ফেরা

ফেরা
ক্লাস এইট-নাইনে যখন তখন থেকে আমি বোরখা পড়া শুরু করি। আমার বোরখা পড়া দেখে এরপর থেকে আমার মাও বোরখা/পর্দা শুরু করেন। এর যথেষ্ট কারণও আছে। আমি ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি আমার বাবা মায়ের কখনো বনিবনা হত না। সারাক্ষণ ঝগড়া বিবাদ লেগে ই থাকত। আমার বাবা হাই প্রোফেশনের মানুষ। আর মাও অনেক উচু বংশের মেয়ে। একেক জনের মতের অমিলে খুনশুটি অনবরত চলত। অথচ আমি যে তাদের সন্তান এসবের প্রভাব আমার উপর পড়ছে কিনা তা কখনো কেউ খেয়াল করতেন না। আমি সবসময় চুপচাপ ঘরের এক কোণে পড়ে থাকতাম। আমাদের বড় বাড়িতে আলাদা তেমন কেউ নেই কাজের লোক ছাড়া।
তাই মা বাবার ঝগড়ার প্রভাব সেই ছোটকাল থেকে ই আমার উপর অস্বাভাবিক ভাবে পরেছে। যার কারণে আমি অনেকটা অসামাজিক হয়ে পড়ি। অসামাজিক বলতে কারো সাথে না মিশা বাইরে কোথাও যেতাম না এমনকি আত্মীয়-স্বজন আসলেও কেমন জানি এড়িয়ে চলতাম। পুরোপুরি ইন্ট্রোবার্ট টাইপের হয়ে গেলাম। যখন ই মায়ের কাছে যেতাম মাকে পেতাম না। মায়ের শপিং উনার বিভিন্ন নারী কমিটির কাজে ব্যস্ত থাকতেন সারাদিন। আর রাত হলে বাবা মা দুজনের সেই তুমুল ঝগড়া।
আমি কান বন্ধ করে সহ্য করতাম। তবে বাবা যখন কাজের জন্য দেশের বাইরে যেতেন তখন একটু শান্তি পেতাম ঝগড়া হত না। কিন্তু তাতে কি..! এরপর যে এর থেকেও ভয়ানক কিছু অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। যখন বাবা বাইরে থাকতেন তখন আমাদের বাড়িতে কোনো এক আঙ্কেলের আনাগোনা চলত। আমি খুব ছোট না হলে মাধ্যমিক লেভেলে পড়াশোনা করি তখন নতুন। পুরোপুরি না বুঝলেও কিছুটা আন্দাজ করতে পারতাম এটা খারাপ কাজ। যদি ঐ আঙ্কেল না আসতেন সেদিন পুরো রাত ফোনে কথা বলে কাটিয়ে দিতেন। আমি যে উনার সন্তান এটা আদৌ মনে ছিল কিনা মায়ের আমার জানা নেই। শেষ কবে মায়ের হাতে মুখে তুলে ভাত খেয়েছি মনে নেই আমার।
মায়ের এমন কর্মকান্ড আমাকে ভিতরে ভিতরে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। যেহেতু ছোটকাল থেকে ই বাবা মায়ের সাথে দুরত্ব এমনিতে ই তাই এসব বাবাকে বলার সাহস পাইনি। আর উনাকে বলার সময় কোথায়..! কাজ ব্যবসা নিয়ে নিজের মত সপ্তাহের পর সপ্তাহ যায় একবার ফোন করেও আমার খবর নেন না। মাঝে মাঝে খুব মন খারাপ হত সৃষ্টিকর্তাকে দোষারুপ করতাম। কেন আমাকে এই পৃথিবীতে পাঠালে। যখন বান্ধবীদের দেখতাম ওদের মা সুন্দর করে চুলে বেণী করে রেডি করে দিয়েছে তখন আমি খুঁজতাম আমার মা কোথায়..! চুল বেণী করতে পারতাম না কোনোরকম স্কার্ফ টা পিন দিয়ে আটকে রেখে দিতাম।তখন মনে হত হয়ত ভুলক্রমে আমার বাবা মা আমাকে এই দুনিয়ায় নিয়ে এসেছেন। এরকম হাজারো আক্ষেপ মনে জমা হত দিনের পর দিন।
দিনের পর দিন এভাবে চলতে ই থাকল। বাবা বাড়িতে আসলে আবার শুরু। আমি মনে প্রাণে চাইতাম আমার বাবা মার ডিভোর্স হয়ে যাক। কোনো সন্তান ই হয়ত এরকম কিছু কখনো চাইবে না আমি চাইতাম কিন্তু তাতে তাদের স্বার্থে লাগে। কারণ আমার দাদার সূত্রে যে সম্পত্তি তা দাদা মারা যাওয়ার আগে আমার নামে লিখে যান। আর বাবার পুরো সম্পত্তি মিলালে সেখানে ৭০% ভাগ ই দাদার অবদান। ডিভোর্স হলে আমাকে নিয়ে দু পক্ষের টানাটানি এর থেকে তো এভাবে ভালো যে যার মত থাকুক স্বার্থ টা তো সুরক্ষিত থাকবে। আমি এককোণে পড়ে রইলে কার ই বা কি আসে।
