আল্ট্রাসানোগ্রাফী বেডে ম্যাডাম যখন বললেন, কি বাবু হবে জানো? ছেলে হবে, ছেলে.. এই কথা বলে তিনি যখন “ডিপ ডিপ” করে হার্ট সাউন্ড টা বাড়িয়ে শুনিয়ে দিলেন, তখন অদ্ভুত একটা শিহরণ খেলে গেল শরীরে, প্রায় সাথে সাথেই মনে হলো, ছেলে হবে তবে? মেয়ে নয় ??
আমার ভীষণ ইচ্ছে ছিলো আমার একটা মেয়ে হবে, তুলতুলে একটা মেয়ে, রেশমি রেশমি চুল, ফোলা ফোলা গাল, টলটলে বড় বড় দুটো চোখ ঠিক ওর বাবার মতো। যখন জানলাম, ডাক্তারের রুম থেকে বের হবার পর মুখটা কি একটু মলিন ছিলো? আমার বর তাড়াতাড়ি এসে আমাকে বসালো, আর চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করলো, “এনি প্রবলেম? সব ওকে তো?” ওকে কিভাবে বলি, ছয় মাস ধরে যা ভাবছিলাম, সেই স্বপ্নে একটু ধাক্কা লাগলো বৈকি? শুধু বললাম, এতদিন ধরে যে ফ্রক আর ক্লীপগুলো কিনবো ভাবছিলাম, তা এখন আর না কিনলেও চলবে!
অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের বাড়িতে তখনও কোনো বাচ্চা নেই, যদিও আমার দেবর ভাসুররা সবাই মিলে চার জন,সবাই বিবাহিত এবং আমার জামাই হচ্ছে তিন নম্বর। আল্ট্রাসনোগ্রাম করে আসার পর কি বাচ্চা হবে সবাই জানার জন্য অস্হির হয়ে গেলো – আগে থেকেই কি বাচ্চা হবে – বলাটা আমার একেবারেই পছন্দ নয়, তাই বললাম, যখন হবে দেখবেন। অথচ সবাই ধরেই নিলো নিশ্চয় মেয়ে হবে তাই বলছি না। ছেলে বাচ্চা হলে খুশিতে বলে ফেলতাম!
এর পরের চার মাস শুধু ভাবতাম, আল্লাহ যেন সুস্হ সবল বাচ্চা দান করেন, কত বাচ্চার কত সমস্যা হয়, মাঝে মাঝে খুব ভয় হতো। যাক, আলহামদুলিল্লাহ, অবশেষে আমার সোনামনি আমার কোল জুড়ে এলো । ওমা, সবাই কি খুশি.. ছেলে হয়েছে, ছেলে.. বংশের প্রথম ছেলে। আমার শ্বশুর – শ্বাশুড়ি সহ বাড়ির সবার খুশি আর ধরে না, ভেবেছিলেন মেয়ে আর হলো কিনা আকাশের চাঁদ! আর আমি অবাক হয়ে ভাবছি, ওতো আমারই সন্তান, কতো কষ্ট করলাম এই কয় মাস ওর জন্য, ছেলে হলেই কি আর মেয়ে হলেই বা কি?
এর পরের দুই বছরের মাঝে এক জা ছাড়া বাকি দুই জনেরই একটা করে ছেলে হলো, আর সেই জায়ের হলো এক মেয়ে। কি যে পরীর মতো সে ভাস্তিটা হলো, কি যে আদর ছিলো তার প্রতি সবার– তারপরেও সেই জায়ের মাঝে মাঝেই মন খারাপ থাকতো। এক বছর পর থেকেই আবার ট্রাই শুরু হলো একটা ছেলের জন্য। পরের বাচ্চাটা দুই তিন মাস পরে এবোরসন হয়ে গেলো, কিছুদিন বিরতি দিয়ে আবার ছেলে চাই। এবার প্রেসার বেড়ে বাচ্চাটা ছয় মাসে পেটেই মারা গেলো, যমে মানুষের টানাটানি… সুস্হ হয়ে বাড়ি এলো, কিন্তু তার ছেলের আশা কমে না। এরপর প্রায়ই আমার অন্যান্য জায়েদের বলতে শুনতাম, ভাগ্গিস্, ছেলের মা হয়ে গেছি, আর কোনো ঝামেলা নেই, নয়তো আমাদেরও তো আজ এই অবস্হাই হইতো! আমার শ্বাশুড়ি মানুষ ভালো, একমাত্র নাতনীকে খুব আদর করতেন, ওকে কোলে নিয়েই প্রতিবেশীদের সাথে গল্প করতেন আহা, ওর যদি একটা ভাই থাকতো! অথচ, একই বাসায় আরো তিনটা ভাইয়ের এক বোন হিসাবেই সে বড় হচ্ছিল, সবার চেয়ে বেশি আদর পেতো সে, তবুও কেন এতো আফসোস?
আমার সেই ভাবীও ইদানিং আবার ছেলের জন্য ট্রাই শুরু করেছেন, ছেলে না হওয়া যেন মস্ত এক অপরাধ, পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে একটা ছেলে যে চাই- ই চাই । মেয়ের মা হিসাবে থাকতে তার আঁতে ঘা লাগছে, এতো সব শারীরিক সমস্যার মাঝেও ছেলের মা তাকে হতেই হবে, বাকি জায়েদের কাছেও তার সম্মান থাকছে না। আর বাকিদের হাবভাব দেখলেও অবাক লাগে, তারাই নাকি ছেলে উপহার দিয়েছে এই ফ্যামিলিকে। অথচ, ছেলে মেয়ে নির্ধারন হয় বাবার ক্রোমজম থেকে- এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদের শিক্ষিত স্বচ্ছল ফ্যামিলি গুলোর কি হাল! আমাদের এদিকে কোনো এক দাওয়াতে এক জন ভাবী একদিন আমার মাকে বলছিলেন, আন্টি আসেন, আমি আর আপনি একসাথে বসে গল্প করি, আমরা তো মেয়ের মা, আর বাকিরা সব ছেলের মা, ওদের সাথে কি আমাদের বনবে? আমার মায়ের দুই মেয়ে আর সেই ভাবীরও দুই মেয়ে, বাকি সবারই একটা না একটা ছেলে আছে। সেই ভাবী একটা কলেজের টিচার, খুব ভালো গান করেন, তার এরকম কথা শুনে একটু অবাক হয়েছিলাম।
আমি বড় হওয়া পর্যন্ত কোনোদিন আমার বাবা মাকে ছেলে মেয়ে ভেদাভেদ করতে দেখিনি, দুই মেয়েকেই তারা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। আর একজন মানুষ ছেলে নাই বলে কখনো আফসোস করেনি, তা হলো আমার দাদী। তিনি আমাদের উপর খুব সন্তুষ্ট ছিলেন, চাকরী পেয়ে যখন দাদীকে শাড়ি দিয়েছিলাম, তখন দুই হাত তুলে দোয়া করেছিলেন। বাকি চাচীদের সবারই ছেলে আছে, তবুও তিনি মাকেই সব সময় প্রাধান্য দিতেন, কখনো মেয়ের মা হিসাবে অবহেলা করেন নি, কটু কথাও বলেননি। সাধারণ গ্রামের এক মহিলার দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে আজও মুগ্ধ করে।
আমাদের এদিকে ছয় সাত বছর বয়সি অনেকগুলো বাচ্চা আছে, ছোটবেলা থেকেই তারা একসাথে মিলেমিশে খেলাধুলা করে বড় হয়েছে, অথচ কয়েকদিন আগে দেখলাম, দুটো ভাগ হয়ে খেলছে এই ছোট বাচ্চাগুলো। কি ব্যাপার জানতে চাইলে শুনলাম, কোনো এক আন্টি বলেছে, ছেলেরা আর মেয়েরা আলাদা খেলতে হয়, একসাথে খেলা যাবে না। হতভম্ব হয়ে চুপ করে রইলাম, এইটুকুনি কতগুলো বাচ্চা, এদেরকেও ছেলে মেয়ের ভেদাভেদ শেখাতে হবে ?
কিছুদিন আগে এক ভাবীর বাচ্চার আকিকার দাওয়াত ছিলো। গিয়ে দেখি হুলুস্থুল ব্যাপার। ভাবী পুরো গায়ে সোনার গয়না পরে ঝমঝম করে হেটে বেড়াচ্ছেন। আগে তার দুটো মেয়ে ছিলো, এইবার ছেলে হয়েছে, খুশি যেন আর ধরেনা। ভাই তাকে তিন ভরি দিয়ে হার গড়ে দিয়েছেন, আর সাথে দিয়েছেন দুটো বালা। আগে সব সময় তিনি কেমন যেনো ম্রিয়মান হয়ে থাকতেন, খালি বলতেন, আপনারা তো ছেলের মা, আপনাদের স্ট্যাটাসই তো আলাদা। আর আজকে ছেলে হওয়ার গর্বে গরবীনি “ছেলের মা” কি ঝলমলই না করছেন! এক ভাবীর দশ বছর পরে মেয়ে বাচ্চা হলো, বয়সও প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি। বাচ্চা হবার সময়ই বেশ কম্লিকেশন ছিলো, অথচ দুই বছরের মাঝেই শুনলাম আবার একটা বাচ্চা হয়েছে, ছেলে, কি খুশি, কি খুশি.. সোনার গয়না গড়িয়ে দিলো স্বামী। অথচ দশ বছরের কত সাধনার ফসল মেয়ের বেলায় তেমন কিছু হয়নি। এত অকৃতজ্ঞ কেন আমরা?
আরেক ভাবী জানতে এসেছেন গত ছয় বছরে তার তিনটা সিজার করে তিনটাই মেয়ে, আরেকটা সিজারে সমস্যা হবে? একটা ছেলের যে ভীষণ সখ তার…. আমি কিছুটা উষ্মা ভরে জানতে চাইলাম, আরো বাচ্চা লাগবে আপনাদের? নিজের দিকটাও তো চিন্তা করবেন নাকি? তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আপনারা তো ছেলের মা, আপনারা কি বুঝবেন? “ছেলের মা” কি গালভরা একটা কথা, না?
আচ্ছা, মেয়ে বাচ্চাগুলো কি আকাশ থেকে টুপ করে ঝরে পরে? মেয়ে বাচ্চা হবার সময় মায়ের কি কষ্ট কম হয়? মা কি বমি করে না, খাবার রুচি মরে যায় না, ভারী শরীরে নড়াচড়া করতে কষ্ট হয় না? নরমাল ডেলিভারীর তীব্র কষ্ট বা সিজারের কাটা পেটের ব্যাথায় সে কি কাতর হয় না? মেয়ে বাচ্চাদের কি ব্রেস্টফিডিং করায় না? রাতের পর রাত জেগে সেই মেয়েকে কি বড় করে না? তাহলে “মেয়ের মা” কথাটা কেন আসে? “ছেলের মা” শব্দটাই বা আসলো কোথা থেকে? একটা সুস্হ সবল বাচ্চা সৃষ্টিকর্তার কত বড় রহমত, যে ফ্যামিলিতে শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী বা এবনরমাল বেবী আছে, কেবল তারাই জানে। ছেলে বা মেয়ের মা হওয়াটা কি কারো নিজস্ব ইচ্ছের উপর নির্ভর করে? তার পরেও আমি ছেলের মা, আমি বিশাল কিছু, আর তুমি মেয়ের মা, তুমি মাথা নীচু করে থাকো। আর যাদের ছেলে নেই, তাদেরও আপনারা ছেলের মা, আমাদের মনঃকষ্ট আপনারা বুঝবেন না, এই কথাগুলোই বা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? ব্যতিক্রম কিছুটা আছে অবশ্যই, তারপরেও সমাজের বড় একটা অংশ কিন্তু এখনও এই “ছেলের মা” জ্বরে আক্রান্ত।
অনেক মহিলারাই একমাত্র ছেলের মা হওয়ার সুবাদে সুপিরিয়র কমপ্লেক্সিটিতে যেমন ভোগে তেমনি অনেক যোগ্য শিক্ষিত মহিলারাও মেয়ের মা হবার জন্য ইনফিরিয়র কমপ্লেক্সিটিতে ভোগে। যেখানে ছেলে বা মেয়ে বাচ্চা হবার ক্ষেত্রে একমাত্র মহান সৃষ্টিকর্তা ব্যাতীত আর কারো কোনো রকমের হাত নেই, সুতরাং সেই বিষয় নিয়েও এতো আদ্যিখেতা নিছক বোকামি আর মুর্খতা ছাড়া কিছুই নয়। আমি ছেলের মা হতে পারিনি, বাচ্চার মা হয়েই আছি, চারপাশের সমাজ আমাকে তথাকথিত ছেলের মা বানাতে পারে নি। একজন ” মানুষের মত মানুষ”- এর মা যেন হতে পারি, সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছি !!
গল্পের বিষয়:
গল্প