এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল তাদের। পাঁচতারা হোটেলের দীর্ঘ ও প্রশস্ত করিডোর, একপাশে সারিবাঁধা রুম, অন্যপাশটা খোলা। করিডোর না বলে ব্যালকনি বলাই ভালো। সেখানে রেলিংয়ে দুই হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিল সে। দূরে তাকিয়ে ছিল, অনেক দূরে, কী ভাবছিল জানে না কেউই। এই করিডোর ধরেই সিঁড়িতে যেতে হয়, কিংবা লিফটে। শায়লাও যাচ্ছিল। ডিনারের সময় হয়ে গিয়েছে। সে একটু আগেভাগেই খায়, ঘুমিয়েও পড়ে তাড়াতাড়ি। কিন্তু লোকটাকে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়ল সে। জামান! হ্যাঁ, জামানই তো! নাকি তার মতো দেখতে অন্য কেউ? প্রায় একুশ বছর আগে শেষ দেখা হয়েছিল জামানের সঙ্গে, তখন সে ছিল এক কান্তিময় যুবক, শায়লাও ছিল লাবণ্যময়ী এক মায়াবী তরুণী।
সহপাঠী ছিল তারা। একুশ বছর দেখা না হলে কি সহপাঠীর মুখ ভুলে যায় কেউ? কিন্তু মুখটা যে দেখা যাচ্ছে না, দেখা যাচ্ছে মুখের একপাশ, দাঁড়িয়ে আছে রেলিং ধরে, সেই একই ভঙ্গি, এভাবেই সে মাঝেমধ্যে দাঁড়িয়ে থাকত কার্জন হলের ব্যালকনিতে, দূরে তাকিয়ে, পরম উদাসীনতা মেখে। সেজন্যই কি দাঁড়াল শায়লা? এই ভঙ্গি যে তার খুব চেনা! তাছাড়া, জামান যে তার সাধারণ সহপাঠী ছিল না, ছিল বিশেষ একজন। তাকে ভালো লাগার কথা জানিয়েছিল জামান একাধিকবার, মধুর ভাষায়। ওরকম ভাষায় কেউ কখনো তাকে ভালো লাগার কথা জানায়নি। প্রেম ছিল তার সেই জানানোর ভঙ্গিতে, ছিল আকুলতা ও সমর্পণ। শায়লার হৃদয় দ্রবীভূত হয়ে গিয়েছিল, তবু প্রেমটি হয়নি, নিজের দুর্বলতার কথা ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ করেনি সে।
কারণ ততদিনে সে আরেকজনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল, বাগদানের তারিখও ঠিক হয়ে গিয়েছিল। ফিরে আসার উপায় ছিল না তার। বরং জামানের প্রতি এক গভীর অভিমানে বুক ভারি হয়ে উঠেছিল – ‘জানাবেই যদি, আগে জানালে না কেন? কেন এত দেরি করলে? তুমি জানো না, আমি আরেকজনের বাগদত্তা হতে চলেছি?’ না, এসব কথা বলেনি সে জামানকে, খুব মিষ্টি হেসে ফিরিয়ে দিয়েছিল, যেন সে বোঝেইনি সেই আকুলতা আর সমর্পণের ভাষা! জামানও আর বলেনি কিছু, কেবল তার চিরবিষণ্ণ মুখটি আরো বেশি বিষণ্ণ হয়ে গিয়েছিল। সেই পর্ব কবেই শেষ হয়ে গেছে! জীবন গিয়েছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার! শায়লার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল ইউনিভার্সিটি থেকে বেরোনোর আগেই। বেরিয়ে সে চলে যায় স্বামীর সঙ্গে আমেরিকায়, বছরখানেক পর জামানও চলে যায় ইতালিতে, পড়াশোনা করতে। এরপর আর দেখা হয়নি। শায়লা ফিরে গেছে দেশে, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই যোগ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। জামান আর ফেরেনি।
অবশ্য মাঝখানে দু-তিনবার দেশে গিয়েছে সে, বেড়াতে। কিন্তু কোনোবারই শায়লার সঙ্গে দেখা হয়নি। দেখা হওয়ার সম্ভাবনাটাই যেন এড়িয়ে চলে জামান। তাদের অনেক বন্ধুই এখন প্রবাসী, দেশে বেড়াতে গেলে পুরনো বন্ধুরা মিলে গেট-টুগেদারের ব্যাপারটা প্রায় নিয়মিত ঘটনাই; কিন্তু জামান খুব একটা যায়নি সেসব মিলনমেলায়। কিংবা যখন গিয়েছে, শায়লা কোনো কারণে যেতে পারেনি সেদিন, পরে জানতে পেরে আফসোস করেছে। এটা কি কাকতালীয়? এই যে দেখা না হওয়া? নাকি ইচ্ছাকৃত, বিশেষ করে জামানের তরফ থেকে? শায়লার তো মন চাইত তাকে দেখতে, জামানের ইচ্ছে করত না? এ-প্রশ্নের উত্তর সে পায়নি কোনোদিন। দেশে কখনো দেখা হয়নি, আর এই দূরদেশে অকস্মাৎ দেখা হয়ে যাবে দুজনের! এও কি সম্ভব?
কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল জানে না সে, তাদের দুজনের মাঝখান দিয়ে লোকজন যাওয়া-আসা করছে, তারা দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির মতো। কী বিব্রতকর! জামান অবশ্য জানেই না, তার পেছনেই কেউ দাঁড়িয়ে আছে তারই জন্য, আর শায়লা নিশ্চিত হতে পারছে না বলে ডাকতেও পারছে না, অপেক্ষা করছে – কখন ফিরে তাকাবে লোকটা, কখন নিশ্চিত হওয়া যাবে, সে জামানই কি না! একসময় ফিরে দাঁড়ায় জামান, একটু চমকে ওঠে, ভ্রম্ন-কুঁচকে অল্প কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে শায়লার দিকে, তারপর তার ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে – তুমি এখানে!
আমিও তো সে-কথাই ভাবছি, তুমি এখানে!
একটা কনফারেন্সে এসেছি। তুমি?
আমিও।
ও! দুজন একই কনফারেন্সে! মজার তো!
বেশ কাকতালীয় না?
হ্যাঁ। তা বটে। তা, এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিলে?
ডিনারে যাচ্ছিলাম, তোমাকে দেখে চেনা মনে হলো, তাই …
তাই দাঁড়িয়ে পড়লে!
হ্যাঁ।
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছ?
অনেকক্ষণ। তুমি কী ভাবছিলে অত মগ্ন হয়ে?
সে-বিবরণ দিতে পারলে তো লেখকই হতে পারতাম!
লেখো না আর?
নাহ্। অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি।
কেন? তুমি তো লেখকই হতে চেয়েছিলে!
হ্যাঁ, তা চেয়েছিলাম।
ছাড়লে কেন?
সে অনেক কথা। এখানে দাঁড়িয়েই বলব?
ও হ্যাঁ, এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা ভালো দেখাচ্ছে না। লোকজন যাওয়া-আসা করছে, ওদের অসুবিধা হচ্ছে।
তাহলে চলো, অন্য কোথাও বসি!
খাবে না? ডিনারের সময় হয়েছে তো!
আমি তো একটু দেরিতে খাই। ঠিক আছে চলো। একটু দাঁড়াও, আমি রুম থেকে আসছি।
তোমার রুম কোনটা?
এই তো, এখানে। দাঁড়াও আসছি।
দু-মিনিটের মাথায়ই ফিরে এলো জামান, বলল – চলো, খেতে খেতে কথা বলি।
হোটেলটি যেমন বড়, রেস্টুরেন্টটাও তেমনি। বুফে খাবারের ব্যবস্থা, অনেকরকম পদ। ইশরাত জিজ্ঞেস করল –
কী খাবে? মানে, কী খেতে পছন্দ করো?
আমি যা খেতে পছন্দ করি তা কি এখানে পাওয়া যাবে?
কী পছন্দ করো, শুনি?
ডাল-ভাত, ভর্তা-ভাজি, কই মাছের দোঁপিয়াজি!
এত বছর ইউরোপে থেকেও অভ্যাস পালটায়নি?
অভ্যাস পালটেছে। আর অভ্যাসের কথা বলছই বা কেন? তুমি জানতে আমার অভ্যাস কী ছিল?
জানতাম।
কীভাবে জানতে?
তোমার মনে নেই। তোমাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম।
ও! জিজ্ঞেস করেছিলে নাকি? সত্যিই মনে নেই। কেন জিজ্ঞেস করেছিলে?
জানি না। হয়তো জানতে ইচ্ছে হয়েছিল!
এরকম ব্যক্তিগত ব্যাপার জানতে ইচ্ছে হয়েছিল কেন?
খুব ব্যক্তিসচেতন হয়েছ দেখছি! বাংলাদেশে এটা কি খুব ব্যক্তিগত ব্যাপার?
না, তা অবশ্য নয়। বাংলাদেশে যে-কেউ যে-কাউকে যে-কোনো প্রশ্ন করতে পারে।
ইউরোপে পারে না?
পারে কি না জানি না, তবে সাধারণত খুব ব্যক্তিগত ব্যাপারে কেউ প্রশ্ন করে না। তুমি তো আমেরিকায় ছিলে অনেকদিন, ওখানে কেউ করে?
না, তা-ও করে না। অবশ্য বাঙালি কমিউনিটি এসব সৌজন্যের ধার ধারে না। তারা সবই জানতে চায়।
আমি কিন্তু বাঙালি কমিউনিটির সঙ্গে মিশি না।
কেন?
শেকড় ছেড়ে এসেছি যেহেতু, বাকিটুকু কেটেও ফেলেছি।
পেরেছ?
না পারিনি। এখনো কিছু দীর্ঘশ্বাস রয়ে গেছে।
দীর্ঘশ্বাস! কিসের?
