ঝাঁট দিতে দিতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসতে থাকে রোশনারা। সিঁড়ির প্রতিটি ধাপের কোনায় জমে থাকা ধুলোবালি, ছেঁড়া কাগজের টুকরো, চকলেটের দোমড়ানো মোড়ক, পাউরুটির পোড়া চামড়া, ফুরিয়ে যাওয়া পেনসিলের গোড়া এমন করে জড়ো করতে থাকে দেখলে মনে হয় কাজটার মধ্যে কিছু একটা খুঁজে বেড়ায় মেয়েটা। কোথায় যেন বাড়তি একটা উৎসাহ ওকে এই কাজে নিবিড় করে, তৃপ্তি দেয়। নিজের ঘর গুছিয়ে ঝাঁট দেওয়ার মতোই মন লাগানো তার কাজ।
স্কুল ছুটি হয়ে গেলে প্রথমে প্রতিটি কক্ষ গোছানোর পর মাজা কুঁজো করে ঝুঁকে ঝাড়ু চালাতে চালাতে চারটা তলা শেষ করে সে। এরপর একেবারে ওপরের সিঁড়ি ধরে ধীরে ধীরে নামে। আর এই সময়টায় প্রতিদিন সিঁড়ির গোড়ায় চেয়ার পেতে বসে লম্বা পা-দুটো সামনে ঠেলে দিয়ে চোখের পাতা না নড়িয়ে রোশনারার ঝাঁট-দেওয়া দেখে মালেক। বস্নাউজের তলে ওর সবল মাইদুটো নিচ থেকে দেখতে গাছের বাঁকা ডালে পাতার আড়ালে ঝুলে থাকা ভিমরুলের চাকের মতো লাগে।
অল্পদিন হলো চাকরিতে ঢুকেছে মেয়েটা। সে-কারণেই কিনা কে জানে, ওর দিকে মালেকের মনোযোগ এতটা তীক্ষন। কিন্তু এতে যে-দৃষ্টিদোষ ঘটছে, তেমনটা অনুভব করে না মালেক। সে শুধু দেখে আর কিছু একটা চিমন্তা করে।
ময়লা নিয়ে নামতে নামতে সিঁড়ির শেষ ধাপটায় কোমর সোজা করে দৃঢ় হয়ে দাঁড়ায় রোশনারা। বলে, সিংহাসনটা লইয়া অহন সরেন তো মালেকভাই, ঝাড়ু দিমু।
ইচ্ছে করছে না এমন একটা অনীহা নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে মালেক। রোশনারার শরীর থেকে ভাপছাড়া ঘামের তীব্র গন্ধটা নাকে এসে লাগে তার।
চারপাশে দেয়াল তোলা একটা উঠোনের সমান প্রায় – পাঁচতলা বাড়ির নিচতলার এই গ্যারেজটা স্কুলের খেলার মাঠ। ক্লাস শুরুর আগে এবং ছুটির পরে এখানে দাঁড়ানোর মতো পরিস্থিতি থাকে না। তখন সিঁড়ির ওপারে দেয়াল ঘেঁষে ক্রিকেট খেলায় মেতে ওঠে শিশুরা। যারা খেলে না, তাদের মধ্যে গুঁতোগুঁতি, হাতাহাতি লেগেই থাকে। কেউ হুটোপুটি খায়, কান ফাটিয়ে চিৎকার দেয় কেউ। একে ও তাড়া করে তো তাকে জাপটে ধরে কয়েকজন। বলার মতো নয়, সবার মধ্যে এমন তিড়বিড়ে অবস্থা চলতেই থাকে। মেয়েগুলো সে-তুলনায় ঢের শান্ত।
গেটের সামনেও কঠিন জটলা, ঠেলা-ধাক্কা, বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ আকুতি। কিন্তু মালেককে ফাঁকি দিয়ে অভিভাবক ছাড়া কোনো শিশু বাইরে বের হবে – এমন সাধ্য কারো নেই।
শিশুরা চলে যাওয়ার পর পড়ন্ত বেলায় শাড়ির আঁচল শক্ত করে কোমরে পেঁচিয়ে শলার ঝাড়ুর দাবড়ানিতে ধুলো উড়িয়ে উড়িয়ে মাঠের এ-মাথা থেকে ও-মাথায় মালেকের থাকার ঘরের সীমানা পর্যন্ত ঝাঁট দেয় রোশনারা। আলোর ঝিলিক দেওয়া তার টকটকে মুখখানায়, পোস্তদানার মতো নাকফুলটার চারদিকে দেখা দেয় বিন্দু বিন্দু ঘাম। ঘাড়ে-পিঠে কিছু এলোমেলো চুল লেপ্টে যেতে থাকে ওই ঘামে। কোমরে প্যাঁচানো আঁচলের ফাঁক দিয়ে এক-আধবার দেখা দেয় ধবল মসৃণ পেট, নাভিমূল। মালেকের নজর এড়ায় না এসবের কিছুই। শ-তিনেক শিশুকে চোখে চোখে রাখার আস্ত হারামজাদা একখানা নজর বটে লোকটার!
উঠোনের পশ্চিমে সিঁড়ির ওপারে আমকাঠের চৌকিপাতা মালেকের ছোট্ট কামরা। একজন মানুষ কোনোমতে দাঁড়াতে পারে এমন একখানা গোসলখানার মধ্যে টয়লেট, পাশে তেমনই এক টুকরো রান্নাঘর। ধুলোর ঝড় ওই কামরার মধ্যে হামলে পড়ার আগ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রোশনারার ঝাড়ু দেওয়া উপভোগ করে মালেক, তারপর দরজা-জানালার সিটকিনি তুলে ভেতরে সেঁধিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
অনেকদিন ধরেই চলছে এমন। তলে তলে ব্যাপারটা যে ভালো লাগছে না রোশনারার তাও নয়। একেকবার মনে হয় একটা অদৃশ্য ফাঁদ রচনা করে রেখেছে মানুষটা, একটা জ্যাঠা মাকড়সার মতো জলের সুতা বিছিয়ে তক্কে তক্কে রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো আলামত খুঁজে পায় না রোশনারা। সবটাই কি তবে তার মনগড়া অনুমান? একটা ধন্দের মধ্যে পাক খেতে লাগে সে। লোকটা জানি কেমন! তা যেমনই হোক ওর বিনয়, শিশুদের ওপর সতর্কদৃষ্টি, সকলের সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলার ধরন আর কর্মতৎপরতা নিয়ে বড় আপার ব্যাপক সুনজরে আছে সে। কিন্তু মালেককে নিয়ে রাঁধুনি পারুলের আলস্নাদিপনার যে-কথা ইদানীং চাউড় হয়েছে তা তো আর এমনি এমনি হয়নি! ওর মধ্যে গোলমাল কিছু আছেই। গেল বিষ্যুদবারেই তো, বড় আপা তার রুমে ডেকে নিয়ে এ-ব্যাপারে পারুলকে দিলেন ধাতানি। আপার কথায় বোঝা গেল কোনো ব্যাপার নিয়ে ঠ্যালা খেয়ে পারুল-মালেক বিষয়ে তার কান ভারি করেছে পারুলের হেলপার আকলিমা।
আপা রাগে লাল হয়ে পারুলকে বললেন, ফের যদি আমার কানে কোনো কথা আসে, একটারও চাকরি থাকবে না পরিষ্কার বলে দিচ্ছি। তোমার হেলপারেরই-বা কী করে সাহস হয় এসব নিয়ে কথা বলার? কতবার তোমাদের বোঝাতে হবে, এটা শিশুদের স্কুল। ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে চর্চা করার কোনো সুযোগ এখানে নেই। আমাদের সকল ভাবনার মূলে শিশু।
আত্মপক্ষের সমর্থনে কিছু বলতে গিয়ে পারুল তখন তোতলায়। আপাও হয়তো ধরে নেন ভেতরে গোলমাল কিছু আছে।
একটা তোয়ালে দিয়ে মুছে মুছে আপার আলমারির বই গোছাচ্ছিল তখন রোশনারা। ব্যাপারটা তার চোখের সামনেই ঘটছে, না হলে তো এসবের কিছুই জানতে পারত না সে। সেদিন থেকেই তাকে নিয়ে মালেকের মনে কোনো কুমতলব আছে এমন একটা অনুভব মাথা থেকে সরাতে পারছে না রোশনারা।
পারুলের হেলপার আকলিমাটারই-বা এ কেমন চরিত্র? প্রতিদিন দুপুরে একসঙ্গে খেতে বসে তারা। একটানা খাটাখাটুনির পর খেতে খেতে ঠাট্টা-তামাশাও চলে। বেটাছেলে মেয়েছেলের মধ্যে একটু-আধটু এমনটা না হলে কি আর জান জুড়ায়? এই আকলিমাই তো বলে, আহা, পারুল আফা, মালেকভাইর মাছ পছন্দ, বাটিতে মাছ তো আছে, দেন না আর এক টুকরা। আবার হয়তো বলবে, দেখছেননি আফা, ডাইলে ডুবায়ে ভাত খাচ্ছে মালেকভাই, মুরগির ঝোল-আলু কিছু নাই?
পাশে যে মাথা নুইয়ে আনমনে খেয়ে যাচ্ছে কাশেম, হামেদ তাদের ব্যাপারে কিন্তু কোনো উচ্চবাচ্চ্য নেই। আর পারুলও বুঝি এমন একটা প্রস্তাবের অপেক্ষাতেই থাকে। সে তৎক্ষণাৎ মালেকের পাতে বাড়তি কিছু না দিয়ে পারে না।
যে-কোনো প্রতিষ্ঠানের ছোট কি বড় কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্বভাবটাই বোধহয় এই হয়ে যায় যে, তারা যে-প্রকারেই হোক আপনজনের মতো আচরণের আড়ালে একে অপরের পেছনে পরজনের মতো লেগে থাকতে পছন্দ করে।
এখানে আসার পর থেকে মালেকের ওপর পারুলের আলগা দরদটুকু তো দেখে আসছে রোশনারা। বড় আপার ঘরের ঘটনার পর থেকে এই নিয়ে সহকর্মী আকলিমার ভূমিকায় তার ভেতরে একটা ঘেন্নাও জেগে উঠেছে, যা আর মন থেকে সরাতে পারছে না সে। তা ছাড়া মালেকের সঙ্গে পারুলের আচরণে যখন-তখন অকারণেই বিচ্ছিরি রকমের রাগ ধরে যায় তার। নাকি এ-ও এক প্রকার ঈর্ষা, রক্ত-মাংসের খোলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থেকে কখন যেন আগাছার মতো অজামেত্ম মনের কোনো এক স্তরে বেড়ে উঠেছে? নিজের ওপর সন্দেহ চাড়া দিয়ে ওঠে রোশনারার।
দুই
দুই হাত বাতাসে মেলে দিয়ে খালপাড়ের শর্ষে খেতে হলদে ফুলের বন্যায় আল ধরে ছুটছে রোশনারা, চারদিকে উড়ছে হাজার হাজার প্রজাপতি। ঘটনাটা তখনকার কোনো এক বিকেলের। কামাবার জন্য রোশনারার বাবা তার খেজুরগাছগুলোতে আগে থেকেই আড়া বেঁধে রেখেছিলেন। পুকুরপাড়ে মানকচু ক্ষক্ষতের কিনারে একটা গাছের ওই আড়ায় দাঁড়িয়ে দড়ায় কোমর রেখে নিশ্চিমেত্ম ঘচ ঘচ করে কামিয়ে যাচ্ছিলেন খেজুরগাছ। কাজে এতই মনোযোগ কোনোদিকে খেয়াল নেই তার। আচমকা হাত ফসকে দা গিয়ে লাগল কোমরে পেঁচানো পুরনো দড়াটায়। ধার দেওয়া দায়ের ঘায়ে দড়ার অর্ধেকটা কেটে গেল। চোখের পলকে বাকিটা ছিঁড়ে সুড়ুত করে গেলেন পড়ে মানকচুর ক্ষক্ষতের ওপর। পাঁজরের হাড় ভেঙে গেল তার। নাক আর কান দিয়ে গড়িয়ে এলো রক্ত। মাথায় গুরুতর আঘাত পাওয়ায় হাসপাতালে নেওয়ার আগেই বমি করতে করতে সব শেষ।
অকালে মারা যাওয়া গৃহস্থটির কবরের মাটি শুকিয়ে এসেছে। গজিয়ে উঠেছে দূর্বাঘাস। আয়-রোজগারহীন ভাবিকে ভাশুর-দেবর আর কয়দিন খাওয়াবে? এর চেয়েও বড় আপদ, রাতের আঁধারে বিধবার ঘরের খিল-দেওয়া দুয়ারে শেয়াল ডাকতে শুরু করেছে।
লেখাপড়া না শিখেও মেয়েদের দলবেঁধে কাজে যাওয়ার যুগ তখনো শুরু হয়নি। তেল ফুরানো প্রদীপের মতো দপ দপ করতে লাগল পতিহীনার সংসার। কীভাবে দিন কাটবে? শেষ উপায় হিসেবে মেয়েটাকে সঙ্গে করে বাপের বাড়িতে ভাইদের আশ্রয়ে উঠতে হলো। কিন্তু গ্রাম্য সমাজে ভাইদের সংসারে জোয়ান বিধবার এভাবে দিন যায় না। বিয়ে হয়ে গেল রোশনারার মায়ের।
বুড়ো নানি লাঠিতে ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে হাঁটেন। বিধবা মেয়েটাকে আবার বিয়ে দিতে পেরে মনে হচ্ছে এবার লাঠি ফেলে সোজা হয়ে চলবেন। তাঁর আঁচলের ওমে মামাত ভাইবোনদের সঙ্গে বড় হতে লাগল রোশনারা। লেখাপড়াও চালিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু নবম শ্রেণিতে উঠতে না উঠতেই সেই ওম ভেঙে বই-খাতা শিকেয় তুলে বিদায় নিতে হলো তাকেও। তারপর পাঁচ বছরের একটানা সংসার। স্বামীটা নির্মাণশিল্প কোম্পানির রাজমিস্ত্রি আলাউদ্দিন। বিয়ের পর শহরে বউ এনে ভালোই চালাচ্ছিল সে। কিন্তু স্বামী আর স্ত্রীতে বছরের পর বছর ধরে ফাঁকা সংসারের ভার ঠেলে কী করে। তাছাড়া নিঃসমন্তান দম্পতির ওপর আত্মীয়-পরিজনের ক্রমাগত চাপ। সব মিলিয়ে সমন্তানের আশায় ডাক্তার-বৈদ্য-ওঝা, তাবিজ-কবচ, ঝাড়ফুঁক, জড়িবুটি, পানিপড়া, মাজার শরিফে মানত – সবটাতেই দৌড়ঝাঁপের আর অন্ত থাকল না।
লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছিল দুজনেই; কিন্তু এই দীর্ঘ দৌড়ের ধাপে ধাপে ধীরে ধীরে রোশনারা এক সময় টের পেতে থাকল, তার ওপর থেকে আলাউদ্দিনের মন জলে-ধোয়া রক্তের মতো ফ্যাকাশে হতে হতে কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। মেজাজ খারাপ হলে আলাউদ্দিনের গালাগালের মধ্যেও এক ধরনের অন্তর্ভাব ছিল; কিন্তু এখন শরীরের সঙ্গে শরীর লাগলেও ছ্যাৎ করে উঠছে লোকটা। বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছে রোজ। এসেই নিঃশব্দে গপাগপ খেয়ে ভার ভার মুখ করে দু-একটা কথার জবাবের পর আলগোছে শুয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে ঘরে ফেরাটা বুঝি ওর শুধুই একটা অভ্যাস।
আগে কখনো এমন ঘটলে কেঁদেকেটে একটা গোল না বাঁধিয়ে ছাড়ত না রোশনারা। এখন আর সে-দিন নেই। সেসব দিনে বউয়ের জন্য আলাউদ্দিনের পরান ছটফট করে উঠত। একটু-আধটু রগচটা হলেও অত খিটকেলে ছিল না সে। দু-একটা চড়-চাপড় দিয়ে বলত, ওই মাগি, আমার দেরি লইয়া তোর এত গুড়গুড়ি ক্যা? আমি কি হুদাহুদি দেরি হরি? না কি হাঙ্গা করছি আর একটা – যেহানে টাইম দেই?
আলাউদ্দিনের দেরি করে ঘরে ফেরাটা ধীরে ধীরে মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে থাকে। ফিরে এসে গোমরামুখ নিয়ে নীরব হয়ে থাকাটাও। বিষয়টা গা-সওয়া হওয়ার কথা; কিন্তু তা না হয়ে গায়ে আগুন জ্বলতে থাকে রোশনারার। সেই আগুনে ফড়ফড়িয়ে উড়তে থাকে অচেনা বাতাস। আর সেই বাতাসে ভর দিয়ে সত্যি সত্যি খবর আসে একদিন। আলাউদ্দিন তার এক বছর বয়সের ছেলেটাকে কোলে নিয়ে নতুন বউসহ হাসপাতালে গেছে টিকা দিতে। পাশের ঘরের আমেনার সঙ্গে সেখানেই দেখা হয়েছে তাদের। বাসায় ফিরে কথাটা পুরোপুরি শোনাতেও পারে না আমেনা, গোড়াকাটা গাছের মতো হাত-পা ছেড়ে দিয়ে ওর কোলে মূর্ছা যায় রোশনারা। দাঁতে খিল লেগে যায়।
দুই পাটি দাঁতের মধ্যে চামচ ঢুকিয়ে সেই খিল খুলে দিলে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাসের পর বুকটা নির্ভার করে বিরস চোখ মেলে তাকায় রোশনারা। কোনো প্রশ্ন নেই, কোনো নালিশ নেই, কোনো আকাঙক্ষা বা স্বপ্ন নেই, মরা মাছের চোখের মতো নিথর, এমনই তার চাউনি।
আমেনা যখন রোশনারাকে ঘটনাটা বলছিল ওর বলার মাঝখানেই কয়েক মুহূর্তের ভূমিকম্পটায় যা হওয়ার তা তো হলোই। রক্ত-মাংসের একটা ধ্বংসসত্মূপের ওপর দাঁড়িয়ে নিত্যদিনের মতো রান্নাবান্নাও হলো। খাওয়া-দাওয়া হলো। বিকেলে একচোট ঘুমও হলো।
আলাউদ্দিন বাসায় এলো যখন, তখন রাত সাড়ে নটা। বোঝা গেল প্রস্ত্তত হয়েই ফিরেছে সে। রোশনারারও কোনো শব্দ পাওয়া গেল না আজ। টেলিভিশনটাও বন্ধ।
