“অই নটি বেটি , দীঘিত গোসল করস ক্যান?”
-আম্মা কলে (টিউবওয়েল) পানি নাই। “পানি নাই। বালতিত কইরা পানি লইয়া যাইবি।এইনে গোসল করস ব্যাটাছেলেগোরে শরীল দেখাইতে?নটির ঘরের নটি।”
-কথায় কথায় আমারে নটি কইবেন না।আমি নটি হইতে পারি আমার মা নটি ছিলেন না। “নটির ছেরির বড় গলা।আমি একশ এক বার কমু তোর মা নটি।কি করবি তুই কি করবি?
– আমার মা নটি হইলে আপনেও নটি।আমার বাপেরে ছলেবলে পটাইয়া বিয়া কইরা আমার মায়েরে খেদাইয়া দিসেন। কি কইলি তুই!!!খাড়া তোর বাপরে আইজক্যা কইয়া লই।আমার সাথে তেড়িবেড়িং?তেড়িংবেড়িং এক্কেবারে ছুটাইয়া দিমু।” জরি কিছু বলল না।কারণ সে জানে সৎ মায়ের সংসারে বাবা কাছে সৎ মার কথাটাই মুখ্য।সবার ক্ষেত্রে হয় না কি জরি জানে না।কিন্তু তার পরিবারের ক্ষেত্রে হয়েছে।
একদিন তার বাবা তার এই সৎ মাকে বিয়ে করে আনে।দিন যায় তার মায়ের সঙ্গে এই সৎ মায়ের বিরোধ বাড়তেই থাকে।একদিন বাবা বাড়িতে ছিল না। জরি ছিল স্কুলে। তার মা ঘরে কাজ করছিল, বাড়ির চাকর ঘরে আসছিল কি জানি নিতে।সৎ মা তখন কৌশলে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়।তারপর গ্রামের মানুষ নানা ভাবে তার মাকে অপবাদ দিতে থাকে।সিদ্ধান্ত হয় যে,”হয় ঐ চাকরের সাথে বিয়ে করতে হবে না হয়। গ্রাম থেকে বের করে দেয়া হবে।” জরির মা এসব সহ্য করতে না পেরে সেই রাতে গলায় দড়ি দিয়েে মারা যান।গ্রামের মাতাব্বররা সত্যটা না জেনে তার মাকে অাত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
জরির বয়স ১৯।আজকে তাকে দেখতে আসবে কেন্দুয়া থেকে।টিউবওয়েলে পানি নেই,তাই পুকুরে এসেছিল গোসল করতে।কয়েকটা ছেলেফেলে ছিলো,কিন্তু জরি এতো কিছু লক্ষ্য করে নি।কারণ এক দেড় ঘণ্টার মধ্যে ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে।তাই একটু তাড়াহুড়ো করছিল কখন ঘরে আসবে।তাড়াহুড়ার পিছনে একটা কারণ আছে।গতরাতে জরি স্বপ্ন দেখেছে কোনো এক সুর্দশন পুরুষের সাথে তার বিবাহ হচ্ছে।চারদিক হৈ-হুল্লোড়, আতসবাজি, এলাকার সব ছেলেমেয়ে রা বর দেখার জন্য ভিড় জমাচ্ছে। এই জাতীয় স্বপ্ন।তবে স্বপ্নে তার আসল মা ছিল,দু বছর আগে মারা যাওয়া ছোট ভাইটাও ছিল। তার বাবাও বেশ হাসিখুশি।
স্বপ্নের সাথে বর্তমানের কোনো মিল নেই।তার বাবা আগের মতো নেই।আর এ পর্যন্ত কোনো সুদর্শন পুরুষ দেখতে আসে নাই।অবশ্য এ কথাটা চিন্তা করাটাও বোকামি।জরিদের আর্থিক অবস্থা ভালো না।বছর বছর জমি বিক্রি করে সংসার চলছে।কিন্তু এর মধ্যে ভালো একটা জায়গায় জরির বিয়ে ঠিক হয়।ছেলের বাড়ি আঠারবাড়ি।সরকারি চাকুরী করে।বিয়ের দিন জরির বাবা একটা আস্ত গরু জবাই করেছে।প্রচুর লোকজন এসেছে বিয়েতে।কিন্তু বরপক্ষ খবর পাঠাল”রাস্তায় বরের মাইক্রোবাস এক্সিডেন্ট হয়েছে।বরের মাথা ফেটে গিয়েছে।বরের বাবার অবস্থা আশঙ্কাজনক। “
আর বিয়ে হয় কিভাবে।বরপক্ষ আর পরে কোনো যোগাযোগ করে নি।অবশ্য কনে পক্ষ থেকেও করা হয় নি।এ পর্যন্ত ৫১ টা সম্বন্ধ এসেছে।এটি বাদে একটিও বিয়ে পর্যন্ত গড়ায় নি।মেয়ে দেখতে আসে, দেখে খায়দায় পরে চলে যায়।গত ৬ মাসের মধ্যে কোনো সম্বন্ধ আসে নি,তাই জরির মধ্যে খানিকটা তাড়াহুড়া। তার এই সংসারে আর ভাল লাগছে না।যেতে পারলে যদি খানিকটা সুখ পাওয়া যায় এই চিন্তায় দিন কাটে। “মুরব্বি, আসসালামু আলাইকুম।আপনেগোরে তো ঠিক চিনলাম না?” প্রশ্নকর্তা দেখতে বেঁটে আকৃতির।খালি গা থাকায় ভূড়িটা ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে।মুখে পান-সুপারি জাতীয় কিছু চাবাচ্চেন।
-ওয়ালাইকুম সালাম।আমাদেরকে চিনবেন না।কেন্দুয়া থেকে এসেছি গিয়াসউদ্দিন ভূইয়ার বাড়িতে।পাশে আমার ছেলে। কাস্টমসে চাকুরী করে। ” সম্বন্ধের গন্ধ পাইতাছি। মাইয়া দেখতে আইছেন নাকি?
– জ্বি,ঠিকই ধরেছেন।তো বাড়িটা কোন দিকে বলতে পারেন? “মাইয়া সম্পর্কে কিছু খোঁজ খবর নিয়া আইছেন নাকি এমনিতেই আইয়া পড়ছেন?”
– কিছু বুঝতে পারছি না কি বলতেছেন।
লোকটি একটু আশেপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ আছে কিনা? তারপর বলল,”আইয়েন, একটু এইনে।” ভূড়িওয়ালা লোকটি বলল,”আমি করিম মিয়া।আপনেরা মাইয়া দেখতে আইছেন খুবই ভালা সংবাদ।কিন্তু মাইয়ার যে এর আগে পাশের গ্রামের এক পোলার সাথে ভাইগা গেছিল গা।বিয়াও হইছিল।৯ দিনের মাথাত ফিইরা আইছে। এইসব কথা কি চাপা দেওন যায়? বাপ ছেলে একে অপরের মুখের দিক খানিকক্ষন তাকিয়ে রইল।কি বলবে বুঝতে পারছে না। ভূড়িওয়ালা করিম মিয়া আবার কথা শুরু করলেন,” বুঝলাইন আমরা হইলাম মাইয়া পক্ষের লোক।এহন যদি খারাপ মাইয়ার লগে আপনের পোলার বিয়া দেই। দুইদিন পরে সংসারে অশান্তি লাইগ্গা হেই মাইয়া আপনেরা তাড়াইয়া দিবাইন। পরে আমরারই পালন লাগবো।”
– কথাটা খারাপ বলেন নাই।তবে আমার কেন জানি সন্দেহ হচ্ছে আপনি বাড়িয়ে বলছেন? ” তওবা তওবা। আমি মিছা কথা কইলে আমার দুই কান কাইটা নিয়েন।”
– আমি আপনার প্রতি খুবই বিরক্ত। আগে বাড়িটা দেখিয়ে দিন।
জরিদের বসার ঘরে মেহমানদের জন্য খানাদানা নিয়ে যাচ্ছে।জরির বাবা আর ছেলের বাবার মধ্যে ভালই আড্ডা জমে উঠেছে।আড্ডার টপিক দুইজনের মধ্যে কমন বন্ধু বান্ধব। ছেলের বাবা বলছে, ” আপনাদের নান্দাইলের একজন উকিল ছিলেন।নামটা যেনো কি? ও হ্যাঁ,আমিনুল হক।চিনেন?” জরির বাবা গিয়াসউদ্দিন বলল,” হ্যাঁ চিনি তো।উনি আর আমি একসাথে আনন্দমোহন কলেজে পড়েছি।পরে ঢাকা ভার্সিটিতে ল তে ভর্তি হয়েছিলেন।তারপর থেকে আর যোগাযোগ হয় নি। অবশ্য আই এ পাশ করার পর আমারও পড়াা হয় নি।
– উনি আমার বড় ভাইয়ের কলিগ।আমার সঙ্গেও ভালো খাতির।
জরি তার ঘরে বসে সাজছে।তার সৎ বোন লিনা সাজিয়ে দিচ্ছে।সে এইবার ক্লাস এইটে উঠেছে।জরির সাথে তার খুব মিল। লিনার মা নানা সময় বলে জরির সাথে না মিশতে।একদিন লিনার মা গিয়াসউদ্দিনকে বলতেছেন,”তোমার বড় মাইয়াডার কারবার দেখছ।”
– না দেখচি না।কও।
” আমার মনে কয় লিনাডারেও খারাপ বানাইতে চাইতাছে।ওইদিন দেখি লিনা আয়নার সামনে দাড়াইয়া মিটমিটাইয়া হাসতাছে।”
– বড় হইতাছে।একটু এরকম করবোই।
“কিছু যদি হয় আমার মাইয়ার তাইলে জরি রে কি করবাম তা তুমি জান না। জরি আড়াল থেকে তাদের কথা শুনেছে।এরপর থেকে জরি লিনাকে অবহেলা করা শুরু করে।লিনা কোনো প্রশ্ন করলে জরি এককথায় উত্তর দেয়।লিনা জরির এই অবহেলা বুঝতে পেরে আজ অবধি কথা বলেনি।কিছুক্ষণ আগে জরি লিনাকে বলল,” কিরে আমার সঙ্গে রাগ করছিস?
– হুঁ “আজকে যে আমাকে দেখতে আসবে সাজিয়ে দিবে কে?.
– আমি কি জানি।তুমি সাজ তুমি গিয়ে সাজো।
জরি তখন নিজের ঘরে চলে আসে।চোখ দিয়ে সামান্য অশ্রুকণাও বের হয়ে এল।পেছন থেকে লিনা এসে বলল,” জরি আপা।থাক আর কাঁদতে হবে না।তুমি জানো না তোমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারি না।তাও তুমি আমাকে অবহেলা কর কেনো? জরি লিনাকে বুকের জড়িয়ে কেঁদে কেঁদে বললো, ” আর করবো না রে পাগল, আর করবো না।” লিনা জরির বুকে পাউডার মেখে দিচ্ছে। “আরে! কম পাউডার দে লিনা।নাক দিয়ে ডুকছে তো।
– আচ্ছা দিচ্ছি । রুমে লিনার মা দিলরুবা বেগমের প্রবেশ।তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,” হইছে আর সাঁজতে হবে না।নটির বেটিগোর সাঁজতে হয় না।শরীল দেখলেই পছন্দ হয়।লিনা বিরক্ত স্বরে বলল,”তুমি চুপ থাকোতো মা।আপাকে নটি বলবা না।আপা নটি না।তাছাড়া আজকে আপারে কিছু কইলে আমি খারাপ কিছু করতে বাধ্য হবো।”
– হইছে করতে হইবো না।এইবার তোমার আপামনিরে বসার ঘরে নিয়া আও।ছেলেপক্ষ দেখতে চাইছে। দিলরুবা বেগম চলে গেলেন। জরির কিছুটা মন খারাপ হল।
– মন খারাপ করো না আপা।তোমারে আজকে পরীর মতন লাগতাছে।থুক্কু পরীর চেয়েও বড়ই সৌন্দর্য তোমার।পরীর ডানা আছে এজন্য ভাল লাগে না,তুমি হইলা ডানা কাটা পরী। জরি বসার রুমে বসে আছে। ঘুমটা দিয়ে মুখ খানিকটা ঢাকা।ছেলের বাবা বারবার বলছে,”মা, ঘুমটা না সরালে তোমাকে দেখবো কিভাবে? দিলরুবা বেগম ঘুমটাটা সরালেন।বিড়বিড় করে অতি নিম্নস্বরে বলল,”শরমে আজকে উপচে পড়তেছে।” এমনভাবে বলল জরি ছাড়া আর কেউ শুনবে না।
-বাহ্, আপনাদের মেয়ের তো বড়ই সৌন্দর্য।তো মা তোমার নাম কি? “জ্বি আমার নাম জরি”
– শুধু জরি? ভালনাম নাই? “ভালনাম ফারজানা আক্তার।”
– মাশাল্লাহ।তুমি কোন ক্লাসে পড়?
“এইবার ইন্টার দিয়েছি”.
– গুড, ভেরি গুড।
ছেলের বাবা জরির বাবাকে বললেন,” মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে।তবে বুঝেন এইতো আজকালকার যুগ। ছেলেমেয়েরা যদি আলাদা একটু কথা বলতো। তাহলে……..
-হ্যাঁ অবশ্যই।যা মা জরি।বাবাজির সঙ্গে একটু কথা বইল্লা আয়। জরিকে আর ছেলেকে বাড়ির বারান্দার একটা কোণে দাড়িয়ে ব্যক্তিগত কথা বলার অনুমতি দেয়া হল। “আমি সাজু।ভাল নাম আসলাম তালুকদার।কাস্টমস অফিসার।”
– জ্বি,আমি জরি।ঐ সময় তো বললামই এইবার ইন্টার দিয়েছি। “জ্বি, মানে কিভাবে যে বলি কথাটা। “
– আমি জানি আপনি কি কথা বলবেন।হ্যাঁ, আমি পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম।কিন্তু অবশেষে বিয়ে টেকে নি।স্বামীর বাড়ী থেকে মেনে নেয় নি। স্বামীও ছলেবলে আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। এখন সন্ধ্যা। আজ চাঁদ উঠেছে।পুরোটুকু উঠে নি।অর্ধেকটা উঠেছে।জরি একা একা হাঁটছে বাড়ির সামনের পুকুর পাড় টায়। ছেলেপক্ষ দেখে চলেগিয়েছে ছয় -সাত ঘণ্টা আগে।সংবাদ পাঠিয়েছে মেয়ের স্বভাব চরিত্র ভালো না।জরি মনে মনে ভাবছে তার কপালে বোধ হয় বিয়ে নেই।মাঝে কান্না করে আর থামে।আবার কাঁদে আবার থামে এবং বলে,”মা, তুই একলা চলে গেলি রে আমারে নিয়া গেলি না ক্যান? জরির পালাইয়া যাওয়ার কাহিনিটা ঠিক এরকম।
“তখন জরি ক্লাস টেনে পড়ে।আবেগ ভালোবাসার বয়স।প্রতিদিন স্কুলে আসে আর যায়।ঐ খানের স্থানীয় একটা ছেলের সাথে ছেলের ভাব হয়।ছেলেটির নাম রাসেল।কি করে জরিও জানে না।প্রায় দেড় বছর এতো মতো প্রেম চলে তাদের । দুএকবার বার ধরাও খাইছে জরির বাবার হাতে।একদিন কঠিন মার দিয়েছে জরির বাবা গিয়াসউদ্দিন ভূইয়া।কিন্তু অল্পবয়সী প্রেম বড়ই খারাপ জিনিস।জরি বারবার হুমকি দিতে থাকে এইরকম করতে থাকলে বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে যাবে।গিয়াসউদ্দিন সাহেব একটু কঠোর প্রকৃতির।
এগুলো কথায় সে কোনো কান দেয় নি।একদিন সকালে উঠে দেখে জরি নাই।ঘরে তার পুরাতন দুটো জামা ছাড়া কিচ্ছু নেই। জরিদের সংসার মূলত তিন দিনের। প্রথম দিন রাসেল বিয়ে করে এক বন্ধুর বাসায় নিয়ে যায়।সেখানে জরিকে আপাতত থাকতে বলা হলো।পরে ফেমেলিকে মেনেজ করে আসল বাড়িতে নিয়ে যাবে।তাদের ফুলশয্যা বেশ ভালোভাবেই হয়।পরদিন খানিকটুক এদিকে সেদিকে ঘুরাঘুরি।জরির কাছে বেশ ভালো মনে হচ্ছিল তখন।কি রঙিন দুনিয়া।চারপাশে কত আনন্দ।তৃতীয় দিন রাসেল সারা দিন কাটিয়ে রাতে বাসায় ফিরে।জরির জিজ্ঞেস করেছিল,” সারাদিন কোথায় গিয়েছিলে?আমাকে একা রেখে?
-ফেলে গিয়েছি বেশ করেছি।নটি বেটির মেয়ে তো নটিই হবে “ছি তুমি আমাকে এ কথা বলতে পারলে?
– এই যে ধর ১০০০ টাকা। বাড়ি যা। তোর সাথে আমার যা হইছে ভুলে যা।আমার ফ্যামিলি আমারে বাঁশ দিতাসে। এই পর্যন্তই তাদের কাহিনী। একা একটি কিশোরী মেয়ের পক্ষে ঐ কন্ডিশনে কি করবে সে বুঝে উঠতে পারছিল না।অবশেষে এক বান্ধবীর বাসায় কয়েকদিন থেকে নিজ বাড়িতে ফিরে আসে। জরি এখনো পুকুর পাড়ের রেইনট্রি গাছটার নিচে বসে আছে।আর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করছে।এর মধ্যে সে তার আশেপাশে কেউ আছে এইরকম কিছু অনুভব করছেন। সে বলল,কে ওখানটায়, কে?
-জ্বি, আমি। পাশের বাড়ির মাস্টার। ও মাস্টার সাহেব। এখানে কি করছেন?
– কিছু না । একটু হাটতে আসছিলাম।
মাস্টারের নাম কবির খান।অরিজিনাল বোধহয় খান না!তাও বলেন খান।পাশের বাড়ির রবিউলদের লজিং মাস্টার। বি এ পাশ। “আসেন,মাস্টার সাহেব এদিকে সুখ দুঃখের আলাপ করি। ” “আচ্ছা বলতে পারবেন মাস্টার সাহেব, আসমানে তারা কয়টা।?
– এইটা তো সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ বলতে পারবে না।তুমি কি জান কয়টা তারা? জরি হেসে দিয়ে বলল,” না,আমিও জানি না।”
– জরি?
“জ্বি,মাস্টার সাহেব?” এই দুকূলে বুঝছো,আমার কেউ নাই।ছোটো থেকে একা বড় হইছি।অনেক দিন রেলস্টেশন,বাসস্ট্যান্ডে ভিক্ষাও করছি।কি করবো,আমার তো আর বাপ মা নেই যে খাওয়াইবো।কষ্ট আর ক্ষুধা দুটোই হানা দিত আমাকে।মেট্রিক পাশ করার পর রবিউলের বাবার সাথে রেলস্টেশনে কিভাবে কিভাবে যেন পরিচয় হয়ে এইখানে আইছি। আল্লায় দিলে এখন ভালাই আছি।”
– আমার তো মা নাই জানেন এই।সৎ মায়ের দেয়া অপবাদের কারণে গলায় দড়ি দিসে।আর বাপ তো থাইক্কাও নাই।পুড়া কপাল আমার একটা বিয়াও হয় না।এই নটি বেটিরে কে বিয়ে করবো। “না না নিজেকে এইরকম ছোটো মনে করবা না।কখনো করতে নাই।তোমার হিস্টোরি আমি সব জানি।কিশোরী বয়সে এরকম হতেই পারে।” কিছুক্ষণ কেউ কথা বলল না।এই পর্বটা হল আবেগ ধরে রাখা বা স্মৃতিচারণের।মাস্টার কবির খান আবার কথা শুরু করলেন, “জরি,আমি তোমাকে বিবাহ করতে চাই?” জরি খানিকটা শকের মতো খেল।জরি কিছু বলল না। “হ্যাঁ জরি,তোমাকে আমি ভালবাসি।কথাটা খুব সহজে বলে ফেললাম। কিন্তু তুমি জান না আমি বছরের পর বছর অপেক্ষা করছি এই কথাটা বলার।”
– মাস্টার সাহেব কথাটা আমার বাবাকে গিয়ে বলেন।সেটা বোধহয় ভাল। কবির মাস্টার জরির দুহাত ধরে বলল, “তুমি রাজি আছো তো? জরির কিছু বলল না।মৌনতা সম্মতির লক্ষণ।সে ভাবছে আড়ালেও কোনো পুরুষ তার কথা ভাবে।তাকে নিয়ে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখে। -মাস্টার সাহেব আপনার তো কিছু করেন না।বিয়ে করে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে একটা পোস্ট অফিসে চাকুরী পেয়েছি।পোস্টমাস্টার পদে।আগামী মাসে জয়েন দিবো। শুক্রবারে ধুমধাম করে বিয়ে হল।সানাই বাজল।আতশবাজি হল।বিদায়ের সময় জরির বাবা বলল,”মা রে তুই এতোদিন কষ্টের মধ্যে ছিলি।কি করমু বল।আমার তো হাঁত বাঁধা।যেখানেই থাকস সুখে থাকিস।কিছু লাগলে আমার কাছে সংবাদ পাঠাবি”
জরির কাছে এতদিন পরে তার বাবাকে আপন লাগছে।এইতো সেই বাবা যে ছোটোবেলা আমাকে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমাত।কোন জিনিস মুখ দিয়ে আসার আগেই দিয়ে দিত।জরি তার বাবার কথা শুনে কেঁদে ফেলল।কবির মাস্টার জরিকে নিয়ে চলে গেলেন।আর কেউ তাদের সাথে আসল না।
এরপর ৫-৬ টা বসন্ত জরির জীবন থেকে চলে গেল।ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনে উঠেছে নান্দাইল রোড আসবে বলে।হাতে একটা লাগেজ।বয়স ২৫-২৬ এর মতো হয়ে গেছে।গায়ে একটা টিয়া রঙের মাঝে কালো কালো ছোপ ছোপ শাড়ি।তাকে আজকে বেশ রূপবতী লাগছে।ভাগ্যক্রমে জানালার পাশে একটা সিট মেনেজ হয়ে গেল।ট্রেন ছাড়তে আর বেশি দেরী নেই।স্টেশনের লাইব্রেরি থেকে জরি একটা বই কিনল।বইয়ের নাম, ” অন্যভুবন”। লেখক হুমায়ুন আহমেদ।
ট্রেন চলছে ১ ঘন্টা ধরে।ট্রেন ভৈরব পর্যন্ত যাবে।লোকাল ট্রেন।জরি ইতিমধ্যে বইয়ে ডুবন্ত অবস্থায় আছে।বিচিত্র কারণে এই লেখকে বই পড়তে তার খুব ভাল লাগে। “আপনাকে চেনা চেনা লাগছে।” প্রশ্নকর্তার বয়স ৩৬ বয়সের কাছাকাছি। পড়নে শার্ট প্যান্ট।ফরমাল অবস্থায়।মনে হয় ছুটি কাটাতে গ্রামে যাচ্ছেন। জরি প্রথমে একটু হাসল। হাসির মাধ্যমে আসল মানুষকে চেনা যায়। কারো কারো চেহারা মাঝে মাঝে অন্যজনের মতো হয়।কিন্তু উভয়ের হাসির ধরণ ভিন্ন হয়।
– জ্বি আমাকে বলছেন? “আপনার নাম জরি না? ভালনাম ফারজানা আক্তার? “
– জ্বি,।
“আমি” বলতে জরি লোকটির মুখে কথা কেঁড়ে নিয়ে বলল – আপনাকে আমি চিনি।আসলাম তালুকদার সাহেব।কাষ্টমস অফিসার।আমাকে দেখতে এসেছিলেন। আমার স্বভাব চরিত্র ভাল ছিল না বলে বিয়ে করেন নি।আসলাম সাহেব কিছুটা আহত হলেন। শুরুতেই এইজাতীয় কথা বলবেন হয়তো তিনি আসা করেন নি।তারপরও হাসি হাসি মুখে বললেন, “হ্যাঁ, আপনি এখনো মনে রেখেছেন?” জরি নরম গলায় বলল,”আমাকে যেসব পাত্র দেখতে এসেছে প্রায় সবাইকে মনে আছে।বলব?
– না না।বলতে হবে না।আপনার কি বিয়ে হয়েছে? হ্যাঁ হয়েছিল এক মাস্টারের সঙ্গে”
– পরে? টেকে নি। টেকে নি বলতে ডিভোর্স হয়ে গেছে?”
– কাগজে কলমে হয় নি।তবে মন থেকে হয়ে গেছে।
” সংক্ষিপ্ত করে কাহিনীটা বলবেন।যদি কিছু মনে না করেন?”জরি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,”কি শুনবেন এই পুড়াকপালের কাহিনী।শুনতে চেয়েছেন তাহলে বলি। এক লজিং মাস্টারের সুপ্ত ইচ্ছা ছিল বিয়ে করা।না না বিয়ে করার ইচ্ছা ছিল না।ইচ্ছে ছিল দেহ ভোগ করার।বিয়ে করে নিয়ে গেল কোথায় আমি জানি না।ওই মুহুর্তে কেউ আমাকে বিয়ে করবে ওইটাই মুখ্য।বেশ ভাল লাগছিল জানেন কেউ আমাকে বিয়ে করে নিয়ে যাচ্ছে।শুনতেই কেন জানি “থামলেম কেন, বলুন?”
– কি বলব ঐ নরপশুর কথা। ফুলশয্যার পরদিন কোথায় যে উধাও হয়ে গেল।আর আসল না।জানেন আমি ওর জন্য একমাস ওই বাসাতে তার অপেক্ষায় ছিলাম কিন্তু ও আসেনি।”ওহ্, সো সেড।পরে কি করলেন? মানে একমাস পরে কি বাড়ি গিয়েছিলেন?
– না। সেখানে আর মুখ নিয়ে যাব।যাই নি সেখানে।” “তো কি করলেন পরে?””বিয়ের বাবার দেয়া অলংকার বিক্রি করে ভালো অংকের টাকা পাই।এরপর সোজা ঢাকা গেলাম।কিছুদিন পড়াশুনার। এরপর ঢাকা ভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্যে চান্স পেয়ে গেলাম।বাকিটা পথ কষ্ট করতে হয়নি।স্কুলকলেজের বাচ্চাদের টিউশনি করিয়ে ভালভাবেই দিনকাল চলো গেছে।”
-“বাহ্, শুনে ভালো লাগলো।তাহলে এখন কি করছেন?”
– এখন আমি ম্যাজিস্ট্রেট। ময়মনসিংহে পোস্টিং পেয়েছি। আসলাম সাহেবের চোখ মুখ যেন আনন্দে শিহরিত।ভেবেছিলো একটা ব্যর্থতার গল্প শুনবে।না তেমন টি হয়নি, আসলাম সাহেব বলল,”পরে বিয়ে করেন নি”
– না সেটা আর করি নি।করবোও না।বলতে গেলে পুরুষ মানুষদের ওপর বিশ্বাস উঠে গেছে।এখন মানুষকে বিশ্বাস করতেই ভয় লাগে। “সামনের আঠারবাড়ি স্টেশনে নামব।আমার শ্বশুরবাড়ি সেখানে। সেখানেই বিয়ে করেছি।স্ত্রী স্টেশনে অপেক্ষা করছে।” আঠারবাড়ি স্টেশনে ট্রেন আস্তে আস্তে দাড়াল।যাত্রীরা নামা শুরু করেছে।আসলাম সাহেবেও ব্যাগ দুটো দু হাতে নিলেন।হাসি মুখে বললেন,” আপনি কোথায় নামবেন?”
– সামনের স্টেশনে।নান্দাইল রোড।বাবার বাড়িতে যাচ্ছি।নতুন চাকুরী পেয়েছি।তাই পরিবারের জন্য কিছু কেনাকাটা।ছোট বোন লিনা কেও দেখি না.। “আচ্ছা, যান তাহলে।আমি নেমে পড়ব।”
জরি জানালার দিকে তাকিয়ে আছেন।আসলাম সাহেবকে তার পছন্দ হয়েছিল।সে ভেবেছিল তার লুকানো সত্য গুলো বললে হয়তো সে বিয়ে করবে কিন্তু করল না। আসলাম সাহেবের হাত থেকে একটা ব্যাগ তার স্ত্রী নিল।আরেকটা হাত দিয়ে দুজনের দু হাত ধরে চলা শুরু করল।এ যেন ভালবাসার শক্ত বন্ধন। তাদের দুজনকে বেশ সুখী মনে হচ্ছে। একে অপরের সাথে কথা বলে হেসে গড়িয়ে পড়ছে।এই রকম একটা সংসার জরিও আসা করেছিল। ট্রেন চলা শুরু করেছে ধীরে ধীরে।ইঞ্জিন থেকে কালো ধোয়া উড়ে যাচ্ছে আকাশ পানে।চারপাশের অপরিচিত স্থির মানুষগুলো তার সাপেক্ষে দূরে সরে যাচ্ছে।ঠিক সেভাবে পুরুষদের প্রতি তার বিশ্বাসও দিন দিন চলে যাচ্ছে।
গল্পের বিষয়:
গল্প