জামান প্রশ্নটার উত্তর দিলো না, বলল – চলো, আরেক প্রস্থ নিয়ে আসি। তুমি তো কিছুই খেলে না।
আমি আর নেবো না। রাতের বেলা কমই খাই।
ডায়েট করো? তোমাকে দেখলেই বোঝা যায়। বয়স বাড়েনি তোমার!
বেড়েছে। অনেক বেড়েছে। সবকিছু কি দেখলেই বোঝা যায়?
আমি চোখের দেখার কথা বলেছি, অন্তর্দৃষ্টির কথা বলিনি।
কথা বলতে বলতে তাদের খাওয়া শেষ হয়ে এসেছিল। জামান জানতে চাইল – চা-কফি কিছু খাবে?
না। ডিনারের পরে আবার ওসব কেন? ঘুম ছুটে যাবে।
না হয় গেলই একদিন।
তুমি খাবে?
হ্যাঁ।
প্রতিদিন খাও?
হ্যাঁ, খাই। অবশ্য প্রতিদিন ডিনার করা হয় না।
খুব অনিয়ম করো, বোঝা যাচ্ছে।
অনিয়ম বলতে কিছু নেই, মানিয়ে নিতে পারলে সবই নিয়ম।
শায়লার খুব জানতে ইচ্ছে করছিল, জামান বিয়ে করেছে কি না, করলে ছেলেমেয়ে আছে কি না; কিন্তু কী এক দ্বিধা তাকে বাধা দিচ্ছিল। এতক্ষণের আলাপে জামান একবারের জন্যও ওসব কথা তোলেনি, না নিজের ব্যাপারে, না শায়লার ব্যাপারে। যেন কোনো আগ্রহই নেই তার এসব বিষয়ে। তাহলে সে তোলে কীভাবে? কিন্তু নিয়ম-অনিয়মের প্রসঙ্গটা ওঠায় সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। মুখ ফসকে বলে ফেলল – এত অনিয়ম করো, বউ কিছু বলে না?
বউ! হা-হা-হা-হা … বউ থাকলে তো!
মানে?
মানে আর কী! বউ নেই!
বিয়েই করোনি, নাকি ছেড়ে চলে গেছে?
হা-হা-হা …
হাসছ কেন?
ওই যে জানতে চাইলে, ছেড়ে চলে গেছে কি না!
এরকম হতে পারে না?
হ্যাঁ, পারে। কিন্তু আমাকে ছেড়ে কোনো মেয়ে চলে যেতে পারবে বলে মনে হয় তোমার?
এত আত্মবিশ্বাস?
আত্মবিশ্বাসের প্রশ্ন নয়। আত্মসম্মানের প্রশ্ন। আমি বোধহয় অতটা খারাপ মানুষ নই যে, ছেড়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করব।
আমি তা মিন করিনি। স্যরি। সবসময় যে ছেলেরাই খারাপ হয় তা তো নয়। অনেক মেয়েও তো ভালোমানুষদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। তা বিয়ে করোনি কেন?
ইচ্ছে করেনি।
একা একা জীবন কাটাতে খারাপ লাগে না?
একা কাটাইনি। বান্ধবী ছিল। লিভ টুগেদার করেছি অনেকদিন।
শায়লা একটু ধাক্কা খেল! একটুক্ষণ ভাবলোও – কেন এমন চমকে উঠলাম আমি? তাহলে কি অবচেতনেই আমি ভাবছিলাম, আমার জন্যই বিয়ে করেনি ও? নাকি লিভ টুগেদারের মতো একটা বিষয় এত সহজে সামনে চলে এলো বলে? আমি কি আশা করেছিলাম, ও চিরদিন নারীস্পর্শবিহীন থাকুক? নিজেকে বেশিক্ষণ ভাবার সুযোগ দিলো না সে, সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল –
ছিল মানে? এখন নেই?
নাহ্। একসময় আর ভালো লাগেনি। আলাপ-আলোচনা করে দুজন দুজনকে মুক্তি দিয়েছি।
কথাটা শুনে আবারো একটু থমকে গেল শায়লা। ওসব দেশে কত সহজেই ‘মুক্তি’ দেওয়া যায় পরস্পরকে! আর বাংলাদেশে? যা কিছুই ঘটুক, লেগে থাকো। মুক্তির কথা ভেবো না। আর যদি সাহসী হয়ে মুক্তি চাও বা দিয়ে দাও তোমার সঙ্গীকে, তাহলে বাকি জীবন গঞ্জনা পোহাতে থাকো। আচ্ছা, আমিও যদি রয়ে যেতাম পশ্চিমা কোনো দেশে, পারতাম সঙ্গীকে গুডবাই বলতে? বিয়ে আর লিভ টুগেদার কি এক ব্যাপার? দাম্পত্য বা প্রেমের সম্পর্কের জন্য সমন্তান থাকা আর না থাকা কি সমান ব্যাপার?
শায়লার আনমনা হয়ে পড়ার ব্যাপারটি চোখ এড়ায়নি জামানের। এই সুযোগে চোখভরে সে দেখে নিচ্ছিল তার প্রথম তারুণ্যের প্রেমকে। না, খুব একটা বদলায়নি শায়লা, শুধু দীর্ঘ-ঘন-কালো চুলগুলো আর আগের মতো নেই। খানিকটা পাতলা হয়ে এসেছে, নিচের দিকে কিছুটা ছেঁটেও ফেলেছে বোধহয়। আগে কোমর পর্যন্ত ছিল, এখন পিঠ পর্যন্ত। আগে লম্বা ছিপছিপে গড়ন ছিল তার, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও কিশোরীদের মতো লাগত, এখন স্বাস্থ্য একটু ভালো হয়েছে। না, বাঙালি মেয়েরা যেমন বিয়ের পরে মুটিয়ে যায়, সমন্তান জন্মের পরে তাদের শরীর যেমন নেতিয়ে পড়ে, ওর তেমন হয়নি।
বরং এখন তাকে লাগছে ভরযুবতীর মতো। শাড়ির আঁচল ভেদ করে তার ভরাট বুকও আন্দাজ করা যাচ্ছে। বয়স কত হলো ওর? তারা তো সহপাঠী। মানে মধ্য-চল্লিশ। অথচ ওর মুখম-লে বয়সের ছাপ ততটা পড়েনি, এখনো তেমনই পেলব-সুন্দর। চোখদুটোও তেমনি গভীর-মায়াময়। ওর চোখে-মুখে সর্বদাই এই মায়াটা লেপ্টে থাকত, জামান আসলে সেই মায়ারই প্রেমে পড়েছিল। অনেকক্ষণ ধরে মনভরে, চোখভরে সে দেখল শায়লাকে, তার অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে। তারপর তার নীরবতা ভাঙার জন্যই বলল – কী হলো তোমার?
উঁ! নাহ্, কিছু না।
কী ভাবছিলে?
তেমন কিছু নয়। রুমে যাবে না? রেস্টুরেন্ট তো খালি হয়ে গেছে!
হ্যাঁ। চলো।
শায়লা এলো জামানের রুম পর্যন্ত; কিন্তু ভেতরে ঢুকল না, নিজের রুম নাম্বারটা জানিয়ে শুভরাত্রি বলে চলে গেল।
সাধারণত তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়ে শায়লা, কিন্তু আজ আর ঘুম আসছে না। কত কথা মনে পড়ছে! খুব মিষ্টি একটা সম্পর্ক ছিল জামানের সঙ্গে তার। যদিও প্রেম ছিল জামানের তবু ও কখনো বাড়াবাড়ি করেনি, কখনো জ্বালায়নি। ওর জন্য শায়লার ভেতরেও একটা অদ্ভুত মায়া ছিল। মন খারাপ হতো ওর জন্য। কিন্তু কিছু করারও ছিল না। আরেকজনের বাগদত্তা হয়ে সে তো এমন কিছু করতে পারে না, যা তার সততাকে প্রশণবিদ্ধ করে! কিন্তু বিয়ের কিছুদিন আগে পরপর দুটো ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। দুর্ঘটনাই বলা যায়। এনগেজমেন্ট রিং পরিয়ে মামুন চলে গিয়েছিল আমেরিকায়। দেড় বছর পর মাস্টার্স শেষ করে ফেরার আগে বিয়ের তারিখও ঠিকঠাক হয়ে গেল। এই সময়টাতেই জামান একটা গল্প লিখল এক লিটল ম্যাগাজিনে। বিখ্যাত কোনো পত্রিকা নয়, জামানও কিছু বলেনি। শায়লার চোখে পড়ারও কথা নয়, তবু চোখে পড়ল। তাদের এক বন্ধুই পত্রিকাটি শায়লাকে দিয়েছিল। গল্পটি পড়ে হয়তো অন্য কারো পক্ষে কিছু বোঝা সম্ভব নয়; কিন্তু শায়লা ঠিকই বুঝল – এটি তাকে নিয়েই লেখা। কী যে হলো তার, পরদিন ক্যাম্পাসে গিয়ে জামানের মুখের ওপর ছুড়ে মারল সে-পত্রিকাটি। তীব্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল – এসবের মানে কী, জামান?
জামান চুপ করে রইল।
বলো! এসবের মানে কী, বলো!
এবারো কোনো উত্তর পেল না শায়লা। হয়তো জামানের নীরবতাই তাকে আরো বেশি ঝাঁঝিয়ে তুলল, আচমকা ওর শার্টের কলার ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে উন্মত্ত মানুষের মতো বলতে লাগল – বলো, তোমাকে বলতেই হবে, বলতেই হবে …
জামান শুধু নিচু কণ্ঠে বলেছিল, ছাড়ো শায়লা। আশেপাশে লোক জমে যাচ্ছে।
শায়লার হঠাৎই সম্বিত ফেরে। নিজের আচরণে নিজেই অবাক হয়। তারপর মাথা নিচু করে দ্রম্নতপায়ে চলে যায়।
অনেকদিন শায়লা ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছে। কেন সে এতটা উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল সেদিন? গল্পটিতে শায়লার দাম্পত্য জীবন নিয়ে এক ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল। বলা বাহুল্য, সেটি সুখকর কিছু ছিল না। হয়তো সেজন্যই ওরকম মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য এতদিন পর এসে সে দেখতে পায়, যতটুকু অস্বসিত্মকর ছিল সেই ভবিষ্যদ্বাণী, তার চেয়ে বেশি অস্বসিত্মকর হয়েছে তার জীবন। গল্পটিতে একটা কথা ছিল – ‘মেয়েটি সব পাবে, কিন্তু মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা ও সম্মান পাবে না।’ শায়লা সেটি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। মামুনের কাছে তার বিন্দুমাত্র সম্মান নেই, শ্রদ্ধা তো
নেই-ই। শায়লাকে সে মনে করে স্বল্প-মেধার এক মানুষ, সুন্দরী মেয়ে বলে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষ। এমনকি মামুন এ-ও বলতে ছাড়েনি, ‘আমার সার্কেলে তুমি কথা বলো না। তোমার কথাবার্তা মূর্খের মতো, আমার সম্মান নষ্ট হয়।’ অথচ শায়লা কখনো বেফাঁস কথা বলে না, বরং বরাবরের মতোই সে কিছুটা অন্তর্মুখী আর চুপচাপ ধরনের। আপত্তিকর কোনো আচরণও সে করে না কখনো। তবু মামুনের এত নিষেধাজ্ঞা! তাকে অপমান করার জন্যই যে ওসব কথা বলে মামুন, সে তা বোঝে।
তো, সেদিনের সেই রুদ্রমূর্তি দেখার পর জামানকে কয়েকদিন আর ক্যাম্পাসে দেখা গেল না। এদিকে শায়লা অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছিল, ওরকম একটা অনাকাঙিক্ষত আচরণ করে ফেলার পর নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছিল না, অথচ জামানের কাছে যে দুঃখ প্রকাশ করবে তার উপায়ও ছিল না। তাকে তো পাওয়াই যাচ্ছে না। তখন হাতে হাতে মোবাইল ছিল না, ইন্টারনেট ছিল না – যোগাযোগের সহজ মাধ্যমগুলো এখন যত সুলভ, তখন ততটাই দুর্লভ ছিল। কোনো বন্ধুর কাছে যে খোঁজ নেবে, তারও উপায় ছিল না। সব সময় একটা দ্বিধা কাজ করত তার ভেতরে, মনে হতো – সবাই বোধহয় বুঝে ফেলবে যে, তাদের সম্পর্কটি সহপাঠী বা বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু। প্রায় সপ্তাহখানেক অপেক্ষার পর সে আর সইতে পারল না, কয়েকদিন পরই মামুন চলে আসার কথা, তারপর বিয়েটিয়ের ঝামেলা, তার আগেই জামানের কাছে সে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে চায়। নিরুপায় হয়েই সে তাদের এক কমন বন্ধু মিন্টুকে জিজ্ঞেস করল – জামানের কী হয়েছে রে? আসে না কেন?
কী জানি! সারাদিন রুমে বসে থাকে। কিছু জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যায়।
আমাকে একটু নিয়ে যেতে পারবি?
কোথায়?
ওর রুমে!
ওর রুমে! তুই যাবি! ছেলেদের হলে তুই যাবি!
কেন, নিষেধ আছে নাকি?
না, তা নেই। তবু, মানে …
তবু কী? সমস্যাটা কোথায়?
মানে, সব ছেলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে তো!
কেন? তোদের হলে কি কখনো মেয়েরা যায় না?
যায়। এবং অন্য সবাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
এখন তো ছেলেরা হলে নেই মনে হয়, সবাই ক্লাসে …
আরে নাহ। সবার কি এক সময়ে ক্লাস থাকে?
যা হওয়ার হোক, তুই আমাকে নিয়ে যাবি কি না বল!
কবে যাবি?
এখনই।
এখনই!
হ্যাঁ, এখনই। কোনো সমস্যা?
না, সমস্যা আর কী! চল যাই।
শায়লা এখনো বুঝতে পারে না, সেদিন সে কেন এমন মরিয়া হয়ে উঠেছিল। এই দুটো দিনে সে যা-কিছু করেছে তার কোনোটাই তার স্বভাবের সঙ্গে যায় না। তো, মিন্টু তাকে নিয়ে গেল জামানের রুমে। রুম ভেতর থেকে বন্ধ করা, নক করতেই খুলে গেল। শায়লা দাঁড়িয়েছিল পেছনে, জামান তাকে দেখেনি, মিন্টুকে জিজ্ঞেস করল – কী রে? এই অসময়ে?
এই এলাম আর কি!
শায়লা পেছন থেকে মুখ বের করে বলল – আমিও এসেছি।
তুমি! এখানে! – জামান ভীষণ অবাক হলো।
হ্যাঁ, আমি। ভেতরে আসতে বলবে না?
হ্যাঁ, এসো।
মিন্টু বলল – তাহলে তোরা গল্প কর। আমার দায়িত্ব শেষ। আমি যাই।
তুই আবার কোথায় চললি!
ক্লাস আছে না? শায়লা পৌঁছে দিতে বলল, তাই দিয়ে গেলাম। যাই।
ও চলে যেতেই শায়লা দরজার ছিটকিনি আটকে দিলো, তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল জামানের বুকের ওপর। ফিসফিসিয়ে বলল – আমি তোমার কাছে এসেছি, আমাকে নাও।
কেন সে বলেছিল সেদিন এ-কথা? শায়লা আজো জানে না। এ-কথা বলার জন্য তো সে যায়নি, বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যও যায়নি! তবু কেন এমন হলো?
তারপরে যা ঘটেছিল তা অকল্পনীয়। দুজনেই যেন নিজেদের সবগুলো ইন্দ্রিয়ের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল। যখন সম্বিৎ ফিরে পেল তখন আবিষ্কার করল, দুজনেই নিরাভরণ, দুজনেই বিধ্বস্ত, ক্লান্ত, পরাস্ত; কিন্তু মুগ্ধ ও পরিতৃপ্ত। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল তারা, যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। জামান এক হাতে শায়লাকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে তার শরীরে আদর বুলিয়ে দিচ্ছিল। কী যে পরম সুখ হচ্ছিল তখন! কিন্তু হঠাৎই পিঠের কাছে একটু ব্যথা করে ওঠায় তার উঁ-ধ্বনি শুনে জামান বলল – কী হলো?
পিঠে একটু ব্যথা লাগল। দ্যাখো তো!
জামান দেখে বলল – ওহ হো! কী কা- দ্যাখো তো! ধুর!
কী হয়েছে?
দাঁতের কামড় বসে গেছে!
তুমি একটা গুণ্ডা। চুমুর বদলে কামড় দিয়েছ!
কোনটা যে চুমু, কোনটা যে কামড়, বুঝিনি!
আমিও তো বুঝিনি।
তাহলে আর কী! দাগটা নিয়েই যাও।
হ্যাঁ, মেয়েদের কোনো না কোনো দাগ নিয়েই যেতে হয়।
ফিলোসফারদের মতো কথা বলো না, ভয় লাগে।
ফিলোসফার তো তুমি, গণক ঠাকুরও। গল্প লিখতে গিয়ে ফিলোসফি আউড়াও, ভবিষ্যদ্বাণী করো।
আর লিখব না।
সেই প্রতিজ্ঞা যে সত্যিই মেনে চলবে জামান, ভাবেনি শায়লা। জানলে উলটো প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিতো। জামান আর কখনো লেখেনি।
এতদিন পর সেসব কথা মনে পড়ায় শরীর শিউরে উঠল শায়লার। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল, শুধু ওই দুটো দিন আলাদা। প্রথমটা না ঘটলে দ্বিতীয় দিনের ঘটনাটাও বোধহয় ঘটত না। আর সেটা না ঘটলে এরকম একটা দাগ বয়ে বেড়াতে হতো না। এমন একটা দাগ, যা দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, শুধু অনুভব করা যায় – ওটা আছে, চিরদিন সঙ্গে লেগে আছে।
ঘুম আসছে না শায়লার। জামানের সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ গল্পটল্প করে এলেই হতো! আচ্ছা, ও কি একবার আসতে পারে না এখানে? নিদেনপক্ষে একটা ফোন? বেশি কিছু তো চায় না সে! অতটুকু চায়নি বালিকা, অত শোভা, অত স্বাধীনতা … চেয়েছিল একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী! না, আসবে না জামান, জানে সে। সে যে ঘুমের কথা বলে এসেছে! শায়লার ঘুম ভাঙানোর মানুষ নয় জামান! তার সিভিক সেন্স খুবই প্রবল। সে যাবে? নাহ্! তা কী করে হয়। কিন্তু তার শরীর কেন এমন করছে, কেন অচেনা লাগছে নিজেরই চিরচেনা এই শরীরটাকে? জামানের কি এরকম অনুভূতি হয়? কী সহজভাবেই না কথা বলছিল সে, যেন কিছুই ঘটেনি কখনো তাদের জীবনে। যেন অতীত বলে কোনো কাল নেই। নেই? সত্যিই ভুলে গেছে সে সবকিছু? কোনো দাগ কি পড়েনি কোথাও ওর, অদৃশ্য দাগ?
না, জামান ভোলেনি কিছুই। সে-ও ভাবছিল সেই দিনগুলোর কথা। ওই দুটো দিনের কথা তারও বিশেষভাবে মনে পড়ছিল। যদিও সে এসবকিছু ভুলেই যেতে চেয়েছে, তবু শায়লাকে দেখে আবার জেগে উঠেছে পুরনো সব স্মৃতি। কত অন্যরকম ছিল দিনগুলো! স্বপ্ন ছিল, আশা ছিল, অনেক কিছু করার সাধ ছিল। নিজেকে, নিজের স্বপ্নকে ছড়িয়ে দেওয়ার সাধ ছিল অনেক মানুষের মধ্যে, নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার সাধ ছিল। আত্মকেন্দ্রিক জীবন সে যাপন করতে চায়নি। অথচ তাই হয়ে গেছে। এর জন্য সে কাউকে দায়ী করে না, যা কিছু দায়-দায়িত্ব সব তার নিজের। এ-জীবন সে নিজে বেছে নিয়েছে। কেউ কখনো জোর করেনি, কেউ কোনোকিছুতে বাধাও দেয়নি। সে যখন বিদেশে চলে এসেছিল, তখনো জানত, পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে যাবে। লেখালেখি করতে চেয়েছিল জামান, স্বপ্ন ও আকাঙক্ষার গল্প লিখত সে, বিপস্নবের গল্প লিখত। শায়লাকে নিয়ে লেখা গল্পটিই শেষ নয়, এর পরও সে অনেক লিখেছে, যদিও প্রকাশ করেনি কোথাও। একই সময়ে পূর্বসূরিদের গল্প-উপন্যাস-কবিতা পড়তে পড়তে সে আবিষ্কার করে ফেলেছিল, এরকম অনেক লেখা হয়েছে। কই, কোথাও তো কোনো ছাপ পড়েনি এসবের! যে-তিমিরে ছিল সে-তিমিরেই রয়ে গেছে সমাজ ও রাষ্ট্র। পশ্চাৎপদ, সংস্কারাচ্ছন্ন, রুগ্ণ, ভঙ্গুর, দুর্বল, গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত। তাহলে এসব লিখে কী হয়? একসময় অর্থহীনতায় ভুগতে ভুগতে ক্লান্ত হয়ে লেখালেখিটাই ছেড়ে দিয়েছিল সে। ভেবেছিল, সমাজ বদলের সবচেয়ে কার্যকর ভাষা রাজনীতি। কিন্তু সেখানেও সে আবিষ্কার করল ধান্ধাবাজি, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, কূটকচাল। ছেড়ে এসেছিল জামান। বিদেশে যাওয়ার পর ভাবত – ফিরে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেবে। তরুণ শিক্ষার্থীদের শোনাবে তার স্বপ্নের কথা, ভালোবাসার কথা। ফেরা হয়নি। সে বিদেশে
থাকতেই মায়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিল, তারপর বহু বছর আর ফিরতে ইচ্ছে করেনি। জীবন চলে গেছে অন্যদিকে, অন্য প্রবাহে। যখন সে বুঝতে পেরেছিল, আর ফেরা হবে না, তখন শেকড় কেটে ফেলার যাবতীয় আয়োজন সে সম্পন্ন করেছে ধীরে ধীরে। মেনে নিয়েছে এই উদ্বাস্ত্ত জীবন, পরবাসী জীবন, ব্যর্থ জীবন, স্বপ্নহীন জীবন। তার ঘর-সংসার হয়নি, ঠিকানা হয়নি, এক জায়গায় বেশিদিন চাকরিও করেনি। তবু খাপ খাইয়ে নিয়েছে এই নতুন জীবনধারার সঙ্গে।
সব ঠিকঠাক চলছিল। আজ হঠাৎ করে শায়লার সঙ্গে এই দেখা হয়ে যাওয়ায় ওলটপালট হয়ে গেছে সব। পৃথিবীর নানা প্রামেত্ম বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে তার দেখা হয়। সে ভুলেও নিজের পরিচয় দেয় না, এমনকি তাদের সঙ্গে বাংলায় কথাও বলে না। কেউ বুঝতেই পারে না, সে বাঙালি। অথচ শায়লার কাছে ধরা পড়ে গেল। খুব সহজ থাকার চেষ্টা করেছে সে শায়লার সামনে, যেন কিছুই মনে নেই, যেন স্মৃতির দাগ লেগে নেই কোনোখানে। আর এখন দ্যাখো, কী তীব্র ইচ্ছে তাকে জাপটে ধরেছে! মনে হচ্ছে এক ছুটে শায়লাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে।
শায়লা বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর বেশ অনেকক্ষণ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল সে। তারপর রুমে ফিরে হুইস্কি নিয়ে বসেছে। নার্ভগুলোকে একটু শান্ত করা দরকার, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। কিন্তু কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। জেগে উঠেছে যৌবনের সেই নিদাগ হৃদয় আর তীব্র শরীর। এত আবেগ সে অনেকদিন বোধ করেনি কারো জন্য, এত তীব্র কামনা বহুদিন তাকে আচ্ছন্ন করেনি। যে-মেয়েটির সঙ্গে দীর্ঘদিন জীবন ভাগ করে নিয়েছিল জামান, সে ছিল দুর্দান্ত সুন্দরী আর আবেদনময়ী ইতালীয় তরুণী। তার প্রতিও সে এত তীব্র কামনা বোধ করেনি। আশ্চর্য! কেন এমন হচ্ছে? বহুক্ষণ চেষ্টা করার পর নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না জামান, বেডসাইড থেকে ফোনটা তুলে নিলো। শায়লার রুম নাম্বারে ডায়াল করল কিছু না ভেবেই।
হঠাৎ করেই ইন্টারকমের ফোনটা বেজে উঠলে শায়লা চমকে উঠল। ভুলেই গিয়েছিল এখানে একটা ফোন আছে। ওপাশে জামানের কণ্ঠ – ঘুমিয়ে পড়োনি তো!
নাহ্! ঘুম আসছে না।
চলে এসো, গল্প করি।
তুমি এসো।
না, তুমি এসো।
সবসময় আমাকেই আসতে হবে?
একটু থামল জামান, বলল – ঠিক আছে আমিই আসছি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজায় নক হলো। দরজা খুলে শায়লা বলল – ভেতরে এসো।
না। তোমাকে নিতে এসেছি। চলো।
যদি না যাই?
জামান হাসল – ফিরিয়ে দেবে? তা তুমি পারো। সব সময় তো ফিরিয়েই দিয়েছ, আজকে নাই-বা ফেরালে!
সব সময় ফেরাইনি। আমি কিন্তু তোমার কাছে গিয়েছিলাম।
হুঁ, মনে আছে। সেজন্যই আজকে নিতে এলাম। চলো।
শায়লা আর কিছু না বলে রুম লক করে চলল জামানের সঙ্গে। গিয়ে দেখল তার রুমে পানীয়ের সরঞ্জাম।
ড্রিংক করছ?
হুঁ।
ডিনারের পরে কেউ ড্রিংক করে?
সাধারণত করি না। আজকে ডিনার করার ইচ্ছেও ছিল না। তুমি ডেকে নিলে বলে গেলাম।
ডিনার যেহেতু করেছই, ড্রিংক না করলেই পারতে!
তোমাকে দেখে এলোমেলো হয়ে গেছে সব। তুমিও একটু নাও না! আমি তো খাই না।
একেবারেই না?
খাই। অকেশনালি। খুব কম।
আজকেরটাও অকেশন ধরে নাও। প্রতিদিন তো আর আমাদের দেখা হয় না।
আচ্ছা দাও।
তারপর খেতে খেতে কখন কথা শুরু হয়েছে, মনের দরজা খুলে গেছে দুজনেরই, কেউ বলতে পারবে না। জামান বলছিল তার নিঃসঙ্গতার কথা, শেকড় কেটে ফেলার যন্ত্রণার কথা, কোনো স্বপ্নই পূরণ না হওয়ার দুঃখের কথা। শায়লা বলছিল তার সম্মানহীন-মর্যাদাহীন দাম্পত্য-জীবনের কথা, অপমান আর স্বসিত্মহীনতার কথা। বলতে বলতে কখন সে কাঁদতে শুরু করেছিল জানে না, কখন জামান এসে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল তাও জানে না। তারপর জামানের শরীরের সঙ্গে নিজের শরীরের মিশে যাওয়ার সময় ফিরে এসেছিল সেই প্রথম সঙ্গমের অনুভূতি, আর হঠাৎ করেই অনুভব করে উঠেছিল – মামুনকে সে কোনোদিনই গ্রহণ করেনি। বিবাহিত জীবনে যতবার মিলিত হয়েছে, ততবার নিবিড়ভাবে ভেবেছে জামানের কথা। তার মিলন ঘটেছে জামানের সঙ্গেই, মামুন সেখানে ছিল না কখনো। এই উপলব্ধি তাকে আরো কাতর করে তুলেছিল, ফিসফিসিয়ে বলছিল – আরেকটা দাগ বসিয়ে দাও। এমন কোথাও, যেন দেখতে পাই, যেন স্পর্শ করতে পারি। জামান বলছিল – কেন চাও? কেন আরেকটা দাগ দরকার তোমার? শায়লা বলছিল – ওই দাগটা নিয়েই বেঁচে আছি, ওটাই আমার একমাত্র সুখের স্মৃতি।
কিন্তু ওটাকে দেখতে পাই না, ছুঁতে পারি না। আরেকটা দাগ যদি উপহার দাও তাহলে ওটাকে দেখে আর স্পর্শ করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারব। এটুকু দেবে না আমাকে? জামান তখন তার সারা শরীরে চুমু দিতে দিতে বলে – এই দাগগুলো নিয়ে যাও। অদৃশ্য। কিন্তু তুমি ঠিকই দেখতে পাবে, স্পর্শ করলে অসিত্মত্ব টের পাবে। যেমন আমি বয়ে বেড়াচ্ছি তোমার দেওয়া অদৃশ্য দাগগুলো – স্পর্শের দাগ, চুমুর দাগ; আমি ওদের দেখতে পাই, স্পর্শ করি, ভালোবেসে হাত বুলিয়ে দিই, তুমিও তা-ই করো।