পৌষ মাসের মাঝামাঝি এক রাতে ঢাকা শহরের লেক সার্কাস এলাকার কেউ কেউ কোনো এক সাইকেলের বেলের ক্রিংক্রিং আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। সেই আওয়াজটা তখন খুবই চেনা চেনা মনে হয়েছিল তাদের কাছে এবং সে-কারণে তখন ভয়ানকভাবে বিস্মিত হয়েছিল তারা। যেমন, রাত দুটোর দিকে ৯১ নম্বর বাসার প্রৌঢ় জগলুল আহমেদ তার বাল্যবন্ধু গোলাম ফারুককে মোবাইলে ফোন করে বলেছিল : সাইকেলের বেল বাজতাছে। শুনতাছস কিছু?
জগলুল আহমেদের প্রশ্ন শুনে তখন বিরক্ত হয়েছিল ২৮ নম্বর বাসার গোলাম ফারুক। জগলুল আহমেদের উত্তেজনাকে কোনো পাত্তা না দিয়ে ঘুমজড়ানো কণ্ঠে গোলাম ফারুক জগলুল আহমেদকে পালটা প্রশ্ন করেছিল : সাইকেলের বেল বাজলে তর কী? মাইনষে কি সাইকেল চালাইব না নেকি? রাইতে কি মানুষের কাম পড়তে পারে না?
গোলাম ফারুকের প্রশ্নমালা শুনে মেজাজ চড়ে গিয়েছিল জগলুল আহমেদের। রাগে সে এক চিৎকার দিয়ে বলে উঠেছিল : আরে ছাগল! তরে কই, সাইকেলের বেলের আওয়াজখান বখতিয়ারের র্যালি সাইকেলের মতন! তা না হইলে এত রাইতে তরে ফোন করতে যাইতাম নেকি উলস্নুক কুনহানকার? বখতিয়ারের র্যালি সাইকেলের বেলের আওয়াজ আমি মোটেই ভুলি নাই!
মৃত বখতিয়ার খানের পাইন গ্রিন র্যালি সাইকেলের প্রসঙ্গ এসে পড়াতে তখন অস্বসিন্ত বোধ করেছিল গোলাম ফারুক এবং লেপের ওমে রচিত তার আরামের ঘুমটা ছুটে যাচ্ছিল তখন। একটু থেমে জগলুল আহমেদকে সে জিজ্ঞাসা করেছিল : যেই মানুষটা মইরা গেছে গেল শ্রাবণ মাসে, হ্যায় কি হালায় অহন সাইকেল চালাইয়া মহল্লায় ঘুরব নেকি? মাথা-উথা খারাপ হইছে তর? ঘুমা গিয়া, যা!
গোলাম ফারুকের অবিশ্বাসের বহর দেখে ফের মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল জগলুল আহমেদের। ফোনকল কেটে দেওয়ার আগে সে গোলাম ফারুককে বলেছিল : আমার কথা বিশ্বাস যাস না তুই? কান খুইলা রাখ হালার পুত!
জগলুল আহমেদের গালমন্দও পাত্তা দেয়নি গোলাম ফারুক। তবে জগলুল আহমেদের সঙ্গে বাৎচিতের কারণে অসময়ে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তার। গায়ে চাদর পেঁচিয়ে বারান্দার অন্ধকারে একটা চেয়ারে বসে সে সিগারেট ধরিয়েছিল। আর সে ভাবছিল : গেল শালার ঘুমটা ভাইঙ্গা! মোবাইলে সে তাকিয়ে দেখেছিল, রাত তখন কেবল দুটো। ফজরের আজান পড়তে তখনো অনেক দেরি। তার মনে হয়েছিল, ঘুমটা যখন ভাঙল তখন আরেকটু পরে ভাঙলেই ভালো হতো আসলে! তবে জগলুল আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে লেক সার্কাসের মসজিদে বাক্কাতিল মুবারাকাহ্তে সে সোজা নামাজ পড়তে চলে যেতে পারত। অনেকদিন তার কোরআন শরিফও পড়া হয়নি। ফজরের নামাজ শুরু হওয়ার আগে সে কোরআন শরিফ পড়ে ফেলতে পারত কিছুটা। এসব এলেবেলে ভাবনার ভেতরে কোনো এক সাইকেলের বেলের ক্রিংক্রিং আওয়াজটা নিজেও শুনতে পেয়েছিল গোলাম ফারুক। তখন আওয়াজটা জগলুল আহমেদের মতো করে তার নিজের কাছেও খুব চেনা বলে মনে হয়েছিল, এ-যেন বখতিয়ার খানের সাইকেলেরই বেলের আওয়াজ, যে-সাইকেলটার রং ছিল পাইন বৃক্ষের পাতার মতো গাঢ় সবুজ! ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করার জন্য তাই গোলাম ফারুক বারান্দার গ্রিলে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রায়-অন্ধকার লেক সার্কাস রোডের কোথাও থেকে তখন বারবারই ধ্বনিত হচ্ছিল কোনো এক সাইকেলের বেলের ক্রিংক্রিং আওয়াজ। কিন্তু রাস্তার উত্তর আর দক্ষিণে যতটুকু চোখ যাচ্ছিল সেখানে ঘন কুয়াশার ভেতরে কোনো সাইকেল বা সাইকেল আরোহীর অসিন্তত্ব গোলাম ফারুকের চোখে পড়ছিল না। তার একটা যৌক্তিক কারণ বের করার চেষ্টা করেছিল সে। তার মনে হয়েছিল, এটাই স্বাভাবিক যে, লেক সার্কাস রোডের নিভু নিভু বাতিগুলো ঘন কুয়াশা ভেদ করে আলো ছড়াবে না কোনোদিকেই। এবং হয়তো সে-কারণেই সাইকেল অথবা সাইকেল আরোহীকে ঠাওর করতে পারছে না সে। তাতে করে সিটি করপোরেশনের ওপরে পুনর্বার বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল গোলাম ফারুক। মনে মনে সে গজর গজর করছিল : রাস্তায় ভালো একখান লাইট লাগানির মুরোদ নাই! আবার তারা নেকি ঢাকা শহররে তিলোত্তমা নগরী বানাইব! কিন্তু ভৌতিক সাইকেলের বেলের আওয়াজ সম্পর্কে সে কোনো উপসংহার টানতে পারছিল না। এভাবে দোলাচল নিয়েই গোলাম ফারুক ফের ঘুমানোর জন্য নিজের ঘরে ফিরে গিয়েছিল।
সকালে মহল্লার মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় করেছিল অবসরপ্রাপ্ত জগলুল আহমেদ আর গোলাম ফারুক এবং তারপর তারা ধানম–র লেকের ধারে প্রাতঃভ্রমণে যাওয়ার জন্য যথারীতি ৮৬ নম্বর বাসার শহিদুল আলমকে ডাকতে গিয়েছিল। মৃত বখতিয়ার খানের মতোই শহিদুল আলমও তাদের বাল্যবন্ধু। সোয়েট প্যান্ট এবং জ্যাকেট পরে তড়িঘড়ি নিচে নেমে এসে কলাপসিবল গেটের তালা খুলতে খুলতে গম্ভীর মুখে তখন তাদের দুজনকে প্রশ্ন করেছিল শহিদুল আলম : কাইলকা রাইত তিনটার দিকে সাইকেলের বেলের আওয়াজ পাইছিলি তরা? সেই প্রশ্ন শুনে কী জবাব দেবে তা বুঝতে না পেরে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেছিল জগলুল আহমেদ এবং গোলাম ফারুক দুজনেই। শহিদুল আলম কলাপসিবল গেটের তালা আটকালে তারা তিনজন মহল্লার রাস্তা ধরে এগিয়ে কলাবাগান থার্ড লেন থেকে বাসস্ট্যান্ডমুখী রাস্তাটা ধরে লেকের দিকে হাঁটতে শুরু করেছিল। কয়েক মিনিটের নীরবতার পরে মুখ খুলেছিল গোলাম ফারুক। শহিদুল আলমের দিকে তাকিয়ে সে বলেছিল : তুই যা ভাবতাছস হেইডা তো নাও হইতে পারে! মুর্দারা কখনো সাইকেল চালাইতে পারে না।
স্পষ্ট কণ্ঠে তখন উত্তর দিয়েছিল শহিদুল আলম : আমি মোটেই মনে করি না যে, বখতিয়ারে জিন্দা হইব; জিন্দা হয়া আগের মতো কইরা সাইকেল চালাইব মহল্লার রাস্তা ধইরা। সাইকেলের বেলটা খুব চিনা মনে হইতেছিল দেইখা তদেরে জিগাইলাম।
রাতের বেলায় ভৌতিক কোনো এক সাইকেল প্রদক্ষিণ করে বেড়াচ্ছে লেক সার্কাস রোড ধরে – এমন একটা সম্ভাবনাকে অসার করার জন্য শহিদুল আলম তার নিজস্ব যুক্তিও উপস্থাপন করেছিল তখন। সে বলেছিল, কিছু বালক-বালিকা ছাড়া লেক সার্কাস মহল্লায় এখন আর সাইকেল চালায় না কেউই। বালক-বালিকাদের কেউ তাদের পিতা-মাতার চোখ ফাঁকি দিয়ে গভীর রাতে মহল্লার রাস্তায় সাইকেল চালাতে নামবে বলে সে মনে করে না। তবে কলাবাগান থার্ড লেন অথবা বশিরউদ্দিন রোডের কেউ অবশ্য লেক সার্কাস রোড ধরে সাইকেল চালিয়ে কোথাও যেতেই পারে। মানুষের কত ধরনের জরুরি কাজই না এসে পড়তে পারে রাতের বেলায়! যেমন, কাউকে কোনো কাজে ছুটে যেতে হতেই পারে পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতাল অথবা শমরিতা ক্লিনিকের ইমার্জেন্সিতে! ওষুধ কিনতে ডলফিন-গলি ধরে লাজ ফার্মায় দৌড়ে যাওয়াটাও বিচিত্র নয়! ঘন কুয়াশার কারণেই হয়তোবা রাতের লেক সার্কাস রোডে সাইকেলটা দেখা যাচ্ছে না মাত্র, দেখা যাচ্ছে না সাইকেল আরোহীকেও। বখতিয়ার খান তো আর পরপার থেকে এসে তার পাইন গ্রিন সাইকেলটা নিয়ে লেক সার্কাস মহল্লার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে পারবে না! সেটা একটা অসম্ভব চিন্তা ছাড়া আর কী? এবং শহিদুল আলম তার দুজন বন্ধুকে আরো যুক্তি দিয়েছিল যে, একই ধরনের বেল একাধারে অনেকগুলো সাইকেলেই লাগানো থাকতে পারে! এমন হতে পারে যে, বেলগুলো সব একই দোকান থেকে কেনা!
শহিদুল আলমের সেসব যুক্তিগ্রাহ্য কথা তার বন্ধু গোলাম ফারুক আদৌ শুনেছিল বলে মনে হয় না। সে একমনে হাঁটছিল কলাবাগান বাসস্ট্যান্ড বরাবর। নাছোড়বান্দা জগলুল আহমেদ কেবল প্রশ্ন তুলেছিল : অপঘাতে মৃত্যু হইছিল বখতিয়ারের, মনে আছে তর আলইম্যা? সে তো আর ডলফিন গলির আবদুর রহমানের মতো হার্ট অ্যাটাক কইরা মরে নাই! জগলুল আহমেদের কথায় তখন বিহবল হয়ে পড়েছিল গোলাম ফারুক এবং শহিদুল আলম দুজনেই। কেননা তাদের মনে পড়েছিল যে, কিছুদিন আগে মোহাম্মদপুরের টাউন হল বাজারে ঢোকার সময় বিদ্যুৎস্পর্শ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল বখতিয়ার খান, যে-ঘটনাটাকে কোনো বিচারেই স্বাভাবিক মৃত্যু বলে বিবেচনা করা যাবে না। সমস্যাটা এখানেই যে, অপঘাতে মৃত্যু হলে মানুষ আবার ভূতপ্রেত হয়ে যেতে পারে! তবে সেসব নিয়ে কোনো বাহাসে যায়নি তারা কেউই। রোদ উঠি উঠি ভোরবেলায় কলাবাগান বাসস্ট্যান্ড থেকে মিরপুর রোড পার হয়ে হাঁটতে হাঁটতে ধানম– লেক এলাকায় ঢুকে গিয়েছিল নিশ্চুপ তিন বন্ধু।
সেদিন রাত দুটোর দিকে লেক সার্কাস মহল্লায় আবারো কোনো এক সাইকেলের বেলের জোর আওয়াজ উঠেছিল – ক্রিংক্রিং, ক্রিংক্রিং…। দোয়া-দরুদ পড়তে পড়তে তখন বালিশ দিয়ে কান ঢেকেছিল স্বভাবে একটু ভীতু গোলাম ফারুক। ফোন করে তখন জগলুল আহমেদের ঘুম ভাঙিয়েছিল শহিদুল আলম। শহিদুল আলম জগলুল আহমেদকে বলেছিল : শুনতাছস কিছু? সাইকেলের বেল বাজতাছে আবারো! আমার এইখান থিকা দেখা যাইতাছে না কিছু! দেখ তো তগো বারিন্দায় গিয়া! কাজেই বিছানা ছেড়ে উঠে দোতলার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল জগলুল আহমেদ। শহিদুল আলমের মতো করে সেও থেকে থেকেই কোনো এক ভৌতিক সাইকেলের বেলের কর্কশ আওয়াজটা পাচ্ছিল তখন। একবার আওয়াজটা স্পষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন ঠিক তার সামনে দিয়ে নিভু নিভু আলোর লেক সার্কাস রোড ধরে চলাচল করছে সাইকেলটা! পরক্ষণেই আওয়াজটা সরে যাচ্ছিল দূরে – উত্তরের পান্থপথের দিকে কোথাও। তাতে করে জগলুল আহমেদের মনে হয়েছিল, স্কয়ার হাসপাতাল সংলগ্ন পান্থপথ থেকে দক্ষিণে থার্ড লেনের পুবমাথা পর্যন্ত লেক সার্কাস রোডটা সাইকেলে চেপে প্রদক্ষিণ করে বেড়াচ্ছে কেউ। সেই রাতে কুয়াশা খুব একটা ঘন না হলেও অনেক চেষ্টাতেও দেখাই যাচ্ছিল না সেই সাইকেলটার অবস্থান অথবা সাইকেল আরোহীর অবয়ব। কাজেই গেল রাতের মতো করেই পুনর্বার বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল জগলুল আহমেদ। সে তার স্ত্রী বিলকিস বানুকে ঘুম থেকে তুলে ঘটনাটা বলেছিল এবং ঘোরতর বিহবলতা নিয়ে বিলকিস বানুকে সে জিজ্ঞাসা করেছিল : কী হইতেছে এইসব? যে-মানুষটা মইরা গেছে, আমাগো মহল্লায় তার সাইকেলের বেল বাজে ক্যান?
পরদিন সকাল দশটা নাগাদ বখতিয়ার খানদের ৪৪ নম্বর বাসার উলটোদিকের ‘তানজিনা জেনারেল স্টোরে’র সামনে এসে জড়ো হয়েছিল লেক সার্কাসের একগাদা বিভ্রান্ত বাসিন্দা – টেইলর মাস্টার সিরাজ মিয়া, মুদিখানার দোকানদার সাইফুল, লন্ড্রিওয়ালা গণি, লেপ-তোশকের সেলাইকর হাকিম, উপ-সচিব ঝুমা খানের ড্রাইভার মিলন, ছোট্ট একটা ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী শিমুল, ৯০ নম্বর বাসার হেরোইনখোর সালেক এবং ২৬ নম্বর বাসার বাসিন্দা ব্যর্থ ব্যবসায়ী খোকন। কানটুপি আর গায়ে চাদর জড়িয়ে প্রথমে এসেছিল পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই খোকন। পৌষের রোদে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে সে চিমিন্তত মুখে ‘তানজিনা জেনারেল স্টোরে’র দোকানদার দুলালের বানানো চা খাচ্ছিল এবং একসময়ে সে ৪৪ নম্বর বাসার নিচের ‘পুষ্প টেইলার্সে’র টেইলর মাস্টার সিরাজ মিয়াকে ডেকে বলেছিল : ওই সিরাজ মিয়া! এইদিক শুইনা যাও তো! টেইলর শপ থেকে সিরাজ মিয়া বের হয়ে দুলালের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালে তাকে অনুসরণ করেছিল সাইফুল, গণি, শিমুল এবং হাকিম। দুলালের দোকান ঘিরে তাদের সকলকে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিলন এবং সালেকও সেদিকে অগ্রসর হয়েছিল। রোদে দাঁড়িয়ে তারা কেউ কেউ চা খাচ্ছিল, সিগারেট টানছিল কেউ, কেউ মনোযোগ সহকারে তাদের ডান ও বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির শুকনো চামড়া দাঁত দিয়ে কাটতে বসেছিল, কেউবা খামোখা তাকিয়েছিল যানবাহনে ঠাসা পান্থপথ বরাবর। সেই নীরবতার ভেতরে পড়ে গিয়ে উসখুস করছিল নেশাগ্রস্ত সালেক। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে শেষ পর্যন্ত সে সকলকে প্রশ্ন করেছিল : কী মিয়ারা! তুমরা সব চুপ কইরা আছ কেন? কী হইছে তোমাগো?
সালেকের প্রশ্ন শুনে সম্বিৎ ফিরে পেয়েছিল সমবেত মানুষেরা। চা শেষ করে চায়ের কাপটা দুলালের দোকানের টেবিলে ঠাস করে রেখে দিয়ে তাই কথা শুরু করেছিল খোকন। লেক সার্কাসের সমবেত বাসিন্দাদের সে জিজ্ঞাসা করেছিল : কাইল রাইতের বেলায় তুমরা আওয়াজ-টাওয়াজ পাইছ নেকি কিছু?
খোকনের প্রশ্ন শেষ হলে মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিয়েছিল সমবেত মানুষের সকলেই। তাদের চোখে-মুখে তখন প্রগাঢ় হয়েছিল বিভ্রামিন্ত। দ্বিতীয় দফায় সিগারেট ধরিয়ে টেইলর মাস্টার সিরাজ মিয়া খোকনের উদ্দেশে বলেছিল : আমি তো কিছুই বুঝবার পারতাছি না! সাইকেলের বেলের আওয়াজটা না এক্কেরে বখতিয়ার মামার র্যালি সাইকেলের বেলের লাহান!
লেপ-তোশকের সেলাইকর হাকিম তখন উত্তেজিত হয়ে উচ্চকণ্ঠে খোকনকে বলেছিল : আঁই তো দুকানের শাটার খুলি রাস্তায় আসি খাড়াইলাম। আঁর পাশ দি সাইকেলের বেল বাইজতেছে, আবার আওয়াজ দূরে চলিও যাইচ্ছে! কিন্তুক আঁই সাইকেল দেহি ন; সাইকেলওয়ালা কাউরেও দেহি ন। তাইজ্জব ঘটনা! বুইজঝেননি?
হেরোইনখোর সালেক তখন সকৌতুকে হো হো করে হেসে উঠে তার নিজের মন্তব্য ছুড়ে দিয়েছিল : কাইল রাইতে তুমরাও কি আমার মতন কইরা নিশা করছিলা নেকি? গাঞ্জাখুরি কথা কওনের জায়গা পাও না মিয়ারা! পাঁচ মাস আগে মইরা গেছে বখতিয়ার ভাই। হ্যায় কি ভূত হয়া সাইকেল চালাইব নেকি?
সমবয়সী সালেকের মন্তব্য শুনে সত্যিই রেগে গিয়েছিল খোকন। ভৌতিক সাইকেলের আগমনের মতো এমন একটা গুরুতর বিষয়কে হালকা করে দেখার কোনো সুযোগ নাই বলে মনে হয়েছিল খোকনের। তাই সে মুখ ঝামটা মেরে সালেককে বলেছিল : আমাগো কথার ভেতরে তরে আইতে কইছে কেডা? এইহান থিকা ভাগ কইতাছি! হেরোইন খাইতছস – তাই খা গিয়া তুই!
খোকনের উষ্মা প্রত্যক্ষ করে আরো বেশি করে হাসছিল সালেক এবং সে-নেশায় ঢুলতে ঢুলতে নিজের বাসার দিকে রওনা দিয়েছিল। চলে যেতে যেতে পেছন ফিরে খোকনকে সালেক বলে গিয়েছিল : খোকইন্যা! তগো সবারই মাথার স্ক্রুপ ঢিলা হয়া গেছেগা! কববর থিকা উইঠা আইসা বখতিয়ার ভাইয়ে কি আর সাইকেল চালাইতে পারব? এইডা কহুনও হয়, নাকি হইব কুনুদিন?
দুলালের দোকানের সামনে সমবেত লেক সার্কাস এলাকার কতিপয় বাসিন্দা অবশ্য সালেকের সে-কথাটা পাত্তাই দেয়নি। তাদের মনে হয়েছিল, এ হেরোইনখোরদের নিয়ে সমস্যা হলো এই যে, তারা এন্তার অসংলগ্ন কথা বলতে থাকবে, যেগুলো শুনলে মাথার চান্দি গরম হয়ে যাবে সঙ্গে সঙ্গেই। সালেকের কথায় উত্তেজিত হওয়ার চেয়ে ভৌতিক সাইকেলের রহস্য খুঁজে বের করাটাই বরং সেই মুহূর্তে তাদের কাছে বেশি জরুরি বলে মনে হয়েছিল।
কিন্তু বিস্তর আলোচনার পরও ভৌতিক সাইকেলের রহস্য উন্মোচনে ব্যর্থ হয়েছিল তারা। কাজেই তারা মহল্লার বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করার পরিকল্পনা নিয়েছিল এবং সেমতো তারা জগলুল আহমেদের শরণাপন্ন হয়েছিল। জগলুল আহমেদের বাসায় গিয়ে তারা দেখতে পেয়েছিল, বসার ঘরের সোফায় পাশাপাশি বসে আছে মৃত বখতিয়ার খানের জানে জিগার তিন বন্ধু – জগলুল আহমেদ, গোলাম ফারুক এবং শহিদুল আলম। জগলুল আহমেদের কোলে লিড খোলা একটা ল্যাপটপ। ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছে তারা তিনজনে মিলে।
তখন জগলুল আহমেদের কাছে ভৌতিক সাইকেল-বিষয়ক কথা পাড়তে অস্বসিন্তই হয়েছিল খোকনের। তাই সে খামোখা একটা প্রশ্ন করে বসেছিল : কী করতাছেন জগলু ভাই?
খোকনের ফাও প্রশ্ন শুনে বিরক্ত হয়ে জগলুল আহমেদ উত্তর দিয়েছিল : ইন্টারনেটে অশরীরী আত্মা লয়া পড়াশোনা করতাছি। ক্যান, কী হইছে?
ভূতপ্রেত লয়া ইন্টারনেটে তারা কী কয়? জগলুল আহমেদের কথায় এবার উৎসুক হয়ে উঠেছিল খোকন।
গভীর সংশয় নিয়ে জগলুল আহমেদ তখন খোকনকেবলেছিল : তুই বুইঝা দেখ, আমরা সকলে মিলvই হয়তোবা ভুল করতাছি! হয়তো সাইকেলের বেলই বাজতাছে না কোথাও!
তাই বইলা দশ-বারোজন মানুষে একলগে ভুল শুনব? এইডা কী কইলেন আপনে জগলু ভাই? বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেছিল খোকন।
জগলুল আহমেদ ফের খোকনকে বলেছিল : তুই তো জানস না, শত শত মানুষে মিলv একই টাইমে ভুল দেখবার পারে; ভুল শুনবারও পারে।
মহল্লার ২৮ নম্বর বাসার বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া সুমিত তখন জগলুল আহমেদের সমর্থনে খোকনকে বলেছিল : এইটারে কয় ‘মাস হ্যালুসিনেশন’। এইটা আপনে বুঝবেন না মামা!
জগলুল আহমেদ এবং সুমিতের কথায় ধন্দে পড়ে গিয়েছিল খোকন এবং সে সপ্রশ্নে তাকিয়েছিল সিরাজ মিয়া, গণি, সাইফুল, হাকিম, মিলন এবং শিমুলের দিকে। কিন্তু তাদের চোখেও সে চরম বিস্ময় ছাড়া আর কিছুই প্রত্যক্ষ করেনি। এমতাবস্থায় খোকনের মনে হয়েছিল, মহল্লার সকলের সংশয় নিরসনের জন্য মৃত বখতিয়ার খানের পুরনো পাইন গ্রিন সাইকেলটার দিকেই আসলে নজর দেওয়া দরকার। এমনও তো হতে পারে যে, রাতের বেলায় লুকিয়ে লুকিয়ে বখতিয়ার খানের সাইকেলের বেল বাজায় কে বা কাহারা এবং শীত-রাতের নিস্তব্ধতা উপচেপড়ে সেই কর্কশ আওয়াজটা সহজেই ছড়িয়ে পড়ে মহল্লার কোণে কোণে। তাই খোকন বখতিয়ার খানের বন্ধু শহিদুল আলমকে জিজ্ঞাসা করেছিল : বখতিয়ার ভাইয়ের সাইকেলখান কি হ্যার বাইড়তেই আছে নেকি ভাই? নেকি চালানোর লিগা লয়া গেছে কেউ? সাইকেলখান আবার বেইচা দেয় নাই তো মালিহা ভাবি?
একটু ভেবে উত্তর দিয়েছিল শহিদুল আলম : হেইডা তো আমরা কেউই জানি না! এক কাম কর – তুই গিয়া একটু খবর নিয়া দেখ!
বখতিয়ার খানদের ৪৪ নম্বর বাসায় যেতে হবে – এমন একটা সম্ভাবনায় কিন্তু অস্বসিন্ততেই পড়ে গিয়েছিল খোকন। খোকন তার বয়োজ্যেষ্ঠ জগলুল আহমেদের সামনে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে কাতরকণ্ঠে বলে উঠেছিল : ওই বাইড়তে আমি একা যাইতে পারুম না। মালিহা ভাবির যে রাগ! সাইকেলখান সরেজমিন দেখার কথা কইলে পরে মালিহা ভাবি যুদি আবার চেইতা যায়!
খোকনের অসহায়ত্ব দেখে শেষমেশ খোকন এবং আর সকলের সঙ্গে মৃত বখতিয়ার খানদের বাসায় যেতে রাজি হয়েছিল জগলুল আহমেদ, গোলাম ফারুক এবং শহিদুল আলম তিনজনেই।
বখতিয়ার খানদের ৪৪ নম্বর বাসার দোতলায় কলিংবেল টিপলে কাজের মেয়ে এসে কলাপসিবল গেট খুলে দিয়ে গিয়েছিল। জগলুল আহমেদের নেতৃত্বে লেক সার্কাসের উৎসুক বাসিন্দারা সিঁড়ি ভেঙে বখতিয়ার খানদের দোতলায় উঠেছিল এবং বসার ঘরে গিয়ে সোফায় বসে পড়েছিল তারা। ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে গম্ভীরমুখো দশজন মানুষকে সোফায় বসে থাকতে দেখে একটু যেন হকচকিয়েই গিয়েছিল মৃত বখতিয়ার খানের স্ত্রী মালিহা খাতুন। বিমূঢ় মালিহা খাতুন তার মৃত স্বামীর বাল্যবন্ধু জগলুল আহমেদের চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেছিল। তারপর সে জিজ্ঞাসা করেছিল : কী ব্যাপার জগলু ভাই? আপনেরা? কী হইছে?
মালিহা খাতুনের উপস্থিতিতে সপ্রতিভ হয়ে হাসতে চেষ্টা করেছিল জগলুল আহমেদ। কিন্তু নিজের মুখম-লে ঝুলে থাকা চিন্তাক্লিষ্টতা ঢাকতে সে ব্যর্থই হয়েছিল। কাজেই কোনো ভনিতা না করে সে সোজা অস্বসিন্তকর প্রসঙ্গটার অবতারণা করে ফেলেছিল এভাবে : বখতিয়ারের সাইকেলখান কই ভাবি?
গ্যারাজে পইড়া আছে। ক্যান? পালটা প্রশ্ন করেছিল মালিহা খাতুন।
আপনে কিছু শুনেন নাই?
কী শুনব? খোলসা কইরা বলেন দেখি!
আইজ দুইদিন ধইরা রাইত বাড়লে পরে মহল্লার রাস্তায় সাইকেলের বেলের আওয়াজ পাওয়া যাইতেছে।
তাতে কী হইল? সাইকেল চালাইলে মানুষে বেল বাজাইব না?
আপনের কথা ঠিক। কিন্তু সাইকেলের বেলের আওয়াজখান বখতিয়ারের সাইকেলের মতন! পেচগিডা লাগছে এই জায়গায়!
জগলুল আহমেদের এ-কথা শোনার পর একটু যেন অস্বসিন্ততেই পড়ে গিয়েছিল মালিহা খাতুন। তবু সে সপ্রতিভ থাকার চেষ্টাতে তখন যুক্তি দিতে চেয়েছিল এই বলে : আপনের বন্ধুর সাইকেলের মতন বেল তো বাজারের বহুত দোকানেই কিনতে পাওয়া যাইতে পারে। পারে না? এইটা নিয়া অবাক হওনের কী হইল শুনি?
মালিহা খাতুনের প্রশ্নের মুখে পড়ে গিয়ে তখন মূল সমস্যাটা খুলে বলেছিল জগলুল আহমেদ : আসলে যেইডা হইছে যে লেক সার্কাস রোডে সাইকেলের বেল বাজতাছে কিন্তু সাইকেলখান আর দেখা যাইতেছে না কোথাও, কে যে সাইকেলখান চালাইতেছে তাও চোখে পড়তাছে না আমাগো!
তারপর মালিহা খাতুনের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছিল জগলুল আহমেদ এবং চরম অস্বসিন্ততে সে মাথা নিচু করে ফেলেছিল। এদিকে জগলুল আহমেদের কথা শোনার পর কিছুক্ষণের জন্য খামোশ হয়ে গিয়েছিল মৃত বখতিয়ার খানের স্ত্রী মালিহা খাতুন। ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে কী যেন ভাবছিল। একটু পরে জগলুল আহমেদের উদ্দেশে সে বলেছিল : আমি কিন্তু কাইল রাইতেই কন আর গেল পরশু রাইতেই কন, কোনো সাইকেলের বেলের আওয়াজ-টাওয়াজ পাই নাই! আপনেরা ভুল শুনতাছেন জগলু ভাই! কেন – সেইডা কই।
মালিহা খাতুনের পরবর্তী আলোচনার সারমর্ম হলো এই যে, বখতিয়ার খানের মৃত্যুর পর থেকে প্রায় রাতেই কোনো কাজে বারান্দায় গেলে মালিহা খাতুন যেন দেখতে পায়, বারান্দার পশ্চিম কোনার চেয়ারটায় বসে বসে আগের মতোই সিগারেট টানছে বখতিয়ার খান। অন্ধকারের ভেতরে সিগারেটের আগুনও যেন স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায় তখন! কিন্তু সেটা যে তার নিজের মনের ভুল তা মালিহা খাতুন ভালো করেই জানে। তাই শেষমেশ মালিহা খাতুন জগলুল আহমেদকে বলেছিল : শুনেন জগলু ভাই! যত যাই কন না কেন আপনে, অশরীরী আত্মাটাত্মা বইলা আসলে কিছুই নাই! এইসব আজগুবি কথাবার্তা বন্ধ করেন আপনেরা!
তবে মৃত বখতিয়ার খানের বসার ঘরে জমায়েত লেক সার্কাসের কতিপয় বাসিন্দা মালিহা খাতুনের বিজ্ঞানমনস্কতায় খুশি হতে পারেনি মোটেই। তাদের মনে হয়েছিল, মালিহা খাতুন আসলে বেশি বোঝে! এমন তো হতেই পারে যে, ভৌতিক সাইকেল চালিয়ে ক্রিংক্রিং আওয়াজ তুলতে তুলতে রাতভর মহল্লার পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে বখতিয়ার খানের অতৃপ্ত আত্মা। কাজেই আর কথা না বাড়িয়ে বখতিয়ার খানের সাইকেলটা সরেজমিন পরীক্ষা করে দেখার জন্য মালিহা খাতুনের কাছ থেকে বখতিয়ার খানদের গ্যারাজের চাবিটা চেয়ে নিয়েছিল জগলুল আহমেদ। তার পিছু পিছু গ্যারাজের দিকে রওনা দিয়েছিল লেক সার্কাস এলাকার অনুসন্ধিৎসু মানুষের দল।
বখতিয়ার খানদের ৪৪ নম্বর বাসার ঠিক পেছনেই তাদের গ্যারাজ। সেই মুহূর্তে গ্যারাজে কেবল একটা মাত্রই গাড়ি রাখা ছিল, যেটা কিনা তিনতলার ভাড়াটিয়াদের। বখতিয়ার খানদের অপরিসর গ্যারাজটার উত্তর কোনায় দুনিয়ার পুরান-ধুরান জিনিসপত্তর ডাঁই করা ছিল – জমাটবাঁধা সিমেন্টের কটা বস্তা, কিছু পুরনো সুরকি, মরচেধরা জবুথবু একটা স্টিলের আলমারি, কাঠের তৈরি বাতিল একটা টেবিল এবং কয়েকটা ভাঙা চেয়ার। ভাঙা টেবিলটার সঙ্গে দাঁড় করানো ছিল বখতিয়ার খানের ধুলায় ধূসরিত পাইন গ্রিন র্যালি সাইকেলটা।
তখন জগলুল আহমেদ, গোলাম ফারুক এবং শহিদুল আলমের মনে পড়েছিল, পাইনগাছের পাতার মতো গাঢ় সবুজ রঙের এই সাইকেলটা চালিয়েই একদা তাদের সঙ্গে ল্যাবরেটরি স্কুল এবং ঢাকা কলেজে যাতায়াত করেছে বখতিয়ার খান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরও বখতিয়ার খান ক্লাস করা এবং বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াতের জন্য এই সাইকেলটাই ব্যবহার করেছে। চাকরিতে যোগ দেওয়ার পরপর তাদের সকলের বাহন ছিল রিকশা অথবা টাউন সার্ভিসের বাস। চাকরির মধ্যপর্যায়ে এসে তারা অফিস করেছে শাটল মাইক্রোবাসে চেপে। তাদের চার বন্ধুর ভেতরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহিদুল আলমই প্রথম, অনেক পুরনো হলেও, একটা কার কিনে ফেলেছিল। সেটা ছিল একটা সেকেন্ড হ্যান্ড টয়োটা। আরো উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে অবসর নেওয়ার বছরদুয়েক আগে সরকারের কাছ থেকে লোন নিয়ে রিকন্ডিশন্ড টয়োটা অ্যালিয়ন কিনেছিল সাধারণ বীমা করপোরেশনের তৎকালীন জেনারেল ম্যানেজার জগলুল আহমেদ, অতিরিক্ত সচিব গোলাম ফারুক এবং সোনালী ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার বখতিয়ার খান। অবসর নেওয়ার প্রায় দুবছর পর পরিবারের তীব্র আপত্তির মুখেই বখতিয়ার খান হঠাৎ করেই তার সেই ছাই রঙের টয়োটা অ্যালিয়নটা বিক্রি করে দিয়েছিল। তারপর সে মহোৎসবে তার মরচেধরা র্যালি সাইকেলটার সিট টিউব এবং ডাউন টিউব মেরামত করিয়েছিল; প্রতিস্থাপন করিয়েছিল দুটো চাকা আর সিট-কভার; এবং পাইন বৃক্ষের পাতার গাঢ় সবুজ রঙের সঙ্গে মিলিয়ে সাইকেলটা সে নতুনভাবে রং করিয়ে নিয়েছিল। তারপর র্যালি সাইকেলটা নিয়েই সে বাজার করা, আড্ডা মারা, কলেজগেটের সোনালী ব্যাংক শাখা থেকে পেনশনের টাকা তুলতে যাওয়া, পুরান ঢাকা আর গ্রিন রোডের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করা ইত্যাদি বিভিন্ন জরুরি এবং ইত্যাকার কাজ করতে শুরু করেছিল। মহল্লার সকলেই তখন অবাক হয়েছিল, কেননা এক উলস্নyক ছাড়া আর কেউই টয়োটা অ্যালিয়ন বিক্রি করে দিয়ে সাইকেল চালাবে না! এ নিয়ে তারা বখতিয়ার খানের সঙ্গে বারকয়েক কথাও বলেছিল। প্রতিবারই বখতিয়ার খান তাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল একইভাবে : কেন? নেদারল্যান্ডস নামে একখান দেশ আছে না? সেই দেশের মাইনষেরা গাড়ি ফালায়া রাইখা দেদারসে সাইকেল চালাইতেছে না? তা হইলে আমি সাইকেল চালাইলে তোমাগো অসুবিধা কী? আর এই ঢাকা শহরের রাস্তায় একখান গাড়ি কম নামলে তো রাস্তার জঘন্য ট্রাফিক জ্যামটা একটু হইলেও কম হইব – তাই না? রাস্তায় নামলে পরে চারদিকে এত গাড়ি যে আমার দম বন্ধ হইয়া যাইতে নেয়!
সাইকেল চালিয়ে যাতায়াত করার পেছনে বখতিয়ার খানের এই যুক্তির সঙ্গে মহল্লার মানুষেরা ঐকমত্য হলেও গাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার ব্যাপারটা তাদের কাছে অদ্ভুতই ঠেকেছিল তখন।
বখতিয়ার খানের সাইকেল প্রসঙ্গে আরো বলতে হয় যে, গেল শ্রাবণ মাসে মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা বিদ্যুতের জবুথবু পোলগুলো থেকে অকস্মাৎ তার ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছিল এই র্যালি সাইকেলটার ওপরেই। এবং তাতে করে বিদ্যুৎস্পর্শ হয়ে সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যুবরণ করেছিল বখতিয়ার খান। সেই থেকে পাইন গ্রিন সাইকেলটা অবহেলায় পড়ে আছে খান পরিবারের এই গ্যারাজে।
মধ্যপৌষের সেই সকালে ৪৪ নম্বর বাসার গ্যারাজে ফেলে রাখা বখতিয়ার খানের সাইকেলটাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিল জগলুল আহমেদ, গোলাম ফারুক এবং খোকন। তারা দেখেছিল যে, সাইকেলটার পাইন গ্রিন রংটা চটে গেছে বিভিন্ন জায়গায়; হ্যান্ডেল এবং ডাউন টিউব বাঁকা হয়ে গেছে কোথাও কোথাও; ভেঙে গেছে বাম দিকের প্যাডেলটা আর সামনের চাকার স্পিন্ডিল; এবং চেইন গার্ডের ভেতর থেকে বের হয়ে বাইরের দিকে ঝুঁলছে ছিঁড়ে যাওয়া চেইন। সাইকেলটা দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল যে, বিদ্যুৎস্পর্শ হওয়ার পরপরই ভারসাম্য হারিয়ে সাইকেলসহ মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারসংলগ্ন রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়েছিল বখতিয়ার খান। তা না হলে সাইকেলটা এমন ক্ষতিগ্রস্ত হতো না বলেই মনে হয়। তখন তারা সহজেই অনুমান করেছিল যে, ভাঙাচোরা এই সাইকেলটা নিয়ে কারোর পক্ষেই কোনোভাবেই রাস্তায় নামাটা অসম্ভব। অর্থাৎ ক্রিংক্রিং বেল বাজাতে বাজাতে ইদানীং রাতের বেলায় লেক সার্কাস এলাকার রাস্তায় যে সাইকেলটা ঘুরে বেড়াচ্ছিল এটা সেই সাইকেল হতেই পারে না। তখন স্বভাবতই জগলুল আহমেদদের মনে প্রশ্ন জেগেছিল, তাহলে গভীর রাতে লেক সার্কাস রোড প্রদক্ষিণ করে বেড়াচ্ছে কোন সাইকেলটা? বিস্তর ভাবনা এবং আলোচনার পরও প্রশ্নটার কোনো সমাধান হয়নি সেই মুহূর্তে।
বখতিয়ার খানদের গ্যারাজে দাঁড়িয়ে থাকার সময় স্বল্প আলোতেই জগলুল আহমেদ, গোলাম ফারুক, খোকন এবং অন্যরা দেখতে পেয়েছিল, বখতিয়ার খানের মৃত্যুর পর গেল চার মাসে সাইকেলটার ওপরে জমে উঠেছে ধুলার পুরু আস্তর এবং সে কারণে সাইকেলটার পাইন গ্রিন রংটা আর ভালো করে বোঝাই যাচ্ছে না। এমনকি সাইকেলটার রুপালি রঙের বেলটাতেও ঘন হয়ে একগাদা ধুলা জমে আছে। এমন একটা অবস্থায় জগলুল আহমেদ খোকনকে বলেছিল : গ্যারাজের লাইটটা জ্বালা তো দেহি!
মহল্লায় ঘুরে বেড়ানো ভৌতিক সাইকেল নিয়ে দুশ্চিমিন্তত খোকন তখন গ্যারাজের লাইট জ্বালানোর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একেবারেই কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না। তাই সে তদ্গতভাবে জগলুল আহমেদকে জিজ্ঞাসা করেছিল : লাইট জ্বালাইতে হইব কেন জগলু ভাই?
খোকনের প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে উত্তর দিয়েছিল জগলুল আহমেদ : আরে দেহি না, বেলের ওপরে কারো আঙুলের ছাপটাপ পইড়া আছে নেকি! এমন তো হইতে পারে যে, রাইতের বেলায় বখতিয়ারগো গ্যারাজে ঢুইকা কোনো বান্দর পোলায় বেল বাজাইতেছে!
জগলুল আহমেদের বুদ্ধিটা পছন্দই হয়েছিল খোকনের। তাই সে শশব্যস্ত হয়ে গ্যারাজের একমাত্র লাইটটা জ্বেলেছিল। কিন্তু ৪০ ওয়াটের লাইটের ম্রিয়মাণ আলোতে, যদিও তখন সকালটা রৌদ্রোজ্জ্বল, গ্যারাজের অন্ধকারটা অপসৃত হয়নি কিছুতেই। তখন সুমিত তার মোবাইল ফোন থেকে সোজা জোরালো আলো ফেলেছিল বখতিয়ার খানের সাইকেলের বেলের ওপরটায়। সেই আলোতে বখতিয়ার খানদের গ্যারাজে সমবেত মানুষজন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল বেলটা। তবে বেলের গায়ের ধুলার ঘন আস্তরের ওপরে কারো আঙুলের ছাপ চোখে পড়েনি তাদের। এভাবে তারা উপসংহার টেনেছিল যে, বখতিয়ার খানের ভাঙাচোরা সাইকেলটার বেল টিপে টিপে কর্কশ একটা ক্রিংক্রিং আওয়াজ তুলছে না কেউই। তখন তারা ভয়ানক অবাক হয়েছিল এই ভেবে যে, বখতিয়ার খানের সাইকেলের বেল যদি না হবে তাহলে কোন সাইকেলের বেল বাজে রাতের বেলায়, যেই বেলের আওয়াজটা অবিকল বখতিয়ার খানের সাইকেলের বেলের আওয়াজেরই মতন? কিন্তু অনেক ভেবেচিস্তেও সেই রহস্যের কোনো মীমাংসা করতে পারেনি তারা। বখতিয়ার খানের সাইকেলের বেলের গায়ে মনুষ্য আঙুলের ছাপ পাওয়া গেলেই যেন তারা স্বসিন্ত বোধ করতে পারত! তাহলে তারা ভাবতে পারত যে, রাতের বেলায় বখতিয়ার খানদের গ্যারাজে চুপিচুপি ঢুকে বেল বাজাচ্ছে মহল্লার কোনো ফাজিল এবং সেই কর্কশ আওয়াজটা বাতাসে ভাসতে ভাসতে ছড়িয়ে পড়ছে নিস্তব্ধ মহল্লার কোণে কোণে। কিন্তু পরিস্থিতি তেমনটা হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নাই বলে তাদের কাছে মনে হয়েছিল। কাজেই ভৌতিক সাইকেল-বিষয়ক চরম অস্বসিন্তটা শেষ পর্যন্ত বলবৎ থেকেই গিয়েছিল বখতিয়ার খানদের গ্যারাজে জড়ো হওয়া লেক সার্কাস এলাকার কতিপয় বাসিন্দার মনের ভেতরে।
বখতিয়ার খানদের গ্যারাজ থেকে বের হয়ে ফের দুলালের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল জগলুল আহমেদ, গোলাম ফারুক, শহিদুল আলম, খোকন, সিরাজ মিয়া, গণি, দুলাল, সুমিত, মিলন আর শিমুল। রাস্তার রোদে দাঁড়িয়ে দুলালের দোকানের চা খেতে খেতে তখন তারা মৃত বখতিয়ার খানের জীবন নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত হয়েছিল। তাদের মনে পড়েছিল, ১৯৫৪ সালে ঢাকা নগরের গেন্ডারিয়া এলাকার ডিস্টিলারি রোডে জন্মগ্রহণ করেছিল বখতিয়ার খান। তার জন্মের আগেই, ১৯৫৩ সাল, পুরান ঢাকার বিভিন্ন বাসায় ভাড়া থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে কলাবাগানে দশ কাঠা জমি কিনেছিল তার পিতা লৌহজংয়ের মোহাম্মদ সেলিম খান। বর্তমান কলাবাগানের ফার্স্ট লেন থেকে কলাবাগান বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত জায়গাটায় তখন কেবল কলাগাছের ছড়াছড়ি। সেই কলার বাগানের উত্তরে ঝোপজঙ্গলের ভেতরে মোহাম্মদ সেলিম খান যে জায়গাটা খরিদ করেছিল তার ঠিক উত্তর দিকে ছিল রায়েরবাজার-ধানমন্ডি-শুক্রাবাদ খাল, যে খালটার ধারা তখন আবার পড়ত গিয়ে পুবের বেগুনবাড়ি খালে। বখতিয়ার খানের জন্মের এক বছরের মতো পরে প্রায়-মনুষ্যবিহীন কলাবাগানে টিনের চাল দেওয়া একতলা একটা বাসা তুলেছিল মোহাম্মদ সেলিম খান এবং বর্ধিষ্ণু গেন্ডারিয়া ফেলে সে তার পরিবার নিয়ে ঢাকা নগরের নতুন একটা এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেছিল। তখন ঢাকা পৌরসভা কর্তৃপক্ষ ধানমন্ডি লেকের ধারের এই এলাকাটার নামকরণ করেছিল ‘লেক সার্কাস’। লেক সার্কাসে নতুন বসতি স্থাপন করলেও পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া, সূত্রাপুর, বকশীবাজার এবং লালবাগ এলাকার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বখতিয়ার খানের পরিবারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থেকেই গিয়েছিল।
ঢাকা নগরের এই লেক সার্কাস এলাকাতেই বেড়ে উঠেছিল বখতিয়ার খান। তারপর একসময়ে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিল। মাস্টার্স পাশ করার পর ১৯৮২ সালে সোনালী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসে জুনিয়ার অফিসার পদে যোগদানের পর থেকে ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় চেকবই ইস্যু করা, দেশে-বিদেশে টাকা পাঠানো, অ্যাকাউন্টহোল্ডারদের বিভিন্ন দাবির ক্লিয়ারিং, শিল্পঋণ বিতরণ ইত্যাদি দায়িত্বপূর্ণ কাজে অংশ নিয়েছিল বখতিয়ার খান। ২০১৩ সালে সে চাকরি থেকে অবসরে গিয়েছিল। কাছাকাছি সময়ে অবসর গ্রহণ করেছিল বখতিয়ার খানের অপর দুই বন্ধু – জগলুল আহমেদ এবং গোলাম ফারুক। তখন প্রাতঃভ্রমণের পর তাদের তিনজনের সামনে অপেক্ষা করছিল দীর্ঘ, অলস একেকটা মুহূর্ত। তারা যার যার বাসায় ফিরে গিয়ে আসেন্ত-ধীরে নাশতা করছিল এবং মনোযোগ দিয়ে পড়ছিল বিভিন্ন খবরের কাগজ। তারপর তারা তিন বন্ধু ঢুকে যাচ্ছিল যার যার নিজস্ব রুটিনের ভেতরে। জগলুল আহমেদ ইন্টারনেটে এটা-ওটা ব্রাউজ করছিল। বাসার ছাদে বাগান করছিল গোলাম ফারুক। বখতিয়ার খান ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেলিভিশনে বিভিন্ন খবর এবং অনুষ্ঠান দেখছিল। দুপুরে গোসল করে খেয়ে-দেয়ে তারা যার যার মতো একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছিল এবং মহল্লার মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করার পর তারা মূলত কলাবাগান ক্লাবে বসেই আড্ডা দিচ্ছিল অনেক রাত পর্যন্ত। আড্ডার কোনো পর্যায়ে তখন তাদের সঙ্গে মিলছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহিদুল আলম। এছাড়া কখনোবা কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডের কাছের ‘আজাদ হোটেল’ অথবা গ্রিন রোডের ‘জিঞ্জিরা হোটেলে’ বসে তারা চারজনে মিলে তারিয়ে তারিয়ে চা খাচ্ছিল। কখনোবা দো-তরফায় ধানমন্ডি লেকের ধারে হাঁটতে যাচ্ছিল তারা। অবসর-পরবর্তী এই শস্নথ জীবন নিয়ে জগলুল আহমেদ এবং গোলাম ফারুকের বিস্তর অভিযোগ থাকলেও বখতিয়ার খানের কিন্তু কোনোই অভিযোগ ছিল না। বরং সে প্রায়ই বন্ধুদের বলত : কী যে কস না তরা! রিটায়ার কইরা তো ভালোই লাগতাছে আমার! রুটিরুজির ধান্দায় কাজবাজ করতে করতে না হয়রান হয়া গেছিলামগা আমি!
এমন একটা সময়ে, ২০১৩ সালের আষাঢ় মাসে, ঢাকা নগরের বিভিন্ন এলাকায় পানির পুরনো লাইনের বদলে যথারীতি নতুন লাইন বসানোর কাজ শুরু হয়েছিল। সে কারণে আবারো বিভিন্ন রাস্তাঘাট কাটাকুটি শুরু করেছিল ঢাকা ওয়াটার অ্যান্ড স্যুয়ারেজ অথরিটি (ওয়াসা)। লেক সার্কাস মহল্লার রাস্তাগুলোও কাটা পড়ছিল তখন। প্রায় তিন সপ্তাহ রাত-দিন ধরে চলছিল ওয়াসার নতুন লাইন বসানোর কাজ। তাতে করে মহল্লার রাস্তাগুলো কার্যত প্রস্থে কমে গিয়েছিল এবং সেখান দিয়ে সহজে প্যাসেঞ্জার কার, জিপ, মাইক্রোবাস এবং রিকশা চলাচল করতে পারছিল না। তদুপরি আষাঢ়ের টানা বৃষ্টিতে রাস্তার ধারে পড়ে থাকা লাল মাটি ভিজে গিয়ে রাস্তা পিছলও হয়ে গিয়েছিল। মহল্লার রাস্তা ধরে তখন হেঁটে চলাফেরা করতে অসুবিধা হচ্ছিল মহল্লার মানুষজনের এবং তাতে করে মহল্লার আদি বাসিন্দা এবং বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের নয়া বাসিন্দাদের ভেতরে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল প্রতিবছরের মতোই। তখন একদিন ভোর ছ’টার দিকে প্রচ- বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল পুরো লেক সার্কাস এলাকা। অতর্কিতে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় হতভম্ব হয়ে বাসাবাড়ি থেকে রাস্তায় নেমে এসেছিল মানুষজন। ২৯ নম্বর বাসাটার সামনের ফাঁকা জায়গাটায় টিনের চাল এবং পাঁচ ইঞ্চি ইটের গাঁথুনি দিয়ে একদা যে অস্থায়ী একতলা বাসা নির্মাণ করা হয়েছিল সেটার একটা বড় অংশ ততক্ষণে ভেঙেচুরে মিশে গেছে মাটির সঙ্গে। দু-ঘরের অস্থায়ী বাসাটার সামনের রাস্তা থেকে প্রজ্জ্বলিত গ্যাসের শিখা আকাশে উঠে গেছে প্রায় বিশ ফুট পর্যন্ত এবং অগ্নিশিখার তাপে ঝলসে যাচ্ছে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেহগনি গাছ।
পূর্ব-অভিজ্ঞতা থেকে লেক সার্কাসের মানুষজন তখন বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছিল যে, গ্যাসের লাইন ফেটে গিয়েই আসলে অস্থায়ী বাসাটাতে বিস্ফোরণ ঘটেছে। কালবিলম্ব না করে তখন ২৯ নম্বর বাসার গ্যারাজের কলে পাইপ লাগিয়ে ধ্বংসসত্মূপে পানি ছিটাতে শুরু করেছিল উপস্থিত মানুষজনের কেউ কেউ। কেউ কেউ আবার ২৮ নম্বর বাসার নিচতলা থেকে বালতিতে করে পানি বয়ে এনে সজোরে নিক্ষেপ করেছিল ২৯ নম্বর বাসায় জ্বলতে থাকা আগুনের ওপর। ৩১ নম্বরে নির্মাণাধীন অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের ভেতর থেকে বালতি দিয়ে বালি টেনে এনে সেই আগুনের ওপরে ছিটিয়ে দিয়েছিল কেউবা। কিন্তু কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছিল না গ্যাস-পোড়া লেলিহান আগুন। কাজেই কেউ একজন বুদ্ধি করে তখন ফায়ার সার্ভিসকে ফোন করে দিয়েছিল। এদিকে প্রজ্জ্বলিত গ্যাসের শিখা উপেক্ষা করে কেউ একজন ধ্বংসসত্মূপের কাছাকাছি গিয়ে দেখতে পেয়েছিল, সেখানে জবলতে থাকা ইট-কাঠ এবং করোগেটেড টিনের নিচে আহত হয়ে পড়ে আছে ২৯ নম্বর বাসার অস্থায়ী অংশের ভাড়াটিয়াদের তিনজন – মহলস্নলার ‘কবির ডেকোরেটরে’র ম্যানেজার আতিক, আতিকের ছোট বোন হ্যাপি এবং আতিকের বিধবা মা। আহত তিনজনকে উদ্ধার করে সঙ্গে সঙ্গেই বেসরকারি একটা অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে। ইতোমধ্যে রাস্তা ফাঁকা পেয়ে মোহাম্মদপুর ফায়ার সার্ভিস স্টেশন থেকে দ্রুতগতিতে দুর্ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হয়েছিল অগ্নিনির্বাপকদের একটা দল এবং তারা ২৯ নম্বর বাসার অস্থায়ী অংশে জ্বলতে থাকা আগুনের ওপরে দ্রুত কার্বন ডাই-অক্সাইড ছিটিয়ে দিয়ে সহজেই আগুন নিভিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু তখনো জ্বলছিল রাস্তার পাশের গ্যাসের মূল লাইনে ধরে-যাওয়া আগুন। অগ্নিনির্বাপকেরা অনুমান করেছিল যে, আগের রাতে পানির লাইন বসানোর জন্য খোঁড়াখুঁড়ির সময় নিশ্চয়ই গ্যাসের লাইন ছিদ্র করে ফেলেছিল ওয়াসার ঠিকাদারের শ্রমিকেরা। সেই ছিদ্র দিয়ে নির্ঘাৎ গ্যাস বের হচ্ছিল সারারাত ধরে। সেই রাতে আতিকদের রান্নাঘরের গ্যাসের চুলা ঠিকমতো বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল কেউ না কেউ এবং সে-কারণে রাত থেকেই রান্নাঘরসহ সারা বাসায় ধীরে ধীরে গ্যাস জমে উঠেছিল নিশ্চয়। এটা পরিষ্কার যে, আতিকরা ব্যাপারটা টেরই পায়নি। তারপর ভোরবেলায় কোনো পথচারী হয়তোবা জ্বলন্ত সিগারেটের উচ্ছিষ্টাংশ ছুড়ে ফেলেছিল রাস্তার পাশে। তখনই নিশ্চয় রাস্তা থেকে নির্গত গ্যাসের সঙ্গে সিগারেটের আগুনের সংস্পর্শটা ঘটে গিয়েছিল। তাতে করে ২৯ নম্বর বাসার গ্যাস-সাপস্নাইয়ের লাইনে ঢুকে পড়েছিল রাস্তার আগুন। সেই আগুন পাইপের ভেতর দিয়ে ছুটে গিয়েছিল আতিকদের বাসা পর্যন্ত এবং সেই বাসায় জমে থাকা গ্যাসে আগুন ধরে গিয়েছিল নিমিষেই। তার পরপরই বিস্ফোরিত হয়েছিল আতিকদের পাঁচ ইঞ্চি গাঁথুনির অস্থায়ী বাসাটা। অগ্নিনির্বাপকদের বিশেস্নষণ মনঃপূত হয়েছিল বটে লেক সার্কাসের বাসিন্দাদের এবং তারা ওয়াসার ঠিকাদার, ঠিকাদারের সহযোগী আর শ্রমিকদের ধরে আচ্ছাসে পেটানোর জন্য মহল্লাময় খুঁজেছিল আঁতিপাঁতি করে। তবে বিপদ বুঝতে পেরে ওয়াসার ঠিকাদার কোম্পানির সবাই ততক্ষণে ভেগে গিয়েছিল কোথাও।
কিছু পরে ফেটে যাওয়া গ্যাস-সাপস্নাইয়ের লাইন মেরামত করতে এসেছিল তিতাস গ্যাস-সঞ্চালন এবং বিতরণ কোম্পানির কর্মীবৃন্দ। পেটানোর জন্য তাদের ওপরে লেক সার্কাসের বাসিন্দারা চড়াও হলে তারা সকলে কাঁচুমাচু হয়ে বলেছিল : তাদের কী দোষ? তারা তো আর গ্যাস-সাপস্নাইয়ের লাইনটা ছিদ্র করেনি! সেই দুষ্কর্মটা করেছে ওয়াসা! কাজেই এই দুর্ঘটনার দায়দায়িত্ব তাদের ওপরে না দেওয়াটাই ভালো! কথা যুক্তিযুক্ত। কাজেই তিতাস গ্যাস-সঞ্চালন এবং বিতরণ কোম্পানির কর্মীবৃন্দ শারীরিকভাবে হেনস্থা হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল শেষ পর্যন্ত।
দুদিন পরে খবর এসেছিল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের ইনটেনসিভ কেয়ারে মৃত্যু হয়েছে আতিকের অগ্নিদগ্ধ মায়ের। আতিকের মায়ের শরীরে কোনোভাবে সেকেন্ডারি ইনফেকশন ছড়িয়ে গিয়েছিল, যা আর কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। আতিকের মায়ের মৃত্যুর এক সপ্তাহের মাথায় একইভাবে মৃত্যুবরণ করেছিল আতিকের ছোট বোন হ্যাপি। তবে সকলকে অবাক করে দিয়ে বেঁচে গিয়েছিল অগ্নিদগ্ধ আতিক।
আতিকের মা এবং তার বোনের অনভিপ্রেত মৃত্যুতে খুবই দুঃখিত হয়েছিল লেক সার্কাস এলাকার আদি এবং নতুন বাসিন্দারা। ঢাকা নগরের সেবা প্রদানকারী বিভিন্ন সরকারি সংস্থাগুলোর অব্যবস্থাপনা এবং তাদের পরস্পরের ভেতরের সমন্বয়হীনতা নিয়ে সে-সময়ে তারা ভীষণ কুপিত হয়েছিল। বখতিয়ার খানও আর সকলের মতোই ভয়ানকভাবে উত্তেজিত হয়েছিল তখন এবং সে তীব্র পরিতাপ নিয়ে তার বন্ধুদের বারবার বলেছিল একই কথা : ঢাকা শহরটা তো ধ্বংস হয়া যাইতেছে! এই নিয়া কারোর কোনো মাথাব্যথা নাই! সবাই মিলা খালি পান খাইতেছে আর গান গাইতেছে। একটা কিছু তো করন দরকার!
এই মুহূর্তে দুলালের দোকানের সামনে সমবেত সকলকে শহিদুল আলম আরো স্মরণ করিয়ে দেয় যে, তখনই জীবনে প্রথম একটা ফিচার লিখে ফেলেছিল বখতিয়ার খান। ঢাকা নগরে জনসংখ্যার অত্যধিক চাপ, নাগরিক সুবিধাদির অপ্রতুলতা এবং সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর ভেতরের সমন্বয়হীনতার চিত্র নিয়ে লেখা সেই ফিচারটা বখতিয়ার খান বহুল প্রচারিত একটা দেশীয় সংবাদপত্রে ছাপতে দেবে বলে মনস্থির করেছিল। সংবাদপত্রটার ওয়েবসাইটে গিয়ে সম্পাদক বা সহযোগী সম্পাদক অথবা কোনো সহকারী সম্পাদকের ই-মেইল অ্যাড্রেস খুঁজে পায়নি বখতিয়ার খান। অতঃপর সে ওয়েবসাইটটাতে উলিস্নখিত ইনফরমেশন সংক্রান্ত ই-মেইল অ্যাড্রেসেই তার ফিচারটা পাঠিয়ে দিয়েছিল।
তারপর তিন মাস অতিক্রান্ত হলেও বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রটাতে বখতিয়ার খানের ফিচারটা ছাপা হচ্ছিল না। লেখাটা কি তবে সম্পাদকের অপছন্দ হয়েছে? এমন একটা ভাবনা থেকে সংবাদপত্রটার জনৈক সহকারী সম্পাদককে ফোন করেছিল বখতিয়ার খান। সহকারী সম্পাদক মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনেছিল এবং সে বখতিয়ার খানকে তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল এভাবে : কোন লেখাটার কথা বলছেন তা তো মনে করতে পারছি না ভাই! আসলে প্রতিদিন এত লেখা আসে আমাদের কাছে যে, মাঝে মাঝে আমরা নিজেরাই ট্র্যাক হারিয়ে ফেলি। আপনি এক কাজ করুন – আমার ই-মেইল অ্যাড্রেস দিচ্ছি আপনাকে। দয়া করে লেখাটা আমাকে পাঠিয়ে দিন।
ফোন রেখে দিয়ে বিরস বদনে সেই সহকারী সম্পাদককে ফিচারটা মেইল করে দিয়েছিল বখতিয়ার খান। এই বৃত্তান্ত শুনে বখতিয়ার খানের বন্ধু গোলাম ফারুক মন্তব্য করেছিল : তর লেখা হ্যারা ছাপাইব না দেহিস! তুই তো আর পপুলার কোনো কলামিস্ট না! পত্রিকা অফিসগুলা মনে করে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার, আমলা, এনজিওকর্মী আর সাংবাদিক ছাড়া এই জগতের আর কেউই কিছু জানে না! বুঝিস কিন্তু!
গোলাম ফারুকের মন্তব্যে কিছুটা হতোদ্যম হলেও ফিচার ছাপা হওয়ার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়েই অপেক্ষা করছিল বখতিয়ার খান। তবে আরো দু-মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও সংবাদপত্রটাতে তার ফিচারটা আর ছাপা হলো না। এভাবে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ফিচার ছাপা হওয়ার জন্য অপেক্ষা করাটা সে বন্ধ করে দিয়েছিল। অবশ্য কদিন পরই আরেকটা ফিচার রচনা করে ফেলেছিল বখতিয়ার খান। তার দ্বিতীয় ফিচারটা ছিল ঢাকা নগরের দুর্বিষহ যানজটের ওপরে।
দুলালের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে শীতের রোদ পোহাতে পোহাতে খোকন এবং অন্যদের তখন এ-ও মনে পড়েছিল, ঢাকা নগরের ক্রমবর্ধমান যানজট নিয়েও ভাবিত হয়েছিল বখতিয়ার খান। অবসর গ্রহণের ঠিক আগমুহূর্তে সে কাজ করেছিল সোনালী ব্যাংকের কলেজগেট শাখার ম্যানেজার হিসেবে। তখন নিজের প্যাসেঞ্জার কারে চেপে লেক সার্কাস থেকে মিরপুর রোড ধরে প্রতিদিন সে অফিসে যেত। সকাল আটটার দিকে ধানমন্ডি এলাকার সবগুলো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ক্লাস শুরু হয় – একথা সকলেরই জানা। ছাত্রছাত্রীকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যখন প্যাসেঞ্জার কারগুলো বিভিন্ন দিকে ফিরে যেতে থাকে তখন সচরাচর সেই গাড়িবহরের একটা বড় অংশের চাপ পড়ে গিয়ে মিরপুর রোডের ওপরে। সেই চাপের ভেতরে পড়ে ২০১০ সালে লেক সার্কাস থেকে কলেজগেট পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে বখতিয়ার খানের প্রায় ৩০ মিনিটের মতো সময় লেগে যাচ্ছিল। সে তখন হিসাব কষে দেখতে পেয়েছিল, কোনো যানজট না থাকলে, বিশেষত যেদিন ধানমন্ডির সব স্কুল বন্ধ থাকে, সেদিন এটুকু পথ মাত্র ১০ মিনিটেই অতিক্রম করে ফেলা সম্ভব। যতই দিন যাচ্ছিল সকালের পিক আওয়ারে মিরপুর রোডে যানজট বেড়ে যাচ্ছিল ক্রমাগত এবং ২০১৩ সালে, বখতিয়ার খানের অবসর গ্রহণের ঠিক আগমুহূর্তে, লেক সার্কাস থেকে কলেজগেট পর্যন্ত যেতে প্রতিবারই আগের চেয়ে বেশি সময় লেগে যাচ্ছিল তার – প্রায় ৪৫ মিনিটের মতো। আর তখন যানজটে পড়ে গিয়ে গাড়িতে বসে থাকতে থাকতে প্রতিদিন বিরক্ত হয়ে পড়ছিল বখতিয়ার খান। অবসর গ্রহণের পরের বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালের পয়লা দিকে পেনশন দাবি করার জন্য বিভিন্ন হিসাবের বিবরণী তৈরির কাজে বাসা থেকে কোনোদিন তাকে যেতে হচ্ছিল সোনালী ব্যাংকের কলেজগেট শাখায়, আবার কোনোদিন মতিঝিলের হেড অফিসে। তখন প্যাসেঞ্জার কারে চেপে লেক সার্কাস থেকে কলেজগেট পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার রাস্তা ভাঙতে তার সময় লেগে যাচ্ছিল প্রায় এক ঘণ্টার কাছাকাছি। আর কোনোদিন পিক আওয়ারে কলেজগেট থেকে মতিঝিলের হেড অফিসে যাওয়া পড়লে তো কেল্লা ফতে! তখন যানজটে পড়ে পাক্কা দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় খামোখা গাড়িতে বসেই কাটাতে হচ্ছিল তাকে।
এভাবে প্রতিদিন তীব্র যানজটের পাল্লায় পড়ে বখতিয়ার খানের মেজাজ চরম পর্যায়ে খারাপ হয়ে গিয়েছিল এবং সে স্থির করেছিল, ঢাকা নগরের যানজট-সংক্রান্ত সমস্যা এবং তার সমাধান নিয়ে সে একটা ফিচার লিখবে; লেখাটা সে ছাপতেও দেবে জনপ্রিয় কোনো সংবাদপত্রের পাতায়। বখতিয়ার খানের দ্বিতীয় ফিচারটার সারাংশটা ছিল এমন : যানবাহন হিসেবে ঢাকা নগরের রাস্তায় যেহেতু সিএনজিচালিত প্যাসেঞ্জার কারের সংখ্যাই বেশি, কাজেই যানজট নিরসনের জন্য স্পষ্টতই প্যাসেঞ্জার কারের সংখ্যা সীমিত করা প্রয়োজন এবং সে-কারণে প্যাসেঞ্জার কারগুলো কর্তৃক সিএনজি ব্যবহারের ওপরে জরুরিভিত্তিতে কর আরোপ করাটাই শ্রেয়। এ বিষয়ে লেক সার্কাস এলাকার আদি এবং নতুন বাসিন্দাদের কারো কারো সঙ্গে আলাপ করেছিল বখতিয়ার খান এবং সেসব বাসিন্দা তার যুক্তির সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছিল। তারপর কোনো এক জনপ্রিয় সংবাদপত্রে ফিচারটা জমা দেওয়ার পর অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল তিন মাসের মতো সময়। কিন্তু বখতিয়ার খানের দ্বিতীয় ফিচারটাও আর ছাপা হচ্ছিল না। তাই অধৈর্য হয়ে সে ফোন করে বসেছিল সংবাদপত্রটার কার্যনির্বাহী সম্পাদককে। কার্যনির্বাহী সম্পাদকের সঙ্গে নাতিদীর্ঘ কথোপকথনের পর সে বুঝতে পেরেছিল যে, সহসা ফিচারটা ছাপা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কাজেই চরমভাবে হতাশ বখতিয়ার খান তার দ্বিতীয় ফিচারটা কিছুটা এডিট করে একটা স্মারকলিপি বানিয়ে ফেলেছিল। তারপর সে সেগুনবাগিচা গিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর জমা দিয়েছিল তার স্মারকলিপিটা।
২০১৪ সালের জাতীয় বাজেট ঘোষণার দিন ক্রমাগত এগিয়ে আসছিল। এদিকে বখতিয়ার খানের বাল্যবন্ধুরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিবেচনাবোধের ওপরে আস্থা রাখতে পারছিল না মোটেই। যেমন, বখতিয়ার খানের বন্ধু গোলাম ফারুক তখন ঘোরতর সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। বখতিয়ার খানকে সে বলেছিল : জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সিএনজির ওপরে ট্যাক্স বসাইব না ছাই! উলটা রিকন্ডিশন্ড কারের আমদানির ওপরে ট্যাক্স কমায়া দেয় কিনা হেইডা আগে তুই দেখ!
গোলাম ফারুকের মন্তব্য শুনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নীতির গতি ও প্রকৃতি নিয়ে বখতিয়ার খানের মনেও সন্দেহ ঘনীভূত হয়েছিল বটে। তবু বাজেট ঘোষণা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়েই সে বসেছিল। কার্যত দেখা গেল যে, ২০১৪ সালের জাতীয় বাজেটে প্যাসেঞ্জার কারগুলো কর্তৃক সিএনজির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। এমতাবস্থায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওপরে ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল বখতিয়ার খান এবং সে তার নিজের প্যাসেঞ্জার কারটা বিক্রি করে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। চলাফেরার অসুবিধার কথা ভেবে সেই সিদ্ধাস্তে আপত্তি জানিয়েছিল তার স্ত্রী মালিহা খাতুন এবং তাদের ছেলেমেয়ে সবাই। পরিবারের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও টয়োটা অ্যালিয়নটা শেষ পর্যন্ত বিক্রিই করে দিয়েছিল বখতিয়ার খান। তারপর মেরামত এবং রং করিয়ে নিয়ে সে শ্রী ফিরিয়েছিল তার পুরনো পাইন গ্রিন র¨vলি সাইকেলটার। তখন পাইন গ্রিন র¨vলি সাইকেলটা চালিয়ে বিভিন্ন কাজে বাইরে যেতে দেখা যাচ্ছিল বখতিয়ার খানকে।
দুলালের দোকানের সামনে শীতের রোদে দাঁড়িয়ে এই মুহূর্তে খোকনের মনে পড়ে, পরপর দুটো সংবাদপত্রে ফিচার ছাপা না হওয়ায় বখতিয়ার খান শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে গিয়েছিল। ঘুরেফিরে সে লেক সার্কাস মহল্লার বাসিন্দাদের বলছিল : আচ্ছা! তোমরাই কও, আমি কি ভুলভাল কিছু লিখছিলাম যে হ্যারা আমার লেখাগুলা ছাপাইল না? এই ঢাকা শহর তো ধ্বংস হয়া যাইতেছে! আর আমরা সবাই মিলা খালি পান খাইতেছি আর গান গাইতেছি। একটা কিছু তো করন দরকার!
এমন একটা সময়ে আষাঢ়ের এক দুপুরে ঢাকা নগরে একটানা তুমুল বৃষ্টিপাত হয়েছিল প্রায় এক ঘণ্টা ধরে। বৃষ্টির পানিতে যথারীতি তলিয়ে গিয়েছিল ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোডের পুবমাথা। মোহাম্মদপুরের টাউন হল বাজারের কাছের একটা দোকান থেকে স্ট্যাম্প পেপার কিনতে গিয়ে তখন অঝোর বৃষ্টিতে আটকে পড়েছিল খোকন। বৃষ্টি থামলে সে রিকশা খুঁজেছিল লেক সার্কাসে ফেরার জন্য। কিন্তু বৃষ্টির অব্যবহিত পরে সবগুলো রিকশাই অত্যধিক ভাড়া দাবি করাতে অগত্যা সে টাউন হল বাজার থেকে আসাদ অ্যাভিনিউ ধরে হাঁটা দিয়েছিল আসাদগেটের দিকে। মিরপুর রোডে ওঠার পর সে দেখতে পেয়েছিল, অজস্র গাড়ি ইঞ্জিন বন্ধ করে রেখে রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। রাস্তা ধরে দক্ষিণে আগালে খোকন আবিষ্কার করেছিল যে, ধানমন্ডি বয়েজ স্কুলের সামনের রাস্তায় প্রায় তিরিশ গজ পর্যন্ত ময়লা পানি জমে আছে কোমর-সমান। সাইলেন্সারে পানি ঢুকে যাওয়ার ভয়ে কোনো গাড়িই আর মিরপুর রোড ধরে পানি ভেঙে উত্তর বা দক্ষিণে কোনো দিকেই যাওয়া-আসা করতে পারছে না। উপায়ান্তর না দেখে রাস্তায় আটকেপড়া প্রায় শ’তিনেক মানুষ গাড়িগুলো থেকে নেমে বয়েজ স্কুলের সামনের ফুটপাত দিয়ে তখন এগিয়ে যেতে থাকে দক্ষিণ দিক বরাবর এবং এক পর্যায়ে তারা তাদের কাপড় হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে নেমে যেতে বাধ্য হয় রাস্তায় জমে থাকা ময়লা পানিতে। একইভাবে পানি ভেঙে দক্ষিণ থেকে উত্তরদিকে চলতে থাকে শখানেক মানুষ। এমন একটা বিপদসংকুল পরিস্থিতিতে খোকন দেখতে পেয়েছিল, জলাবদ্ধ মিরপুর রোডের প্রায় কোমর-সমান ময়লা পানির ভেতর দিয়ে সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে তার সমান্তরালে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বখতিয়ার খান। পানি পারি দিয়ে মিরপুর রোডের শুকনো অংশে ওঠার পর খোকন এবং বখতিয়ার খান ভেজা শরীরে হাঁটতে হাঁটতে লেক সার্কাসের দিকে হাঁটা দিয়েছিল এবং ওয়াসা আর ঢাকা সিটি করপোরেশনের মু-পাত করছিল তারা। বখতিয়ার খান তখন খোকনকে জানিয়েছিল যে, সে বেড়াতে গিয়েছিল তাজমহল রোডের তার চাচাতো ভাইয়ের বাসায়। তুমুল বৃষ্টিতে সে ওখানেই আটকে গিয়েছিল। ধানমন্ডি সাতাশ নম্বরের পুবমাথা যে ততক্ষণে তলিয়ে গেছে বৃষ্টির পানির নিচে তা তার ধারণাতেই ছিল না। বৃষ্টি থামার পর সাইকেল চালিয়ে জাকির হোসেন রোড ধরে লালমাটিয়ার ভেতর দিয়ে মিরপুর রোডে ওঠার পর সে বিপদটা টের পেয়েছিল। অতঃপর আর সবার মতো করে সে মিরপুর রোডে জমে থাকা ময়লা পানিতেই নেমে পড়েছিল তার র¨vলি সাইকেলটা নিয়ে।
খোকন আরো স্মরণ করতে পারে যে, আষাঢ় মাসের সেই রাতেই ঢাকা নগরের জলাবদ্ধতা দূর করার পদ্ধতি নিয়ে তার তৃতীয় ফিচারটা রচনা করেছিল বখতিয়ার খান। সে লিখেছিল যে, ঢাকা নগরের সমস্ত খালবিল জরুরিভিত্তিতে সংস্কার করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রয়োজন রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা বর্জ্য প্রতিনিয়ত অপসারণ করা। তা না হলে বৃষ্টির পানিতে ভাসতে ভাসতে বিবিধ বর্জ্য বক্স কালভার্ট আর ড্রেনগুলোর মুখে গিয়ে আটকে যাবে এবং তখন জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবেই হবে। ঢাকা নগরের জলাবদ্ধতা-বিষয়ক সেই ফিচারটা ছাপানোর জন্য বখতিয়ার খান কোনো একটা অনলাইন সংবাদপত্রে মেইল করে দিয়েছিল। তারপর লেক সার্কাস মহল্লার আদি বাসিন্দা এবং অ্যাপার্টমেন্ট-বিল্ডিংগুলোর নতুন বাসিন্দাদের কাউকে কাউকে বখতিয়ার খানের তৃতীয় ফিচারটার ফটোকপি বিলিয়ে দিয়েছিল দুলাল আর সিরাজ মিয়া।
উল্লেখ করা যেতে পারে, লেক সার্কাস মহল্লার আদি এবং নতুন বাসিন্দাদের কারো কারো কাছ থেকে ঢাকা নগরের জলাবদ্ধতা বিষয়ক তার ফিচারটার ওপরে বেশ কিছু ভালো প্রতিক্রিয়া পেয়েছিল বখতিয়ার খান। দুজনের প্রশসিন্তমূলক বাক্য তার ভেতরে প্রণিধানযোগ্য। ফেনীর মানুষ বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থার পরিচালক (প্রশাসন) জাফর উল্লাহ তাকে বলছিল যে, দীর্ঘদিন ধরে এই ঢাকা শহরে বসবাস করার পরও এই শহরটার উন্নয়ন নিয়ে সে কখনো ভাবেনি! বখতিয়ার খান তার চোখ খুলে দিয়েছে। এমন মন্তব্য শুনে প্রীতই হয়েছিল বখতিয়ার খান। তাছাড়া ‘লেক এম্পোরিয়াম’ নামে নতুন একটা অ্যাপার্টমেন্ট-বিল্ডিংয়ের বাসিন্দা দিনাজপুরের শাহেদ আহমেদও ভূয়সী প্রশংসা করেছিল বখতিয়ার খানের লেখার। কোনো একটা আন্তর্জাতিক এনজিওর দেশীয় পরিচালক শাহেদ আহমেদ সাইফুলের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে একদিন উপযাজক হয়ে বখতিয়ার খানের সঙ্গে আলাপ করেছিল এবং সে বখতিয়ার খানকে জানিয়েছিল যে, শিগগিরই তাদের এনজিও ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা দূর করার ব্যাপারে জনসচেতনতা তৈরির কাজে নামতে যাচ্ছে। তাদের আসন্ন ক্যাম্পেইনে বখতিয়ার খান যুক্ত হলে খুবই খুশি হবে তারা। শাহেদ আহমেদের প্রস্তাব শুনে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করেনি বখতিয়ার খান। বড় কোনো কাজে যুক্ত হওয়ার আগে সে তার নিজের মহল্লার বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আলাপ করে নিতে চেয়েছিল।
ঢাকা নগরের জলাবদ্ধতার ওপরে লেখা বখতিয়ার খানের ফিচারের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়াও প্রকাশ করেছিল কেউ কেউ। উদাহরণস্বরূপ কলাবাগান এলাকার আদি বাসিন্দা ওয়ার্ড কমিশনার মতিউর রহমানের কথা বলা যেতে পারে। একদিন মাগরিবের নামাজ আদায় করার পর মতিউর রহমান তাকে মসজিদ থেকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেছিল : আইচ্ছা! তর মতলবডা কী, ক তো বখতিয়ার! তুই কি কমিশনার পদে আমার অ্যাগেনেস্টে খাড়াইতে চাস? তখন বখতিয়ার খান নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছিল এভাবে : কমিশনার হওনের কুনও খায়েশ আমার নাই! তুমিই এইসব ফালতু কাম চালু রাখো গিয়া!
এছাড়া ঢাকা নগরের জলাবদ্ধতা বিষয়ক ফিচারটা পড়ার পর কেউ কেউ হতাশাজনক প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছিল বখতিয়ার খানের কাছে। যেমন, লেক সার্কাসের আদি বাসিন্দা মরহুম আকবর হোসেনের মেয়েজামাই ডাক্তার নাসিরুদ্দোজা তার কাছে অনুযোগ করেছিল এই বলে : এইসব ভালো ভালো কথাবারতা লেইখা কী হইব বখতিয়ার ভাই? এই শহরের সমস্যা সমাধান করা যাগো কাম তাদেরে কি আপনে কিছু বুঝাইতে পারবেন? অন্ধ থাইকা যাওয়াটাই তাগো জন্যে ভালো। তাই না? তখন হতাশাগ্রস্ত নাসিরুদ্দোজাকে বখতিয়ার খান বোঝাতে বসেছিল। বখতিয়ার খান তাকে বলেছিল : কিন্তু আমাগো তো চেষ্টা করনের দরকার আছে। আমরা সবাই মিলা তো খালি পান খাইতেছি আর গান গাইতেছি! ঢাকা শহরটা তো ধ্বংস হয়া যাইতেছে!
তারপর বখতিয়ার খান-লিখিত ঢাকা নগরের জলাবদ্ধতা-বিষয়ক ফিচারটা আর অনলাইন সংবাদপত্রটাতে ছাপা হচ্ছিল না দিনের পর দিন। ফিচারটা নিয়ে মহল্লার মানুষজনের আলাপ-আলোচনা ধীরে ধীরে সিন্তমিতও হয়ে যাচ্ছিল একসময়ে। এদিকে বখতিয়ার খান তার পেয়ারের বন্ধুদের সঙ্গে আগের মতোই লেক সার্কাস মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় করছিল; তারা নিয়মিতভাবে ভোরবেলায় ধানমন্ডি লেকের ধারে হাঁটতেও যাচ্ছিল; প্রায়শই তারা নিউমার্কেট অথবা হাতিরপুল না হলে মোহাম্মদপুর বাজারে সদাই করতে যাচ্ছিল একসঙ্গে; প্রতিসন্ধ্যায় তারা কলাবাগান ক্লাবে বসে বসে আড্ডাও দিচ্ছিল। এসবের ফাঁকে ফাঁকে ঢাকা নগরের বেদখল হয়ে যাওয়া মাঠগুলো কীভাবে পুনরুদ্ধার করা যায় তা নিয়ে একটা ফিচার লেখার পরিকল্পনা করছিল বখতিয়ার খান। তখন শ্রাবণ মাসের এক সকালে মাছ কেনার জন্য পাইন গ্রিন র্যালি সাইকেল চালিয়ে সে রওনা দিয়েছিল মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারের উদ্দেশে। মিরপুর রোড ধরে আসাদগেটে পৌঁছানোর আগেই হঠাৎ আকাশ কালো করে টিপটিপ বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছিল। আসাদ অ্যাভিনিউ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে পশ্চিমে যাওয়ার সময় কমজোর বৃষ্টিতে ভিজে যেতে শুরু করেছিল তার হাফ-হাতা জামা, প্যান্ট, মাথার চুল, চোখের পাতা, নাক, দু-গাল, থুঁতনি, ঘাড় এবং হাতের উন্মুক্ত অংশ। সেই সঙ্গে ভিজে উঠেছিল তার পাইন গ্রিন সাইকেলটা। মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারে ঢোকার মুখে তখন একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। বিভিন্ন জবুথবু খুঁটিতে জড়ানো-পেঁচানো বিদ্যুৎ সরবরাহের অজস্র্র তারের ভেতর থেকে ক’টা তার হঠাৎ করে ছিঁড়ে গিয়ে পড়েছিল বখতিয়ার খানের সাইকেল এবং রাস্তার পাশে অপেক্ষারত একটা টেম্পোর ওপরে। অতিসহজেই বিদ্যুৎকে আকৃষ্ট করে ফেলেছিল বৃষ্টিতে ভেজা ধাতব সাইকেল আর টেম্পো। বিদ্যুৎস্পর্শ হয়ে তখন ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেছিল সাইকেল-আরোহী বখতিয়ার খান এবং টেম্পোতে বসে থাকা চারজন যাত্রী। শ্রাবণ মাসের সেই দিনে বাদ আসর মৃত বখতিয়ার খানকে গোর দেওয়া হয়েছিল আজিমপুর গোরস্তানে।
বখতিয়ার খানের মৃত্যুর পর এদিকে পাঁচ মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। লেক সার্কাস এলাকার মানুষজন ধীরে ধীরে ভুলেও যাচ্ছে বখতিয়ার খানের সরব উপস্থিতির কথা। তখন মধ্যপৌষের কোনো কোনো রাতে লেক সার্কাস রোডে কোনো এক ভৌতিক সাইকেলের বেলের ক্রিংক্রিং আওয়াজ উঠছে। ভৌতিক সাইকেলের বেলের আওয়াজটা যেন অবিকল মৃত বখতিয়ার খানের পাইন গ্রিন র¨vলি সাইকেলের বেলের মতোই! এমন একটা রহস্যের কোনো সুরাহা হচ্ছে না এবং ভৌতিক সাইকেলটা লেক সার্কাস এলাকার বাসিন্দাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েই থেকে যাচ্ছে।
২৮ নম্বর বাসার ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া সুমিত তখন মাঘের শেষের কোনো এক সন্ধ্যায় প্রৌঢ় জগলুল আহমেদকে বলছে : নাইটগার্ড ব্যাটাদেরে ধইরা নিয়া আসি? তারা তো কিছু জানতেও পারে! কী বলেন মামা? সুমিতের প্রস্তাব মনঃপূত হয় জগলুল আহমেদের এবং তার নির্দেশে উপসচিব ঝুমা খানের ড্রাইভার মিলন গিয়ে ধরে নিয়ে আসছে লেক সার্কাস কল্যাণ সমিতি কর্তৃক নিয়োজিত রহমত এবং পল্টু নামে দুজন নাইটগার্ডকে। জগলুল আহমেদ, গোলাম ফারুক, খোকন, সুমিত, দুলাল এবং সিরাজের উপস্থিতিতে জগলুলর গাড়ি-বারান্দায় দাঁড়িয়ে নাইটগার্ড দুজনকে জেরা করছে মিলন। নাইটগার্ডদের মিলন জিজ্ঞাসা করছে : ওই ব্যাডারা! রাইতের বেলায় পাহারা দেতে আছ না ঘুমাইতে আছ? কও দেহি!
মিলনের প্রশ্ন শুনে রীতিমতো ঘাবড়ে যাচ্ছে রহমত এবং পল্টু। জেরার মুখে পড়ে গিয়ে ভড়কে যাওয়াতে তরুণ পল্টুর মুখ থেকে কোনো কথা আর সরছে না তখন। অন্যদিকে ভয় পেয়ে গেলেও সপ্রতিভ হতে চেষ্টা করছে প্রৌঢ় রহমত। সে সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর করছে : কী যে বলতে আছেন না মিলন ভাই! মোরা তো ঠিকঠাক কইরাই পাহারা দেতে আছি। চোর-ডাকাইত এই এলাকায় ঢোকতে গেলে ডর খাইবেই খাইবে!
তখন ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়ে নাইটগার্ড দুজনকে প্রশ্ন করছে টেইলর মাস্টার সিরাজ মিয়া : কোন এক ব্যাডা যে রাইতের বেলায় আমগো মহল্লায় বেল বাজাইতে বাজাইতে সাইকেল নিয়া ঘুইরা বেড়াইতাছে – হেইডা কি তগো কানে যায় নাই?
এমন সরাসরি প্রশ্নে আতংকের উদ্রেক ঘটছে রহমতের ভেতরে এবং তার চোখ-মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে নিমিষেই। তবু সে পুনর্বার সপ্রতিভ উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছে। রহমত উত্তর দিচ্ছে : কই? মোরা তো কিছুই হুনি নাই, দেহিও নাই!
এ-কথা শোনার পর তরুণ নাইটগার্ড পল্টুর দিকে তেড়ে যাচ্ছে মিলন। ‘মিছা কথা বলনের জায়গা পাইতে আছ না তোমরা!’ – এই বলে সে পল্টুর ডান গালে কষে একটা চড় বসাচ্ছে। চড় খেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলছে পল্টু এবং সে বলছে : এই এলাকায় ভূত আইছে মিলন ভাই! সাইকেলের বেল বাজদে আছে কিন্তুক মুই কাউরে দেহি না! মোর ডর করতে আছে! মুই আর নাইটগার্ডের চাকরি হরমু না।
পল্টুর স্বীকারোক্তির পর লেক সার্কাস মহলস্নvর বাসিন্দাদের হাতে চড়থাপ্পড় খাওয়ার আশংকায় ভয় পেয়ে যাচ্ছে রহমত এবং সে তখন ভৌতিক সাইকেলের ব্যাপারে মুখ খুলছে। রহমতের কথার সারাংশটা এমন : এই মহলস্নvয় আসলেই একটা সাইকেলওয়ালা ভূতের আমদানি হয়েছে! কিন্তু ভূতটাকে কখনোই চোখে দেখা যায় না। তাই ভূতের ভয়ে আজকাল রাত বারোটার পর লাঠি হাতে হেঁটে হেঁটে তারা মহলস্নv পাহারা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। পাহারা দেওয়ার বদলে তারা আজকাল লুকিয়ে থাকছে তেঁতুলতলার একটা অ্যাপার্টমেন্ট-বিল্ডিংয়ের কোনায় এবং ভয় তাড়ানোর জন্য তারা দোয়া-দরুদ পড়ছে রাতভর।
এমতাবস্থায় নাইটগার্ড রহমত এবং পল্টুকে আদেশ দিচ্ছে জগলুল আহমেদ : আইজ রাইতে ভালো কইরা পাহারা দিবা মিয়ারা। এমনও তো হইতে পারে যে, গ্রিন রোড না হইলে বশিরউদ্দিন রোডের কেউ রাইতের বেলায় খামাখা আমগো মহল্লায় আইসা সাইকেল চালায়া মজাক করতাছে! মাঘ মাসের ঘন কুয়াশা পড়তাছে বইলা আমরা সাইকেলডা আর সাইকেলওয়ালারে দেখতে পাইতেছি না! জগলুল আহমেদের আদেশ মেনে নিয়ে দুলালের দোকানের সামনে থেকে তখন দ্রুত ভেগে যাচ্ছে নাইটগার্ড দুজন।
মাঘ মাসের শেষের দিকের সেই দিনে রাত গভীর হলে লেক সার্কাস এলাকার রাস্তা থেকে ভৌতিক সাইকেলের ক্রিং ক্রিং আওয়াজটা পাওয়া যাচ্ছে আবারো। সাইকেলের বেলের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে এলাকার অনেকেরই এবং যা হয়, ভৌতিক সাইকেলটা অথবা সাইকেলের আরোহী – কিছুই চোখে পড়ছে না তাদের। ভোরবেলায় ফজরের নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় জগলুল আহমেদ এবং গোলাম ফারুক দেখতে পাচ্ছে, ২৮ নম্বর বাসার সামনে রাস্তার ধারে দাঁতকপাটি লেগে পড়ে আছে তরুণ নাইটগার্ড পল্টু। দিন শুরু হলে অপর নাইটগার্ড রহমতকে খুঁজতে বসেছে এলাকাবাসী। অনেক পাত্তা লাগানোর পরও রহমতকে তখন কোথাও আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
তারপর ফাল্গুন যায়, চৈত্র মাস যায়, নতুন একটা বছরও ঘুরে আসে। কলাবাগানের লেক সার্কাস রোডে কোনো কোনো রাতে এখনো আগের মতোই ধ্বনিত হচ্ছে ভৌতিক এক সাইকেলের বেলের ক্রিংক্রিং আওয়াজ।
তখন ফের ঘুম ভেঙে যাচ্ছে অবসরপ্রাপ্ত বীমা কর্মকর্তা জগলুল আহমেদের। বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে সে বারান্দায় দাঁড়াচ্ছে এবং অন্ধকার রাস্তার দিকে তাকিয়ে সে আঁতিপাঁতি খুঁজছে ভৌতিক সাইকেল এবং সাইকেল আরোহীর অসিন্তত্ব।
বিছানায় শুয়েই পুনর্বার ভৌতিক সাইকেলের বেলের আওয়াজটা শোনার জন্য উৎকর্ণ হচ্ছে এনজিও কর্মকর্তা শাহেদ আহমেদ এবং একটা ভূত কেন বেল বাজাতে বাজাতে সাইকেল নিয়ে লেক সার্কাস এলাকায় ঘুরে বেড়াতে যাবে তা সে কোনোভাবেই বুঝে উঠতে পারছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহিদুল আলম উত্তেজিত হয়ে তার স্ত্রীকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে বলছে : দেখছ, আবারো সাইকেলের বেল বাজতাছে! বখতিয়ারের সাইকেলের বেলের মতন আওয়াজটা। তাই না? শুনতে পাইতাছ তুমি?
সাইকেলের বেলের আওয়াজ শুনে তখন সভয়ে কানে বালিশ চেপে ধরে দোয়া-দরুদ পড়ছে অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব গোলাম ফারুক। মনে মনে সে ভাবছে : এই হালার ভূত এই মহলস্নv ছাইড়া যায় না কেন?
‘তানজিনা জেনারেল স্টোরে’র মালিক দুলাল বিছানা থেকে উঠে গিয়ে জানালা দিয়ে আধো অন্ধকার লেক সার্কাস রোডের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে তখন সাইকেলটা খুঁজতে বসেছে। কিন্তু সাইকেলটার কোনো নিশানা করতে না পেরে বিরক্ত হয়ে এক গস্নাস পানি খেয়ে পুনর্বার ঘুমের আশায় সে শুয়ে পড়েছে তার বিছানায়।
সাইকেলের বেলের কর্কশ আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেছে ব্যর্থ ব্যবসায়ী খোকনেরও। বখতিয়ার খানের প্রয়াণে খোকন পুনর্বার ব্যথিত হয়েছে এবং সে ভাবছে : আহারে! বখতিয়ার ভাইরে আর কোনোদিন দেখুম না আমরা!
তখন শাটার একটুখানি তুলে অস্বসিন্ত নিয়েই কুয়াশাচ্ছন্ন লেক সার্কাস রোডের দিকে তাকিয়ে ভৌতিক সাইকেলটার চলাচল লক্ষ করতে সচেষ্ট হচ্ছে ‘পুষ্প টেইলার্সে’র টেইলর মাস্টার সিরাজ মিয়া। যথারীতি তার চোখে পড়ছে না কিছুই। তবুও সে সন্দিগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে অনতিদূরের রাস্তাটার দিকে।
সাইকেলের বেলের আওয়াজে এদিকে ঘুম ভেঙে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া সুমিতেরও। ভৌতিক সাইকেল-বিষয়ক ভয় কাটানোর জন্য সে রাত-বিরাতে তার প্রেমিকাকে খামোখা একটা ফোন করে বসেছে এবং সে ভয়ানকভাবে বকা খেয়েছে অসময়ে ফোন করার জন্য।
প্রায় নববই লাখ মানুষ অধ্যুষিত কমপক্ষে আটশো বছর পুরনো এই ঢাকা নগরের বিবিধ সমস্যা নিয়ে মৃত বখতিয়ার খান যে-কথাটা বলেছিল, তখন, সেইসব রাতে, লেক সার্কাস এলাকার বাসিন্দাদের সকলেরই মনে পড়ছে সে-কথাটা। একদা বখতিয়ার খান তাদেরকে বলেছিল : ঢাকা শহরটা তো ধ্বংস হয়া যাইতেছে! একটা কিছু তো করনের দরকার! আমরা তো খালি পান খাইতেছি আর গান গাইতেছি! বখতিয়ার খানের মতো করে লেক সার্কাস এলাকার বাসিন্দারাও সেইসব রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঢাকা নগরের উন্নয়ন নিয়ে বিভিন্ন চিন্তাভাবনার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। তবে সকালবেলায় ঘুম থেকে ওঠার পর তাদের আর সেসব কিছুই মনে থাকছে না।