কাঁচ ভাঙা হাসি

কোথাও কী কাঁচ ভাঙলো? কাঁচের গ্লাস, ফুলদানী ভেঙে চুরমার হলো যেন! অন্তত সম্বিত ফেরার আগে এক মুহূর্ত আরিফের তেমনই মনে হয়। তারপর ভাবে ওতো গাড়িতে, গ্লাস ফুলদানী নয়, ভাঙলে গাড়ির কাঁচ ভেঙেছে। আরিফ পায়ের ওপর ম্যাপ আর জিপিএস মেশিন রেখে ওর ফিল্ডওয়ার্কের জায়গাগুলোতে হিসাব নিকাশ করে লাল মার্কারের চিহ্ন বসাচ্ছিল এবার সে মনে মনে বলে ‘হুম এ হলো কাঁচভাঙা হাসি’। লুসি পাশে বসে আছে। জানালা দিয়ে পথের দিকে তাকিয়ে একা একাই হেসে গড়িয়ে পড়ছে।

হঠাৎ গাড়ির ঝাকুনিতে আরিফের সাধের জিপিএস হাঁটু থেকে ছিটকে নিচে পড়তে পড়তে আরিফ কোনোরকমে সামলে নেয়। এতে হাঁটুতে বিছিয়ে রাখা ম্যাপ, মার্কার পড়ে যায়। ফলে কাজ বন্ধ করতেই হয়। তবে মগ্নতায় বাধা পড়লেও তার বিরক্ত লাগে না। মুগ্ধ হয়ে সে লুসির বাঁধভাঙা হাসি দেখতে থাকে। সেও মনে মনে হাসে একটু। বেচারা ড্রাইভার একেবারে চমকে গেছে। তার আর দোষ কী—লুসির এই হাসি বিয়ের পর থেকে আরিফকেও কী কম চমকাচ্ছে!

আরিফের একটু বিব্রত লাগে আবার ভালোও লাগে লুসির এই প্রাণবন্ততা। ওরও ইচ্ছা করে লুসির সাথে গলা মিলিয়ে হাহা হোহো করতে কিন্তু পারে না শুধু একটা স্মিত হাসি ঝুলে থাকে ঠোঁটের কোণে। তারপর বলে, কী আছে এখানে যে এমন হেসে কুটি কুটি হচ্ছো?

লুসি হাসি থামানোর চেষ্টা করতে করতে বললো, জানো এখানের একটা জায়গার নাম ফাজিলপুর তারপর আবারও হাসির দমকে ফেটে পড়ে আর বলে এটা দেখে একটা ঘটনা মনে পড়লো জানো…

আরিফ লক্ষ করে ড্রাইভার গাড়ি একেবারে স্লো করে ফেলেছে। লুসির আচরণে তার সমস্যা হচ্ছে বোধহয়। উসখুশ করছে। আরিফ বলে মতিউর সামনের চৌমাথার বাঁ দিকে গাড়ি থামাবা। লুসির কোনদিকে নজর নেই আবার হাসিতে ভেঙে পড়তে পড়তে বলে একবার ট্রেনে করে বেড়াতে যাচ্ছি তো দেখি একটা জায়গার নাম বোকানগর। আমি চেঁচিয়ে বাবাকে বললাম বাবা এখানের সব মানুষ বোকা নাকি? বলতেই দেখি এক বোকা মহিলা…হি হি হি…রাস্তার পাশে বসে টয়লেট করছে… আর কথা শেষ করতে পারে না হাসতে হাসতে তার চোখে পানি গালদু’টো টকটকে লাল। আরিফের ভয় ধরে যায় ও কী হাসতে হাসতে মরেই যাবে নাকি!

হাসির রোগ আছে ওর। নিজেই বলেছে একবার হাসতে হাসতে পেশাব হয়ে গিয়েছিল। এই বিব্রতকর পরিস্থিতি কী করে সামলানো যায় আরিফ ঠিক করতে পারে না। শুধু ওর আবদারে সায় দেয়ার জন্য নিজেকে গাধা বলে গালাগাল করে আর ঠোঁট কামড়ায়। এরপর গাড়ি থামতেই হ্যাঁচকা টানে ওকে নিচে নামিয়ে মনোযোগ ঘোরানোর জন্য বলে আইসক্রিম খাই চলো, যা গরম।

লুসি তখনও আঁকুপাঁকু করে হাসছে। আরিফ দ্রুত ড্রাইভারের কাছ থেকে দূরে যেতে চেষ্টা করে। জানে ড্রাইভারের মাধ্যমে এই গল্প অফিসে ছড়িয়ে পড়বে। ড্রাইভারদের প্রধান কাজ হচ্ছে সময় পেলেই স্যারদের হাড়ির গল্পগুলো জমিয়ে অন্যদের শোনানো।

লুসি ধনীর মেয়ে। বিষয়গুলো অবশ্যই জানে। কিন্তু পাত্তা দেয়ার বান্দা সে না। পেছনে কে কী বলবে তা থোড়াই কেয়ার করে সে। মফস্বল থেকে আসা সরকারি কর্মকর্তার মতো জড়োসড়ো হয়ে থাকা তার পোষায় না। মুশকিল হচ্ছে আরিফের। লুসিকে কিছু বলতেও পারে না সইতেও পারে না। টেনশনে আধমরা হয়ে থাকে শুধু।

২.

প্রতিটি জায়গা দেখার সময় লুসি সেই নাম নিয়ে কিছু একটা প্রতিক্রিয়া দেখায়। হয় হাসে, নয় এর শানে-নুযুল খোঁজে, নইলে স্মৃতিচারণ করে অথবা মন্তব্য। নিশ্চিন্তপুর শুনে বললো, বাহ এখানে এলে মানুষের কোনো চিন্তা থাকে না বুঝি? চলো আমরা এখানেই থেকে যাই, তাহলে তোমার চেহারা থেকে চিন্তার ছাপ মুছে গিয়ে তোমায় অনেক ভালো দেখাবে। সুজানগরে জানতে চাইল মোঘল রাজপুত্র সুজা এখানে এসেছিল কিনা। খানকা বিলাইকান্দি শুনে হেসে গড়িয়ে উচ্চারণ করলো কানখা বিলাইকান্দি, এখানের সব বিড়াল বুঝি কান খায়? মানুষের কান নয়তো? আরিফকে অপদস্থ করার বেশ একটা সুযোগ পেয়েছে যেন!

কিন্তু আরিফের ভালো লাগে না অন্য কারণে। সে লক্ষ্য করছে একটা উটকো ছেলে যেখানেই তারা যাচ্ছে সেখানেই হাজির আর চোখমুখ শক্ত করে লুসির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোয়ালদুটিও বেশ শক্ত। সেখানে এলোমেলো পাতলা দাড়ি। সবুজ পাঞ্জাবি আর ময়লা সাদা সালোয়ারের নিচে স্পঞ্জ পরিহিত ময়লা পা মাথায় গোলটুপি পরা ছেলেটিকে খালি গা লুঙ্গি পরা গ্রামবাসীদের চেয়ে আলাদা দেখায়। নাওরি পৌঁছালে গাড়ির ভেতর থেকেই আরিফ দেখে ছেলেটি ক্ষেতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। কিভাবে আসে এত তাড়াতাড়ি বুঝে পায় না সে। হয়তো গ্রামের ভেতর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে আসে। আরিফ আশেপাশে তাকায় সাইকেলটির খোঁজে কিন্তু দেখতে পায় না। কেমন একটা অস্বস্তি চেপে ধরে তাকে। লুসিকে বলে এই রোদে আর নামার দরকার নেই আমি একদৌড়ে এই সামনের ক্ষেত থেকে একটা স্যাম্পল নিয়ে আসি। এখানে কোনো কৃষক তো দেখছি না দেরি হবে না।

৩.

মাটি কালেকশানের একটি বিশেষ পদ্ধতি আছে। প্যাঁচানো ফলাযুক্ত অনেকটা বল্লমের মতো দেখতে অগার নামের যন্ত্রটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মটির ভেতর ঢুকিয়ে দিলে মাটি স্লাইস হয়ে কেটে কেটে প্যাঁচের ভেতর আটকে যায়। এরপর যন্ত্রটি উঠিয়ে নিয়ে স্লাইসগুলো ফলা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সাবধানে ফলা থেকে বের করে বেলচা দিয়ে বিশেষ পলিব্যাগে পর্যায়ক্রমে সাজিয়ে রাখতে হয়। তারপর পলিব্যাগের মুখ সিল করে দিতে হয় যেন হিউমিডিটি ঠিকঠাক থাকে। প্রতিটি ক্ষেত থেকে অন্তত তিনটি স্যম্পল নেয়ার নিয়ম সেই সাথে কৃষকের কাছ থেকে তথ্য নেয়া। আরিফ দ্রুত স্যাম্পল কালেক্ট করার চেষ্টা করে। খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। এখন আর কোনো কৃষককে মাঠে পাওয়া যাবে না। সে এই স্যাম্পল নেয়া শেষ করেই আজ ফিরে যাবে। মাথার ওপর চড়া রোদ, ক্ষিদেও পেয়েছে খুব।

এসময় আবার কাঁচভাঙার শব্দ। লুসি একা একাই হাসছে নাকি। এত জোরে একা একা এই দুপুরে হাসছে ও! কেমন যেন মাথাখারাপ লাগে! আরিফ ঘুরে তাকিয়ে আর্তনাদ করে ওঠে।গাড়ির কাছে একটা জটলা, কতগুলো ছেলে গাড়ির কাঁচ ভাঙছে, নেতৃত্ব দিচ্ছে কি সবুজ পাঞ্জাবি পরা ছেলেটি? আতঙ্কে দিশেহারা আরিফ ছুটতে শুরু করে, হাতে অগার নিয়ে ড্রাইভারও ছুটছে তার সাথে কিন্তু হঠাৎ অগারটি শূন্যে ঝলসে ওঠে তারপর নামতে থাকে নিচের দিকে। আরিফ আর পারে না, তীব্র ব্যথায় লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।

৪.

জ্ঞান ফিরলে ‘আমি কোথায়’ বলার অবসরটি আর সে পায় না। চোখ খুলেই দেখে অনেকগুলো মুখ ঝুঁকে আছে তার ওপর। এর মধ্যে লুসির উদ্বিগ্ন মুখটিও দেখে সে। নড়ার চেষ্টা করে কিন্তু হাত পা আটকানো মনে হচ্ছে। ওকে কি বেঁধে রেখেছে শত্রুর দল? বুকের বামপাশটায় বেশ ব্যথা অগারটি বোধহয় এখানেই বিঁধেছিল। একটু সময় নিয়ে লুসি জিজ্ঞেস করে কেমন লাগছে এখন? লুসিকে সুস্থ্য সবল দেখে আরিফের মনে হয় সে স্বপ্ন দেখছে হয়ত। পানি খেতে চায়, নার্স এগিয়ে এসে বলে স্যালাইন চলছে পিপাসা কমে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে। সে তাহলে হাসপাতালে? কি করে কী হলো এরকম একটা কৌতুহলের মধ্যে দরজা ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে উঠলে সে দেখতে পায় সবুজ পাঞ্জাবি আর পেছনে ডাক্তার একজন। আতঙ্কে অস্থির আরিফের সামনেই লুসি সবুজ পাঞ্জাবিকে বলে আসো ভাইয়া জ্ঞান ফিরেছে ওর। আরিফকে বলে এ হচ্ছে ফিরোজ ভাইয়া, উনি লোকজন ডেকে সাহায্য না করলে তোমাকে নিয়ে কী যে করতাম আমরা!

ডাক্তার আরিফকে বলে আপনার রিপোর্ট সবই ভালো। এমন শক্ত করে বুক খামছে ধরেছিলেন কেন ব্যথা করেছিল নাকি? আমরা তো ঐ অবস্থায় আপনাকে পেয়ে হার্ট অ্যাটাক ভেবেছিলাম। আপনার আঙুলগুলো বুকের মাসলে এমন শক্ত হয়ে আটকে গিয়েছিল খোলাই মুশকিল হচ্ছিল। ওটাই ছিল রিস্ক বুঝলেন বেশ কিছুদিন ব্যথা করবে। কী হয়েছিল মনে করতে পারেন?

ডাক্তারের কথার উত্তর না দিয়ে আরিফ লুসিকে দেখে। সবুজ পাঞ্জাবির সাথে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে। স্নিগ্ধ, নরম দুটি মুখ, যেন কতকালের ভাইবোন তারা!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত