ঘড়িতে দশটা বেজে ত্রিশ মিনিট।এই সকাল বেলাতেও আজ বেশ গরম পড়েছে।রোদ পড়েছে প্রখর ভাবে।জায়েদ শার্টের হাতা দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে রিক্সা থেকে নামলো।ইচ্ছে ছিল হেটে আসবে।কিন্তু এই গরমে হেটে আসার কোন মানেই হয় না।এই গরমে হাটবে পাগল প্রকৃতির লোক।অথবা যার পকেটে রিক্সা ভাড়া নেই।জায়েদ এ দুটোর একটাও না। জায়েদকে দেখে অফিসের গেইটে দাড়ানো রফিক মিয়ার মুখে হাসি ফুটে ওঠে।লোকটা জায়েদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
-স্যার,এতদিন পর।কোই ছিলেন?
রফিক মিয়ার কথায় জায়েদ কিছু বলে না।মুচকি হাসে।জায়েদকে এই লোকটা প্রচন্ড রকমের শ্রদ্ধা করে।ভালবাসে।অবশ্য তারও একটা কারন আছে। এই রঙিন দুনিয়ায় শুধু শুধু কেও কাউকে ভালবাসে না।ভালবাসা পেতেও কিছু করতে হয়।জায়েদও তেমন কিছু একটাই করেছিল রফিক মিয়ার মেয়ের বিয়েতে।জায়েদ রফিক মিয়ার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
-আপনার বড় স্যার এসেছেন?
-জ্বী স্যার,অনেক আগেই।
জায়েদ আর দাড়ায় না।এই অফিস জায়েদের বেশ পরিচিত।তবে আজ অফিসের লোকদের তাকানোটাই বলে দিচ্ছে হু আর ইউ?জায়েদ এসবে লক্ষ করে না। শফিক সাহেব জায়েদের দিকে আবারও তাকালেন।কেমন শান্ত ভাবেই বসে আছে।নির্বিকার।মনে হচ্ছে এত দিন অফিসে না আসাটা তার জন্যে বেশ স্বাভাবিক ব্যাপার।অবশ্য জায়েদ যে কোন পরিস্থিতিতেই স্বাভাবিক থাকার এক অদ্ভুত ক্ষমতা রাখে।শফিক সেটা বুঝেছিল তার বিয়ের দিন। বোনের বিয়েতে অন্যসবার যে ব্যাস্ততা ভাব থাকে জায়েদের মাঝে সেরকম কিছু দেখা যায়নি।সারাদিন তাকে খুজেই পাওয়া গেলো না।সে যখন আসলো তখন সন্ধা গড়িয়ে প্রায় রাত হয়ে গেছে।এতক্ষন কোই ছিল কেও জানেনা।তার সহজ উত্তর, “কাজ ছিল”। জায়েদকে দেখে মিতু যখন জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিল তখনও শফিক জায়েদের চোখে কোন পানি দেখতে পায়নি।এর রহস্যা শফিকের আজও অজানা।জায়েদ কিছুটা চুপ থেকে বললো,
-আমি চাকরিটা আর করতে চাচ্ছি না। শফিক ভ্রু কুচকে বললো,
-কেন?
জায়েদ কিছু বললো না।চুপ করেই রইলো।তার কিছু বলতেও ইচ্ছে করছে না।সে আজ এখানে আসতো ও না।ইচ্ছে ছিল না।এসেছে মিতুর জন্যে।বোনের কথা সে ফেলতে পারেনি।গতরাতে ফোনটা ধরতেই মিতুর প্রথম প্রশ্ন ছিল,
-ভাইয়া,অফিসে যাচ্ছিস না কেন?
-শরীরটা ভাল না।আর এ চাকরি টাও করতে চাচ্ছি না।
ভাইয়ের অসুস্থতার কথায় মিতুর মুখটা একটু মলিন হয়ে যায়।এসময় মিতু বাসায় থাকলে অন্তত কিছু একটা করতে পারতো।কিন্তু সেটাও হচ্ছে না।ভাবতেই মিতুর চোখ ভিজে ওঠে।মিতু কাপা গলায় বলে,
-তুই কাল শফিকের সাথে দেখা করবি।যা বলার ওকেই বলবি।আর অফিস থেকে বের হয়ে সোজা আমার এখানে চলে আসবি। জায়েদ আর কথা বাড়ায় না।আচ্ছা বলে ফোনটা রেখে দেয়।এখন একটু ঘুমানো দরকার।গরমে কেমন যেন অস্বস্থি লাগছে।এসময় শাওয়ার নিলে মন্দ হয় না।শীতের দিনে মানুষ পানি গরম করে গোসল করে কিন্তু গরমে কেন ফ্রিজের বরফ ভিজিয়ে গোসল করে না!জায়েদ এসব ভাবতে পারে না।ভাবতে ইচ্ছেও করে না।ফ্রিজ থেকে বরফ বের করে বালতিতে ডুবিয়ে রাখে। জায়েদ একটু চুপ থেকে বলে,
-আপনি হচ্ছেন আমার ছোট বোনের বর।আর আপনার শফিক জায়েদকে থামিয়ে দেয়।আস্তে করে বলে,
-আপনি আবারও আমাকে আপনি করে বলছেন। জায়েদ হাসে।মুচকি হেসে বলে,
-জ্বী এটাই সমস্যা।তোমাকে তুমি করে বললে অফিসের সবাই ভাল চোখে তাকায় না।বসকে তার অফিসের এক কর্মচারী তুমি করে বলবে এটা তারা মোটেই সহ্য করতে পারবে না।তাছাড়া ছোট বোনের জামাইয়ের অফিসে জব করাটা আমার কাছে ভাল দেখায় না। জায়েদের কথায় শফিক কিছু বলে না।চুপ করে থাকে।জায়েদ সাহেবের কথাটা ফেলে দেওয়ার মত নয়।অফিসের বসকে তুমি করে ডাকলে সবাই একটু আড়চোখে তাকাবেই।তবে শফিকের মাথায় এর বিকল্প দিক দেখা দিয়েছে।শফিক আস্তে করে বললো,
-আচ্ছা, তাহলে আপনি আমাদের ফুলতলির অফিসের দায়িত্বটা নিয়ে নেন।সেখানে অন্তত এ ঝামেলা থাকবে না।
জায়েদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলে,
-এসবের আর দরকার নেই।লাগবে না।
শফিক সাহেব জায়েদের কথায় আর কিছু বলে না।এই লোকটাকে এখন কারন জিজ্ঞেস করে লাভ নেই।সে কিছুই বলবে না।তার চেয়ে বাসায় ফোন করা যাক।মিতুকে অন্তত জানানো দরকার। অফিস থেকে বের হয়ে জায়েদ তাপমাত্রা মাপার চেষ্টা করে।সকালের থেকে এখন গরম কিছুটা বেশি।এতক্ষন এসির মধ্যে বসে থেকে বাইরের আবহাওয়া প্রায় ভুলেই গিয়েছিল।জায়েদের হাতে এখন অনেক সময়। সে কি করবে ভাবতে পারে না।অনুদের বাসার দিকে যাওয়া যেতে পারে।কিন্তু ওকে কি এখন পাওয়া যাবে?পাওয়া গেলেও কি অনু আমাকে দেখে আসবে, আমার কাছে।হয়তো আসবে,নয়তো না। মিতুর বাসার দিকে যাওয়া যেতে পারে।বাসার প্রত্যেকটা রুমেই এসি লাগানো।একটা কুল শাওয়ার নিয়ে লম্বা ঘুম দেওয়া যাবে।জায়েদ আর কিছু ভাবে না।হাটা দেয়। এসময় কেমন যেন রিক্সা নিতে ইচ্ছে করছে না।তাহলে কি সকালের ধারনা তার ভুল ছিল।অবশ্য ভুল হতেই পারে।জায়েদের পকেটে রিক্সা ভাড়া আছে।তাহলে কি ও পাগল হয়ে যাচ্ছে!জায়েদ ভাবতে পারে না।অনুর মুখটা ভেসে ওঠে। “জায়েদের সাথে সেদিন ছাতা মাথায় অনু বেশ ঘামছিল।মেয়েটা হাতে রাখা রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বললো,
-তোমার চাকরীর খবর কি?
-এইতো খুজছি।
-সেটা তো আরও বছর খানেক আগে থেকেই শুনছি।
-আরও শুনবে,বছর খানেক।
জায়েদের কথায় অনু আর কিছু বলে না।বলতে পারে না।ওর গলা ধরে আসে।চোখটা ভিজে ওঠে।বাসা থেকে বিয়ের জন্যে ছেলে দেখেছে।শহরে নাকি নিজেদের বাসা আছে কয়েকটা।অবশ্য অনুর এসবে খেয়াল নেই।সে তাকায় জায়েদের দিকে। “অনুর বিয়ে হয়ে যায় হুট করেই।আরও সপ্তাহ খানেক আগে।জায়েদের চাকরীর খবরটা অনু জানতেও পারে না।আবার এখন যে চাকরীটা ছেড়ে দিয়েছে অনু সেটাও জানে না।এতকিছু জানার দরকারও নেই। জায়েদ ঘাম মুছতে মুছতে আবারও হাটা দেয়।বড় বড় পা ফেলে।নির্বিকার ভঙ্গিতে। ভাবলেশহীন ভাবে।ব্যাস্ত শহরের এই ব্যাস্ত রাস্তায়।যার প্রতিটা দেয়ালে আত্বচিৎকারের প্রতিচ্ছবি।এখানে কেও কারও নয়। কেও কারও নয়।
গল্পের বিষয়:
গল্প