সেদিন দুপুরে রিকশা নিয়ে ক্যাম্পাসের দিকে যাচ্ছি। ওয়েস্টার্ন গলি পার হতেই কে যেন পেছন থেকে ডাক দিলো, লিফট দেয়া যাবে? আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি, জলপাই রঙের শাড়ি পরে একটা মেয়ে রিক্সার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে খুব বেশি ব্যাস্ততা তার। এমনিতে শুক্রবার দুপুরে রাস্তায় রিকশা কম থাকে। আমি ডাক দিয়ে বললাম হ্যাঁ, আসুন। মেয়েটা রিক্সার কাছে আসতেই আমি রিকশা থেকে নেমে গিয়ে বললাম
-আপনি যান। আমি ক্যাম্পাস পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারবো।
-সে কী কথা? এটা অন্যায় হয়ে যাবে। এভাবে তো আমি লিফট চাইনি।
-আমার অভ্যাস নেই, আপনি যান। আমি কিছু মনে করব না।
-তাহলে আমিও যাচ্ছি না। এভাবে আপনাকে নামিয়ে যাওয়াটা আমার ঠিক হবে না। মেয়েটার সাথে কথা বলে পারা যাবে না। তাই কাচুমাচু হয়ে রিকশার একপাশে উঠে বসলাম। সেও উঠল। রিকশার চাকা ঘোরা শুরু করার সাথে সাথে তার মুখও চলা শুরু করল।
-কাজিনের জন্মদিন। ২টায় অনুষ্ঠান। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও রিকশা খুঁজে পেলাম না তাই আপনাকে কষ্ট দিলাম।
-এটা কোনো ব্যাপার না। আমি তো ক্যাম্পাসের গেটেই নেমে যাবো। আপনি তারপর পুরো রিকশা নিয়ে আয়েশ করে চলে যেতে পারবেন।
ক্যাম্পাসের গেটে এসে আমি নেমে গেলাম। সে রিকশা নিয়েই চলে গেল। হোস্টেলে এসে বুঝতে পারলাম ছাতাটা রিকশায় ফেলে এসেছি। ছাতার আশা ছেড়ে দিলাম একেবারে। বিকালে সায়েমের সাথে মাঠে খেলতে গেলাম। এরপর রাতের ঘুম শেষে আগের দিনের কাহিনী পুরো ভুলে গেলাম। মঙ্গলবার টিউশনির জন্য যাচ্ছিলাম। ওয়েস্টার্ন গলির মুখে যখন আসলাম তখন সেদিনের সেই পরিচিত গলায় আমাকে উদ্যেশ্য করে কিছু একটা বলতে শুনলাম। আমি তার দিকে এগিয়ে গেলাম। সে বলতে শুরু করেছে,
-সেদিন ছাতা ফেলে গেলেন, খোঁজ করেছেন?
-এই বিশাল শহরে পরিচিত মানুষগুলো হারিয়ে যায়। সেখানে সামান্য ছাতা?
-ছাতাটা আমার কাছে আছে। কখন নেবেন?
-কাল গ্রীন ক্যাফেতে আসতে পারেন। কফি খাওয়ার নিমন্ত্রণ। সাথে ছাতাটাও ফেরত দিয়ে যাবেন।
-আচ্ছা। তবে, যোগাযোগের কিছু একটা পেলে ভালো হতো
-ফেসবুক আইডি নিতে পারেন। Antik Al Mahadi
-আমি তৃণা।
-কাল কথা হবে। একটু ব্যাস্ত আছি।
-আচ্ছা। ঠিক আছে।
কোনো এক মনিষী বলেছেন, যে জিনিস একবার হয় তা দ্বিতীয়বার না-ও হতে পারে। তবে যে জিনিস দ্বিতীয়বার হয় তা তৃতীয়বার অবশ্যই হয়। সেই দিক থেকে তৃণার সাথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে গেল। রাতে ফেসবুকে একটা ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পেলাম। তৃণা চৌধুরী নামে। আমি একসেপ্ট করে রেখে দিলাম। সকালে সে মেসেজ দিয়ে বললো,
-ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করে মানুষ অন্তত স্বাগত কথাবার্তা সেরে নেয়। আপনি তো দেখছি তাও করলেন না।
-ব্যাস্ত ছিলাম। ক্যাফেতে আসবেন কখন?
-চারটায় আসি। সমস্যা হবে?
-না। চারটায় চলে আসবেন তাহলে। আমিও থাকবো চারটায়।
এই বলে অফলাইনে চলে আসলাম। বিকেলে বাদামি রঙের একটা শার্ট পরে হোস্টেল থেকে বের হলাম। ৩:৫৫ এর সময় আমি ক্যাফেতে গিয়ে বসলাম। সে তখনও আসেনি। প্রায় ১৫ মিনিট পরে সে আসলো।
-দেরী হলো যে? সমস্যা হয়েছিল কোনো?
-জ্যামে আটকে গিয়েছিলাম পথে।
-যাক, ভালো আছেন আপনি?
-হ্যাঁ, আপনি ভালো আছেন?
-আমি ভালো আছি। তবে ছাতাটা এনেছনে তো? না-কি আপনিও ভুলে বাসায় ফেলে এসেছেন?
-সেটা নির্ভর করবে কথা বলার শেষে। আপনি ছাতা ছাতা করছেন কেন? রিকশায় ফেলে এসে তো আর খোঁজ করেননি।
-আমার অনেক ছাতা হারিয়েছে। কেউ ফেরত দেয়নি। আপনি ফেরত দিলে সেটা হবে নতুন ইতিহাস।
-আচ্ছা বুঝলাম। এজন্যই এত আগ্রহ আপনার?
-সেটা বলতে পারেন। আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক।
-আপনি এভাবে কথা বলেন সবসময়?
-কীভাবে?
-এইযে, গম্ভীর হয়ে। কেমন যেন। তবে যা-ই বলেন, আপনি কিন্তু দারুণ কবিতা লেখেন।কাল রাতে আপনার তিনটা কবিতা পড়েছি। এর মধ্যে “কৃষ্ণচূড়ার শবযাত্রা” কবিতাটা আমার অনেক বেশি ভালো লেগেছে।
-সব তো এক ধাঁচের। “কৃষ্ণচূড়ার শবযাত্রা” কবিতাটা ভালো লাগার কারন?
-“বসন্তে দুটি গ্রহের একীভবন দেখে তার হৃদয় ফেটে রক্ত ফোঁটে” এই লাইন দুইটার জন্য অনেক বেশি ভালো লেগেছে। এটা একদম মুখস্ত করে নিয়েছি।
-বাদ দেন, পরিচিত হই আগে। আমি অন্তিক, অন্তিক আল মাহাদী। কেমিস্ট্রি, ফোর্থ ইয়ার।
-আমি তৃণা চৌধুরী। বিবিএ, সেকেন্ড ইয়ার।
-বাহ্! আপনার প্রিয় রঙ কী?
-গাড় নীল। আপনার?
-বাদামী।
-বাদামী আপনার পছন্দের রঙ? বাদামী একটা রঙ হলো?
-আমি সবার মতো নয়। সবার সাথে মিশে গেলে আমার অস্তিত্ব কোথায়?
-সে যাই হোক, আপনি আপনার অস্তিত্ব ধরে রাখেন। তবে, আপনি এত গম্ভীরভাবে কথা বলেন কেন?
-ভালো লাগে তাই। আপনার শুনতে ভালো লাগে?
এর মধ্যে একটি ছেলে এসে কফি দিয়ে গেল। আমি এসেই অর্ডার করে রাখছিলাম। কফি খেতে খেতে আগের কথা বলার বিষয়বস্তু ভুলে গেলাম। টুকটাক আলাপচারিতা সেরে, বিল চুকিয়ে দিয়ে ক্যাফে থেকে বের হয়ে গেলাম। সামনে রাস্তায় তৃণা রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি বলে উঠলাম,
-ছাতাটা দেবেন না?
-আরেকদিন দেখা করার জন্য যদি রেখে দেই তবে রাগ করবেন?
-দেখা করার প্রয়োজন হলে ডাক দিয়েন। চলে আসবো। তবে ছাতাটা দিয়ে যান।
-এই নিন আপনার ছাতা। তবে সাবধান, অন্য কাউকে লিফটা দিতে গিয়ে ছাতাটা আবার রেখে আসবেন না।
এই বলে ছাতা আমার হাতে দিয়ে রিকশা নিয়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় পেছন ফিরে হাত নাড়ালো আর বলে গেল, আবার দেখা হবে। আমি ঘুরে ক্যাম্পাসের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। বাসায় এসে ফেসবুকে ঢুকতেই তৃণার মেসেজ।
-আপনি তো অনেক ভীতু। কথায় প্যাচ লাগিয়ে ফেলেন। কথা বলার চর্চা করবেন।
-লজ্জা দিচ্ছেন? ওসব চর্চা করে আমার কথার জড়তা ভাঙবে বলে মনে হয় না।
-আপনি তাহলে ভীতু থেকে যান। ভীতু হয়ে থাকাটা ভালো।
-তা অবশ্য ঠিক।
এভাবে টুকটাক কথা বলতে বলতে ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ হওয়ার পর্বটাও সেরে নিয়েছি। ওকে একটা নামও দিয়ে দিয়েছি ‘মধুলতা’। দুয়েকবার পার্কে আড্ডা দিয়েছি। আবার ফুটপাতে চা খেয়েছি। এভাবে চলছিল আমাদের পথচলা।
করোনা ভাইরাসের আগমনে থমথমে শহরে আমাদের দেখা হয় না অনেকদিন হলো। শহর প্রায় সুস্থ্য, আমরা আজ দেখা করবো। ওয়েস্টার্ন গলির মুখে আমি বাদামী পাঞ্জাবি পরে অপেক্ষা করছি তৃণার জন্য। এই শাড়িটার জন্য একদিন প্রশংসা করেছিলাম। প্রশংসা পেতে কে না চায়? হয়তো সেজন্য ও বারবার এই শাড়িটা পরে। আমরা রিকশা নিলাম। আজকেও রিকশায় চড়ে আকাশ দেখছি আমরা। আমি আর তৃণা পাশাপাশি। তবে সেদিনের মতো কাচুমাচু হয়ে নয়। মাঝখানে দূরত্ব নেই।
হঠাৎ তৃণা বলে উঠল অন্তিক, আকাশের রঙ বাদামী হলে কেমন হতো? আমি ওর দিকে তাকিয়ে অবাক চোখে বললাম, তবে তোমাকে খুঁজতাম আকাশের বাদামী আভায়। তৃণা ব্যাগ থেকে আমার কবিতার বই বের করে কবিতা আবৃত্তি শুরু করেছে। “চলো প্রিয়তমা, কংক্রিটের শহরে আমরা নিস্তব্ধতা বিক্রি করি” রিকশা চলছে, চলছে, চলেই যাচ্ছে…..
গল্পের বিষয়:
গল্প