মা বাবার উপর প্রচন্ড অভিমান জমতে থাকলো। সাথে নিজের উপর বিতৃষ্ণা। না কাউকে বলতে পারতাম নিজের গোপন ব্যথা গুলো না কেউ শোনার মত ছিল। স্কুলেও এক কোণে বসে কাটিয়ে দিতাম তেমন কেউ ছিল না আর হবে ই বা কি করে আমি শুধু ওই সব ঘোরে ই থাকতাম। যখন ইচ্ছা করত না যেতাম না। ক্লাস সেভেন থেকে প্রচন্ড ভাবে একাকিত্বে ভুগে বই পড়া শুরু করলাম। ইলেকট্রনিক্স জিনিস আমার থেকে দূরে রাখার নির্দেশ ছিল সবসময়। নিজের এই অসহ্য সময় গুলোর সঙ্গি হয়ে পড়ল বই। এর আগেও পড়তাম অল্প। বইয়ের সাথে আমার বন্ধুত্ব শুরু হল। যতক্ষণ একা থাকতাম বই ছিল আমার ভরসা। সেই বই পড়া থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে ধর্মীয় বইগুলা আমাকে আকর্ষণ করতে লাগল। প্রথমে বই পড়তাম সময় কাটানোর জন্য গল্প উপন্যাস রম্য ফেলুদা সবগুলো পড়তাম। কিন্তু কখন জানি এসবের মাঝে একটু একটু করে ধর্মীয় বইগুলা জায়গা করে নিল।
আমি প্রচন্ড মনের অশান্তি তে শান্তি স্বস্তি খুঁজতাম ধর্মীয় বই গুলোতে। বইয়ে তখন কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের বাংলা অনুবাদে যেন নিজের চির মুক্তি খুঁজে পেতাম। কিন্তু তখনো আমি কোরআন পড়তে জানিনা। আর আমার পারিবারিক অর্থ ব্যবস্থা ভালো ছিল বলে বই কিনতে আমার তেমন কষ্ট হত না। একদম ইন্ট্রোবার্ট টাইপের হওয়ায় নিজের মত থাকতাম সারাক্ষণ খাওয়ার সময় খাওয়া ঘুম আর বই। পড়তে ই থাকলাম আর তিলওয়াত শেখার উদ্যোগ নিলাম। একটু একটু করে মনের একাগ্রতার কারণে অল্প দিনে ই আমি তিলওয়াত করতে শিখে যাই। যখন আবার মন খারাপ হত তখন আর অন্য বই না কোরআন নিয়ে বসে পড়তাম অযূ করে। নামাজের জায়নামাজে বসে কাঁদতাম এরকম জীবন থেকে একটু স্বস্তি পেতে।
আর অন্যদিকে চলত আমার বাবা মায়ের আজব সংসার। তার মধ্যে আবার মায়ের পরকীয়া। নিজের পথ নিজে ই বাছাই করলাম। নামাজ কোরআনে নিজেকে জীবিত রাখলাম। সবসময় চাইতাম আল্লাহ আমাকে পথ দেখাও আমি আর পারছি না। রাতে যখন বাবার অনুপস্থিতি তে মা মায়ের মত থাকত তখন আমি দুহাত তুলে এসব থেকে মুক্তি চাইতাম। আর চাইতাম বাবা মাকে এক সাথে দেখতে। প্রচন্ড কান্নায় আমার রাত পার হয়ে যেত। সবকিছু জেনে বুঝে আস্তে আস্তে আমি নিজেকে ইসলামী তরিকায় তৈরি করে নিতে চেষ্টা করলাম। সবকিছু ই করতাম আর আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতাম।
একদিন রাতে প্রচন্ড জ্বর নিয়ে নামাজ পড়ছিলাম। শীতে আমার হাত পা কাঁপছিল। মোনাজাত করে আর বসে থাকতে পারিনি। মা তখন স্কুলের বেতন দিতে আমার রুমে এসে দেখে আমার এই অবস্থা। তারপর এই প্রথম হয়ত মা আমাকে একটু আগলে রাখে সারারাত। সকালে একটু সুস্থ হলে আমি আমার মত থাকলাম। কারণ অনেক দিনে অনেক দুরত্ব তৈরি হয়েছিল মাঝে। কিন্তু মোনাজাতে ঠিক ই চাইতাম আমার পরিবারে একটু শান্তি আসুক।
এরপর থেকে কেন জানি মা প্রতিরাতে এসে একবার হলেও উঁকি দিতেন আমি দেখেও না দেখার ভান করতাম। আমার স্কুল লেভেল শেষ তখন। যখন তিলওয়াত করতাম মা লুকিয়ে পিছনে এসে শুনতো আমি ঠিক টের পেতাম। তখন আমি আরো দীর্ঘ সময় তিলওয়াত করতাম যখন সেটা বুঝতাম তখন চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে আসত কান্নায় চোখের পানি বাঁধ মানত না। এরকম কয়েকদিন চলতে লাগল। শেষ একদিন তিলওয়াত রেকর্ড করে এককোণে রেখে মায়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। মা আসলেন এসে আমাকে দেখার জন্য উঁকিঝুকি দিতে লাগলেন তখনি আমি মায়ের হাতটা ধরি। মা অনেকটা ভয় পেয়ে যান। কি বলবে না বলবে হয়তো লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকেন। মায়ের হাত ধরে রুমে নিয়ে যাই। এই ১ম হয়ত মা আমার দিকে এত মমতাময় দৃষ্টি নিয়ে তাকি ছিলেন।
সংকোচ পেড়িয়ে বললেন এই তিলওয়াতের আওয়াজে নাকি আমি মাকে প্রতিরাতে ডাকি। কোনো এক অজানা টানে ছুটে আসেন আমার দরজার কাছে। এই কথা শোনার পর জোড়ে ঝাপটে ধরি মাকে। আর কিছু বলতে পারিনি শুধু ওই আল্লাহ সুবহানের নাম নিয়ে কাঁদতে তাকি মায়ের বুকে। মায়ের উষ্ণ ছোঁয়ায় সেদিন আমার কান্নার বাঁধ থামছিল না। প্রত্যেকটা বার আমি চাইতাম আল্লাহ আমাকে সাহায্য করো। এরপর থেকে মা পাল্টাতে লাগলেন। একটু একটু করে পাল্টাতে লাগলেন। সময় করে মা মেয়ে নেমে পড়তাম তিলওয়াত প্রতিযোগিতায় আমার আনন্দের সীমা থাকতো না। যেন পরম পাওয়ার তৃপ্তিতে বুকটা ভরে যেত। অপেক্ষা করতে লাগলাম বাবার। বাবা দেশে আসলেন।
ঘরের পরির্বতন বাবা এসে ই আঁচ করলেন। জায়নামাজে মাকে দেখে অনেকটা হচকচিয়ে গেলেন। রাতে মা নিজের হাতে বাবাকে ভাত বেড়ে দিলেন। আর আমি সেই দৃশ্য দেখছিলাম আর কাঁদছিলাম। ভাবছিলাম ওই উপরওয়ালা কাউকে নিরাশ করেন না কখনো। নিজে নিজেকে সাহায্য করলে মহান আল্লাহ অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করবেন। আমি কান্না করছিলাম প্রচন্ড রকম কান্না করছিলাম মা বাবাকে এমন দেখে। মা ডেকে নিলেনন আমায়। আমি তখনো কান্না করছি মুখ দিয়ে কিছু বলতে পারছিনা এতটা কান্না করছিলাম। বাবা বললেন কান্না করছিস কেন মা..! মা
– ডাকটা শোনায় এই ১ম বাবাকে বাবা বলে জড়িয়ে ধরলাম কিচ্ছু বলতে পারলাম না মুখ দিয়ে অথচ কত কথা বলার ছিল।
গৃহিনী ঘর আগলে রাখলে কর্তা আর কতদিন দূরে থাকবে। বাবাও পাল্টাতে লাগলেন। বাবা ঘুমানোর পরে আবার মা মেয়ের প্রতিযোগিতা শুরু হত তিলওয়াতের। এ যেন সবকিছু স্বপ্নের মত মনে হতে লাগল। তিলওয়াত শেষে যখন তাহাজ্জুদ পড়ব তখন পাশে আরেকটা জায়নামাজ নিয়ে বাবা হাজির। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি। নামাজ শেষে বাবা মায়ের কাছে সকল ভুলের ক্ষমা চাইলেন আর মা তার গোপন সবকিছু বলে নিজের ভুলের ক্ষমা চাইলেন। আমি আবারো কাঁদছিলাম। তবে সেটা সুখের কান্না..! কয়জন পারে এভাবে পরিবার নিয়ে মাঝরাতে আল্লাহর দরবারে হাত তুলতে..! আমি পেরেছি। সৃষ্টিকর্তা সত্যি বলেছেন, ” তুমি নিজেকে সাহায্য করো আমি তোমাকে সাহায্য করব।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত