সবেমাত্র বিছানা ছেড়ে উঠেছে আমন। রাতে ঘুম হয়নি। গতরাতে ঘুমদূত আমনের চোখে মরফিন দিতে ব্যর্থ। তার কারণ প্রতিরাতে একলাইন হলেও লিখে আমন। একটা রাত তার জীবন থেকে অপচয় হলো। সে রাতে তার কলম আঁচড় কাটতে পারেনি। বিরক্তিকর! নিজে নিজেই একথা বলে ঘর থেকে বের হতেই থমকে দাঁড়ায়। ভালভাবে তাকিয়ে দেখে না, তার ভুল হচ্ছে না, যা দেখছে তা সত্যি! এ নির্জন দ্বীপে একমাত্র মানব সে-ই। চারদিকে ধূ-ধূ পানির চাদর। দূরে মাটির বাঁধ দিয়ে নদীকে পৃথক করা হয়েছে। স্থল বলতে এ বাঁধের মাটি। এ মাটির ওপর সারি সারি সবুজ নারকেল গাছ । গাছের ফাঁকে ফাঁকে সবজির ক্ষেত। এটা আমনের তৈরি। এতে দুটো কাজ হয়েছে। একদিকে নাঙ্গা দ্বীপের মাঝে কিছুটা সবুজের আলপনা। অন্যদিকে আমনের নিত্যদিনের খাবারের চাহিদা পুরণ হচ্ছে।
এ মানবীর আগমন কোথা থেকে ! আমনকে ভাবিয়ে তুললেও অবাক করেনি। পৃথিবীতে অনেক ঘটনাই ঘটে। স্রষ্টার কাজ নতুন কিছুর মাধ্যমে পৃথিবীকে বৈচিত্রমণ্ডিত করে তোলা। এমনই কোনো এক স্নিগ্ধ শরতের ভোরে জনমানবহীন এ নির্জন দ্বীপে আমনের আগমন ঘটেছিল। সেটা ছিল সত্তর দশকের ঘটনা। তখন এ উত্তাল মাতামুহুরী ছিল দুর্দান্ত স্রোতস্বিনী। তার মূর্তি ছিল ভয়ংকর। ওই দূরে নদীর ওপারে উপকূল ছিল আরো বিশ মাইল ব্যবধান। আজ উপকূলীর গ্রামের গাছগুলো এখান থেকে একেবারেই ঝাপসা । মনে হয় ওখানে কোন গ্রাম আছে।
সেই মহাসমুদ্রের মতো নদীতে বাবার সাথে মাছ ধরতে এসেছিল আমন। উপকুলবর্তী গাঁয়ের মানুষগুলোর জন্য মাতামুহুরী ছিল এক দিকে যেমন আর্শীবাদ তেমনি অপরদিকে অভিশাপ। তাদের জীবন জীবিকার প্রধান উৎস এ নদী। আবার কখনো কখনো ভয়ঙ্কর নদী তার প্রলয়ঙ্করী তাণ্ডবে মুহূর্তে সবকিছু কেড়ে নিয়ে যায়। উপকূলীয় মানুষগুলো মাতামুহুরীর এই খামখেয়ালীপনার সাথে অভ্যস্ত। মাঝে মাঝেই কোনো না কোনো বাড়ীতে কান্নার রোল। সে বাড়ির জেলে মাছ ধরতে গিয়ে ফিরে আসেনি। জেলে বধূ নিরবে নিভৃতে চোখের জল ফেলে পথ চেয়ে কালক্ষেপণ করে। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষায় প্রহর গুণতে গুণতে গৃহবধূর নিশ্বাস চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
উপকূলীয় কোনো এক নিভৃত গাঁয়ে আমনের জন্ম। শিশু বয়স থেকেই ছেলে বাচ্চাদের মাছ শিকারের কলাকৌশলগুলো ধীরে ধীরে রপ্ত করতে হয়। অনেকবার মাঝনদীতে মৎস্য শিকারে বাবার সাথে এসেছে আমন। সেদিন ছিল বর্ষার শেষ দিন। আকাশে মেটে জোছনা। প্রচুর মাছ ধরা পড়েছে আমনের জালে। তখন দশম বছরের বালক হলেও আমন মাছ শিকারে বেশ পোক্ত হয়ে উঠেছিল। নৌকাভর্তি মাছ দেখে পিতা-পুত্র ভীষণ খুশি। কিন্তু প্রলয়ংকরী মাতামুহুরী ওদের খুশির উপর মুহুর্তে অভিশাপের সামিয়ানা টেনে দেয়। চারদিক অন্ধকার হয়ে সবকিছু তছনছ হয়ে গেল। জ্ঞান ফিরে আমন নিজেকে আবিষ্কার করে এই দ্বীপের এ জায়গাটিতেই। যেখানে আগন্তক নারীটি পড়ে ঘুমোচ্ছে।
ঘুমন্ত মানবের নিষ্পাপ মুখের দিকে আমনের চোখ তাকিয়ে আছে পলকহীন। শ্যামা বরণ । চোখ দুটো ঘুমে ডোবা । বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে চোখের ডাগর গড়ন। স্নিগ্ধ দুটো ঠোঁট। কালো তিল ঠোঁটের নীচে স্পষ্ট। আরো মোহময়ী করে তুলেছে।
ঘরের কোণে নারকেল গাছটিতে বেশ কিছু পাখির আবাস। আমনের প্রতিবেশী ওরা। আজ আশ্বিনের প্রথম ভোর ! দোয়েলগুলো জুটি বেঁধে খুনসুটি খেলছে। ওদের কিঁচির-মিচির শব্দতরঙ্গ আমনের সৌন্দর্য দর্শনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। আমনের ভেতরে তখন মায়াবী টান। মেয়েটিকে ধরে পাজাঁকোলা করে ঘরের ভেতর নিয়ে শুইয়ে দেয় বিছানায় । শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন। হয়তো কোনো পাষণ্ড মেয়েটিকে অত্যাচার করেছে। ক্লান্ত নিথর শরীর ! পাতলা চাঁদর জড়িয়ে দেয় ওর গায়ে। মনে মনে বলে, ঘুমোও মেয়ে, স্বস্তিতে! মেয়েটির ঘুমন্ত শান্ত মুখ দেখে। ভেতরে ভালোলাগার স্নিগ্ধ অনুভুতি। মনটা প্রশান্তিতে ভরা।
প্রকৃতিতে ভোরের আনাগোনা, তবে এখনো আলো ফোটেনি। আলোআধাঁরিতে ছাওয়া পাখির কিঁচির-মিচির। আকাশের অন্ধকার বিলুপ্ত হচ্ছে ধীরগতিতে। আমন নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সবজি বাগানে গিয়ে রান্নার জন্য লাকড়ি সংগ্রহে ব্যস্ত । অন্যদিন লতা-পাতা দিয়ে সকালের নাস্তা সেরে নেয় আমন। কিন্তু আজ তার ঘরে অতিথি। সে হয়তো এসব খায় না।
কিছু সবজি ও লাকড়ি নিয়ে নৌকা ছেড়ে দেয় ঘরে ফেরার উদ্দেশ্যে। সূর্য উঠে গেছে। প্রথম আশ্বিনের ঝলমলে রোদ চারদিকে। প্রকৃতি যেন উৎফুল্ল । ঠিক যেমনটি আনন্দ আজ আমনের মনে।
মেয়েটি ঘুম থেকে জেগেছে সবে। শান্ত স্বাভাবিক চেহারা! হাতমুখ ধূয়েছে। ঘরটার দিকে তাকিয়ে দেখে নেয় বার কয়েক। ঘর বলতে কাঁদা মাটির ওপর বেশ উঁচু করে মাচানের উপর ছোট্ট কুঁড়ে ঘর। ঘরের ভেতর আসবাব বলতে একপাশে বিছানা পাতা। বিছানার ওপর তেলচিটচিটে একটা বালিশ আর কম্বল। রান্নার জন্য দুটো হাঁড়ি আর কয়েকটা ঘটি-বাটি। এক পাশে মাটি দিয়ে খানিকটা জায়গা বিঘতখানেক উঁচু। এ মাটির ওপর তিনপাশে তিনটি মাটির ঝিক বসিয়ে তৈরি করা হয়েছে উনুন।
আমন ঘরে প্রবেশ করে আরো বেশি খুশি তার ঘরে যেন কোন শিল্পীর ছোঁয়া পড়েছে । সবকিছু ঝকঝকে তকতকে। মেয়েটি সবকিছু পরিষ্কার করে রেখেছে। ঘরের দক্ষিণ পাশে ছোট জানালা। জালানা দিয়ে পানির দ্বীপ দেখছে মেয়েটি।
বাহ্ ! চমৎকার ! আমনের কথায় মেয়েটির চোখ দুটো জানালা থেকে সরানোর পরপরই বক্রভাবে পড়ে আমনের দিকে। আমন জিজ্ঞেস করে, তুমি কে ? কীভাবে এখানে এলে ?
মেয়েটি নিরত্তর। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমনের দিকে।
আমন ভাবনার জালে আছন্ন, হয়তো বলতে চাচ্ছে না তার জীবনের কথা। ওর চাউনি বলে দিচ্ছে, কিছু বলতে চায় না , কিছু মনেও রাখতে চায় না। আমন ফের নামটা জানতে চায়, আমি তোমার সস্পর্কে কিছুই জানতে চাই না। কিন্তু কোন নামে ডাকব তোমাকে ? এবারও নিরত্তর।
আবারও স্নিগ্ধ কণ্ঠে পুনরাবৃত্তি, বল না গো অচেনা মানবী, কী নাম দেব?
তবুও নিরুত্তর মেয়েটি। শুধু চোখ দুটো অসীম গহীন। কালো দুটো চোখের গভীর চাহনি কি বলতে চাইছে, মনে মনে ভাবে আমন।
বেশ খানিকটা সময় পার হয়ে যায়। নির্জন দ্বীপের মাঝে নির্বাক দুটো মানব মানবী। পাখির কিঁচির মিচিরে যেমন এ দ্বীপের নিরবতায় কিছুটা ব্যাঘাত ঘটায় তেমনি আমন এ মুহুর্তের নিরবতা ভেঙে দিয়ে পুনরায় জানতে চায়, কিছু একটা বল ! তোমার যা ইচ্ছে করে, যেমন ইচ্ছে !
না, মেয়েটির মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই।
আমনের মনে প্রশ্ন, তাহলে মেয়েটি বোবা ! উত্তরটাও নিজেই দিয়ে দেয়, হয়তো তাই। এই মেয়ে শোন ! প্রত্যেক মানুষকে ডাকবার জন্য একটা নাম থাকে। আমি তোমাকে একটা নাম দিলাম, ‘আশ্বিন’। যেহেতু আজ আশ্বিনের প্রথম দিন ! এই নির্জন দ্বীপে দ্বিতীয় মানবের পদার্পণ, নিজের মনে যুক্তিটা দাঁড় করায় আমন ।
আশ্বিন ততোক্ষনে উনুনের উপর ভাতের হাঁড়ি বসিয়ে দিয়েছে। সবজি কেটে নিজে নিজেই রান্না শুরু করেছে। আমন দেখছে, একজন শিশুর কাছে যেমন পৃথিবীর সবকিছু নতুন লাগে। তেমনি বিস্ময়ের আলোড়ন ওর মনে। আশ্বিন এই দ্বীপে যেন নতুন কোনও শিশু।
নির্জন জলরাশির সঙ্গে আমনের বসবাস দীর্ঘদিন। মনের অব্যক্ত কথাগুলো কলমের ছোঁয়ায় কাগজের পাতায় এঁকে রাখে। আর ওই দূর আকাশের অসীম শূন্যতায় উড়িয়ে দেয় মনের আলাপন। লাবন্যময় বৈকালী বৈঠকে খুনসুটি করে উড়ন্ত ধবল বকের সঙ্গে। নারকেল গাছের বাসিন্দা পাখিদের সাথে খেলা করে কাটিয়ে দিয়েছে অনেকগুলো বছর। আজ তার পাশেই আশ্বিন। অদ্ভুত রহস্যের ঘেরা। কেন যেন বার বার তার ইচ্ছেকে নাড়া দিচ্ছে কেউ রহস্যের জট উন্মোচন করতে। আমন মনকে সংযত রাখবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। কিছুতেই বারণ মানতে চাইছে না মন। যতই চেষ্টা করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে, ততই মনটা বেঁয়াড়া হয়ে ওঠে আশ্বিনকে জানবার জন্য। কিন্তু কিভাবে জানবে ! আশ্বিন যে বোবা ! সে কারণেই কী আমনের জানার আগ্রহ প্রবল! হাওয়া যেমন নিষিদ্ধ গন্ধমের আকর্ষণে নিজেকে সংযত রাখতে ব্যর্থ হয়েছে, আমনের ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে।
পড়ন্ত বিকেল ! প্রকৃতির সর্বত্র সিগ্ধ সুন্দর! পানির স্তর কমে এসেছে। তাই তো বকের দল লম্বা ঠোঁট মেলে দিয়ে মাছ শিকারে ব্যস্ত। অল্প পানিতে মাছদের লাফালাফিটা বেশি লক্ষ্য করা যায়, ঘাটে বাঁধা নৌকায় বসে আছে আমন। তার সকল সঙ্গীরা সঙ্গে আছে। শুধু আশ্বিনের উপস্থিতির অভাব বোধ করছে সে। আশ্বিন ! আশ্বিন ! বাইরে এসো।
আশ্বিন বাধ্য মেয়ের মতো আমনের পাশে এসে বসে। কোন জড়তা নেই। দীর্ঘদিনের পরিচিত যেন ওরা। অথচ আজ ভোরের অতিথি আশ্বিন। পানিতে হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে বেশ উৎফুল্ল। আলতা পড়া রঙিন পা দুটো পানিতে যেন রঙিন মাছ, ছোট ছোট ঢেউ তুলছে জলে। আমন প্রশ্ন করে, আশ্বিন, তোমার ভালো লাগছে ?
প্রশ্নটা শুনতে পেরেছে কি-না তা বুঝবার উপায় নেই। আশ্বিন আপনমনে যা করছিল তা নিয়েই ব্যস্ত।
আমন হাত দিয়ে আশ্বিনের হাতটা ধরতে গিয়েও থেমে যায়। হাত ধরাটা হয়তো আশ্বিন পছন্দ নাও করতে পারে। আমন চোখ দুটো সরাসরি শান্ত আসমানের যৌবনতটে নিক্ষেপ করে। আকাশের নীলে শরতের সদ্য ফোটা ফুলটি এখন নক্ষত্রের মতো। নাকি আশ্বিনের হাস্যোজ্জল মুখের প্রতিচ্ছবি। দেখতে দেখতে বিদায় ঘন্টা বেজে ওঠে সূর্যের। সন্ধ্যা দেবীর আয়োজনে আবছা শামিয়ানা, এক সময় ঢেকে যায় সমস্ত প্রকৃতি। আশ্বিন ঘরে গিয়ে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালিয়ে দেয়। ছোট্ট কুঁড়ে ঘরটি মুহুর্তে জ্বলে উঠে তারকারাশির মতো।
আমন হাতমুখ ধুয়ে ঘরের কোণে ছোট্ট পাটির উপর প্রার্থনায় বসে। কোনো ধর্মই আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেনি সে, ধর্ম বলতে বুঝে ভেতরের জ্ঞান, মুল্যবোধ আর নৈতিকতা। সে কারণেই সে প্রার্থনা করে সুন্দর প্রকৃতি যেন সব সময়ের জন্য অক্ষত থাকে। কিন্তু আজ তার প্রার্থনায় যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা । আশ্বিনের মঙ্গল কামনা করে প্রার্থনার সমাপ্তি টেনে দেয় আমন। পেছন ফিরতেই চোখে পড়ে, আশ্বিনও দুহাত তুলে প্রার্থনা করছে। আমন ঠোঁট চেপে হাসছে।
ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায়। ভাবে তার সকল সঙ্গী নির্বাক ! শুধু হৃদয়ের গভীর অনুভূতি দিয়ে সব কিছু বুঝে নিতে হয়। আশ্বিন; বাদ যায়নি ! তাই তো স্রষ্টা বোবা আশ্বিনকে তার কাছে পাঠিয়েছে। যাতে নিয়মের কোন হেরফের না হয়। নির্জন দ্বীপের নির্জনতাকে রক্ষা করবার জন্য বুঝি এমনটা করা হয়েছে। আমনের অস্থির মনটা শান্ত হয়ে আসে।
আমন খাতা কলম নিয়ে লিখতে বসে। আশ্বিনের উদ্দেশ্যে বলে, তুমি বিছানায় শুয়ে পড়। আমি নিচে ঘুমোব।
আশ্বিন যেখানে বসে ছিল সেখানেই বসে আছে। আমন লিখতে বসেছে। কলমের নীপে শুধু আশ্বিনের মুখ। কলমে শুধু আশ্বিনের মুখ। খাতার মধ্যে কলমের ওলটপালট আঁচড়। সেখানে নতুন প্রাতিচ্ছবি। তবে কি আমনের মস্তিস্ক অনুর্বর হয়ে পড়েছে ! বিরক্ত হয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। টানা পায়চারি । বিক্ষিপ্ত মন। কিছুক্ষণ পর ঘরে ঢুকে। আশ্বিন শুয়ে পড়েছে। আমন আর কালক্ষেপন না করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে।
কতগুলো দিন পার হয়ে গেছে এই দুই মানবের। আজ বিদায় নিচ্ছে শীত। শীত রাণীর বিদায় হলেও কাঁপন এখনো আছে। ভোর দূতের বার্তা আমনের চোখে পড়তেই ঘুমদূত পালিয়ে যায় আর সে চোখ মেলে তাকায়। তার গায়ে শীতল দুটো হাত। পাশ ফিরে হতবাক ! আশ্বিন ! এখানে এভাবে ! জড়িয়ে রেখেছে তাকে। হাত দুটো আলতো করে নামিয়ে দেয়। ঘুমন্ত আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে আছে নির্ণিমেষে।
আমনের নীল যৌবনতট অন্ধকারে আচ্ছাদিত। এ অজ্ঞাত জগত সম্পর্কে আমন কিছুই জানে না । হয়তো সেকারণে আশ্বিনের উত্তাল ঢেউয়ের শব্দ সে শুনতে পায়নি।
বাকহীন নারী মুখে কিছু বলতে না পারলেও তার তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের হাহাকার, শুনতে পায় কি সে ? কিন্তু নির্বোধ পুরুষও বাকরুদ্ধ ! আশ্বিনের দগ্ধ মনটা এখনো ভাঙতে পারেনি, আমনের রুক্ষ দ্বার। কতগুলো রাত পার করছে আগুনের যন্ত্রণায়। ফুটন্ত ফুলের উত্তপ্ত দংশনে দগ্ধ হয়েছে প্রতিটি রাত !
দিনের অগমনে ফুটন্ত ফুলের পাঁপড়িগুলো স্বাভাবিক নিয়মে দল মেলে। আশ্বিন কাজ কর্মে ব্যস্ত। নৌকা নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছে আমন। আজ হাটবার। সপ্তাহের এই দিনে কিছু মাছ বিক্রি করে প্রয়োজনীয় জিনিস কেনে সে । মাতামুহুরী পার হয়ে বহুদূরে বটতলায় হাট বসে। ঘাটে নৌকা বেঁধে হাঁটে যায় আমন। ঘুরে ঘুরে বেচা-কেনা শেষ করে একপাশে গানের আসরে গিয়ে বসে। গানের আসর না বলে জনসংযোগ বলা যায়। লোকজন ঘিরে ধরেছে। কিছুক্ষণ শোনবার পর আর ভালো লাগছে না। মনটা উদাসীন। এর কারণ সম্পর্কে সে অজ্ঞ। কি যেন তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। নৌকা ছেড়ে দেয়।
যখন ঘরে ফিরেছে তখন গভীর রাত ! আজ প্রথম বসন্ত। ঘরের দরজা খোলা। আশ্বিন বিছানায় ঘুমে। বুকের বসন সরে গেছে। জানালার ফাক দিয়ে জোছনার আলো পড়েছে সদ্য প্রস্ফুটিত দুটো ফুলে। আমনের বুকের ভেতরে হাসফাঁস. দম বন্ধ হয়ে আসছে। আাশ্বন কি জেগে আছে? নাকি না বোঝার ভান করে পড়ে আছে কে জানে! আমন ধীরে ধীরে কাছে অগ্রসর হচ্ছে। একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে কাপড়টা টেনে বুকের উপর ছড়িয়ে দিতেই আশ্বিন খপ করে ধরে হাত দুটো । নিজের গালের সাথে ছোঁয়ায় হাত।
আমন হাতটা ছাড়িয়ে আনবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। নির্জন দ্বীপের নিরবতা ভেদ করা কন্ঠে যেন আর্তনাদ, আমি আর পারছি না আমন। আর কষ্ট দিও না।
আমন দুবাহু বেষ্টন করে আশ্বিনকে অলিঙ্গনে জড়িয়ে বলে, আশ্বিন ! আশ্বিন ! তুমি কথা বলছ ? বল, বল, আরো বল। বুকের ভেতরে জেগে উঠেছে কামনার দানব। বত্রিশ বছরের শেষ প্রান্তের বসন্ত পথ দেখিয়ে দিচ্ছে নতুন পৃথিবীর। কোথাও যেন বিদ্যৎ চেরা জিব লকলকিয়ে উঠছে।আশ্বিনের নগ্ন বুকের মাঝে আমনের শুষ্ক দুটো ঠোঁট। আশ্বিন তাকে ঠাঁই দিচ্ছে নগ্নতার ভাঁজে ভাঁজে। আশ্বিনের বুকের গহীনে উচ্ছল জলের মধ্যে স্নানে নিমগ্ন আমন। দুটো ফুলের রেনু মাখা বৃন্তে ঠোঁটদুটো রাঙিয়ে নেয়। রক্তিম ঠোঁটের উষ্ণতায় ঘুমন্ত যৌবনের সিঁড়িগুলো ভেঙে যাচ্ছে। এক এক করে পৌছে যাচ্ছে আগুন নেভানোর পর্বে। আমন এখন পরিপূর্ণ কৃষক। উর্বর বীজ রোপনের তাড়না পেয়ে বসেছে তাকে। হঠাৎ দুহাতে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসে আশ্বিন। পরাজিত সৈনিকের মতো থমকে যায়, আমন।
আশ্বিন কাপড়ে জড়িয়ে নিয়েছে নিজেকে। ভাবে, না আমন, আমি তোমাকে ঠকাতে পারব না। আমাকে ক্ষমা করো।
আমন নিজেকে সামলে নিয়ে হাপাঁচ্ছে । নিজের কাছে জানতে চাইল, কেন ? আশ্বিন, এ পথের খোঁজ তো আমার জানা ছিল না। তুমিই দেখিয়েছো পথ। কিন্তু এখন আবার কী হলো?
সেই বীভৎস ঘটনাগুলো মাথার মধ্যে কোথা থেকে যেন এসে জাপটে ধরেছে । দরিদ্র কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে উদ্ধার করতে ভিনদেশী এক যুবক ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে আশ্বিনকে বিয়ে করে নিজের বাড়িতে তোলার নামে এক নারী পাচারকারীর হাতে বিক্রি করে দেয়। সে পাষণ্ড পাচারকারী বন্ধ ঘরে রেখে দিনের পর দিন বলাৎকার করেছে, ভিন্ন পুরুষও এনেছে ঘরে। রাজী না হওয়ায় প্রচণ্ড মারধোর করত। একবার ওরা নৌকা করে নিয়ে যাচ্ছিল বার্মা সীমান্তে। কথা ছিল বার্মার দালালের হাতে বিক্রি করে দেবে এবং সে বার্মিজ দালাল থাইল্যান্ড নিয়ে যাবে।
নরপশুদের বলি থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল সে মৃত্যুকে স্বেচ্ছায় বরণ করতে। জ্ঞান ফিরে নিজেকে আবিষ্কার করেছে আমনের ঘরের দূয়ারে। তার কন্ঠ রোধ হয়ে আসে। তারপর আর কথা বলবার চেষ্টাও করেনি। এতদিন পর সত্যিকার মানুষের ছোঁয়া পেয়ে আজ সে অন্যরকম নারী। কিন্তু আশ্বিন তার অপবিত্র নারীত্বে আমনের জীবনকে জড়াতে চায় না। কলুষিত করতে চায় না ওকে।
লেখক: লাভলী তালুকদার পেশায় একজন কলেজ শিক্ষক। লেখালেখি তার নেশা। দু হাতে লিখে চলেছেন গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও প্রবন্ধ। সাহিত্যের সব শাখায় তার সফল পদচারণ। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: ‘তদবিরে তকদির’, ‘শতকবির প্রেমকাব্য’, ‘নাঙ্গা হুজুরের পাথর স্বর্গ’, ‘কালপুত্র’, ‘খোয়াবের দেশে’, ‘আমার দ্বাদশ প্রেম’, রিংটোন পরী’, ‘পেত্মীরাজ্য আলোক রাজা’, ‘রূপকথা ও রাক্ষসী’ এবং ইংরেজী কাব্যগ্রন্থ ‘ব্লেসফুল মেমরি’।