্জন মাঠের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেল। শুকনা নদীর পারে ঝোপঝাড়ের ভেতর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা নারিকেলগাছটার দিকে। রাতের বাতাস আজ তার পাখায় এত সংবেদিতন্ত্রগুলো জাগিয়ে রেখেছে যে, কস্ত্তরির মনে হচ্ছে তার কলঙ্ককে শনাক্ত করার জন্য কুকুরের ঘ্রাণবাহী নাসারন্ধ্রের মতো তা শোঁ-শোঁ শব্দ তুলে তাকেই যেন খুঁজছে। বাতাসের দোলায় পটোলক্ষেতের বেড়ার একটা কলমির পাতায় দোলা লাগলেও কস্ত্তরির ভেতরটা কেঁপে উঠছে।

কিন্তু কেন মৃত্যুস্থানটি বেছে নিতে সে নারিকেলগাছটার সান্নিধ্যে যেতে চাইছে – তা সে জানে না। তা কি এজন্য যে, গাছটি খুব একা? ঝোপঝাড়ের অনেক আগাছার ভেতর থেকেও তার মতো প্রতিজন মানুষের মতো একা? গাছটা তার জীবনের নিয়তি কি আগে থেকে জানত বলে তার দিকে চোখ পড়লেই কস্ত্তরির ভেতরটা অমন হাহাকার করে উঠত? এমন নিঃসঙ্গতা আর একাকিত্বে বুঝি মৃত্যুকেই সঙ্গী হিসেবে বেশ মানায়। না কি তা এজন্য যে, কস্ত্তরি যখন মাত্র জীবন নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে তখন স্কুল থেকে ছাতামাথায় হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে এই গাছটার দিকে তাকিয়ে সে কেমন উদাসী হাওয়ায় মন ভাসাত? যতবার গাছটার দিকে তার দৃষ্টি গেছে ততবার গাছটার জন্য বুকের মধ্যে কেমন হু-হু করে উঠেছে। মনে হতো, তার একটা ঘর হবে, তার মাথার ওপর থাকবে এমন একটা নারিকেলগাছ। নারিকেলগাছ আর তার স্বপ্ন – দুজন দুজনের সঙ্গী হবে! স্বপ্নগুলো কেমন স্বপ্নই থেকে যায়, বাস্তবে তারা আর ধরা দেয় না।

কস্ত্তরির চোখের ভাষা অাঁধারের ভাষার কাছে ততক্ষণে শিখে নিয়েছে রাতের সব কথা। ঝিঁঝিদের সঙ্গে তার হৃদয়ও এখন একই তানে নিনাদিত। রাতের এই প্রহরকে ফাঁকি দিয়ে কস্ত্তরি পৌঁছে গেল এককালের স্রোতময় আর বর্তমানের শুকিয়ে যাওয়া নদীর কিনারের ঝোপের কাছে। মহাকালের সঙ্গে ঝিঁঝির কলতান হওয়ার জন্য সে এখন প্রস্ত্তত। সে আল্লাহর কাছে তার শরীরে বেড়ে ওঠা ভ্রূণটাকে হত্যা করার জন্য ক্ষমা চাইল। তারপর পাতলা ঝোপঝাড়ের পাতা মাড়িয়ে পৌঁছে গেল নারিকেলগাছের তলায়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত