আড়ালের হাতছানি

কখনও ভূত দেখে চমকে ওঠার মতো রাত্রির প্রয়োজন হয় জীবনে। প্রয়োজন হয় তুমুল রোদের শাসন ভেঙে ঘোলাটে কুয়াশা নামিয়ে আনার। ক্রমাগত পূর্ণ হয়ে ওঠা একটা গ্লাসকে পাতালে নামার কুয়া ভেবে ভ্রমণে ডেকে নিতে হয় মনকে। সবটা আয়োজন তো আসলে আড়ালের আয়োজন। একটা জীবনের ভেতরে চলতে চলতে রুগ্‌ণ হয়ে আসা আত্মাকে অন্য পথে ঠেলে দেওয়া। সে পথ নেশার পথ, সে আড়াল নেশার আড়াল।

কে কাকে আড়াল করে? কার কাছ থেকে আড়াল করে? ধরা যাক রাজ্যের আবর্জনায় পূর্ণ একটা জায়গা। এগিয়ে গেলে পেছন দিকে কয়েক ঘর মানুষের বসবাস। সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে শূকর, উড়ছে মাছির দল ঝাঁক বেঁধে বোমারু বিমানের মতো। সেখানেই পাতা চারপায়ার খাটিয়া। তাতে শুয়ে আছে মানুষ। ঘুমাচ্ছে অথবা পুড়ছে। পুড়ছে প্রবল বিস্মৃতির জ্বরের দাপটে। পেছনের ঘরগুলোতে হাতে হাতে ঘুরছে পাতালে নামার আয়োজনের গেলাস। কারা আসত এখানে একদা? অথবা এখনও আসে? হয়তো অন্য মানে খুঁজতে এসেছিল কেউ কেউ এখানে একদিন। দেখতে চেয়েছিল জীবনের অন্য দৃশ্যে অভিনয়ের মঞ্চ।

‘আসক্তি’ আসলে কী? শুধুই নেশা, নাকি বারবার অস্থির চেতনায় উল্টেপাল্টে দেখতে চাওয়া নিজেকেই? কে যেন একবার বলেছিল কর্কশ গলায়, ‘যতটা পারিস খেয়ে নে। বমি করা যাবে না কিন্তু।’ মনে আছে পাকস্থলীতে তরল আগুন চালান করে দিয়ে সেই গুম মেরে বসে থাকা। পৃথিবী দুলছে। বদলে যাচ্ছে পরিচিত রাস্তাঘাট, দৃশ্যের পর দৃশ্য, চেয়ারের হাতল, বাজারের ব্যাগ, মেয়েদের স্কুল ইউনিফর্ম। কত বছর আগে বাঘের পিঠে চড়ে বসার মতো সেই অঘটন। নেশার বাঘ চমকের মতো উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে গ্রাম, শহর ভেদ করে। অচেনাকে চিনে ফেলাটাই তখন নতুন নাবিকের একমাত্র ব্রত যেন।

বলছিলাম জীবনের অন্য দৃশ্যে অভিনয়ের কথা। নেশার পৃথিবী তো এক ধরনের অভিনয়ই। জীবনের নিস্তরঙ্গ অংশে যে চরিত্রের ভেতরে বসবাস করি তার বিপরীত কোনো চরিত্রের ভেতরে ঢুকে পড়ার মতো। কে জানে, হয়তো ওই বিপরীত চরিত্রটাই আসল চরিত্র একজন মানুষের। হাওয়া পেয়ে, আগুনের স্রোত পেয়ে, শহরের গলিপথ বেয়ে সে-ই তখন রাজত্ব করে। একজন মানুষ নিজেকে ভুলে গিয়ে পরিধান করে অন্য পোশাক, দাঁড়ায় নিজস্ব আয়নার সামনে।

নেশার জীবন তো আসলে একটা বইয়ের অনেক অনেক লাইনের ফাঁকে লিখে রাখা অদৃশ্য কিছু লাইন। সেই লাইনগুলো যোগ করলে একটা আলাদা পৃথিবী তৈরি হয়ে যায়। একজন মানুষের এই পৃথিবীতে নিজস্ব নির্জনতার জগৎ। সেখানে নেশা কিছুটা নির্ভরতাও হয়তো। ইংরেজ কবি কোলরিজ নাকি আফিমের নেশায় বুঁদ হয়েই লিখেছিলেন তার বিখ্যাত ‘কুবলাই খান’ কবিতাটি। নেশার ডানায় ভর না করতে পারলে এই কবিতার জন্ম হতো না বলে মনে করেন কেউ কেউ। নেশা কি তাহলে একটা দ্বীপ, যাতে আচ্ছন্নতা খুঁজে পেয়ে একজন সাহিত্যিকের চেতনার জগতে অন্য দরজা খুলে যায়? অনেকেই না বলবেন এমন প্রশ্নের উত্তরে। কিন্তু প্রশ্নটি কি এক কথায় নাকচ করে দেওয়া যায়?

এই রাজধানীতে তখনও আফিমের দোকানের দরজা বন্ধ হয়নি। বন্ধ হয়নি আফিমের দোকানের উল্টোদিকে দুধের দোকানও। আবগারি বিভাগের অনুমোদন লাগানো নিক্তিতে মেপে বিক্রি হয় গাঁজা। বেপরোয়া তরুণ শরীর তখন পোকা মারার ওষুধের শমনেও স্বাক্ষর করে দেয় অবিচল হাতে। তখন সময়টাই এ রকম। ঘোর যৌবনগ্রস্ত এক শহরে নিজেরই অন্য পরিচয় খুঁজে বেড়ানোর কাল। নাবিকের মতো জাহাজ ভাসিয়ে চলে যাওয়া অজানা বন্দরের খোঁজে। সে খোঁজে ছিল এক ধরনের আত্মনিপীড়ন। মনে হতে থাকে ক্রমাগত শরীরের ভেতরে নেশার ছায়াচ্ছন্ন জগৎ তৈরি হলেই বাইরের আচ্ছন্নতাকে, অর্থহীনতাকে হয়তো ভুলে থাকা যাবে। নগরজীবনের ঘোড়দৌড়ের ক্লান্তি ভুলতেই নেশাকে আঁকড়ে ধরা। যে রকম নিজেকে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করতে গিয়ের্ যাঁবো ডুব দিয়েছিলেন আফিমে। লিখেছিলেন ‘এ সিজন ইন হেল’। নেশা নরকে এক ঋতু কাটানোর মতোই ঘটনা। মানুষ কেন নরকের আগুনকে ডেকে আনে জীবনে?র্ যাঁবোর কেন জ্বলতে সাধ হয়েছিল? উত্তর ছাড়াই বেড়ে ওঠে একেকটা শহর, তার গলিপথ, শুঁড়িখানা আর নেশার সংযোগ সেতু।

নেশার বর্ম পরে কেউ হয়তোর্ যাঁবোর মতোই সংযোগহীন হতে চান চারপাশের চেনা আবহ থেকে। কিন্তু তাতে কি নিস্তার পাওয়া যায়? চেতনার ভেতরে বয়ে যাওয়া ঝোড়ো হাওয়া ফিরিয়ে আনে সেই চেনা মানুষটাকেই। উপুড় করে স্মৃতির ঝুড়ি। এ যেন ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ। নিজের ছায়াকে ভুলতে চেয়ে বেশি করে ফিরে পাওয়া। পাওয়া যায় কি? উজ্জ্বল হাসিমুখের এক তরুণ। লেখালেখির জগতে পা রেখেছিল অনেক বছর আগে। তারপর শুরু হলো তার দহনকাল। নেশার জগতে এই দহনকাল শেষ আশ্রয়টুকুও পুড়িয়ে দেয়। সেই তরুণও কি ভুলতে চেয়েছে নিজের ছায়া? তার সঙ্গে দেখা হয় রৌদ্রের স্বৈরশাসনে ক্ষতবিক্ষত শহরে। দেখা হয় বর্ষার বৃষ্টিতে ধোয়া শহরেও। এক মনে পথের পাশে তার বসে থাকা। দৃষ্টি হারিয়ে গেছে কোনো সময়হীন দ্বীপে। সেখান থেকে কেউ ফিরেছে বলে জানা নেই। নিজেকে খুঁজে ফেরা তার শেষ হবে না এক জনমেও।

চমকে দেয় নেশা। ভূত দেখার মতোই তো ব্যাপারটা। নিজেকে দেখে ফেলা এক লহমায়। আসক্তির মতো ঝুলে থাকে নিজেকে দেখার এই লোভ। নিজের সঙ্গে কথা বলার অবকাশ তাড়া করে ফেরে। নেশার রকমফের তো আরও আছে- মাছ ধরা, বই পড়া, জুয়া অথবা আরও অন্যকিছুও তো নেশাই। আসক্তি সেখানেও আছে। কিন্তু কুড়ি বছর ধরে যে মানুষটা পানশালার নির্দিষ্ট একটা চেয়ারে বসে থাকে সামনের টেবিলে দুটো গ্লাস সাজিয়ে রেখে তার নেশার পৃথিবীর ডাকনাম কী? সে মানুষটিকে কি চমকে দিচ্ছে তার নিজেরই ভূত? জানি না। কিন্তু নেশার পৃথিবীতে ঢুকে পড়ে এই চমকে ওঠার লোভটাও কম নয়। সোজা ভাষায়, মুখোমুখি হওয়া নিজস্ব বোধের সঙ্গে। আর বোধ তো চিরকাল বিপন্নই করে। জীবনানন্দের কবিতার লাইনের মতো লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমাতে চায় কেউ। আবুল হাসানের কবিতার সেই লাইন মনে পড়ে- এই তার জেগে জেগে ঘুমাবার সাধ। নেশা তো জেগে জেগেই ঘুমিয়ে পড়া। চেতনাকে ঢেকে ফেলে আরও কোনো চেতনার হাতে নিজেকে সমর্পণ করা। সেখানে নিজের অন্দরমহল, সেখানে গোপন ঝড়, সেখানে বেহাগের সুর।

হাওয়ার শরীরে হাত রেখে উড়ে যাওয়ার নামই হয়তো নেশা। বাইরে বাঁচার পথ নেই দেখে কেউ ভেতরে বাঁচতে চায়। আমাদের রক্তের ভেতরে নেশা ঢুকে পড়ে। হেরে যাওয়া, জিতে যাওয়া আর পথ চলার চিরচেনা গল্পকে অন্যরকম করে সাজায়। অন্তর্গত রক্তের ভেতরে গড়ে তোলে অজানা রাজ্য। সেখানেও কি মুক্তি মেলে?

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত