টঙ্গিঘরের সামনে রিকশায় সাহেব-মেম

বাড়ির বাইরে টঙ্গিঘরের বারান্দায় বসে তৌহিদ আলম কাঁচি দিয়ে সাবধানে রঙচঙে একটি গ্লসি ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠা থেকে কেটে টেবিলের ওপর রাখে শিলাপাহাড়ের ফটোগ্রাফ। ম্যাগাজিনটির নাম ‘চায়না পিকটোরিয়েল’। বেজিং থেকে কাগজটি ছাপা হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। তার ঠিক ১০ বছর পর ১৯৯৬ সালে তৌহিদ অভিবাসী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কোশেশ করে। সফল সে হয়নি, পাসপোর্ট-ভিসায় জালিয়াতিজনিত গলদ থাকার কারণে ইমিগ্র্যান্ট অফিসাররা তাকে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে ঢাকায় ফেরত পাঠায়। দেশত্যাগী হওয়ার সে অভিযানে তৌহিদের জননী চার কেদার ধানি জমি বিক্রি করে তহবিলের জোগান দিয়েছিলেন। এক থোকে এত টাকার খতরা করে বিদেশ যাত্রায় ব্যর্থ তৌহিদের বাড়ি ফিরতে সংকোচ হচ্ছিল। তো সপ্তাহখানেক সে সলিমুল্লাহ হলে এক বন্ধুর কামরায় ডাবলিং করে কাটিয়ে দেয়। তখন উদ্বেগ লাঘবের প্রয়াশে তৌহিদ নগরীর অলিগলিতে পয়দলে মাইলের পর মাইল হাঁটত।

একদিন সন্ধ্যাবেলা পুরান পল্টন থেকে গলিপথে রমনার দিকে আসার সময় সেগুনবাগিচার একটি পুরনো বইয়ের দোকান থেকে সে খরিদ করে অতি সামান্য পয়সায় বেশ কিছু চায়না পিকটোরিয়েল। তৌহিদ ম্যাগাজিন থেকে ছবি কেটে কোলাজের মতো সাজিয়ে গদ দিয়ে আটকিয়ে তা দেয়ালে ঝুলাতে ভালোবাসে। টঙ্গিঘরের দেয়ালে তার কাটা ছবি দিয়ে করা নকশাগুলো নীরবে ঝুলছে। গতকাল সে অন্য একটি ম্যাগাজিন থেকে কেটেছে প্রান্তরে চরে বেড়ানো ঘোড়ার ছবি। ভাবছিল, আলোকচিত্রের অশ্বগুলোকে গদ দিয়ে জুড়ে দেবে শিলাপাহাড়ের পাদদেশে। কিন্তু অজানা এক ক্ষোভে তার মন ফুঁসে ওঠে।

বারান্দা রোদেলা হয়ে উঠেছে। কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সঠিক সময় কত- সে তা বুঝতে পারে না। কারণ, ঘড়িটির ব্যাটারি বদলানো হয়নি। ঘুম থেকে দেরি করে উঠেছে তৌহিদ। হাতমুখ ধোয়নি, তিন-চার দিনের বাসি দাড়ি কামানোরও কোনো প্রয়োজন বোধ করেনি। ভেতরবাড়িতে খাবার টেবিলে মা নাশতার খিচুড়ি ও আলু ভাজা সরপোশ দিয়ে ঢেকে রেখেছেন। সে তা ছুঁয়েও দেখেনি। এক পেয়ালা চা চেয়েছিল; মা তাকে হাতমুখ ধুয়ে নাশতার আগে চা দিতে চাননি। তাই বিরক্ত হয়ে তৌহিদ বাড়ির বাইরে টঙ্গিঘরের বারান্দায় বসে ছবি কাটতে শুরু করে। হঠাৎ কেন জানি তার মেজাজ খাট্টা হয়ে ওঠে। সে এক শলা স্টার সিগ্রেটে আগুন দিয়ে বেরিয়ে এসে পুকুরের বাঁধানো ঘাটলায় বসে। তাদের গ্রামের নাম ময়নার-মল। গ্রামটি মৌলভীবাজার জেলা শহর থেকে মাইল পাঁচেক দূরে। এখানে মসজিদ সংলগ্ন মক্তব ছাড়া শিক্ষা-দীক্ষার অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। হাট-বাজারের প্রয়োজনে গাঁওবাসীর হামেশা যেতে হয় জেলা শহরে। গম কোটার হলারসহ একটি রাইস মিল ছাড়া এ গ্রামে অন্য কোনো যান্ত্রিক স্থাপনা নেই। ময়নার-মলে তৌহিদের মতো সোশিওলজিতে মাস্টার্স পাস দেওয়া যুবকের মেতে থাকার মতো সুযোগের বড় অভাব। ঘাটলায় বসে সামনের তীব্র সবুজ ধানক্ষেত বা জমি থেকে সামান্য উঁচু ঠেকে চরতে থাকা ছাগলগুলোর দিকে চেয়ে থেকে থেকে ধূমপানরত তৌহিদের বিবমিষা ধরে যায়।

যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হওয়ার প্রচেষ্টার বছর দেড়েক আগে থেকেই তৌহিদের দিনযাপনে কুফা লেগেছে। বিজ্ঞাপন দেখে দেখে সিভিসহ কমছে-কম বাইশটি চাকরিতে দরখাস্ত করেছিল। কোনো সূত্র থেকেই ইতিবাচক সাড়া পায়নি। হতাশা যখন ওষুধের শিশি থেকে অসাবধানে বিছানায় গড়িয়ে পড়া তরলের কাঁথা-কম্বলে জড়িয়ে যাওয়ার মতো চারদিকে লেপ্টে যাচ্ছে, তখন একদিন কী ভেবে তৌহিদ সন্ধ্যাবেলা গিয়ে হাজির হুমায়রার বাসায়। অনার্স পরীক্ষার পর দীর্ঘ ছুটিতে মায়নার-মলে এসে সে কিছুদিন মেয়েটির বিনা বেতনে গৃহশিক্ষক হিসেবে কাজ করে। হুমায়রার পিতামাতা পারিবারিক সূত্রে পরিচিত।

লতা-পাতায় আত্মীয়তারও কিছু ব্যাপার আছে। মেয়েটির ভ্রমণকাহিনীতে শখ আছে জানতে পেরে তৌহিদ তাকে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ’ বইখানা পড়তে দিয়েছিল। তা ফেরত আসে ভেতরের পৃষ্ঠায় মেয়েলি হাতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আবেগ-ঊর্মিত চিরকুটসহ। এতে উৎসাহিত হয়ে তৌহিদ তাকে জসীম উদ্‌দীনের ‘চলে মুসাফির’ বইটি পড়তে দেয়। গ্রন্থটি ফেরত আসে পাতার ভাঁজে চিড়ে-চ্যাপ্টা হওয়া সুরভিত গোলাপসহ। তো বেকারি হালতে বিভ্রান্ত হয়ে সে রবীন্দ্রনাথের ‘ইউরোপ প্রবাসীর পত্র’ নামক পুস্তকটি হাতে হুমায়রার বাসায় গিয়ে মেয়েটির খোঁজ করে। কাম-কাজের ঝি-বেটি তাকে এক গেলাস তেঁতুলগুলা শরবত পান করতে দেয়। ড্রয়িংরুমে বসে বসে সে যখন গোলাপ ও চিরকুটের স্মৃতিতে তন্ময় হওয়ার চেষ্টা করছিল, তখন ঝি শরবতের ট্রে ফেরত নিতে এসে নিরাসক্ত মুখে জানায়, হুমায়রার সম্বন্ধ পাকা হয়েছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না- মেয়েটির সাথে তার সাক্ষাৎ হওয়ারও সম্ভাবনা ফুরিয়েছে।

ঘাটে বসে এলোমেলো ভাবনায় বেদিশা বোধ করছিল তৌহিদ। নীলে সবুজের বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে একটি মাছরাঙা জলে যেন ছোবল দেয়। কিন্তু চঞ্চু দিয়ে কোনো মাছ বিঁধতে পারে না। বর্ণাঢ্য খেচরটির ঝাপটে সৃষ্ট জলীয় বৃত্তের দিকে ধুন ধরে চেয়ে থেকে তৌহিদ আরেকটি স্টার সিগ্রেটে আগুন দেয়। বৃত্তটি প্রথমে বিস্তৃত হয়, তারপর ছোট হতে হতে একটি বিন্দুতে মিলিয়ে যায়। ভ্রমণসাহিত্যের মনোযোগী পাঠক তৌহিদের দেশানন্তরী হয়ে দূরদেশে বসবাসের আকাঙ্ক্ষাও বোধ করি প্রসারিত হতে হতে নিঃসীম বিন্দুতে মিলিয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হওয়ার অসফল উদ্যোগের পরপরই সে আক্রান্ত হয় ক্রনিক অনিদ্রায়। এ সময় তার আচরণও এলোমেলো হতে শুরু করে। তখন ছোট ভাই মুফাদ কুয়েত সিটিতে কয়েক বছর ওভারসিয়ার হিসেবে কাজ করে বিস্তর টাকা-পয়সা নিয়ে মাস খানেকের জন্য দেশে ফেরে। কুটুমখেশ জড়ো করে মা ধুমদামের সাথে তার বিয়েঢর আয়োজন করেন। এতে ভেতরে ভেতরে চৌকাঠে অবহেলায় পড়ে থাকা পাপোশের মতো লাঞ্ছিত বোধ করে তৌহিদ। বিষদগ্রস্ততা তাকে পেয়ে বসে। মাঝে মাঝে কোনো কারণ ছাড়া ক্ষেপে উঠলে তার আচরণ সামাজিক সম্মতির গণ্ডি অতিক্রম করে যায়। ছোট বোন সামিনা তাকে ফের তহবিল জোগায় বিদেশযাত্রার। নিপাট স্যুট পরে তৌহিদ আদম ব্যাপারীর দেওয়া পাসপোর্ট-ভিসা সম্বল করে বিমান থেকে অবতরণ করে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিমানবন্দরে। কিন্তু রিটার্ন ফ্লাইটে তাকে ফিরে আসতে হয় স্বদেশে। এ ব্যর্থতার অভিঘাতে পারিবারিক জীবনে সৃষ্টি হয় মারাত্মক সংকটের। সামিনার স্বামী কোতোয়ালি থানার ওসি স্ত্রীর কাছে বিপুল অংকের ক্যাশ-টাকা সংগোপনে রাখার জন্য দিয়েছিলেন। স্বামীর অজান্তে সামিনা তা তৌহিদকে ব্যবহার করতে দিয়েছিল। ওসি সাহেব বিষয়টি কীভাবে যেন জানতে পেরে সামিনার ওপর চোটপাট শুরু করেছেন।

বিদেশ সম্পর্কে তৌহিদের আগ্রহের সূত্রপাত হয়েছে মূলত ভ্রমণ পুস্তক পড়ে। এ আগ্রহে ইন্ধন জুগিয়েছে ম্যাগাজিনে জেনিভা, বার্লিন ও লস অ্যাঞ্জেলেসের রঙচঙে চিত্রাদি দেখে। বার কয়েক অসফল হওয়ার পরও তৌহিদ এ আগ্রহের সম্মোহনী বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। চোখে ছানিগ্রস্ত মানুষ যেমন দৃশ্যমান জগৎকে কল্পনায় তর্পণ করে, সে রকম তৌহিদও একাকী ধূমপান করতে করতে অন্যমনস্ক হালতে দেখে ফরাসি দেশের কোনো সমুদ্রসৈকত বা স্কটল্যান্ডের পাহাড়ি ল্যান্ডস্কেপ। তো সে হাল ছাড়েনি। এবার চেষ্টা করছে ইংল্যান্ড বা আমেরিকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বৈধভাবে ওই ধরনের কোনো দেশে যাওয়ার। ওয়েস্টার্ন কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অ্যাডমিশনের প্রধান শর্ত হচ্ছে ইংরেজি ল্যাংগুয়েজ প্রফিশেন্সি টেস্টে কামিয়াব হওয়া। তো তৌহিদ কিছু ইংরেজি বইপত্র, অভিধান ও ভাষা শেখার কয়েকটি ক্যাসেট-টেপ জোগাড় করেছে।

ক্রমাগত স্টার ফোঁকার ফলে ঠোঁট-মুখ তিতকুটে স্বাদে ভরে উঠলে বিরক্ত হয়ে তৌহিদ ফিরে যায় টঙ্গিঘরে। ম্যাগাজিনের রঙিন ছবি কাটতে ইচ্ছা হয় না। তো সে চায়না পিকটোরিয়েলটি এক পাশে সরিয়ে রেখে রেকর্ড প্লেয়ারে ইংরেজি শেখার ক্যাসেটটি ঢোকায়। কিন্তু ব্যাটারি দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে রিল ঘোরে না।

মায়ের কাছে নতুন ব্যাটারি কেনার জন্য টাকা চাইতে ইচ্ছা হয় না। চাইলেও যে পাবে- সে সম্ভাবনা কম। সামিনার কাছ থেকে টাকা নেয়ার পর থেকে মা বেজায় রকম তেড়িয়া হয়ে আছেন। তাকে দাড়ি কামানোর রেজর-ব্লেড কেনার জন্য টাকা-পয়সা দিতেও তিনি নারাজ। তৌহিদের মাথায় কী যেন এক ব্যথা চিনকিরি দিয়ে ওঠে। সে চোখ বন্ধ করে, সাথে সাথে তার করোটির দেয়ালে কে যেন আলপিন দিয়ে গেঁথে দেয় একটি মানচিত্র। ওয়ার্ল্ড ম্যাপটিতে পৃথিবীর নানা দেশের বিচিত্র সব নগরীর লোহিত বিন্দুগুলোকে রেখা টেনে যুক্ত করা হয়েছে। এ ধরনের একটি মানচিত্র সে এয়ারলাইন্সের একটি ম্যাগাজিনে দেখেছিলও। আজকাল প্রায়শ তার সচেতনতায় ফিরে আসে রেখা টানা মানচিত্রের ইমেজটি। তৌহিদ মাথা ঝাঁকিয়ে দৃশ্যপটটি মুছে ফেলতে চায়। কিন্তু মানচিত্রের নগরী-চিহ্নিত রেড স্পটগুলো বাল্ক্বের মতো দপদপ করে জ্বলে। সাথে সাথে তীব্র হয় অপ্রাপ্তির দহন। মনে হয়, ফাঁদে পড়া শালিকের পায়ে লেগে থাকা ঘন আটার মতো হতাশা সর্বাঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। তার ধূমপান করতে ইচ্ছা হয়, কিন্তু প্যাকেটে সিগ্রেট আর অবশিষ্ট নেই। সে টঙ্গিঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায়। তখন তাদের বর্গাচাষির ছেলে রাখাল মরম আলী পড়ি-মরি ছুটে এসে বিচিত্র সংবাদটি দেয়। রিকশা করে এক জোড়া সাহেব-মেম তার সাথে কথা বলতে এদিকে আসছে!

নাদুস-নুদুস দেহের টাক পড়া সাহেবের সাথে রিকশা থেকে টঙ্গিঘরের সামনে সাবধানে নামে ছিপছিপে গড়নের লালচুলো এক মেম। তৌহিদের সাথে হাত-টাত মিলিয়ে চেয়ার টেনে বসতে বসতে সাহেব সিলেট অঞ্চলে ব্যবহূত বাংলায় জানতে চান- বাড়িটি মাহবুবুল আলমের কি-না? মরহুম মাহবুবুল আলম ছিলেন তৌহিদের পিতামহ। তিনি পুকুরপাড়ের পারিবারিক গোরস্তানে সমাহিত, তার জন্মের আগে। সাহেবের পরবর্তী প্রশ্নের জবাবে সে তাকে জানায়- ‘ইয়েস, হি ওয়াজ ওয়ার্কিং ফর দি লংলা টি এস্টেট? তিনি লংলা চা বাগানে কেরানী হিসেবে কাজ করতেন পার্টিশনের অনেক বছর আগে। কিন্তু ঘটনা কী? তার খোঁজখবর নিচ্ছেন কেন?’

মেম আলতো করে তার কাঁধ ছুঁয়ে বলেন, ‘আই অ্যাম রিয়েলি স্যরি, তোমাকে চমকে দেয়ার জন্য।’ এদের আগমনে পানাপুকুরে ডলফিন দেখার মতো বেজায় তাজ্জব হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অতঃপর সে ইংরেজিতে জানতে চায়, ‘প্লিজ, টেল মি- হোয়াই ইউ কেম টু আওয়ার হাউস?’ মেম তার ইংরেজির তারিফ করে সাহেবের দিকে তাকান। সাহেবটি নীল চোখে দ্যুতি ছড়িয়ে তার পরিচয় দেন ‘রবার্ট ক্লার্ক’ বলে। তাদের আধখ্যাচড়া সিলেটি ও তৌহিদের টুাটাফাটা ইংেরেজিতে বাতচিত জমে ওঠে। রবার্ট ও তার স্ত্রী র‌্যাচেল ইংল্যান্ডের বাঙালি অভিবাসী অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেট এলাকায় একটি স্কুলে কাজ করেন। রবার্ট বিজ্ঞানের শিক্ষক, র‌্যাচেল কাউন্সেলর হিসেবে ছাত্রদের মানসিক সমস্যা সমাধানে সহায়তা করেন। তাদের স্কুলটির অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর পিতামাতা পঞ্চাশ কিংবা ষাটের দশকে বাংলাদেশের সিলেট এলাকা থেকে অভিবাসী হিসেবে বিলাতে বসবাস করতে শুরু করে। ছাত্রদের সাথে কমিউনিকেশনের সুবিধার কথা ভেবে এ দম্পতির দু’জনেই শিখে নিয়েছেন কাজ চালানোর মতো যৎসামান্য বাংলা।

এ পর্যন্ত শুনে কিন্তু তৌহিদের কৌতূহলের কোনো কূল-কিনারা হয় না। সে কষ্টেসৃষ্টে আরেকটি ইংরেজি বাক্যে প্রশ্ন করে, ‘আই স্টিল ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড ইয়োর কনেকশন উইথ মাই গ্রান্ডফাদার মাহবুবুল অলাম।’ র‌্যাচেল উষ্ণ হেসে মন্তব্য করেন, ‘তৌহিদ, ইয়োর ইংলিশ ইজ ফার মোর সুপিরিওর দ্যান মাই বাংলা।’ এ প্রশংসা ঝিরিঝিরি বৃষ্টিস্নাত বিষণ্ণ দিনে এক পশলা রোদের মতো তৌহিদের মেজাজকে প্রসন্ন করে তোলে।

রবার্ট নোটবুকের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে বলেন, ‘১৯৩১ থেকে ১৯৩৬ সাল অব্দি আমার পিতামহ আলবার্ট পারকার লংলা টি এস্টেটের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন। মাহবুবুল আলম তখন ছিলেন চা বাগানটির হেড ক্লার্ক। ১৯৩২ সালে আলবার্ট সাহেবের স্ত্রী আমার মাতামহী ডারোথি পারকার শিশুপুত্র ডেভিড পারকারের জন্ম দিয়ে কয়েক ঘণ্টার ভেতর অ্যাকলেমশিয়া রোগে মৃত্যুবরণ করেন। মাতৃহারা শিশু ডেভিডের পাকস্থলীতে জল মেশানো গরুর দুধ হজম হাচ্ছিল না। তখন মাহবুবুল আলমের সদ্য প্রসূতি স্ত্রী মিসেস খোদেজা আলম তার শিশুপুত্র নুরুল আলমের সাথে আমার পিতা শিশু ডেভিডকে তার স্তন্যপানের সুযোগ করে দেন। অ্যাজ অ্যা ম্যাটার অব ফ্যাক্ট.. তোমার বাবা নুরুল আলম ও আমার বাবা ডেভিড পারকার বাচ্চা বয়সে একই জননীর স্তন্য পান করে বড় হন।’

এ পর্যন্ত বলে সাহেব নোটবুকের ভেতর থেকে বের করেন দুটি রঙচটা সাদাকালো ছবি। তার একটিতে চা-বাগানের ম্যানেজার-বাংলোর লনে ট্রাইসিকেল চালাচ্ছে শিশু ডেভিড পারকার, পাশে দাঁড়িয়ে ছোট্ট ছেলে নুরুল আলম। অন্য ছবিটি তৌহিদের দাদি মিসেস খোদেজা আলমের। মাথায় ঘোমটা টেনে তিনি বসেছেন একটি বেতের মোড়ায়। তার হাঁটু সংলগ্ন হয়ে দু’পাশে দাঁড়ানো দুটি সাদা-কালো শিশু- ডেভিড ও নুরুল।

এ কাহিনীর সত্যতা যাচাই করার জন্য তৌহিদ ছুটে যায় ভেতরবাড়িতে মায়ের সাথে কথা বলতে। মা এ কাহিনী বহুবার শুনেছেন তার শাশুড়ি ও স্বামীর কাছে। এরা দু’জনে বর্তমানে প্রয়াত। তিনি কাম-কাজের বেটিকে ডেকে মেহমানদারিতে হাত লাগান। তৌহিদ ফিরে আসে টঙ্গিঘরে। ওখানে র‌্যাচেল ক্যামেরা দিয়ে দেয়ালে লটকানো তার ম্যাগাজিনের ছবি কেটে করা কোলাজের আলোকচিত্র তুলছেন। তাকে দেখতে পেয়ে হেসে জানতে চান, দেয়ালের কাজগুলো কি তার করা? সে হ্যাঁবাচক ভঙ্গিতে মাথা হেলালে ঘুঘুচোখা মেমটি উচ্ছ্বসিত স্বরে বলেন, ‘ইউ মাস্ট বি অ্যা টেলেন্টেড আর্টিস্ট, তৌহিদ। তোমার কোলাজগুলো দুর্দান্ত।’ প্রশংসা শুনতে অনভ্যস্ত তৌহিদ তার সৃষ্টির তারিফ শুনে চমকে ওঠে। মনে হয়, অনেক অনেক দিন পর তার মনলোকের স্যাঁতসেঁতে জমিনে গজিয়ে উঠছে একটি সবুজ চারাগাছ।

ক্যামেরা বাগিয়ে রবার্ট জানতে চান, তার পিতামহের কবরের ছবি তোলা যাবে কি-না? ফুরফুরে মেজাজে সে তাদের নিয়ে যায় পুকুরপাড়ের গোরস্তানে। ছবি তোলা হলে ছাতিম গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে তাদের আরও কিছু কথাবার্তা হয়। রবার্ট ও র‌্যাচেল টঙ্গিঘরের টেবিলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা ইংরেজি শেখার উপকরণগুলো খেয়াল করেছেন। তার পাশ্চাত্যের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার আগ্রহের কথা জানতে পেরে তারা তাকে বিকেলে জেলা শহরের তাদের হোটেলে আসার আমন্ত্রণ জানান। রবার্ট জোর দিয়ে বলেন, ‘তুমি যদি সময় করে আসতে পার, আমি কীভাবে অ্যাডমিশনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়, কীভাবে পেপারওয়ার্ক করতে হয়, এসব দেখিয়ে দেব।’ তৌহিদ তাদের সাহায্য নিতে সংকোচ বোধ করলে র‌্যাচেল তার কাঁধ ছুঁয়ে অন্তরঙ্গ স্বরে বলেন, ‘ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড, ইন অ্যা সেন্স রবার্ট ইজ লাইক ইয়োর রিলেটিভ। প্রয়োজনে মানুষ তো আত্মীয়স্বজনের সাহায্য নেয়।’ অপ্রত্যাশিত এ অন্তরঙ্গতায় তার হৃদলোকের ভেজা জমিনে গজিয়ে ওঠা চারাগাছে যেন ফুটে ওঠে ঝলমলে কিছু ফুল। রবার্ট সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায়, ‘টৌহিড, টুমি আমার কুটমখেশের মটো’ বলে তাকে ফের তাজ্জব করেন!

তারা ভেতর-বাড়ি থেকে মায়ের পাঠানো পরোটা, ডিমের মামলেট ও সুজির হালুয়া ইত্যাদি খেতে খেতে জানান, লন্ডনের টাওয়ার হ্যালমেটে বাঙালি অভিবাসীদের বাড়িতে তারা বার কয়েক দাওয়াত খেয়েছেন। ভাত, ভর্তা, ডাল, পিঠা, সন্দেশ প্রভৃতি খাবারের স্বাদের সাথে তারা বিঘতভাবে পরিচিত। চা পান করতে করতে র‌্যাচেল জানান, ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি তার পিতামহ ওয়াল্টার স্মিথ মৌলভীবাজারের এসডিও হিসেবে কাজ করতেন। তিনি এসডিও-বাংলোটির লোকেশন খুঁজছেন। তৌহিদ ফুরফুরে মেজাজে জানায় যে- বিকালে হোটেলে তাদের কথাবার্তা শেষ হলে পর সে তাদের নিয়ে যাবে এসডিও-বাংলোয়, যা বর্তমানে ডিসির বাংলোতে পরিবর্তিত হয়েছে। রবার্ট আগামীকাল লংলা টি এস্টেটে যেতে চাচ্ছেন। ওখানকার গির্জাঘরের কাছাকাছি সেমিটারিতে সমাহিত হয়েছেন তার পিতামহী ডারোথি পারকার। তিনি লংলা চা বাগানে যাওয়ার জন্য রোডম্যাপ খুঁজছেন। তৌহিদ তাকে আশ্বস্ত করে বলে, ‘ডোন্ট ওয়ারি, ম্যাপ-ট্যাপের কোনো দরকার নেই। ওই এলাকা মোটামুটি আমার চেনা। আগামীকাল একটি বেবিট্যাক্সি ভাড়া করে আমিই আপনাদের নিয়ে যাব লংলা চা বাগানে।’ এ প্রস্তাবে উচ্ছ্বসিত হয়ে রবার্ট বলেন, ‘থ্যাংকস্‌, দিস সাউন্ডস্‌ লাইক অ্যা হেল্প ফ্রম অ্যা রিয়েল রিলেটিভ। মারভেলাস।’ তৌহিদ খুশিমনে স্পোকেন ইংরেজির চটি বই থেকে শেখা আরেকটি বাক্য সফলভাবে প্রয়োগ করে- ‘নো মেনশন, প্লিজ।’

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত