লোভ

লোভ
‘শশুর বাড়ির একই মাংস আর ভালো লাগেনা শীলা’। ডাইনিংয়ে মাংসভুনা আর ছিটরুটি রাখতে আসা শ্যালিকা শীলাকে লক্ষ্য করে বললো দুলাভাই মামুন। শীলা মামুনের ছোট শ্যালিকা। বয়স পনেরো। এবছর ক্লাশ নাইনে পড়ছে। শীলারা তিনবোন, শীলা, নীলা, নীলু। নীলা এবার ইন্টারে পড়ছে। মামুনের বউ নীলু।
মামুনের শশুর মারা গেছেন পাঁচ বছর হলো। তখন থেকে মামুনই ওদের অভিবাবক, দুই শ্যালিকা আর বিধবা শাশুড়ির সংসার মামুনকেই চালাতে হয়। নীলুর বিয়ে হয়েছে আট বছর হলো, ওদের ছেলেসন্তানের নাম অয়ন, বয়স পাঁচ। ‘এইভাবেই করা মাংসই তো পছন্দ করতেন দুলাভাই!’ একটু বিস্মিত হয়েই জিজ্ঞেস করে শীলা। ‘পুরানো মাংস আর কতো ভালো লাগে কও’- হাসি দিয়ে বলে মামুন। হাসির শব্দটা শুনে চোখ তুলে মামুনের দিকে তাকাতেই জমে হিম হয়ে যায় শীলা। মামুন খুব তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শীলার শরীরের দিকে।
বয়েস পনেরো হলেও এরকম হাসি, কথা আর দৃষ্টির মানে জানে শীলা। মামুন যখন এ বাড়িতে আসে জামাই হয়ে তখন শীলার বয়স নেহায়েতই কম আট বছর। ইদানিং একটু বড় হয়াতে অনেক হেঁয়ালি করে মামুন, শ্যালিকার প্রতি হেঁয়ালি দুষ্টামি এরকম মনে করেই মনে বরং শিলার আলাপ করতে ভালই লাগতো। কিন্তু আজকে মামুনের কথা ও দৃষ্টি দুটোই এতো নোংরা ছিলো যে শীলা চোখের পানি থামাতে পারলোনা। শিলার চেহারা দেখে কিছু একটা আঁচ করে রুমে পড়তে থাকা বড়বোন নীলা। কি রে! কি হয়েছে? বলবেনা বলবেনা ভেবে গোটা ব্যাপারটা নীলাকে খুলে বলে শিলা। বই বন্ধ করে ডাইনিংয়ের দিকে এগিয়ে যায় নীলা৷
‘কি ব্যাপার মামুন ভাই, আপনার নাকি এরকম করে রান্না করা মাংস পছন্দ না? তা কি একটা ডিম করে দেবো, দিই? পত্রিকা পড়েছেন নাকি আজকের? শুনলাম আজকাল নাকি পুলিশেও ডিম দেয়া শুরু করছে? মামুন একটু সতর্ক হয়ে যায়। নীলা খুব ডানপিটে ধরনের। নীলুর বেশ কবছর যাবত শরীর খারাপ যাচ্ছে। বাচ্চা হবার পর থেকেই নীলুর শরীর ভাংগনের দিকে। মামুনের ইচ্ছা ছিলো এবার শিলাকে কিছুদিনের জন্য নিয়ে মামুনের বাসায় রাখবে। সম্ভবত এবার শাশুড়ি শিলাকে দিতে চাইলেও নীলা মানা করবে। ‘মা কোথায়, মা কে ডাকো একসাথে খাই, তুমি বসো শিলাকেও ডাকো’- খুব স্বাভাবিক ভংগিতেই বলে মামুন। মামুনের কথার ধরনে নীলার একবার মনে হলো শীলাটা ভুল বুঝে নাই তো? কিন্তু এরকম মনে না হওয়ার কারন ইদানিং মামুন ডাবল মিনিংয়ের কথা নীলার সাথেও বলেছে কয়েকবার।
মামুনের আচার ব্যবহার মামুনের শাশুড়ির খুব বেশি পছন্দ না হলেও মামুনের করা সহায়তার কারনে উনি দুই মেয়েকে নিয়ে চলতে পারছেন এই ভাবনাটা সবসময়ই উনাকে একটু ভীত করে রাখে। নীলার সাথে করা দুই একটা ফাইজলামি আচরনের মাঝে একটু অন্যরকম গন্ধ মনে হওয়াতে নীলাকে এখন আর মামুনের সামনে যেতে দেননা শাশুড়ি মালিহা বেগম। যদিও নীলাকে এটা বুঝতে দেননি। জামাই হিসেবে যত্নয়াত্তি যা করার তিনি নিজেই করেন অথবা শিলাকে দিয়ে করান। শিলা ছোট বাচ্চা, তাই কিছুটা নিশ্চিন্ত থাকেন। মামুনের স্বভাব এরকম ছিলোনা৷ গত তিনবছর যাবত মামুন ব্যবসায় খুব ভালো করছে, পয়সাপাতি হচ্ছে, পয়সা হবার সাথে সাথে স্বভাবে পরিবর্তন এসেছে মামুনের।
বাচ্চা জন্মানোর সময় নীলুর কিছু জটিলতা হয়েছে, সেই জটিলতা কাটাতে নীলুর জড়ায়ু ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। অয়নের জন্মের পর টাকাপয়সা টানাটানির কারনে নীলুই মামুনকে ব্যবসার পরামর্শ দিয়েছিলো। নীলু জানতো ব্যবসার ধরনটা ভালো মানুষের নয়, কিন্তু কাঁচা টাক আর নিজের দুইবোন ও মাকে নিয়ে ওই সংসার চালাতে মামুনের খুব টানাটানি পড়ে যাওয়াতে নীলু নিজেই জোর করে মামুনকে। এতে করে মামুনের পয়সা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু স্বভাবে বিশেষ বাজে পরিবর্তন এসে গেছে। নীলু যে আর দ্বিতীয় সন্তান দিতে পারবেনা আর একসন্তানে মামুনের হবেনা – এ কথা নীলুকে প্রায়ই স্মরণ করিয়ে দেয়, নীলুর মায়ের সংসারের খরচ চালানোর খোটাও দেয়। নীলু একথাগুলো তার বোন বা মা কাউকেই কিছু বলেনি। তার খুব ইচ্ছা কোনভাবে নীলাটা ইন্টার পাশ করে গেলেই মামুনকে সে ছেড়ে দেবে, তখন নিশ্চয়ই কিছু একটা করে সংসার চালানোর কথা ভাবতে পারবে তিন বোন আর মা। সমস্যা কেবল নীলুর সন্তান অয়নকে নিয়ে, সে তার বাবার স্নেহ হারাবে।
নীলু সরাসরি কিছু না বললেও মালিহা বেগম আঁচ করতে পেরেছেন। ভয়ে তার বুক শুকিয়ে গেছে নীলু যদি মামুনকে ছেড়ে চলে আসে তবে তিন মেয়েকে নিয়ে কোথায় দাড়াবেন তিনি? ভয়ে মালিহা বেগমের নামাজ বেড়ে গেছে, একইসাথে বেড়ে গেছে জামাই মামুনের প্রতি লোক দেখানো দরদ। মালিহা বেগম জানেন মামুনের ইনকাম কোন পথে হয় তবুও সে নিয়ে কোন কিছু ঘাটান নাই। এতো ঘাটাঘাটির মধ্যে তিনি নাই, তিনি আছেন সংসার নিয়া যন্ত্রণায়।
তবু মাঝেমধ্যে মালিহা বেগমের মনে হয়- মামুন যদি অভাবেই থাকতো, যদি কাঁচা টাকার যোগান না থাকতো, নীলু যদি এই ব্যবসার ধরন জানার পরেও মামুনকে এই ব্যবসায় ঢুকানোর জন্য জেদ না ধরতো তবেই বুঝি ভালো হতো। অভাব থাকলেও এতো শংকার মধ্যে থাকতে হতো না। মামুনের স্বভাবও খারাপ হতো না। শিলাকে ব্যাগ গুছাতে বলে মালিহা বেগম নফল নামাজে বসলেন – হে পরওয়ারদিগার, আপনি আমাদেরকে রক্ষা করেন। আমাদের পথ দেখান। শেষ মূহুর্তে মালিহা বেগম শীলাকে না দিয়ে নীলাকে যেতে বললো মামুনের সাথে। নীলুর স্বাস্থ্য খারাপ যাচ্ছে, দেখভালের জন্য মানুষ দরকার।
গোটা রাস্তা মামুন কোন ধরনের এলোমেলো কথা বললোনা। কেবল বললো- ‘তোমার আপার স্বাস্থ্য খুব খারাপ যাচ্ছে আমিও ব্যস্ততায় খেয়াল রাখতে পারিনা। তাই ভাবতেছিলাম তুমি আমাদের বাসায় থাইক্যা গেলেই তুমি তোমার আপা আর আমার দুইজনেরই একটু খেয়াল রাখতে পারতা।’ নীলা একটু মজা ও আন্তরিক সুরেই জিজ্ঞেস করলো – আপনার কি ধরনের খেয়াল রাখতে হবে মামুন ভাই? মামুন হাসলো, নীলাকে ঠিক বুঝা যাচ্ছেনা। ‘তোমার আপাকে খেয়াল রাখলেই আমারে খেয়াল রাখা হবে, আমি একটু কাজে মনযোগ দিতে সময় পাই।’ মাঝরাতে নীলার দরজায় শব্দ হলো, ঘুমের ঔষধ খেয়ে নীলু এখন গভীর ঘুমে থাকবার কথা। নীলা বুঝতে পারছেনা দরজাটা তার খোলা উচিত হবে কি হবেনা? তীক্ষ্মস্বরে সে জিজ্ঞেস করলো- কে? ফিসফিস স্বরে ওপাশ থেকে নীলুর জবাব এলো। নীলু থরথর করে কাঁপছে দরজার সামনে আর তার হাতে একটা ব্যাগভর্তি কেবল টাকা। কি করেছিস আপা?
তোর দুলাভাইকে দুধের সাথে আমার ঘুমের ঔশুধটা খাইয়ে দিছি। এইটাকার ব্যাগটাতে তোর দুলাভাইয়ের পাঁচলাখ টাকা আর বেশ কিছু গহনা আছে, এগুলো নিয়ে তোর দুলাভাইকে ছেড়ে এখন ভেগে গেলে আমরা তিনবোন কিছু একটা দাড় করিয়ে ফেলতে পারবোনা নীলু? কি বলিস তুই? নীলা জবাব দেয়না৷ আমি আর পারছিনা রে নীলু। রোজ রাতেই তোর দুলাভাই ড্রিংক্স করে আর মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি সেড়ে বাড়ি ফিরে। নীলা টাকার ব্যাগটা পাশে রেখে বোনকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে – ‘আপা, মামুন ভাইকে এই ব্যবসাটাতে কেনো নামতে বাধ্য করছিলি? গরীব থাকলেও তখন কি এরকম ভয়ে ভয়ে কাটাতি বল? মামুন ভাইও কি এমন পাজী ছিলো?’ নীলু জবাব দেয়না, ঢুকরে কেঁদে উঠে। পাশের ঘর থেকে মামুনের নাক ডাকার শব্দ ভেসে আসে। দুই বোন জড়াজড়ি করে কাঁদতে থাকে।
নীলু জানে নীলা খুব ভুল কিছু বলেনি, কিন্তু তবুও কোথায় যেনো তার নিজেকে ডিফেন্ড করতে ইচ্ছা করে। নীলাকে কান্নাস্বরে বলতে থাকে- ‘ মামুন কেনো নিজে নষ্ট হলো? আমি তো কেবল ড্রাগসের ব্যবসাটা মামুন করুক এই চেয়েছি। ব্যবসা করতে এসে মামুন নিজেই ড্রাগে আর নারীতে অভ্যস্ত হোক এটা তো চাইনি।’ নীলুর হাতের বাঁধন থেকে আস্তে করে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় নীলা- নীলুটাও নষ্ট হয়ে গেছে মামুন ভাইয়ের সাথে সাথে। কিংবা কে জানে নষ্ট হয়তো আগেও ছিলো, নিজের বোন তাই হয়তো নীলুর ভিতরের লোভটাকে কখনো চোখে পড়েনি।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত