বেলাশেষে

বেলাশেষে
ফয়সাল”
-“কেমন আছিস?”
আমাকে দেখে আবির বেশ অবাক হলো। শুধু অবাক নয় বেশ অবাক হলো।হয়তো আমাকে এখানে এভাবে দেখবে সে আশা করেনি। আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। আবির চুপ করে আছে। কিছু বলছে না। আমি আবার স্বাভাবিক ভাবে বললাম,,
-“কি হলো ?বললি না তো কেমন আছিস?”
-“ভালো !” আবির এই বলে চুপ করে থাকলো।আর নার্সের কাছ থেকে কি যেনো একটা কাগজ নিলো। মনে হয় প্রেসক্রিপশন হবে। আমি আবার বললাম,,
-“তো এখানে কেনো?কেউ অসুস্থ?” আবির বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো।হয়তো বিরক্ত হচ্ছে। একপ্রকার বিরক্তি নিয়ে বললো,,
-“মা এর বুকে ব্যাথা !তাই এসেছি।“
এই বলে আবির আমার সামনে থেকে সিঁড়ির দিকে চলে গেলো।হয়তো ঔষধ আনার জন্য। আমি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। প্রায় তিন বছর পর আবিরের সাথে আমার দেখা।অথচ আজ সে কতটা বদলে গেছে। অবশ্য তার এই বদলানোর জন্য আমি দায়ী। আমি চুপ করে হসপিটালে রাখা চেয়ারে বসলাম। বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। হটাৎ করে খেয়াল করে দেখি একটা মেয়ে নার্সের সাথে কি বিষয় নিয়ে যেনো কথা বলছে। আমি একটু ভালো করে খেয়াল করে দেখি নিশি।নিশি কে দেখে আমার মনের ভেতর কেমন যেনো অস্থিরতা সৃষ্টি হলো। খুব অস্বস্তি লাগছিলো। আমি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। আমাকে যেভাবেই হোক নিশির সামনে থেকে যেতে হবে।আর মানুষের কাছে বেইমান হতে চাই না। কিন্তু হঠাৎ করে পেছন থেকে নিশি আমায় ডেকে উঠলো। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। কেনো যেনো পা টা আর এগোচ্ছে না। আমি পেছনে ফিরে তাকালাম। দেখি নিশি আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।হয়তো ভাবছে এতোবছর পর আমি এখানে ? হয়তো আশা করেনি। নিশি বললো,,
-“কেমন আছেন?”
-“এইতো আলহামদুলিল্লাহ ভালো ! তুমি?
-“আছি কোনো রকম !” আমি কিছু বললাম না। চুপ করে রইলাম।নিশি আবার বললো,,
-“আপনি এখানে হটাৎ ?”
-“এই এখানে একটা দরকারে এসেছি। তেমন কিছু না।“
-“ওহ !ঠিকাছে।“
-“হুম ! তোমার পরিবারে সবাই কেমন আছে?” নিশি কিছু বললো না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। আমি একটু বিচলিত হলাম। নিশি বললো,,
-“মায়ের শরীর খুব খারাপ।আজ হসপিটালে ভর্তি করালাম।আর ভাইয়ার চাকরিটা মাসখানেক আগে চলে গেছে। এখন চাকরিও পাচ্ছে না। এখন সবাই একটু সমস্যার মধ্যে আছি।কি করবো বুঝতে পারছি না?” আমি নিশির দিকে এখন ভালো করে তাকালাম।মুখটা কেমন উদাস হয়ে আছে। আমি নিশি কে কিছু বলতে যাবো হটাৎ করে পেছন থেকে আবির বলে উঠলো,,
-“কি রে নিশি ! তুই এখানে কি করছিস?মা রূমে একা।যা রুমে যা।“ নিশি আবিরের কথা শুনে আমার দিকে এক মলিন দৃষ্টি দিয়ে চলে গেলো। আমি চুপ করে শুধু তার চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলাম। কিন্তু হঠাৎ করে আবির বলে উঠলো,,
-“আবার তুই কি চাস? কেনো এসেছিস এখানে? আবার কোনো ঝামেলা করতে?” আবির বেশ রাগান্বিত হয়ে কথাগুলো বললো। আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। আমি কিছু বলতে যাবো হটাৎ করে শাহেদ ডেকে উঠলো,,
-“ভাইয়া চলেন । রক্ত দেওয়ার সময় হয়ে গেছে। ডাক্তার আপনাকে ডাকছেন।“ আবির আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। আমি এক নির্লিপ্ত হাঁসি দিয়ে বললাম,,
-“মনে আছে ? ভার্সিটি লাইফে আমাদের একটা সংগঠন ছিলো ! যেখানে আমরা বন্ধুরা মিলে রক্ত জোগাড় করতাম।আর বিভিন্ন রোগীকে রক্ত দিয়ে সাহায্য করতাম। তুই আর আমি ছিলাম উক্ত সংগঠনের প্রধান !” আবির আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। হয়তো সে এরকম কিছু ভাবছে। আমি আবার বললাম,,
-“আমাদের বন্ধুত্ব ভেঙেছে ঠিকই। কিন্তু আজও আমি সেই মূহুর্তগুলো কে হারাতে চাইনা।যে কাজকর্মের জন্য আমরা সবার কাছে প্রিয় ছিলাম।“ আবির আমার কথায় আর কিছু বললো না। চুপ করে রইলো। আমি আর কিছু না বলে শাহেদের সাথে চলতে শুরু করলাম। চোখ দিয়ে একফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়লো। আমি তা হাতের কুনই দিয়ে মুছে ডাক্তারের রুমের দিকে পা বাড়ালাম।
মাঝে মাঝে যখন আমার মন খারাপ হয় তখন আমি হাঁটতে বের হই। আজকেও বের হয়েছি।রাত এগারোটা মতো বাজে। মনে কি রকম যেনো এক অশান্তি বিরাজ করছে।মন খারাপের ফলে যে বিষন্নতা সৃষ্টি হয় তা কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলে কিছুটা হলেও মুছে যায়। হেঁটে হেঁটে শহর দেখি।এই যানবাহন,এই গাছপালা, রাস্তার নিয়ন আলোয় নিজের ভেতরে কেমন যেনো একটা স্বস্তি বিরাজ করে। নিজেকে ভাবতে শেখায়।আর আমার এই ভাবনার ভেতর কেনো যেনো নিশি কে শুধু মনে করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয় সেই তিনবছর আগের ধূসর স্মৃতিগুলো।
নিশি কে আমি গত পাঁচবছর ধরে ভালোবাসি।এক তরফা ভালোবাসা যাকে বলে।এক তরফা বলার কারণ নিশি কে আমি অজান্তেই ভালোবেসে ফেলি।আর যে ভালোবাসায় কোনো অগ্রাধিকার নেই।নেই কোনো আশা। তবুও আমার মন তাকে কেনো ভালোবাসলো এটা আমাকে আজও ভাবায়।নিশি হলো আবিরের একমাত্র ছোট বোন। খুব আদরের বোন আবিরের।আর এই আদরের জায়গায় আমি অন্যায় ভাবে ভাগ বসাতে চেয়েছিলাম।আর যার শাস্তিস্বরূপ আমি আজ নিঃস্ব। শুধু নিঃস্ব একদম নিঃশ্ব।এই ইটপাথরের শহরের মাঝে আমার কেউ নেই।আর যখন একা মনে হয় তখন আমার খুব রাগ হয়। ভীষণ রাগ হয় আমার নিজের প্রতি। আমি কি একা থাকার জন্য বেঁচে আছি।আমার তো ইচ্ছে করে আমার আপনজন আমার দুঃখের সময় পাশে থাকুক। আমাকে শান্তনা দিক।কেউ আমার দুঃখগুলো আমার সাথে অনুধাবন করুক।
আমি কি এতোই হতভাগা?আর এসব ভাবতেই আমার চোখে নোনাজল এসে জমা হয়।আর সেই জল আমাকে আমার মায়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।আপন মা নন। আমার পালিত মা। মরিয়ম বেগম। আমি যখন খুব ছোট তখন আমার আসল মা আমাকে ছেড়ে চলে যায় অন্য এক মানুষের হাত ধরে। যখন আমার খুব মন খারাপ হতো মায়ের আদর পেতে চাইতো তখন আমি খুব কাঁদতাম। বারবার বাবাকে বলতাম আমার মাকে এনে দাও। কিন্তু আমার বাবা তা পারেনি।বাবা প্রায় বলতেন আমার বুকে খুব ব্যাথা করছে। কিন্তু এই ব্যাথা প্রায় একবছর পর আমার বাবাও আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়।আমার বাবাও দূর আকাশের তাঁরা হয়ে যায় স্বার্থপরের মতো আমাকে একা করে। আমার বাবারা দুইভাই ছিলো।বাবা মারা যাবার বেশ কিছুদিন পর আমার কাকা আমাকে এতিমখানায় দিয়ে যায়। এরপর তারা কখনোই আমাকে দেখতে আসেনি। আমি তখন চারবছরে বাচ্চা। আমি শুধু কান্না করতাম সেখানে।আর সেখানে চাকরি করতো মরিয়ম বেগম।
একদিন তিনি আমাকে ডেকে বললেন,”কি হয়েছে বাবু? তুমি কান্না করছো কেনো?”আমি কান্না করতে করতে বলি,”আমি মায়ের কাছে যাবো? আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চলো?”এরপর মরিয়ম বেগম আমাকে তার কাছে নিয়ে আসেন।এনে আমাকে বলেন,”জানো আমি কোনদিন মা হতে পারবো না? আমাকে তুমি মা বলে ডাকবে?”এরপর থেকে আমি আমার নতুন মাকে খুঁজে পাই। আমাকে ঘুম মাথায় হাত দিয়ে ঘুম পাড়ানো,খাইয়ে দেওয়া, পড়ালেখা শেখানো সব মরিয়ম বেগম করেন। আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে আমাকে উনি দত্তক নিয়ে এসেছেন। শুনেছিলাম তার স্বামী নাকি তাকে তালাক দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন।কারণ তিনি মা হতে অক্ষম ছিলো। আমি অবাক হয়ে মানুষ কেনো এতো স্বার্থপর? কেনো মানুষকে সব পেতে হবে?তারা কেনো কিছু অপূর্ণতার মাঝে পূর্ণতা খুঁজে নেয় না।
এরপর অনেক বছর কেটে গেছে। আমি ভার্সিটিতে পদার্পন করি।আর এই ভার্সিটি পদার্পণ করার পর আমার পরিচিত হয় আবিরের সাথে। আমার জীবনে সবচেয়ে কাছের বন্ধুর সাথে। আবিরের সাথে আমার প্রথম কোনো ভালো সম্পর্ক ছিলো না। আমাকে প্রায় আবির সবার সামনে তাচ্ছিলো করার চেষ্টা করতো। কিন্তু কি রকম ভাবে হটাৎ করে আবিরের সাথে আমার একটা ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়। শুধু ভালো বন্ধুত্ব নয় যাকে বলে বেস্ট ফ্রেন্ড। আবিরের সাথে আমার ভার্সিটি লাইফ খুব ভালো কাটছিলো। আনন্দ, দুষ্টুমি,ঘুরাফেরা, মানুষের পাশে দাঁড়ানো আর মাঝে মাঝে রাতের অন্ধকারে চুপিসারে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে খুব ভালো লাগতো।আমরা এতোটাই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম যে ক্যাম্পাসে অনেক আমাদের বন্ধুত্ব দেখে হিংসা করতো। এভাবে কেমন করে যেনো দু’বছর চলে গেলো ভার্সিটিতে। একদিন আবিরের বাসায় আবির আমাকে নিয়ে যায়।গত দু’বছরে সেইদিন প্রথম আবির আমাকে তার বাসায় নিয়ে যায়।
আবিরের বাবা ছোটবেলা মারা যান। আবিরের বাসায় আবির তার মা আর তার ছোটবোন নিশি থাকে। আর আমি আবিরের বাসায় সেদিন প্রথম নিশি কে দেখি।নিশি ছিলো ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। আমি প্রথম নিশি কে দেখে নিশির প্রেমে পড়ে যাই। অনেকে হয়তো প্রথম দেখায় প্রেম জিনিসটাকে বিশ্বাস করে না।আমার ও হতো না। কিন্তু নিশিকে দেখে আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। অজান্তেই নিশি কে নিয়ে আমার মনে স্বপ্ন বাঁধতে শুরু করে। এরপর আমি প্রায় নানা বাহানায় নিশি কে দেখতে আবিরের বাসায় যেতাম।নিশি কে দেখার জন্য আমার মন কেনো জানি ছটফট করতো।তার চিকন দাঁতের হাসি আর ঠোঁটের নিচে তিলটা আমাকে বাধ্য করতো তাকে দেখতে। মাঝে মাঝে নিশি কে দেখতে তার কলেজের সামনে চলে যেতাম। দূর থেকে দেখে আমার মনের অস্থিরতা দূর করতাম।
আমি যে নিশির প্রেমে পড়েছি এটা আমি কাউকে জানায়নি। কাকে বলবো? বন্ধু বোনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি এটা কি কাউকে বলা যায়?বলা যায় না। মাঝে মাঝে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হতো। মনে হতো আমি অন্যায় করছি। কিন্তু তবুও এই পাগল মন শুধু নিশির হতে চাইতো। নিশির প্রেমে পড়তে চাইতো। এভাবে প্রায় একবছর কেটে যায়। আমি আরো নিশির প্রতি আসক্ত হয়ে যাই।একদিন দুপুরে আমি আবিরের ছাদে যাই।যেয়ে দেখি নিশি হাতদুটোকে প্রসারিত করে শীতল বাতাস অনুধাবন করতে।আকাশটা মেঘে ঢেকে যাচ্ছে।হয়তো একটু পর অজর ধারায় বারিপাত হবে।ভিজিয়ে দিয়ে যাবে এই প্রকৃতিকে। দিয়ে যাবে এক নতুন সৌন্দর্য।আর এটাই হয়তো নিশি মনে মনে অনুধাবন করছে। আমি ছাদের দরজার পাশে হেলান দিয়ে তা দেখছিলাম। হটাৎ করে কি যেনো ভেবে আমি বললাম,,
-“কখনো কি প্রিয় মানুষটার হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজেছো?” আমার এমন কথায় নিশি পেছন ফিরে তাকায়। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। আমি একটু বিচলিত না হয়ে নিশির সামনে এগোতে লাগলাম।আর এরমধ্যে বৃষ্টি পড়তে শুরু করে দিয়েছে। আমি নিশির সামনে গিয়ে থামলাম।নিশি মাথা নিচু করে রয়েছে। বৃষ্টির পানিতে তার চুলগুলো ভিজে সামনে চলে আসছে।এতে তাকে অনিন্দ্য সুন্দরী লাগছে।নিশি ভিজে যাওয়া চুলগুলো কানে গুজলো।আমি একটু পর বললাম,,
-“বৃষ্টিতে প্রিয় মানুষটার হাত ধরে হাঁটার যে আনন্দ এটা আমি কোনোদিন অনুধাবন করতে পারিনি। আমার খুব ইচ্ছে করে এই রিমঝিম বৃষ্টির মাঝে প্রিয় মানুষটার হাত ধরে হারিয়ে যেতে। আমি কি তোমার হাতদুটো ধরতে পারি?”
নিশি আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। আমার কাছ থেকে হয়তো সে এমন কিছু আশা করেনি।এক দৌড়ে নিশি ‌ছাদের সিঁড়ির দিকে চলে গেলো। আমি তার পথের পানে চেয়ে রইলাম। মনে ভয় সৃষ্টি হলো আবিরকে কিছু বলে দিবে না তো আবার?
কিন্তু আমি খুব অবাক হয় নিশি আবিরকে সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে কিছু বলেনি। তখন আমার মনে প্রশ্ন জাগে তবে কি নিশিও আমাকে মনে মনে পছন্দ করে।এই প্রশ্নের উত্তর আমি কখনো পাইনি। মাঝে মাঝে যখন আবিরের বাসায় যেতাম তখন নিশির সাথে আমার চোখাচোখি হতো। আমি অস্বস্তিতে পড়ে যেতাম। মাঝে মাঝে মনে হতো নিশির ও মনে আমার জন্যে জায়গা তৈরি হয়েছে। কিন্তু আবার মাঝে মাঝে তা ভুল প্রমাণিত হতো। যখন নিশি আমাকে আরিফ ভাইয়া বলে ডাকতো।
তখন আমার খুব রাগ হতো। মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করতো আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভালোবাসার মানুষটির কাছ থেকে ভাইয়া ডাক শুনার পর মনে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, তুমি কি তা বুঝো। বলতে পারিনা সেগুলো কথা।না বলায় থেকে যায় আমার হৃদয়ের অন্তরালে। এভাবে আরো অনেকদিন কেটে যায়।আর কয়েকমাস পর আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে।আর নিশিও ভার্সিটিতে পদার্পন করে।আর বেশ কিছু দিন পর চলে যেতে হবে আমাকে এই শহর ছেড়ে।বেশ কয়েকদিন আমি আমার মা মরিয়ম বেগমের কাছে থাকি। তিনি অসুস্থ ছিলেন। যেদিন ভার্সিটিতে আসি সেদিন আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো নিশি কে একনজর দেখার। মনে কিরকম এক বিদ্রোহ শুরু করে দেয় সেই মায়াময় মুখটা দেখার।আর তাই আমি সেদিন ভার্সিটিতে না গিয়ে নিশির ভার্সিটির সামনে যাই নিশি কে দেখতে।
ভার্সিটি ছুটির পর দেখি নিশি তার বান্ধবীদের সাথে আসছে। হটাৎ করে আমার মন আবার বিদ্রোহ শুরু করে নিশির সাথে কথা বলতে। আমি ও আর কিছু না ভেবে নিশির সাথে কথা বলতে তার সামনে যাই।নিশি আমাকে দেখে বেশ অবাক হলো।বেশ কিছুক্ষণ নিশির সাথে আমার কথা চললো। কিন্তু হঠাৎ করে কোথা থেকে আবির এসে আমাকে মারতে শুরু করলো।আমিসহ ক্যাম্পাসের সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আবির শুধু একা নয় তার সাথে আরো কিছু ছেলে ছিলো তারা আমাকে মারতে শুরু করলো। আমি কিছুই করতে পাচ্ছিলাম না। এতোগুলো মানুষের সাথে আমার পেরে উঠার কথা না। যখন আমার জ্ঞান ফিরলো তখন আমি নিজেকে হসপিটালে আবিষ্কার করি। আমার কিছুই মনে পড়ছে না আবির আমার সাথে এরকম কেনো করলো।
শুধু শেষ একটা কথা কানে বাজছে “তোকে আমি আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ভাবতাম আর তুই কিনা আমার আদরের বোনের দিকে হাত বাড়ালি !” বেশবেশ কিছুদিন এভাবে হসপিটালে ছিলাম।হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ ছিলো। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলাম। কয়েকদিন পর ভার্সিটিতে যখন আমি প্রবেশ করবো তখন হঠাৎ করে আবির সামনে এসে দাঁড়ালো। আমাকে আপাদমস্তক ভালো করে দেখলো।আর বললো “নিজেকে কখনো ভেবে দেখেছিস?তোর তো মা-বাবা কেউ নেই।সবাই তো তোকে ছেড়ে চলে গেছে।কি আছে তোর?আর তুই কিনা আমার কলিজার বোন নিশি কে নিয়ে স্বপ্ন দেখিস?তোর মনে বাঁধে না?” আবিরের এই কথা আমার মনে আঘাত করে। ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে।
আবিরের কাছ থেকে আমি এই কথা কোনদিন আশা করেনি।আসলেই মানুষ যতোই প্রিয় হোক না কেনো দুর্বল জিনিসে সবাই আঘাত করলে যতোটা কষ্ট হয় তার থেকে বেশি কষ্ট হয় কাছের মানুষের কাছ থেকে আঘাতটা। হৃদয় চুরমার হয়ে যায়। এরপর আমি ভাবতে থাকি আমার উচিত নয় নিশিকে নিয়ে ভাবা।আবির তো ঠিক কথায় বলেছে নিশি আমাকে কেনো ভালো বাসবে?আমার অতীত সম্পর্কে জেনে নিশির মতো একটি সুন্দরী মেয়ে কখনো মেনে নিবে না। কিন্তু আমার মন তবুও বাঁধা মানে না।নিশি কে তবুও দেখতে চায়।এরপর একমাস আমি নিশি কে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছি। কিন্তু আমার মনে একটা প্রশ্ন ঠিকই জাগতো নিশি কি আমায় নিয়ে ভাবে?এর উত্তর আমাকে রাতে ঘুমাতে দেয় না।
মনে হয় নিশি যদি আমার হয় তবে পৃথিবীটা আমার করে পাবো। কিন্তু এর উত্তর আমি পাইনা।তাই একদিন নিশির সামনে আবার যাই আমি আমার এই প্রশ্নের উত্তর জানতে। কিন্তু নিশি সেদিন কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। শুধু বলে,,”আপনি আমাকে নিয়ে যে ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখছেন তা কখনো বাস্তবে রূপান্তরিত হবে না।কি লাভ এই মিথ্যে স্বপ্ন গুলো দেখে ?”আমি নিশি কে বলতে পারিনা। আমার স্বপ্নের মাঝে যে শুধু তুমি আছো। আমি না চাইলেও আমার মন শুধু তোমাকে নিয়ে সেই ধূসর ভয়ঙ্কর স্বপ্নগুলো দেখে। আমি কি করবো? এভাবে বেশ কয়েকবার আমি আমার উত্তর নিশির কাছে জানাতে যাই। কিন্তু নিশি আমাকে অগ্রাহ্য করে। আমি তাকে বুঝাতে পারিনা আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।
চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে ভালোবাসি নিশি খুব ভালোবাসি।বলা হয় না।নিশির কোনো রকম আগ্রহ দেখায় না। আমার কষ্ট হয়। খুব কষ্ট হয়। এরপর বেশকিছু দিন যখন আমি নিশির কাছ থেকে কোনো উত্তর পাইনা একদিন নিশির বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। মনে কেনো যেনো সাহসটা আসে জানি না। অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি।আর আমাকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে একটু পর আবির আসে। আবার আমাকে মারে। অনেক মারে।শেষে পুলিশ এসে আমাকে নিয়ে যায় ইভটিজার হিসেবে। আমার এই কষ্ট দেখতে নিশি আসেনি সেদিন। এরপর আমাকে আমার মা মরিয়ম বেগম তার কাছে নিয়ে যায়।বেশ কিছু দিন তার কাছে থাকি। তিনি আমাকে বুঝান।তার মাধ্যমে আমি আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করি। ভার্সিটিতে আবার আসি ফাইনাল পরীক্ষা দিতে। পরীক্ষা শেষে হারিয়ে যাই এই শহর থেকে।
নিশির প্রতি এক বিষাদময় ভালোবাসা নিয়ে হারিয়ে যাই বহুদূরে।এর পর কুমিল্লায় একটা চাকরি করি দু’বছর বছর। কিন্তু হঠাৎ করে চাকরি বদলি হয়ে আমাকে আবার এই চট্টগ্রাম শহরে নিয়ে আসে।আর এর মাঝে আমার পালিত মা আমাকে ছেড়ে চলে যায় স্বার্থপরের মতো দূরদেশের তাঁরা হয়ে। আমি আবার একা হয়ে যাই।আর এখানে গত তিনমাস এসেছি।এই শহর আবিরের শহর থেকে দূরে হলেও ভাগ্যক্রমে আবার তাদের সামনে হাজির করায়। জীবনটা সত্যি খুব অদ্ভুত। আজ দুদিন পর আবার সেই হসপিটালে আসলাম। খুব ইচ্ছে করছিলো নিশি কে আরেকটি নজর দেখার।তাই আসা।অবশ্য অন্য কারণ আছে।সেদিন যে মহিলাকে রক্ত দিয়েছিলাম তার সাথে দেখা করতে এসেছি। তিনি নাকি আমাকে দেখতে চান। হসপিটালে তিনতলায় পা রাখতেই শাহেদের সাথে দেখা।সে আমাকে ওই মহিলার রুমটার দিকে নিয়ে গেলো। আমি রুমে প্রবেশ করে অবাক হলাম।
শুধু অবাক নয়।বেশ অবাক হলাম।ইনি আর কেউ না। আমার জন্মদাত্রী মা।যিনি নিজের স্বার্থের জন্য আমাকে ছেড়ে চলে গেছিলো। আমাকে দেখে তিনি ইশারায় আমাকে তার দিকে ডাকলেন। আমি কিছু না ভেবে তার দিকে গেলাম। তিনি আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। একটু পর বললেন , “তোমাকে দেখে আমার কেনো জানি খুব চেনা চেনা লাগছে? তোমাকে কি এর আগে আমি কখনো দেখেছি?” আমি ওনার কথায় কি বলবো বুঝতে পারছি না। তিনি হয়তো আমাকে চিনতে পারছে না। কিন্তু আমি ঠিকই চিনতে পারছি। কলেজ লাইফে একবার চুপিসারে তাকে আমি দেখতে গেয়েছিলাম।আজও তার একটা ছবি আমার মানিব্যাগের মধ্যে রয়েছে। আমি এতো দিন তা যত্ন করে রেখেছি। তিনি আবার বললেন, “তোমাকে দেখে আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে তুমি আমার খুব কাছের কেউ? কেনো এমন হচ্ছে বলো তো?”আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। আমি বললাম, “আপনি এখন কেমন আছেন?
মহিলা মাথা নেড়ে বুঝালো ভালো আছেন।মহিলা আমার কথায় কি মনে করলো আমি জানি না। কিন্তু আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে এসব কথা বলতে। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছ পালিয়ে যেতে। হটাৎ করে তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে চাইলেন আমি সোজা উঠে দাঁড়ালাম।আর একপ্রকার দৌড়ে চলে আসলাম রুম থেকে। চোখে যে অশ্রু জল ঝরে পড়ছে। লুকাতে পারছি না।আমার কেনো যেনো খুব ইচ্ছে করছিলো তার হাতের ছোঁয়া পেয়ে। কিন্তু আমার মনের অভিমান কি এতোই সস্তা। আমি পারবো না তাকে মা বলে ডাকতে। আমি ঘৃণা করি স্বার্থপর মানুষদের। আমি হসপিটালে চেয়ারে বেশ কিছু ক্ষণ বসে রইলাম। দাঁতে দাঁত চেপে কান্না লুকাতে লাগলাম। হটাৎ করে নিশি আমার পাশে বসলো। আমি অবাক হয়ে তাকালাম। নিশি বললো,,
-“কাদছেন কেনো?” আমি চুপ করে থাকি। কিছু বলতে পারিনা। চোখে জল মুছে বলি,,
-“জানো মানুষগুলো খুব স্বার্থপর।তারা শুধু নিজেরটাই বুঝে। নিজের স্বার্থের কথা ভাবে। খুব খারাপ তারা। খুব খারাপ।“
-“হটাৎ এই সব কথা কেনো বলছেন?”
-“অনেকদিন পর আমার জন্মদাত্রী মাকে দেখলাম।যিনি আমাকে একা ফেলে অন্যের হাত ধরে ছেড়ে চলে গেছিলো তার নিজের স্বার্থের জন্য।আর আজ এতো বছর পর তার সাথে দেখা।তাও কেমন করে জানো? আমি তাকে রক্ত দিয়েছি।তাকে নিজের রক্ত দিয়েছি। তিনি জন্ম দিয়ে আমাকে যে কষ্ট করেছিলেন তার কিছুটা ঋণ আমি হয়তো আজ পূরণ করতে পেরেছি।“ নিশি আমার কথায় বেশ কিছু ক্ষণ চুপ করে রইলো। বললো,,
-“তো আপনার মা আপনাকে চিনতে পারেনি? আপনি বলেননি যে আপনি তার সন্তান?”
-“না তিনি আমাকে না চিনতে পারেনি। আমি পেরেছি।
আমি বলি নাই তাকে।জানো আমার খুব ইচ্ছে করছিলো তার হাতের ছোঁয়া পেয়ে কিন্তু এতো বছরের অভিমান কি এতোই সস্তা?আমার তাকে মা বলে ডাকতে ইচ্ছে হয় না। ঘৃণা হয়।” নিশি আমার কথায় কিছু বললো না। চুপ করে রইলো। আমি ও বেশ কিছু ক্ষণ চুপ করে রইলাম। এরপর নিশি বললো,,
-“আসলেই মানুষ খুব স্বার্থপর।দেখেন না আমিও আমার স্বার্থের কথা ভেবে আপনাকে কষ্ট দিয়েছি। আপনার ভালোবাসাকে অবহেলা করে আপনার কাছে স্বার্থপর হয়ে গেছি। আমিও আপনার কাছে স্বার্থপরের মতন একজন তাই না?” আমি নিশির এই কথায় কিছু বলি না। চুপ করে থাকি।নিশি আবার বলে,,
-“জানেন আমি কখনো আপনার কথা কাউকে বলিনি। আপনি যে আমাকে আগে থেকেই ভালোবাসতেন তা আমি বুঝতাম কিন্তু কখনো তা কাউকে বুঝতে দেয়নি।। কিন্তু আমার ভাই কেমন করে যেনো জেনে যায়। আর তারপরে এই অবস্থা সৃষ্টি হয়। বিশ্বাস করুন আমি এগুলো কিছু চাইনি। কিন্তু আমার ভাই যেদিন আপনাকে আবার মারলো সেদিন আমি ঘরে বন্দি ছিলাম। আমি যে আপনার প্রতি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম সেজন্য আমাকে বন্ধী করে রেখেছিলো।আর তারপরে আমি আপনাকে বলতে পারিনি যে ধীরে ধীরে আপনার প্রতিও আমার ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে। আপনার ভয়ঙ্কর স্বপ্নগুলো কে আমার করে নিতে চাইছি।“ আমি নিশির কথায় বেশ অবাক হলাম।দেখি নিশি চোখের জল মুছছে।নিশি ভাঙ্গা গলায় বললো,,
-“আর এই ভয়ঙ্কর সাদাকালো স্বপ্নগুলো কখনো রঙিন হবে না।কারণ আমি চাইলে তা কোনোদিন হবে না। আমার ভাইকে আমি খুব ভালোবাসি।তার কথা আমাকে মেনে নিতে হবে।বাবা মারা যাবার পর এই ভাই আমাকে নিজ হাতে মানুষ করেছে।আর তাই আপনাকে আজ সব কথা বললাম।পারলে আমাকে ক্ষমা করবেন।“ এই বলে নিশি উঠে চলে গেলো। আমি বেশ কিছুক্ষণ নিশির যাওয়ার পানে চেয়ে রইলাম।আর ভাবতে লাগলাম। আমার সাথে কেনো এমন হয়? কেনো আমি পারিনা আমার কাছের মানুষের পাশে থাকতে? আমি কি এতোই হতভাগা। আবিরকে আমি একটা খাম ধরিয়ে দিলাম। আবির আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হয়তো জানতে চাচ্ছে কি এটা?আমি বললাম,,
-“কাল সকালে একটি অফিসে তোর চাকরির ইন্টারভিউ। গিয়ে শুধু এই খামটা দিবি।তবেই তোর চাকরি নিশ্চিত !”
আবির কিছু বলছে না। চুপ করে রইলো। আমি বললাম,,
-“তোর হয়তো বা ভালো বন্ধু হয়ে থাকতে পারিনি।তোর কাছে বেইমান ঠিকই হয়েছি। কিন্তু তোর খারাপ সময়ে পাশে দাঁড়াবো না।এতটা খারাপ আমি নই। ভালো থাকিস।“ এই বলেই আমি চলে আসতে লাগলাম। হটাৎ করে কি যেনো আবার মনে করে পেছন ফিরে তাকালাম। আবিরকে বললাম,,
-“আমি খুব হতাভাগা। খুব খুব।আমি আমার প্রিয় মানুষগুলোকে কাছে পেয়েও কেনো যেনো হারিয়ে ফেলি।পালিত মা কে গত দু’বছর আগে হারালাম।আর কাল আমি আমার জন্মদাত্রী মাকে দেখলাম। কিন্তু দেখ কাছে পেয়েও আজ তিনি আমার থেকে কতদূর।আর একই ভাবে তোকেও হারিয়েছি অনেক আগে। সাথে আমার জীবনের সাথে অন্য একজনকে। আমার আক্ষেপ নেই কোনো। শুধু একটাই আফসোস।কারোও ভালোবাসায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারলাম না।সবাই স্বার্থপরের মতো দূরে চলে গেলো।“ এই বলেই আমি চলে আসি।আর কিছু বলতে পারিনা। মনে কষ্ট হয়। খুব কষ্ট হয়। কাছের মানুষ হারানোর কষ্ট।এই কষ্টের কোনো ঔষধ নেই। শুধু আছে বেদনা। বিষাদময় বেদনা।
রাস্তার ফুটপাত দিয়ে এলোমেলো ভাবে এই দুপুরে হেঁটে চলেছি।মনে হয় আজ আকাশেরও আমার মতো মন খারাপ।তাই সে আজ তার বুকে কালো মেঘ জমেছে। বর্ষণ হবে অজর ধারায়। ধুয়ে মুছে দিবে তার মনের সব দুঃখ-গ্লাণি। আকাশের মতো যদি আমার মনটাও এমন পরিষ্কার হতে পারতো নিজেকে খুব হালকা মনে হতো। কিন্তু তা কখনো সম্ভব নয়।যতই মন থেকে নিজের দুঃখকে মুছতে চাই ততোই তার হৃদয়ের মাঝে স্থান করে নেয়। কাল যখন আবিরকে চাকরির চিঠিটা দিয়ে চলে আসছিলাম তখন মনে শুধু একটা কথা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিলো। নিশির সেই কথাগুলো। এতো দিন ভাবতাম নিশি হয়তো আমাকে পছন্দ করে না। কিন্তু নিশিও যে আমাকে তার মনের অন্তরালে পুষে রেখেছে তা আমি জেনে খুব অবাক হয়েছি।
এরপর নিশির সাথে আমার কেনো যেনো আবার দেখা করতে মন চাইছিলো। কিন্তু এটা হয়তো সম্ভব নয়। আবিরকে সাহায্য করেছি এর বিনিময়ে যদি আবার তার মনে দুঃখ দেই তবে এটা হয়তো আমার জন্য খুবই হতাশাজনক কিছু হবে।ভাবছি হারিয়ে যাবো এই শহর থেকে। কিছুদিন পর হারিয়ে যাবো।এসব ভাবতে ভাবতে চোখে দিয়ে জল পড়তে শুরু করে। কিন্তু এখনো আকাশের বর্ষণ হয় না। কেনো হয় না?তবে কি আমার দুঃখ আকাশের থেকে বেশি।এসব ভাবতে ভাবতে যখন আমি অজানায় হেঁটে চলেছি কোথাও যাচ্ছি আমি নিজেও জানি না তখন আকাশ কান্না করতে শুরু করলো।হয়তো সে আর অভিমান ধরে রাখতে পারেনি। টুপটাপ করে বৃষ্টি।এই বৃষ্টিতে আমার কেনো যেনো একটা গান খুব মন পড়ছে।
“বৃষ্টি নেমেছে আজ আকাশ ভেঙ্গে হাটছি আমি মেঠোপথে মনের ক্যানভাসে ভাসছে তোমার ছবি বহুদিন তোমায় দেখি না যে তোমায় নিয়ে কত স্বপ্ন আজ কোথায় হারায় পুরোনো সেই গানটার সুর আজ মোরে কাঁদায় তুমি তো দিয়েছিলে মনে কৃষ্ণচূড়া ফুল আমি তো বসেছিলাম নিয়ে সেই গানের সুর তুমি দিয়েছিলে মনে কৃষ্ণচূড়া ফুল চলে গেছো কোথায় আমায় ফেলে বহুদূর !!!” হটাৎ করে আমার মাথায় উপর কে যেনো ছাতা ধরলো। আমি অবাক হলাম। শুধু অবাক নয় ভীষণ অবাক হলাম।নিশি !নিশি আমার পাশে হেঁটে চলেছে।আর ছাতাটি সেই ধরেছে। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই নিশি বললো “জানেন আপনি খুব বোকা একটা মানুষ ! আপনি আমাকে একবার বলতে পারলেন না চলো নিশি আমরা পালিয়ে যাই এই শহর ছেড়ে নতুন এক শহরে।যে নতুন শহরে শুধু তোমার আমার ভালবাসা দিয়ে আমাদের ধূসর স্বপ্নগুলো রঙিন করে তুলবো।“ আমি নিশির এই কথার প্রত্যুত্তরে কি বলবো বুঝতে পারি না। আসলে আমি মানুষটা খুব বোকা।
তা না হলে আমি এতো কষ্ট কেনো নিজের ভেতরে রেখে ধুঁকে ধুঁকে মরছি। আমি কেনো নিজের ভেতরে কাব্যগুলোকে নিয়ে স্বপ্ন আকার অদম্য চেষ্টা করিনা। আমি চুপ করে থাকি। হটাৎ করে আমার ফোনে একটা মেসেজ আসে। আমি মেসেজটা দেখে অবাক হয় আবিরের নাম্বার থেকে এসেছে। আবির লিখেছে “আমরা মানুষগুলো আসলেই খুব স্বার্থপর।দেখোস না আমি এতো বছর তোকে এতো কষ্ট দেওয়ার পরেও তুই ঠিকই স্বার্থের মতো তোর চাকরিটা আমাকে দিয়ে দিলি।ভেবেছিলি এই কাজ করে তুই খুব মহান হয়ে যাবি।কচু হবি। পালিয়ে যাবি ভেবেছিলি কিন্তু আমি তা কখনো হতে দিবো না। তোকে আবার কষ্ট দিবো।তোর এই স্বার্থপরতার জন্য একমাত্র শাস্তি হচ্ছে আমার বোনকে নিজের করে নেওয়া।এতো দিন আমি তোদের দুজনের সাথে খুব খারাপ করেছি।আমিও তো দেখেছি নিশির ডায়রির পাতায় শুধু তুই। এতো দিন আমি ভুল ছিলাম। আমার ভুলের শাস্তি তুই আমার বোনকে দিস না। বেঁধে রাখিস তোর অন্তরালে।“
আমি এই কথাগুলো পড়ে কি করবো বুঝতে পারছি না। চোখের জল আরো জোরে পড়ছে। মুছতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু হঠাৎ করে নিশি আমার চোখের জল মুছে দিলো তার নরম হাতের আঙ্গুলের পরশে।আর বললো, “ আপনার না খুব ইচ্ছা ছিলো বৃষ্টিতে প্রিয় মানুষটার হাত ধরে হাঁটার।আজ আমাকে আপনার প্রিয় মানুষ ভেবে হাঁটবেন। আমি আপনার সাথে হারিয়ে যাবো অজানায়।“আমি কিছু বলতে পারি না। মনের ভেতর কেমন যেনো একটা শান্তি বয়ে যাচ্ছে নিশির হাতের ছোঁয়া পেয়ে।নিশি আমার কথায় উত্তর না পেয়ে হাতের ছাতাটা বন্ধ করে আমার হাত শক্ত করে ধরলো।আর হাঁটতে লাগলো। ভিজতে লাগলাম বৃষ্টিতে। আমি ও তার সাথে হাঁটতে লাগলাম।সেই বেলাশেষে ভালোবাসাকে নিজের করে পেয়ে….
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত