খণ্ডিত চাঁদের ভেতর

এখান থেকে আলতামির দুইটা পথ বেছে নিতে পারে—যেতে পারে ঢাকার দিকে—যে দিকটা সে তিনটা ঘণ্টা আগেও ফেলে আসতে চেয়েছিল। ঢাকা মানেই মৃত্যু হয়ে উঠেছিল আলতামিরের জন্য। শ্বাস নেওয়ার প্রতিটা সময় ছিল ভীতিকর। পেঁয়াজপট্টির ভেতর দিয়ে, মুখের ওপর গামছা চাপিয়ে, পদ্মর হাত ধরে যখন সে ছাড়ছিল কারওয়ান বাজার, মনে মনে খোদার কসম কেটেছিল আলতামির—জান থাকতে আর কোনোদিন ঢাকায় ফিরবে না সে। না, শুধু সে নয়। সে আর পদ্ম।

তা কাজটা তারা কম মন্দ তো করেনি।

সরদারের ডেরায় থেকে, সরদারেরই চোখের আড়ালে তারা প্রেম করেছে। এ যেন পানির ভেতর থেকে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ। কিন্তু আলতামিরের এক গোঁ…যে কুমির, তার সঙ্গে বিবাদে ভয় নেই, যদি ডাঙা থাকে পায়ে!

ডাঙা এখন আলতামির আর পদ্ম দুজনেরই পায়ের তলায়। প্রায় ১৭ কিলোমিটার উড়ে এসে এই যে ব্রিজের ওপর উত্তর-দক্ষিণের দুটো পথ…একটা ঢাকা—মৃত্যুর, অন্যটা উন্মুক্ত—জীবনের! তবে তাতেও সন্দেহ হয় আলতামিরের। তার ধূর্ত চোখ বুঝে গেছে ওপাশেও হেডলাইট জ্বেলে দাঁড়িয়ে আছে সরদারের আজ্ঞাবাহী ছায়ারা। সরদার শুধু কারওয়ান বাজারের ওপর যে ছড়ি ঘোরায় তা নয়, বরং তার লোক ছড়িয়ে আছে দশ দিকে। কুলিগিরি করতে গিয়েই তো পদ্মর চোখে মজেছিল আলতামির, কাজল না দেওয়া ডাগর চোখে কী যে হাতছানি! বাজার থেকে কাঁচা সুপারির খদ্দের পদ্ম, প্রতিদিন আলতামিরকে কাছে আসার সুযোগ দিত ভিড়ের মধ্যে। কোনো কোনো দিন যেন তাড়াহুড়ো করেই সন্ধ্যা নেমে যেত। সেদিন…আরও অনেক দিন…একদিন হাত ছুঁয়ে একদিন কাঁধ, আলতামির বুঝেছিল ঢাকার বস্তিঘর ছেড়ে তাকে কোনো জঙ্গলে যেতে হবে। যদি পদ্মর প্রশ্রয় থাকে।

প্রশ্রয় তো ছিলই! না থাকলে সরদারের বউ হয়েও কেন পদ্ম এমন মোহন হাসে? সন্ধ্যার মুখে পটল কেনার নামে পানির ট্যাংকের পেছনে উদ্গ্রীব কেন চলে আসে? আর একাও যে আসে তা তো না…কত আবদার আর খুনসুটি থাকে সঙ্গে!

এক রাতে সরদার যখন বাংলা মদ গিলছিল, তখন আলতামির শক্ত করে ধরে পদ্মর হাত। ঢাকাকে বিদায় দিয়ে পৌঁছাতে চায় জঙ্গলে, ডাঙায়। কিন্তু রাতের এই স্তব্ধ ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে সে গুমগুম শোনে মোটরসাইকেলের শব্দ—দুপাশ থেকেই। উত্তরে ঢাকা—যেখানে কোনোদিন ফিরবে না তারা; আর দক্ষিণে পৃথিবী—যেদিকে কথা ছিল প্রেম আলিঙ্গন করবে তাদের। কিন্তু সরদারের শক্তিবলয় এখন দুপাশ থেকে ইঞ্জিনের শব্দ তুলে অপেক্ষমাণ। তাই দক্ষিণে গিয়েই ফিরে আসতে হয় তাদের, মৃত্যুর মুখ এমন কালো হয় কেন? এরচেয়ে কি ভালো ঢাকার সরদার…ক্ষমাও যদি মিলে যায়! কিন্তু ভালোবাসা নিয়ে ক্ষমাই বা চায় কীভাবে মানুষ?

তাহলে পথ নেই কোনো!

একটা বিন্দুর মতো চাঁদ অনেক নিচের সরু এক সুতানদীতে নিজেকে আছড়ে রেখেছে। আলতামিরের হাসি পায় এই দুর্যোগেও। পথ না থাকলে চাঁদের আলো কোন কাজে আসে? উত্তরে ফেরা যায় না এ আলোয়…দক্ষিণ থেকে হা রে রে রে করে ছুটে আসতে থাকা কালো মৃত্যুর মুখেও এ আলো ভীষণ অকার্যকর!

অথচ দুটো বন্ধ পথকে তীব্রভাবে ভেঙিয়ে পদ্ম আর আলতামির পরস্পরকে প্রবলভাবে জড়িয়ে ধরতেই তাদের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসে তৃতীয় পথ। চাঁদ তাদের সাহায্য করে হয়তো। অথবা কবেকার শোনা পালাগান, আরব্য রজনী বা পাখিরা হয়তো তাদের মাথার ভেতর ডেকে ওঠে হঠাৎ করেই। তারা দুজন দুজনাকে ধরে তৃতীয় অতিকায় এক পথ সৃষ্টি করে লাফিয়ে পড়ে ব্রিজ থেকে।

তারা পাখি নয় বলে উড়ে যেতে পারে না। তারা মায়াবী নয় বলে মিলিয়ে যেতে পারে না বাতাসে। তবে অনেক নিচের চাঁদকে তারা দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে। লোকে বলে, ভালোবেসে এর আগেও অনেকেই চাঁদকে এমন দ্বিখণ্ডিত করে গেছে!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত