ভাড়াটিয়া

ভাড়াটিয়া
জাবেদ সাহেব ও তার স্ত্রী দুজনে বড় বাসায় থাকেন তাদের একমাত্র মেয়ে বিদেশে থাকে। তাই দুজনে অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলেন একটা রুম ভাড়া দেবেন। তাই গেটের সামনে সুন্দর করে লিখে দিলেন “রুম ভাড়া দেওয়া হবে ৩য় তলায়”।
আজ শুক্রবার ছুটির দিন সকালে নাস্তা করে সবেমাত্র খবরের কাগজ নিয়ে বসেছেন তখনি ডোরবেল বেজে উঠল, জাবেদ সাহেব দরজা খুলে দেখেন দুজন ছেলেমেয়ে। ” কাকে চাই, কেন এসেছেন?” এরকম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন। ছেলেটি সালাম দিয়ে বললো, ভেতরে আসবো? জাবেদ সাহেব বললেন, হ্যা হ্যা আসুন। “আসলে আপনার একটি রুম ভাড়া দেওয়ার কথা বাইরে লেখা দেখলাম।” জাবেদ সাহেবের স্ত্রী ভেতরের রুম থেকে আসতে আসতেই বললেন, কে এসেছে? ড্রইংরুমে এসে ছেলেমেয়ে দুটোকে দেখে বললো, আপনারা দাঁড়িয়ে কেন? বসুন। ছেলেটি বললো, আমার নাম রোদন রহমান আর আমার স্ত্রী লাবণ্য রহমান। আপনাদের রুমটি ভাড়া নিতে চাই। হ্যা ভাড়াতো দিবই আসলে টাকার জন্য নয় এতো বড় বাসা দুজনে থাকি খালি খালি লাগে তাই ভাড়া দেয়া, জাবেদ সাহেব বললেন। তখন তার স্ত্রী বললো, তোমাদের সম্পর্কে কিছু বলো, ওহ‌!
তোমাদের তুমি বললাম কিছু মনে করো না তোমরাতো আমার সন্তানের বয়সী। তখন রোদন বললো, না না আন্টি ঠিকই আছে আপনি বলাতেই বরং খারাপ লাগছিলো। কি করো তুমি? আমি একটা কম্পানিতে চাকরি করি, নতুন বিয়ে করেছি। এতোদিন ভাইয়ের বাসায় ছিলাম তাই জাবেদ সাহেব সব শুনে বললেন, আমরা যে রুমটা ভাড়া দিব ওটা ছিল আমার মেয়ের রুম, সাথে ওয়াশরুমও আছে দেখে নিতে পারো। এতক্ষণে মেয়েটি মানে লাবণ্য চারপাশে তাকালো ভালো করে একটু সামনে গিয়ে রান্নাঘরের দিকে তাকালো, কী সুন্দর করে সাজানো গোছানো। জাবেদ সাহেবের স্ত্রী লিলি বেগম বললো, এই পাশের রুমে আমরা থাকি আরও একটা রুম খালি পড়ে থাকে। রোদন বললো, কত ভাড়া দিতে হবে? জাবেদ সাহেব বললেন, চার হাজার টাকা কিন্তু কিছু শর্ত আছে।
রোদন বললো, কী শর্ত! শর্ত হলো নিজের বাসা মনে করে থাকতে পারবা তোমরা কিন্তু বেশি রাত করা যাবে না,কারণ আমরা দুজনেই রাত দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি। লিলি বেগম বললেন, ভাড়াটিয়া মানে নিকট প্রতিবেশী তাই মিলেমিশে থাকতে হবে। লাবণ্য বললো, অগ্রীম ভাড়া লাগবে? লিলি বেগম বললেন, না। “আমরা তাহলে এক তারিখে আসি।” তোমরা যে রুম নিবে, সেটা দেখবে না? লিলি বেগম বলেন। লাবণ্য খুশি মনে বললো, সুন্দর বাসার আর কিছু দেখতে হয় নাকি। তবুও তোমরা দেখে নাও। তখন রোদন আর লাবণ্য দুজনেই রুমে গেলো দেখলো খাট, আলনা, পড়ার টেবিল মোটামুটি সব আছে। মিসেস জাবেদ বললেন, আসলে অন্য ঘরে নিতে হলে অসুবিধা হবে, তোমরা নতুন বিয়ে করেছ এসব ব্যবহার করতে পারো। রোদন বললো,ভালোই হলো আন্টি।
জাবেদ সাহেব বললেন, তোষক,বালিশ, চাদর এসবতো টুকটাক কিনতে হবে। নতুন সংসার শুরু করোছো তো আসতে আসতে বুঝবে ঠেলা কাকে বলে সবাই তার কথায় হেসে উঠল। এক তারিখ সকালে রোদন ও লাবণ্য একটা ভেনে করে যা আনলো কয়েকটি অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি পাতিল, একটা কেটলি,একটা কার্টনে কাঁচের প্লেট, গ্লাস, কাপ ও একটা কাপড়ের ব্যাগ ও বিছানা পত্র। সব রুমে রাখার পর রোদন লাবণ্যকে বললো, আমি বাজারে যাব, কী কী আনবো? মিসেস জাবেদ বললেন, বাজারে পরে যাবে, এখন আমাদের সাথে খাবে চলো। এই বলে বিছানার দিকে তাকিয়ে বললো, আরে খদ্দেরের বিছানার চাদর, কী সুন্দর নকশী কাঁথা! লাবণ্য বললো, হ্যা আন্টি মা আমার জন্য সেলাই করেছিলেন। মিসেস জাবেদ হেসে বললেন, রান্না করতে পারো? অল্প অল্প পারি আন্টি। তোমার পড়াশোনা কতদূর?
এইচ. এস. সি পাশ করেছি। তারপর বিয়ে দিলেন বাবা, মা নেই৷ পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন। লিলি বেগম বললেন, আহা কি হয়েছিল! আমার ছোট ভাইটা হবার সময় মা মারা গেছেন, ভাইটাও মারা যায়। তোমার বাবা আবার বিয়ে করেন নি? না তবে এখন মনে হয় করবে। তুমি কি বাইরে যাবে? জ্বী আন্টি বিকেলে যাবো। দুপুরে খাবার টেবিলে অনেক রকমের রান্না দেখে রোদন বলে, এতো খাবার! চিংড়ি মাছের দোপেয়াজো, ইলিশ মাছ,পাপদা মাছ, মুরগির মাংস, গরুর মাংস, ঘন মুগের ডাল, সালাদ ও পায়েশ। লাবণ্য হেসে বলে,আমরা গ্রামে বিয়ে বাড়িতেও এতো খাবার খাইনি৷ মিসেস জাবেদ বললেন,খাও অল্প অল্প করে, দেখবে ভালো লাগবে। বিকালে বাজার থেকে কাঁচা বাজার ও একটা কিচেন রেক একটা মাটির হাড়ি আনলো নতুন দম্পত্তি।
লিলি বেগম টিভি দেখতে ছিলেন মাটির হাঁড়ির দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে লাবণ্য বললো, ঠান্ডা পানি খাবার জন্য।
আমাদের ফ্রিজ আছে বলতে গিয়েও বললেন না শুধু একটু হাসলেন লিলি বেগম। দুইমাস পরে জাবেদ সাহেবের মেয়ে ফোন করে বললো বাবা আমি দেশে আসবো আগামী সপ্তাহে। খবরটি শুনে লিলি বেগম আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। ৭ বছর পর মেয়েকে দেখতে পাবেন। রোদন খবর পেয়ে লাবণ্যকে বললো, আমাদের কী এখন বাসা ছেড়ে দিতে হবে। লাবণ্য বললো, না আরও একটা রুম আছে তো। রোদর একটু চিন্তা মুক্ত হলো।
জাবেদ সাহেবের মেয়ে চীনে থাকে গত ৭ বছর কাজের চাপে এতোদিন দেশে ফিরতে পারেনি। গত কিছুদিন ধরে চীনের অবস্থা বেশি ভালো যাচ্ছিল না করোনা নামক এক ভাইরাসের জন্য সব বন্ধ হয়ে যাবে যাবে অবস্থা। তখনই তার মেয়ে বাংলাদেশে আসতে চাইল, যখন তারিখ ঠিক করলো বাবা মাকে দেখতে পারবে এই খুশিতেই থাকলো। তখনও এই ভাইরাস নিয়ে অতো সচেতনতা শুরু হয়নি তাই এটার প্রভাবের কথা মাথায় এলো না।
এয়ারপোর্টে জাবেদ সাহেব ও তার স্ত্রী এলেন মেয়েকে নিতে। মেয়ে আসার সাথে সাথে মা কে জড়িয়ে ধরলো তারপর বাবাকে। তারা এক সাথে বাইরে খাওয়া দাওয়া শেষে বাসায় যাবে তখন জামাই বললো, বাবা আমরা আগে মায়ের সাথে দেখা করে দুইদিন পর আপনাদের বাসায় আসবো। লিলি বেগমের মন খারাপ হলেও জামাইয়ের কথা মেনে নিয়ে বাসায় চলে আসলেন। শাশুড়ীর বাড়িতে যাওয়ার পর খবর প্রচার হয়ে যায় যে চীন থেকে চৌধুরী সাহেবের ছেলে আর ছেলের বউ নাতিকে নিয়ে এসেছে৷ তখন পুলিশরা এসে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বললেন।
জাবেদ সাহেবের ও তার স্ত্রীর জ্বর হলো সকালে উঠে দেখেন গলাও ব্যথা করছে। রোদন ও লাবণ্য খবরে দেখে জানতে পারলো গত কয়েকদিনে যতজন চীন থেকে এসেছে সকলেই করোনায় আক্রান্ত এবং এর কোন প্রতিষেধক নেই আর তাই পরিষ্কার থাকা, বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, গরম পানি পান করা ইত্যাদি। আর রোগটি ছোঁয়াচে তাই দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। আর এই রোগের লক্ষণ হলো জ্বর, গলা ব্যথা, হাঁচি কাশি আর এতটুকু শোনার পরপরই লাবণ্য বললো, শুনছো আন্টি আর আংকেলেরও এই লক্ষণগুলো তো দেখা যাচ্ছে এখন কী হবে? তখন রোদন বললো, এই অবস্থায় তাদের ফেলে চলে যাওয়া যাবে না। লাবণ্য তখন বললো, তা তো অবশ্যই নিজের বাবা মা হলে কী ফেলে চলে যেতাম নাকি। তুমি বরং জুয়েল ভাইকে ফোন করো আর এর প্রতিকার সম্পর্কে ভালোমতো জানো।
ডাক্তারের কাছে থেকে সব জানার পর রোদন বুঝতে পারলো অবস্থা বেশি ভালো না আর এই ভাইরাসের প্রভাবে অনেক ক্ষতি হবে মানুষের। যাইহোক লাবণ্যকে সতর্ক করে রোদন বাজারে গেলো তারপর যা যা কেনাকাটা করার সব করে বাসায় ফিরলো। এসে শুনলো জাবেদ সাহেবের অবস্থা বেশি ভালো নয়। তখন রোদন মাক্স পরে হাতে সেনিটাইজার লাগিয়ে উনার সেবা করতে গেলো। গরম পানির ভাপ দেয়া, আদা লেবুর চা থেকে শুরু করে খাবার খাওয়ানো সবকিছুই করলো। আর দুইজনকে দুই রুমে রাখা হলো নিয়ম অনুযায়ী আর তাদের সেবার পরপরই রোদন আর লাবণ্য গোসল করা সব ধোয়া মোছা করতে থাকলো কিন্তু বাবা মায়ের মত এই অসহায় মানুষ দুটিকে ছেড়ে যাবার কথা ভাবলো না। ভয় যদিও ছিলো নিজেরাই যদি আক্রান্ত হয় তাহলে কী হবে!
কিন্তু এসব ভাবার সুযোগ নেই কারণ এখনও অনেক দায়িত্ব। এদিকে খবর এলো জাবেদ সাহেবের জামাই মেয়ে আর নাতিটা মারা গিয়েছে। একেতো অসুস্থ দুটো মানুষ তার মধ্যে এতো বড় অাঘাত এমনকি নিজের সন্তানকে শেষ নজর দেখারো সুযোগ নেই মাটির দেবার অধিকারও নেই। এই অসহায় অবস্থায় এই অচেনা ছেলেমেয়ে দুটোই তাদের বাঁচার একমাত্র মাধ্যম হয়ে উঠলো। লিলি বেগম পাথরের মতো হয়ে গেলেন কোনো কথা বলেন না এই কয়দিনে এতো কান্না করেছেন যে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। লাবণ্য দূর থেকে লিলি বেগমের এই অবস্থা সহ্য করতে পারছিলো না। মা কে হারিয়ে নতুন মা পেয়েছে ও এই মা কে কিছুতেই মরতে দিবে না সে যে কোনো ভাবেই হোক বাঁচাবেই।
লাবণ্য বললো, আমি হয়তো তোমার মেয়ে হারানোর কষ্ট দূর করতে পারবো না কিন্তু তোমার আর একটা মেয়ে হবার সুযোগ করে দাও। মা হারানোর কষ্ট আমি জানি এক মাকে হারিয়ে আমি নিঃস্ব তোমার মাঝে নিজের মা কে পেয়েছি তোমাকে হারাতে চাই না। মিসেস জাবেদ লাবণ্যর কথা শুনে ভাষা হারিয়ে ফেললেন তবে এইটুকু বুঝে গেছেন এই ভাড়াটিয়া তার নতুন জীবনের একমাত্র আশ্রয়। করোনা ভাইরাস জাবেদ সাহেব ও তার স্ত্রী কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু কিন্তু এই দুর্যোগের মধ্যে রোদন ও লাবণ্যের মতো ছেলেমেয়ে দিয়েছে যাদের মাধ্যমে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভালোবাসায় জড়িয়ে থাকবে তারা।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত