তুমি
আষাঢ়-শ্রাবণ মাসটা হরবখত আকাশ কালিঝুলি হয়ে থাকে। এমনিতে মহানন্দা বড় খেয়ালি, কখনো সাপিনীর মতো লচক দিয়ে স্রোতের তোড়ে উড়িয়ে নিয়ে যায় নাও, কখনো গাভীন নদীতে চর জাগে আচমকা কোথাও। আমার তকদিরের মতোই। শ্মশানঘাটার কাছে একটা পুরোনো ছনের ঘরে থাকতাম আমি। নদী একদিন পাড় ভেঙে উঠে এসে সেই আস্তানা নিয়ে গেল, আমি গিয়ে উঠলাম বিবির বাগিচাতে। গরমকালে বওলাগাছটার ছায়ায় শুয়ে থাকি, শীতে উঠে আসি নাজিমপুর মসজিদের ভাঙা আঙিনায়। ইয়ারবন্ধুরা এসে মিলত-জুলত সেখানে, সন্ধ্যায় সেখানেই শামা জ্বালিয়ে আমরা ফকিরেরা মিলে মর্সিয়ার দুঃখী সুর তুলে ভিক্ষা করতাম কিংবা কপাল দেখে তকদির বলে দিতাম।
মুলকচাঁদ শরদর্দের মালিশ দিত, দোয়া–ফুঁকে দেওয়া সুপারি দিত, মানুষজনের কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলে বাতলে দিত, ‘পিপ্পল পাতায় এই আয়াত লিখে দিচ্ছি, চেটে খাও আচ্ছাসে।’ দানেশের একখানা টিয়া ছিল, বড় চতুর পাখি। সে আমায় দেখলেই সরু গলায় ডাকত, ‘কানকাটা শাহদানা।’ আর আমার মাথায় খুন চেপে যেত। পরে ভাবতাম আমার খনখনে হাতে খুন হওয়াটা ওর নসিবে নেই, থাকলে হয়ে যেত। আমার বিশ্বাস।
একটি কান আমার কাটা জরুর, সে মামুলি কারণে থোড়ি কাটা, বাদশাহি হুকুমে কাটা। জুলপি আর লম্বা চুল দিয়ে ঢেকে রাখি, কারণ ঘা দেখিয়ে বেশি দিন হামদর্দী পাওয়া যায় না। লোকে বড় ভুলে যায়। মির্জাসাব আমাকে ডাকতেন শয়তান।
কখনো রেগে কখনো হেসে। কত ভালোবাসতেন ফকির-মিসকিনদের। মির্জাসাবের ওফাতের পর সবাই তাঁকে ভুলে গেল না? পরথম পরথম একটু দুখ পৌঁছায় বুকে। বাজারে বাই নতুন বাজাতে শুরু করলে তার যেমন লাগে। কিন্তু ওই যে বললাম, হামদর্দী বেশি দিন টেকে না, সদমাও না, লোকে বেমালুম ভুলে যায়।
কিন্তু আমি ভুলি কি না, সে আমি কাউকে বলব না। তীক্ষ্ণ নজরে মহানন্দার দিকে তাকিয়ে আমি কার পরওয়ানার অপেক্ষায় থাকি, আমি তা কাউকে বলব না। ওই দানেশ বা মুলকচাঁদকেও না। পরওয়ারদেগার একদিন ভাসিয়ে আনবেন মঞ্জিলে মকসুদকে, অপেক্ষমাণের কাছে। আমিন।
সেদিন খুব বারিশ-দোয়াতের মতো কালো আসমান। আমাদের তুকতাক করার শুকিয়ে রাখা ভোজ পাতাগুলো, জাফরানের কালির বদলে চালানোর কুসুমফুল, দোয়া ফুঁকবার মিছরি-সুপারি, আমাদের চাদর ভিজে একসা। এই সব দিনে আমি আকছার সারা দুনিয়ার সঙ্গে বেজার হয়ে শুয়ে থাকি, কিন্তু ঘুমাই না। টের পাই সুবহে কাজেবের আকাশে রোশনাইয়ের পুচ্ছ জাগছে, এরপর জেগে উঠবে বাজারের সারি সারি তন্দুর, তারপর রোটির ঘ্রাণ। মির্জাসাবের বাড়ির পুরোনো ঘণ্টাঘরে আর সকালের ডঙ্কা দেয় না কেউ, তন্দুরের গনগনে ঘ্রাণে আমরা জেনে যাই ভোর হলো, অনাহারীর আরেকটি দিনের শুরুয়াত। মুলকচাঁদ কার মেয়ের বিয়ে জাদুটোনা করে বন্ধ করছিল আঙিনায় বসে, তার বড় বিবি এসে বেশ খানিকক্ষণ তকদিরকে আর মুলককে গালিগালাজ করে দোপ্যাহরিয়া মাতম করে গেল একসময়। বিরক্ত হয়ে আমি বিছানা ছেড়ে উঠলাম। না খেয়ে খেয়ে গলার হাড় টোটার মতো বের হয়েছে চামড়ার ভেতর থেকে। রাতের বাতাসে খবর রটে যায় ফওরন, ইমামসাবের মুখে গত রাতে দানেশ আর মুলকচাঁদ যখন থেকে শুনেছে তোষাখানা খুলে দেওয়া হয়েছে, নবাব যুদ্ধ করার জন্য লোকবল চাইছেন, তখন থেকে তারা ভাবছে মুর্শিদাবাদ যাবে, ফকিরি আর করবে না। তা কুঁজোর চিত হওয়ার মর্জি তো হতেই পারে!
দুপুর ফুরানো ঝাপসা আলোয় দেখলাম বাজারের দিকে যাওয়ার ধনুষের মতো বাঁকা বাদশাহি পুলটার ওপর কে যেন চাদর মুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে। দীর্ঘদেহী লোকটার হাতে সুরাহী। অচেনা চেহারা। মির্জাসাব বলতেন আমি শয়তানের মতো বেশ বদল করি; করলাম। আদবের সঙ্গে তার পরিচয় জানতে চাইলাম। মাঝিশ্রেণির এক কমবখত আগেই জবাব দিয়ে দিল, ‘ওগো আমরা ভগমানগোলা থেকে আসছি।’ আহা তাই বলো। এখানকার লোকজন কাকে না চিনি। শুধুই কি লোক। কে বদখোয়াব দেখে, কার ঘুসঘুসে জ্বর, কার পিলে কত বড়, কার বিবি ভেগেছে, কার বাচ্চাকে পেঁচোয় পেয়েছে—সব তদবির জানি। এইসবই তো বলছিলাম, লোকটা আমায় অ্যায়সা এক ধমক দিল যে আমার আস্ত কানটায় তালা লাগল। তার তাড়া ছিল বাজারে যাওয়ার, নৌকোয় নাকি তিন দিনের ভুখা পরিবার বসা, বড় ভাই, তার বিবি, তার ফুটফুটে বাচ্চা জোহারা বিবি।
আহা, জোহারা, কী মিষ্টি নাম, পুব আকাশের নক্ষত্রের নাম। লোকটা খপ খপ করে হেঁটে বাজারে গেল, তার চলন মির্জাসাব কী খাজাসাবের মতন—ওগো, দেয়াল ফুঁড়ে যেমন বুরুজ বের হয়ে আসে, তেমনি করে শানদার আদমির শানশওকত বের হয়ে আসে। আমি তবু পিছে পিছে এলাম, সদাই কেনার সময় দরদস্তুর করে দিলাম, এ-ও আশা যদি হাতে তুলে দেয় কিছু…মাঙতে হবে কেন।
আসমানে তখন একদিকে ফিরোজা আরেক দিকে মরকতের রং ধরেছে। সন্ধ্যার মায়ুসি ধরেছে নদীর গায়ে, তার অতল থেকে উঠে আসছে কালামোতির রং। শরবনের কাছে আড়াল করে রাখা নৌকো। প্রায় অন্ধকারে আমি প্রথম পেলাম সুবাস, রওজাহে আতাহারের সুবাস। বিবি-বাচ্চাসহ চাদর মুড়ি দিয়ে আরেকজন মানুষ বসে আছে নৌকোর ছইয়ের নিচে।
ব্যাকুল ছোট্ট মেয়েটি চাদর ঠেলে উঠে এল খাবারের গন্ধে, হাত বাড়িয়ে বলল, পানি! পানি! মায়াবী আলোয় ঝিকমিক করে উঠল তার গায়ে ফুলদার মসলিনের ওড়না। আমার মনে হলো, ইমাম হোসেনের বংশধর কেঁদে উঠল পানি চেয়ে। মেয়ের বাপ দ্রুত মেয়েটিকে কোলে নিলেন, আমি নিমেষেই এক জোড়া বাদশাহি জুতা দেখতে পেলাম। মাঝিমাল্লা আর কারপরদাজ খিচুড়ি রান্নার এন্তেজাম করতে শুরু করল, বাজারে পরিচয় হওয়া লোকটা আমার হাতে একখানা মোহর দিয়ে খেদিয়ে দিল। আমি শাহদানা ফকির সন্ধ্যার অন্ধকারে টিমটিম করে জ্বলতে জ্বলতে ফিরলাম।
ওগো, আমি কি এই চেহারা ভুলতে পারি? পাগড়ি-পেশওয়াজের অভাবে কি আর রাজপুরুষ চেনা যায় না? তার মাথা যে গম্বুজের মতো ফুঁড়ে ওঠে আসমান। আমার কাটা কানে আপনা থেকে আমার হাত এসে পড়ে। ঠুঁটো লোক কি তার জখম ভোলে? আমার অন্তরে ভাগীরথীর বাঁধ আর পলাশীর আমগাছে ঝুঁরছে অন্ধকার। কে বলে বারিশে গোলাবারুদ ভিজে যায়। নবাবি গোলা ভিজতে পারে, আমার বুকে গোলা বেঁধে বসে আছি সে কোন জমানায়…আঁসু অব্দি ভিজাতে পারে না তাকে।
মুলকচাঁদ আমায় বলেছিল তো, ইমামসাব বলেছেন, মুনসিতে এখন রাজা হবে, নমক হারাম এখন নবাব হবে, বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাবের বয়স এক যুদ্ধে বেড়ে গেছে, আগে ছিল পঁচিশ আর এখন হয়েছে পঁয়ষট্টি। নাম মীর জাফর আলী খান।
বলেছি তো, এই মহানন্দার দিকে বাজপাখির মতো চেয়ে চেয়ে আমি কত ইন্তেজার করেছি মঞ্জিলে পৌঁছাবার। মুর্শিদকুলি খাঁয়ের তোপ দাগার শব্দে গর্ভনাশ হতো মেয়েদের, ভাগীরথীর জলে খিজির পিরকে শিন্নি মেনে ভাসত বিশাল ভেলা আর আলোয় উজালা বজরা, রোশনিবাগ সাজত আলোর ঝালরে…সেই সব দবদবা রবরবার দিনের শেষ রোশনি দপ করে নিভিয়ে দিতে পারি তো আমি। বলেছি তো, মির্জাসাব আদর করে বলতেন আমি শয়তানের মতো রূপ বদলাই, একবার ফেরেশতাদের সর্দার, আরেকবার খোদার ওপর খোদকার।
দুই.
আমায় কেউ ঢোল চড়িয়ে খুঁজল না, তোপের মুখে দেগে দিল না, মায় থুকল না পর্যন্ত, ইমামসাব খড়ম ছুড়লেন না, ভেবেছিলাম ভাও বুঝে গা ঢাকা দেব, তার দরকার হলো না। শুধু মুলকচাঁদের বড় বিবি একবার গলা চড়িয়ে আমায় ‘নাফরমান’ গালি দিয়ে বলে গেল, কালের ফেরে আমার আরেকটা কানও কাটা পড়বে! বিবির বদতমিজিতে আমার দোস্ত ঘাবড়াল না, মাফিও মাঙল না। এবারের নওয়াবসাব নাকি ভরি ভরি আফিম খেয়ে ঘুমোতে থাকেন, নবাব যা করে তার রায়তও তাই করে…ঝিমোয়, নিঁদ যায়…আমরাও নিঁদের ঘোরেই শুনতে পাই এবারের নবাবজাদা নাকি সেরাজউদ্দৌলার বেওয়া লুৎফাকে শাদি করতে চান। লুৎফা ফির বেগম হলে কি আর শাহদানাকে ভুলবেন, যার বেইমানিতে তাঁর মেয়ে উম্মে জোহারা বাপ হারাল, মুলকচাঁদের বড় বিবির আঁখ খুশিতে নাচে। কিন্তু তাকেও ঘুমের নেশায় ধরেছে, ‘আচ্ছে করম’ করার তাগিদ কমে আসছে খিদের জ্বালায়। ঝিমোতে ঝিমোতে সে-ও রোটি পুড়িয়ে ফ্যালে, তাকিয়ে দেখে যেন ফতেচাঁদ জগৎশেঠ ভাগীরথীর মোহানা পয়সায় বাঁধিয়ে দিতে গিয়ে গলতি করে আকাশ ভরে দিয়েছে সিতারায়…আকালের আকাশ।
সময়ের চরকি ঘুরে যায় নির্ভুল। মসজিদের খিলানের নিচে হেলান দিয়ে বসে কে কপাল চাপড়ায় আজ এত দিন পর। দানেশের মাথাটা একেবারে গেছে, সে কখনো মালেকুল মওতের অপেক্ষা করে, কখনো মোহাম্মদী বেগের অপেক্ষা করে। আমরা এখনো মসজিদের ভাঙা আঙিনায় থাকি। প্রতি সন্ধ্যায় শামা জ্বালিয়ে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার তাড়াতে তাড়াতে দানেশ জিজ্ঞেস করে, ‘শাহদানা, মীর কাশেমের লোককে তুই নবাবের কথা বলে দিলি?’
আমি মাথা নাড়ি, হ্যাঁ। দানেশ আবার জিজ্ঞেস করে, ‘মুর্শিদাবাদের রাস্তায় নবাবের হাতি নবাবের বোটি বোটি করা লাশ পিঠে নিয়ে বের হলো?’
আমি মাথা নাড়ি, হ্যাঁ। দানেশ আলোয় উড়ে আসা পোকা তাড়াতে তাড়াতে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, ‘নবাবের আম্মির সামনে হাতি এসে বসে গেল?’
আমি মাথা নাড়ি, হ্যাঁ। দানেশ বলে, ‘আমার নবাবের কাটা টুকরোতেই তাঁর আম্মি চুমা খেতে লাগলেন?’
আমি মাথা নাড়ি, হ্যাঁ। রাজনন্দিনী আমেনা বেগম, হোসেন কুলী খাঁয়ের গোপন মাশুকা, নবাবের আম্মিজানকে অন্ধকারেই ঠাহর করে দেখতে চায় দানেশ। নির্দোষ হোসেন কুলী খাঁয়ের রক্তের বদলা নেওয়া হলো—এইসব আমি দানেশকে বোঝাতে যাব ভাবি, কিন্তু কী ফায়দা। অনেকক্ষণ পর দানেশ অবশেষে গায়েবি চাল দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘শাহদানা, ফিন তুই নবাব হলি?’
আমি মাথা নাড়ি, হ্যাঁ। দানেশ নিস্তেজভাবে হাসে। আফিমের নেশা যেমন খেয়াল কি আঁখোসে দেখায়, তেমনি করে আন্ধারে আমি আর দানেশ দেখি আমাদের খোশহাল—আমরা নবাবি হাতিতে চড়ে রাজ্য দেখতে বের হয়েছি। বাগে চম্পা থেকে ভুরভুর সুবাস আসে। অন্দর থেকে আসে রোটি আর কাবাবের ঘ্রাণ। রৌশনচোকি থেকে সানাইয়ের শব্দও হয়। শুধু আন্ধার ভেদ করে দানেশের চশমখোর টিয়া পাখি ফুকরে ওঠে, ‘দুই কানকাটা শাহদানা!’
‘চোপরাও!’, বলি আমি। পরে ভাবি, আহা লোকে ভুলে যাবে, যেমন ভুলে যায় রাজরাজড়ার নানান গল্প, যেমন ভোলে দারুণ দুঃখ…পাখিও এই ডাক ভুলে যাবে, মুফতে একটা প্রাণ নষ্ট করি কেন।