হাত-মুখ ধুয়ে কাঁঠাল-কাঠের চৌপায়াটার ওপর স্টিলের বাটিগুলোতে ঢেকে রাখা রাতের খাবার ছুঁলো না আলাউদ্দিন।
কাঁথাটা টেনে নিয়ে প্রতিদিন যেমন শোয়, তেমন করে খাটের ডানদিকে নিঃশব্দে শুয়েও পড়ল না আজ। ঘরের দরজার ওপাশে আড়াই ফুট চওড়া খাঁচার মতো অন্ধকার বারান্দাটার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে লাগল।
দুই ঘর পরে আমেনাদের টিভিতে বাংলা সিনেমার গান চলছে। বাসায় ফিরে হররোজ বউয়ের প্যানপ্যানানিতে কান না দিয়ে যতটা সম্ভব মুখ বুজেই তো থাকে আলাউদ্দিন। কিন্তু আজকের এই গুমোট, এই নীরবতার আগুনে জ্বলে যাচ্ছিল সে আর একটা চাপা অবাধ্য উত্তেজনায় ফুঁসছিল। আচমকাই চড়াত করে মগজে বাজ পড়ল যেন। ঘরে ঢুকে রোশনারার চুলের মুঠি ধরে ইচ্ছেমতো ঝাঁকাতে লাগল আলাউদ্দিন, ওই মাগি, আমার খাবি, আমার পরবি, আবার আমার লগে দেমাগ দেহাবি? ঠাপাইতে ঠাপাইতে শাউয়ার হাড্ডি ফাডাইয়া হালাইলাম তোর, তাও যদি একবার প্যাট ধরাইতি। বাঁজা মাগি, প্যাটে পাত্থর হান্দাইয়া রাখছোছ? আওয়াজ করোস না ক্যান? অই মাগি, আওয়াজ কর। আওয়াজ কর। নইলে বাইর হ আমার বাসাত্তন।
এরপর অগণিত চড়-চাপড়-লাথিতেও কোনো শব্দ করল না রোশনারা। না রাগ, না ক্ষোভ, না অভিমান কিছুই নয়। মার খেয়ে একেবারে বেবোধা হয়ে একটা অচল আধুলির মতো শীতল মেঝেতে পড়ে থাকল সারারাত।
সকালে কখন বেরিয়ে গেছে আলাউদ্দিন, টের পায়নি রোশনারা। শেষরাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। ঘুম ভেঙে দেখে, জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকে এক টুকরো রোদ উত্তরের দেয়ালে ঝুলে আছে। শরীরে প্রচ- ব্যথা আর শ^াসকষ্ট হচ্ছে। স্থির হয়ে কিছু ভাবার শক্তিও তার নেই। প্রবল একটা ঝাঁকুনির মধ্যে জীবনের বাইরে থেকে বয়ে আসা অস্ফুট শিসের ধ্বনি কানের কাছে বারবার আছড়ে পড়ছে বলে অনুভব করল সে।
দশটার দিকে প্রয়োজনের কাপড়-চোপড় যেটুকু পারল একটা ব্যাগে ভরে নিয়ে ঘরের চাবিটা রেখে আসে আমেনাদের বাসায়। হেঁটে প্রথমে বাসে, তারপর রিকশায় চড়ে ঠিকানা খুঁজে খুঁজে দূর-সম্পর্কের এক খালার বাসায় এসে উঠল রোশনারা। সব শুনে খালা বললেন, দামড়াটার সংসারে জুতা মারলি, তুই তো একখান বাপের বেটি রে! অহন কী আর করবি, আমার এইখানেই থাক।
তিনটা বেডরুম, ঝকঝকে সোফায় মোড়ানো ড্রয়িং, ডাইনিং, কিচেন মিলিয়ে বিশাল ফ্ল্যাট। কিন্তু এতো বড় ফ্ল্যাটের কোথাও খালার ছেলেমেয়ের কাউকেই দেখতে পেল না সে। অচেনা দুটি মেয়ে, সিনেমার নায়িকাদের মতো তাদের সাজ-পোশাক, কোনার ঘরের খাটে বসে আড্ডা দিচ্ছে। খালাকে জিজ্ঞেস করবে সে-সাহসও হলো না তার। মুখ বুজে রান্নাঘরে বুয়ার সঙ্গে কাজে লেগে গেল।
সারাদিন নানা কাজের মধ্যে প্রায় দমবন্ধ করে রেখেছিল রোশনারা। রাত প্রায় নটার দিকে শ^াস পড়ল তার। দেয়ালে ঝোলানো টিভিটায় হিন্দি সিরিয়াল চলছে। মেহমান বিদায় করে বেরিয়ে গেছে মেয়েদুটি। থলথলে ক্লান্ত শরীরটা খাটের ওপর ঢেলে দিয়ে চোখ মুদে রয়েছেন খালা। জড়সড় হয়ে পাশে বসে তার কপাল টিপছে রোশনারা, চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। তন্দ্রার মধ্যে কুয়াশা-ছড়ানো একটা ঘোর লাগছে এতে। ওই ঘোরে ডুবতে ডুবতেই থ্যাবড়ানো গলায় তিনি যা বলতে লাগলেন তা মোটামুটি এরকম – শ^শুরের পেনশনের টাকা নিয়ে স্বামীটি তিন বছর হলো মালয়েশিয়ায় গিয়ে ব্যবসা করছে। দেখলে মনে হবে ভেজাবিলাই; কিন্তু আস্ত হারামির বাচ্চা একটা! একটা হারামখোর। কোনো মাসে টাকা পাঠায় তো পরের তিন মাস খবর রাখে না, ফোনও ধরে না। বড় মেয়েটা সিলেট মেডিকেলে পড়ছে, ছেলেটা পড়ছে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে। ছোট মেয়েটা ড্রাগ অ্যাডিকটেড, ওকে একটা নিরাময় কেন্দ্রে রেখে দিয়েছেন। বিরাট খরচ। এর মধ্যে বাপের বাড়িতেও টাকা পাঠাতে হচ্ছে। খরচের দড়া টানতে টানতে হাড়-মাংসে কড়া পড়ে গেছে তার। জানে আর কুলাচ্ছে না। নামি-দামি কিছু মানুষ আসে বাসায়, কিছুক্ষণ আরাম-আয়েস করে, এই আর কী! তেনাদের দয়ায়ই তো টানতে পারছেন সংসারটা।
একটা ঝুনো নারকেলের মতো একটানা এসব বৃত্তামেত্মর ওপর গড়াতে থাকেন খালা। চুলের গোড়ায় গোড়ায় রোশনারার আঙুল আর থামে না। ধীরে ধীরে খালার কথায় জট লাগতে থাকে। গলা বুজে আসতে থাকে। ওই তন্দ্রা, ওই ঘোর তাঁকে সুখানুভবের টোপের মধ্যে, গাঢ় ঘুমের মধ্যে ঠেলে দেয়।
নিশ্চল মানুষটার ওপর স্থির দৃষ্টি রোশনারার। ঘন কালো চুলে পাক ধরেনি, তবে চামড়ার টানটান ভাবটা মরে গিয়ে কিঞ্চিৎ বয়সের ছাপ ফুটে উঠেছে। চোখবোজা শীতল মুখখানার ওপর পাঁচ বছর আগে ফেলে আসা নিজের মায়ের মুখ একঝলক ভেসে উঠতে দেখল রোশনারা। গ্রাম ছেড়ে আসার পর কয়েকবার নানিবাড়িতে গেলেও মায়ের সঙ্গে আর দেখাই হয়নি। মুহূর্তের জন্য সেই মুখ! দম ছেড়ে প্রাণটা একেবারে মোচড় দিয়ে উঠল যেন। হুল ফুটিয়ে একটা পতঙ্গের উড়ে যাওয়া অনুভব করল রোশনারা।
তিন
দিনসাতেক এভাবে কাটানোর পর জানে আর সবুর সইল না রোশনারার। আমেনাকে ফোন করল সে। ফোন পেয়ে আমেনা তো আর ছাড়ে না। একটা একটা করে রোশনারাকে শোনায় যে, রোশনারার অবর্তমানে আলাউদ্দিনের নতুন বউটা তারই খাটে শুয়ে, তারই হাঁড়িকুড়িতে রেঁধেবেড়ে কীভাবে স্বামী আর ছেলেকে সোহাগ করছে। ভ্যানগাড়িতে চড়িয়ে সবার সামনে দিয়ে কীভাবে ফ্রিজ, ড্রেসিং টেবিল নিয়ে আসছে।
ফোন রাখার পর থেকেই আমেনার আকুল কণ্ঠের প্রতিটি উচ্চারণ মাথার মধ্যে পাগলাঘণ্টির মতো বাজতে লাগল রোশনারার। কিছুই ভাবতে পারছে না সে – ও আলস্নাহ, রাগের মাথায় এ কেমন ভুল সে করেছে! মারধর, অত্যাচার, অপমান যা-ই করুক, স্বামীই তো। দাঁত কামড়ে পড়ে থাকলে সংসারটা কী আর এভাবে বেহাত হয়? হায় হায়! ও খোদা, আমার ওপর এ তোমার কেমন বিচার?
শীতল আগুনের মতো ক্রোধে নিজের মধ্যে জমে যেতে থাকে রোশনারা। টানা বিলাপের ভেতর পরানের আলুথালু তাড়নার ওপর দিয়ে তিরতিরে ঠান্ডা একটা স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে আলগোছে নেমে যেতে টের পায় সে। খালার কাছে সব খুলে বলার পর দুদিনের মধ্যে আরো টের পায়, নির্ভরতার আশায় এ-বাড়িতে তো অতি সহজেই এসেছিল সে; কিন্তু এখন আর এখান থেকে সটকে পড়া তার পক্ষে মোটেও সহজ নয়। গ্রামে থাকতে পাখিশিকারির আঠামাখা ফাঁদ সে দেখেছে। আধার দেওয়া মনোরম সেই ফাঁদ! একবার ওতে পড়লে আর উপায় থাকে না। যত নড়বে, পেলব কোমল পালক ফাঁদের আঠায় ততই জড়াবে।
রোশনারা আন্দাজ করে, যে করেই হোক খালা এবার তাকে হাটে না তুলে ছাড়বেন না। নিশ্চিত বলবেন, মাইয়াটা আমার খুব লাজুক। একটু ম্যানেজ কইরা নিয়েন। শেষমেশ করলেনও তাই – কোমল কিন্তু কঠিন ভাষায় ইনিয়ে-বিনিয়ে, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, চটকদার পোশাকে মুড়ে ওকে তার পূর্ণ অনুগত করে তুললেন। এবার খাস মেহমানদের কাছে হাজির হতেই কড়কড়ে কাঁচা টাকা। দেখতে দেখতে কদিনের মধ্যেই রোশনারার জীবনটা একেবারে বদলে গেল!
বিয়ের পর যখন কেবল শরীর বুঝে উঠতে শুরু করেছিল রোশনারার, রক্তে-মাংসে-মনে তার কী যে আলোড়ন! কী আজব এক মাতামাতি! একবার হয়ে গেলে আতরের সৌরভের মতো দিনভর ওই গন্ধে ডুবে থাকত। কোনো কোনো দিন এমনও তো হয়েছে, ও চাইছে কিন্তু আলাউদ্দিনের একটুখানি অনাগ্রহ, তাতেই দিশেহারা হয়ে উঠত সে। সেই উন্মাদনাও একসময় ডাক্তার-বৈদ্য, ঝাড়-ফুঁক-তাবিজ-কবচ নিয়ে যন্ত্রের মতো চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে গেল। আর এখন এই নতুন নতুন শরীরের ভারে, তাপে, ঠাপে তার সেই ক্লান্তিও নেই। দলা দলা ঠান্ডা মাংসের মধ্যে নাক-মুখ ডুবিয়ে পুরুষের কী সুখ, ভেবে পায় না রোশনারা।
কখনো কখনো শরীরের নিয়মে মুহূর্তের জন্য হলেও জেগে যে ওঠে না তাও তো নয়; কিন্তু সৌরভহীন সেই তাড়না ফুলকির মতো জ্বলে উঠেই নিভে যায়। নিঃসাড়ায় মনের ওপর কোনো চাপ নেই; কিন্তু ওভাবে জ্বলে উঠে নিভে যাওয়ার চাপ সে আর নিতে পারে না। ধপ করে কামনার তাড়না ফুরিয়ে গেলে গাজুড়ে ঘিনঘিনানি শুরু হয় তার। মনে হয় সে বুঝি সমর্পিত হয়েছে আর তখন থেকেই রক্তের মধ্যে সারাক্ষণ একটা কিলবিলানি চলতে থাকে। এদিকে ওর এই মানসিক বিপর্যয়ের কিছুই আঁচ করে উঠতে পারেন না খালা।
এই কিলবিলানি নিয়ে দু-মাসের মধ্যেই ভেতরে ভেতরে একেবারে অধির হয়ে যায় রোশনারা। এর মধ্যে একদিন বিকেলে কালো বোরখা পরে বাসায় এলো একজন। ও দরজা খুলে দিতেই বড় বেডরুমটায় গিয়ে যেই না বোরখা খুলেছে, গুটিপোকার ভেতর থেকে প্রজাপতির মতো বেরিয়ে এলো চোখ-ধাঁধানো ছটফটে একটা মেয়ে। ছিপছিপে তার গড়ন, ঘন-কালো দীর্ঘ তার সিল্কি চুল আর ডালিম ফুলের মতো উজ্জ্বল চেহারা। বাটা মাছের চোখের চেয়েও ঢলঢলে তার চোখ।
ঠিক দেখছে তো? মনে মনে নিজেকে জিজ্ঞেস করে রোশনারা। মেয়েটাকে দেখে ভেতরটা একেবারে কেঁপে উঠল। কী জানি কেন খুব মায়া জাগতে লাগল। এই মায়া বড় দুঃসহ – ছড়ছড়িয়ে পুড়ে যাচ্ছে বুক, উথলে উঠছে মেজাজ। ঘোর লেগে যাচ্ছে কি! দুই হাত বাতাসে মেলে দিয়ে হলদে শর্ষে ফুলের বন্যায় ক্ষক্ষতের আল ধরে ছুটছে রোশনারা, চারদিকে উড়ছে হাজার হাজার প্রজাপতি। মেয়েটাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে, নাকি কষে একটা চড় দিতে? আহা রে! এইরহোম মাইয়া এই কামে আসে! ও মাইয়া, কই থাহোস তুই, কে-বা মা, কে-বা বাপ? কীসের অভাব তোর?
কিছুক্ষণের মধ্যেই এক ভদ্রলোক এলেন। গেট খুলে দিলেন খালা। মানুষটি দেখতে যেমনি সুপুরুষ, তেমনি তার গায়ের রং। সোফায় আয়েস করে বসে ব্যাগ খুলে টেবিলে সাজিয়ে রাখলেন হুইস্কির বোতল, বাদাম, চিপস। নিজের হাতে ঠান্ডা পানি আর গস্নাস নিয়ে এলেন খালা। মুখোমুখি বসে দুজনে মিলে খেতে খেতে মশগুল হয়ে গল্প করতে লাগলেন। তাদের আলাপের ভাব দেখে কোনো সন্দেহ থাকে না যে, তিনি খালার বিশেষ কেউ। মেয়েটিও লোকটির গা-ঘেঁষে বসে বাদাম চিবাতে চিবাতে আপনমনে মোবাইল টিপে ফেসবুক চষে বেড়াচ্ছে। হাতের ছোট্ট পর্দায় এমনই নিমগ্ন সে,
কোথায় এসেছে, কেন এসেছে কিছুতেই যেন কিছু যায় আসে না তার।
বেসন দিয়ে ফুলকপি ভেজে বাটি ভরে নিয়ে আসে রোশনারা। এই আসা-যাওয়ার মাঝে একটুখানি ওকে দেখলেন ভদ্রলোক। কিছুক্ষণ পর ওদের নেশা চড়ে গেলে মেয়েটা হঠাৎ কোথায় যে উড়ে গেল! এ-ঘর ও-ঘর তালাশ করতে করতে রোশনারা শুনল খালা তাকে আদুরে গলায় বেডরুমের দিকে ডাকছেন।
বাতি নিভিয়ে কোমল আলো জ্বালার দরকার হলো না। ফিনফিনে পর্দা পেরিয়ে রাস্তার আলো ঘর ভরে রেখেছে। সেই শর্ষে ক্ষিত, হাজার প্রজাপতি আর হঠাৎ হাওয়া হয়ে যাওয়া মেয়েটার মুখ কিন্তু মাথা থেকে সরছে না রোশনারার। শাড়ি ছেড়ে পেটিকোট পরা অবস্থায় ওয়্যারড্রোবের কোনায় গিয়ে দাঁড়ায় সে। বস্নাউজের হুক ছোটাতে ছোটাতে দেখে, মাত্র হাতদুয়েক দূরে খাটে বসা ভদ্রলোক প্যান্টের ভেতর থেকে বাঁ-পাখানা খুলে সিথানে রেখেছেন আর তাকে ইশারায় কাছে ডাকছেন। পা হারিয়ে প্যান্টের একটা দিক বিছানায় লেপ্টে আছে। এ-অবস্থায় বস্নাউজ খুলবে কী, বুকের মধ্যে পাঁজরভাঙা গুঁতো খেয়ে অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম রোশনারার।
নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তিরতিরিয়ে কাঁপতে লাগল সে। প্রাণভরে যে একবার দম নেবে, সে-সুযোগও পেল না। এক ঝটকায় অমন সুঠাম মানুষটার বগলদাবা হয়ে কুঁকড়ে যেতে থাকল। যতই কুঁকড়ে যাচ্ছে, আন্তা শুকিয়ে আসছে, ততই সমস্ত ভার নিয়ে বিষমভাবে চেপে বসছে দেহটা। কী করছে সে, মেরে ফেলবে নাকি? পাটার ওপর মরিচ পেষার মতো পিষছে! গোখরো সাপের ফণা তোলা বিশাল শিশ্ন ফুঁসফুঁসিয়ে শুকনো খোঁদলে অনবনত ছোবলে যাচ্ছে।
চার
সিদ্ধান্ত নিয়েই বেরিয়েছে রোশনারা। বড় রাস্তায় না গিয়ে উঁচু-নিচু দালানকোঠার ফাঁকে সরু সরু গলিপথে ফালি ফালি আকাশের নিচে এলোমেলো পায়ে হাঁটতে থাকে সে। উদ্দেশ্যহীন এই হাঁটার কোনো কূলকিনারা নেই। ও আলস্নাহ, আবার এ কী করল মেয়েটা! বুকের মধ্যে দপদপাচ্ছে তার। অন্তরে অজানা একটা কিছু বিষমাখা ছুরির মতো ঘাই মেরে বিঁধছে। ঘর ছেড়েছিল সে খালার ঠিকানাটা হাতে নিয়ে, স্বামী-সংসার হারানোর ক্ষোভে, দুঃখে, মনে মরণ কামড়মারা অভিমানে। সকল অসহায়তার মধ্যে, নিরুপায় হয়ে ফাঁদে পড়ে পাখা ঝাপটাতে ঝাপটাতে পরপুরুষের কাছে নিজেকে খুলেও দিয়েছে সে। কিন্তু এখন কোনদিকে যাবে? কোন পথের রিকশা নেবে? কোন গাড়িতেই বা চড়বে? দাঁড়াবেই-বা কোথায়? চারদিকে অজস্র উৎসুক চোখ, উতরোল জনস্রোতের ভিড়ে পদে পদে লাখো-কোটি ফাঁদ!
নিজের কাছে টাকা-পয়সা থাকলেও সারাদিন না খাওয়া মেয়েটা কী করবে কিছুরই কোনো উদ্দেশ পেলো না। হাঁটতে থাকল। এই হাঁটা কি তবে নতুন কোনো পথের আবিষ্কার না কি পুরনো পথেরই নতুন আবর্তন? মনের মধ্যে কিছুর একটা ইশারায় মন্থর ওর এই হাঁটা চলে বিরাম নিয়ে নিয়ে অবিরাম একা – বুঝি বা অনমেত্মর পিছু পিছু।
নিজের ভরকে নিজেই বহন করে হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা পার হলে যখন আর এক কদমও এগোতে পারছে না, পুরনো একটা দোতলা বাড়ির গ্যারেজের সামনে বোগেনভেলিয়ার ঝাড়ের আড়ালে আধখানা টিনশেডের তলায় উঁচু বেদিটার ওপর ব্যাগটা রাখে সে। একটা উদাসীন অবসন্নতা নিয়ে গুটিসুটি মেরে বিপন্ন হয়ে বসে চোখের জলে ভিজতে থাকে।
রাত তখন প্রায় নটা। বাড়ির গেটে এসে হেডলাইটের আলোয় একটা মেয়েকে ওখানে ওভাবে বসে থাকতে দেখে গাড়ি থেকে নেমে এলেন মধ্যবয়সী মহিলা। ডেকে গ্যারেজের মধ্যে নিয়ে গেলেন ওকে। নানা রকম জেরার পর যা শুনলেন তা কি বিশ^াস করবেন, না কি করবেন না, ভেবে পেলেন না। পথে-ঘাটে আঁতকে ওঠার মতো এমন তো কতই শোনা যায়! কিন্তু মেয়েটা প্রায় নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে দেখে বিশ^াস করতে ইচ্ছা হলো তাঁর।
স্বামী ভদ্রলোক একটু দূরে ডেকে নিয়ে খুব করে বোঝালেন, এভাবে একটা অচেনা মেয়েকে হুট করে বাসায় তোলা ঠিক না। তিনি শুনলেন না, ওকে বাসায় নিয়ে এলেন। স্বামী বেচারা তখনো গজগজ করে চলেছেন।
একমুঠো টাকা হাতে দিয়ে মেয়েটা বলে, এইটা আপনের কাছে রাখেন আপা আর আমারে এট্টু আশ্রয় দেন। আপনের ঘরের সব কাম আমি করমু। আমি সব পারি, আমারে খেদাইয়েন না।
নিঃসমন্তান মানুষ। ছোটদের সান্নিধ্যে আনন্দের সঙ্গে জীবনটা পার করবেন স্থির করে গুরুত্বপূর্ণ পদের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে একটা স্কুল খুলেছেন। দিন-রাত ওই নিয়েই তো আছেন। তার পুরোটা জগৎ জুড়ে এখন শিশু আর শিশু। শিশুর নিরাপত্তা। শিশুর অধিকার। শিশুর মর্যাদাবোধ। মেয়েটার কথা শুনে তার চোখ ভিজে এলো।
কিছুটা লেখাপড়া জানে বলেই ওকে বাড়িতে না রেখে দুদিন পর তার স্কুলের পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজে লাগিয়ে দিলেন।
পাঁচ
প্রায় ছ-মাস হয়েছে রোশনারা চাকরি করছে এখানে। আজ ছিল পুতুলের বিয়ে অনুষ্ঠান। এরকম অনুষ্ঠান এর আগে আর দেখেনি সে। পুতুলের বিয়ে তো ছোটদের একটা খেলা, তা নিয়ে আবার এমনও হতে পারে! পুরো স্কুলে সাজগোজ, হই-হুলেস্নাড়, গান-বাজনা, খাওয়া-দাওয়া, যেন একটা আসল বিয়েবাড়ি।
সবাই চলে যাওয়ার পর ঝেড়েমুছে সোজা হতে বিকেল হয়ে গেল রোশনারার। হাত-মুখ ধুয়ে যখন বেরিয়ে যাবে জোর হাওয়া দিয়ে নামল ঝমঝমে বৃষ্টি। আকাশ ফুটো হয়ে ঝরে পড়া এই বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণই নেই। ওপরের সবগুলো ঘরের দরজা-জানালা আটকে নিচে এসে মালেক দেখে রোশনারা তার কাজকাম গুছিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে মগ্ন হয়ে কী যেন ভাবছে। আচমকা ওকে লক্ষ করে একেবারে আঁতকে উঠল মেয়েটা।
বেউলা বিবির মতো গালে হাত দিয়া অত কী ভাবো, রোশন? সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়েই বলে মালেক।
কপালে লেখা দুঃখের কথা ভাবি মালেকভাই। যদি পারেন ঝামা ইট দিয়া কপালখান এট্টু ঘইষা দিয়েন।
মালেক জানে, ওর কথা বলার ধরন এমনই। সে হেসে বলে, তা দিমুনে, যেই বৃষ্টি নামছে, যাইতে তো আর পারবা না এখন, আসো মুড়ি ভাইজা খাই।
এই ঝুম বৃষ্টিতে মরিচ-পেঁয়াজ দিয়ে মুড়ি ভাজার প্রস্তাবটা মন্দ নয়, তবু রোশনারা একটু খোঁচা দিয়ে বলে, মুড়িভাজা কেন মালেকভাই, এত্তো মণ্ডা-মিঠাইয়ের ছড়াছড়ি গেল আইজ, পারুল আপা আপনের জন্য কিছুই রাখে নাই?
তুমিও কী যে পাইছো এক পারুল, পারুল। আসো, আসো, পেঁইজ-মরিচ কাইটা দাও।
একফোঁটা জায়গায় একটা চুলা নিয়েই মালেকের পাকঘর। দুপুরবেলা যদিও সে খায় সবার সঙ্গে স্কুলে। বাকি দুবেলা তো এখানে রান্না করেই খেতে হয়। রোশনারা পেঁয়াজ-মরিচ কাটতে কাটতে বলে, কই মালেকভাই, দিলেন না তো আমার কপালডায় ঝামা ঘইষা?
মালেক তার চৌকিরতলা থেকে গুঁড়া দুধের কৌটায় রাখা মুড়ি বের করে এনে একটা বাটিতে ঢালতে ঢালতে বলে, সত্যিই দিমু, রোশন?
রোশনারা বোধহয় মালেকের ইঙ্গিতটা আন্দাজ করে উঠতে পারেনি। আবার মালেকও রোশনারার কথাটা যেভাবে অনুবাদ করে নিয়েছে তাতে এই ঘোর বৃষ্টির আসন্ন সন্ধ্যা কার অনুকূলে গেল কে জানে! গরম তেলে পেঁয়াজ-মরিচ ঢেলে দিয়ে কাঠের হাতায় মাত্র নাড়া দিয়েছে রোশনারা, পেছন থেকে মালেক এসে জাপটে ধরে ওকে।
ও আলস্নাহ, এইডা কী করেন আপনে, রোশনারা মালেকের শক্ত বেষ্টনীর মধ্যে মোচড়াতে মোচড়াতে বলে। চুলোর ওপর গরম তেলে ভাজা হয়ে যাচ্ছে সব। হুঁশ হারিয়ে ফেলেছে মালেক। রক্ত খাওয়া বাঘের মতো দীর্ঘ অনাহারি সে। বস্নাউজ-ব্রা টেনে বগলের দিকে তুলে দিয়ে রোশনারার মাই দুটো বের করে এনেছে। ঘাড়ের কাছে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে কানের কাছে ফিসফিসাচ্ছে মালেক, এইটা কেন বোঝ না রোশন, আমি যে তোমারে ভালোবাসি।
মুখে না না বলতে থাকলেও রোশনারার শরীর একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মালেকের শক্ত বাহুতে আলগা হয়ে যায়। চোখের পাতা মুদে আসে তার। ভেজা গলায় বলে, কড়াইটা পুইড়া গেল, মালেকভাই, চুলাডা নিভায়া দেন।
ছয়
ওদের এই সম্পর্কের মাসদুয়েকের মাথায় রোশনারার পৃথিবী একেবারে ঘোলা হয়ে আসে। ঘুমের মধ্যে সে হাজার প্রজাপতির ডানায় ভর দিয়ে নিজেকে কোথায় যেন উড়ে যেতে দেখে। তার গা গুলায়, বমি আসে। খাওয়া-দাওয়া একদম ভালোলাগে না আর। মালেক ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ব্যাপারটা খোলাসা হলেও আকাশ ভেঙে পড়ে তার মাথায়। এদিকে মেয়েটা মালেকের ওই ভাঙা আকাশের নিচে পরির মতো নেচে ওঠে, ফড়িংয়ের মতো উড়তে থাকে, সাগরের ফেনায় বুঝি ভাসতে লাগে সে! বলে, কত চেষ্টা করছি, কত ডাক্তার দেখাইছি, কত মানত দিছি, কী করি নাই! এইটা আলস্নায় দিছে। এ আলস্নার দান।
মালেক মুঠিতে চুল খামচে ধরে মাথা নিচু করে বসে থেকে বলে, যা হওয়ার হইছে, চলো, অ্যাবরশন করাই। জানাজানি হইলে বড় আপার কাছে, বাড়িতে বউয়ের কাছে, মা-বাবার কাছে, ছেলের কাছে কী জবাব দিমু আমি?
ওর মুখে এ-কথা শুনে কলজে লাফিয়ে উঠে পাঁজরের হাড় গুঁড়িয়ে দিতে চায় রোশনারার। কী বলে মানুষটা! এর চেয়ে বরং তাকে নিঃশব্দে মেরে ফেলুক মালেক।
পাথরের মতো কঠিন হয়ে উঠল সে, আবার কাদার মতো নরম হয়ে বলল, কারো কাছে কোনো জবাব দিতে লাগবে না আপনের। বিয়া করেন আমারে। বাচ্চাটা জন্মাইলে পর না হয় তালাক দিয়েন। বাচ্চাটা তার একটা পরিচয় তো পাইবে। আপনের সংসারে কাঁটা হমু না আমি। এই দয়াটুক করেন।
কিন্তু তার অবস্থানে অনড় হয়ে থাকল মালেক। ওদের মধ্যে গোপন লড়াইটা বেশিদূর এগোল না। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো এসে বড় আপার সাহায্য চাইল রোশনারা। ও কল্পনাও করতে পারেনি, রাগী হলেও অমন ধীরস্থির তাদের বড় আপা এভাবে জ্বলে উঠতে পারেন। যতখানি জ্বলে উঠেছেন, মুখ দেখে মনে হলো ভেঙে পড়েছেন তার চেয়েও বেশি। এর একটি কথাও যেন বাইরে না যায়, কঠোর হুকুম দিয়ে পরদিন দুজনকে নিয়ে বসবেন জানালেন।
আপার রুমে ঢুকেই নিঃশব্দে কেঁদে চলল রোশনারা। মাথা নিচু করে পাথরের মূর্তির মতো একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে মালেক।
কী যে বলবেন বড় আপা আগা-মাথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তবু অন্ধকার হাতড়াতে হাতড়াতে বললেন, তোমাদের দুজনকে কতটা স করেছি আর তোমরা কি না সেই বিশ্বাসের ওপর আগুন ঢেলে দিলে! যদিও এটা একান্তই তোমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার তবু প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে, প্রতিষ্ঠানের শিশুদের স্বার্থে আমাকে ভাবতে হচ্ছে। শোনো রোশনারা, তোমার কথা শুনে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে বাসায় উঠিয়েছিলাম, সেদিন তুমি কাঁদতে কাঁদতে আমাকে আসলে মিথ্যা বলেছিলে। আমার সামনে অভিনয় করেছিলে। আজো তেমনটাই শুরু করেছ। ব্যাপারটা জানাজানি হলে একজন গার্জিয়ানও তার শিশুকে আর এখানে রাখবেন মনে কর?
উত্তেজনা দমাতে পারছিলেন না বড় আপা, চেয়ারে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। মনে হলো নিজেকে শক্ত করার জন্যই এই নীরবতাটুকুর সাহায্য নিলেন তিনি। বললেন, অ্যাকাউন্টসে বলে দিচ্ছি, তোমাদের পাওনার বাইরে অতিরিক্ত দু-মাসের বেতন নিয়ে আজই চলে যাও।
নাকের পানি, চোখের পানিতে একাকার রোশনারা। আপার কথা শেষ হতেই আঁচল দিয়ে মুখটা মুছে দুজনার দিকে তীব্র এক চাহনি ছুড়ে দেয় সে। ভেজানো দরজা খুলে হনহনিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে – অনেক নিছি, আর কারো দয়া লাগবে না।