পকেটে মাত্র দেড় শ টাকা৷ এক প্যাকেট হলিউড কেনামাত্রই যা সত্তর টাকায় রূপ নিল। আমি কখনোই চাই না পকেটে দু-তিন হাজার টাকা না থাকা অবস্থায় কারও সঙ্গে আমার দেখা হোক। এক্সেপ্ট, ধার দিতে আসা কোনো সজ্জন। অবশ্য এ ক্ষেত্রেও বলা যায়, সামনাসামনি হাজির হয়ে ধার প্রদানের চেয়ে আমি বরং প্রেফার করি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তা সম্পন্নকরণে। ভাগ্যিস, আমার কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষী নিয়মিত আমাকে টাকা ধার দিয়ে থাকে। আর তা অফেরতযোগ্য মনোভাব থেকেই। না হলে আমার যে কী হতো, ভাবতেও ভয় পাই। বিশেষত আমি বলতে পারি রবার্ট ব্রুসের কথা। এই নামটা ওর আমেরিকায় গিয়ে নেওয়া। বাংলা নামটা চেপে যাওয়াই ভালো, কেননা দেশ ছাড়ার আগে নানা অপকর্মে জড়িত থাকা ওকে চিনে ফেলাটা অসম্ভব কিছু না।
আমার জীবন চলছে মূলত রবার্ট ব্রুসের অফেরতযোগ্য ধারের টাকায়৷ আরও যেসব ধার আমাকে করতে হয়, এমনকি যার কোনো কোনোটা ফেরতযোগ্য, সেগুলোর বেশির ভাগই অন্যের উপকার করতে গিয়ে করা ধার। যেমন প্রায়ই আমার এক সাবেক প্রেমিকাকে—বর্তমানে বিধবা—অন্তত দশটি হাজার করে টাকা পাঠাতে হয়। স্বামীর মৃত্যুতে পর্যাপ্ত আয়-উপার্জনহীন অবস্থায় পড়ার কয়েক মাস আগে থেকেই বিলকিসের সঙ্গে আমার পুনরায় কথাবার্তা শুরু হয়। যদিও ওর বিয়ের পর এই পুনর্যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় সময় লেগেছিল সাত বছর। এই সাতটি বছর আমি ব্যাকুল ছিলাম কখন, কবে বিলকিস আবার আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে, সেই অপেক্ষায়। আদৌ করে কি না, সেই আশঙ্কায় এবং যোগাযোগহীনতায় পার হয়ে যায় কি না ক্ষুদ্র মানবজীবন, এই দুশ্চিন্তায়।
তবে বিলকিস ধারের বিষয়টাকে এখনো মাসোহারা পর্যায়ে নামিয়ে আনেনি। গড়ে প্রতি সোয়া দুই মাস অন্তর বাধ্য হয়ে ওকে একবার ধার চাইতে হয়। আমিও তত দিনে বাবলীর কাছ থেকে দু-এক কিস্তিতে হাজার দশেক টাকা ধার নিয়ে রাখি, বিলকিস চাওয়ামাত্র ওকে টাকাটা ফরোয়ার্ড করে দিই। বাবলীর প্রবলেম হলো স্বামীর সংসারে ওকে কড়া নজরদারির মধ্যে থাকতে হয়। এমনিতে প্রচুর টাকাপয়সা ওড়ানোর স্বাধীনতা বাবলীর থাকলেও সমস্যা একটাই—কোথায় কোন টাকাটা খরচ হচ্ছে, তার ওপর একধরনের প্রচ্ছন্ন নজরদারি বহাল থাকছে। বাবলী সাধারণত ড্রাইভার, মালি গোত্রের লোকজনকে দিয়ে লুকিয়ে-চুরিয়ে হাজার দুয়েক করে টাকা পাঠাতে পারে। তা-ও কারও যেন সন্দেহ না হয়, সে জন্য একেকবার টাকা পাঠানোর মাঝখানে ওকে মেইনটেইন করতে হয় বিশ্বাসযোগ্য গ্যাপ।
রবার্ট ব্রুসের ফোন আসামাত্র আমি আহ্লাদের স্বরে ওকে জানালাম, ‘বন্ধু, আমার কাছে মাত্র দেড় শ টাকা আছে এই মুহূর্তে।’ শুনে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে রবার্ট হুংকার দিল, ‘কী! কার এত বড় সাহস?’ আমি যারপরনাই হতাশ হয়ে ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, ‘ব্যাপারটা মোটেই সে রকম কিছু না।’ কিন্তু রবার্ট জানাল, ওর প্রচণ্ড নেশা হয়ে গেছে। এখন বার থেকে ওকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার মতো নাকি কেউ নেই। ‘কেন, দূতাবাসের সেই মেয়েটা কোথায়?’ জানতে চাইতেই সম্মানিত মেয়েটাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করল রবার্ট। ‘এখন আমার সাথে দূরত্ব বজায় রাখে, হা হা।’ বলেই আবার ক্ষুব্ধ হলো, ‘হু কেয়ারস? বল!’ উঠে দাঁড়াল যেন, আর নতুন উদ্যমে বলল, ‘একাই পারব ফিরে যেতে। কাউকে লাগবে না।’ আমি বাধা দিয়ে বললাম, ‘আরে, বেপরোয়া হোস না। একটু সময় নে…’ কিন্তু রবার্ট লাইন কেটে দিল বা কোনোভাবে কেটে গেল সেই লাইন।
ওয়েটিংয়ে ঢোকা শওগত ভাইকে কলব্যাক করলে শওগত ভাই বললেন, ‘শ্যামলী আসছিলাম তাই তোমারে ফোন দিলাম। আছ কই?’ কলেজ গেট থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে শওগত ভাই ফিরে এলে তাঁর সঙ্গে কোলাকুলি করতে হলো। ‘ছিলাম তো এখানেই ভাই। একটা জরুরি কল আসায়…’ শওগত ভাই বললেন, ‘চলো, কোথাও বসি গে।’ শ্যামলী স্কয়ারের টপ ফ্লোরে গিয়ে একটা মেক্সিকান খাবারের দোকানে বসি আমরা। ‘তারপর কী অবস্থা বলো? সংসার কি জোড়া লাগবে না আর?’ একটু অবাক হওয়ার ভান করলাম আমার ব্যাপারে শওগত ভাইয়ের কম জানাশোনায়, ‘ফিরলাম তো সংসারে। জানেন না?’
‘না তো! কবে? কোথাও তো দেখলাম না।’
‘কোথায় আর দেখবেন? তেমন কাউকে জানানো হয় নাই। দুই মাস তো হয়ে গেল।’
শওগত ভাইকে মনে হলো, ভালোই শকড হলেন। ‘দেখো কাণ্ড, এদিকে আমি তো জানিই না। উল্টা…’
‘উল্টা কী?’ আমি না জানার ভান করে জানতে চাইলাম তাঁর কাছ থেকে।
‘আর বইল না। আমার আসলে তোমার সাথে যোগাযোগ রাখা দরকার ছিল।’ আমি শওগত ভাইকে আর বিব্রত করতে চাইলাম না। কাঁধে হাত রেখে বললাম, ‘ব্যাপার না ভাই। সূর্যমুখী আমাকে বলছিল, আপনি ওকে নক করছেন।’
খানিকটা সেইফ জোন পেয়ে শওগত ভাই বললেন, ‘সূর্যমুখীও তো আমাকে বলতে পারত তুমি ফিরছ। ও কোনো রিপ্লাই দেয় নাই।’
অর্ডারকৃত সাবওয়ে স্যান্ডউইচ চলে এলে আমি খেতে শুরু করি। শওগত ভাই বসে থাকেন মাথা নিচু করে। খানিকটা ভর্ৎসনা করেন নিজেকে উদ্দেশ্য করেই, ‘মদ খেয়ে প্রায়ই সূর্যমুখীকে মেসেজ দিয়ে ফেলি। ও তোমাকে বলে কিনা জানি না। তবে আমার ওকে এভাবে মেসেজ পাঠানো উচিত না নিশ্চয়ই।’
আমি প্রসঙ্গ বদলের ইঙ্গিত করে সাবওয়ে স্যান্ডউইচ খেতে বলি তাকে, ‘খাচ্ছেন না কেন। এটা সূর্যমুখীর খুব প্রিয়।’ শওগত ভাই মাথা তুলে তাকান। তারপর খেতে শুরু করেন।
আমার ঠিক আগে আগেই শওগত ভাইয়ের সাথে সূর্যমুখীর প্রেম ছিল। কোনো এক কোরবানি ঈদে রামপুরায় শওগত ভাইদের বাড়িতে গিয়েছিল সূর্যমুখী। যে রুমে শওগত ভাইয়ের জন্ম, শওগত ভাই বরাবর সেই রুমেই থাকেন। সূর্যমুখীও গিয়েছিল সেই রুমে। সেখানে শওগত ভাইয়ের মায়ের সঙ্গে সূর্যমুখীর পরিচয় হয়—এসব অবশ্য সূর্যমুখীই আমাকে বলেছিল। সংসার ছাড়ার পর যখন সূর্যমুখীর সঙ্গে আমার আজ ডিভোর্স হয় কি কাল ডিভোর্স হয় অবস্থা, তখন একদিন পিকক বারে একই টেবিলে শওগত ভাই ও আমার দেখা হয়ে যায়। বিয়ের আগে থেকেই ছবির হাটে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে যেসব আড্ডা হতো, সেসব আড্ডার কমন মুখ হিসেবে শওগত ভাইকে চিনতাম। সূর্যমুখীর সঙ্গে সম্পর্কের পর ওর সাবেক প্রেমিক পরিচয়ে শওগত ভাইকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে হয়েছিল। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ এবং যে যার মতো মদ্যপান করতে থাকার একপর্যায়ে নীরবতা ভাঙলেন শওগত ভাই, ‘কী খবর তোমাদের? সংসার কেমন চলছে?’
ততক্ষণে দুজনেরই মোটামুটি নেশা হয়েছে। শওগত ভাই আমাকে জানালেন, আমার ও সূর্যমুখীর বিয়েতে তিনি খুশি। আমাদের বাচ্চা হওয়ার পর সূর্যমুখীকে ফোন করে সে কথা জানাতেও নাকি ভোলেননি। ‘বিশেষত সূর্যমুখীকে আমি বলেছি, যে পিতা তার সন্তানের এত সুন্দর নাম রাখতে পারে, তাকে বিয়ে করে তুমি কোনো ভুল করো নাই।’ শওগত ভাই হা-হুতাশ করেন, ‘এত ভালো নাম আমি রাখতে পারতাম না।’
কিন্তু তত দিনে উত্তরা ছেড়ে শ্যামলীতে আমি আলাদা বাসা নিয়েছি৷ যেকোনো দিন আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে। নেশার ঘোরে এসব তথ্য শওগত ভাইকে প্রদানের পর তারপর তাঁকে বলেছিলাম, ‘আপনি সূর্যমুখীর সাথে আবার প্রেম করার চেষ্টা করেন।’ মূলত সেই প্রশ্রয়ে এই দফায় শওগত ভাইয়ের পুনরাগমন।
সাবওয়ে স্যান্ডউইচ খেয়ে শওগত ভাই মোবাইল স্ক্রিনে সময় দেখেন একবার। তারপর বিল মিটিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়তে চান, ‘চলো, নামি। তো সংসারে ফিরলে তুমি শ্যামলীতে কী করো?’ চলন্ত সিঁড়িতে দাঁড়িয়েছি ততক্ষণে, বেসামাল হয়ে পড়েই যাচ্ছিল শওগত ভাই, আমি ধরলাম। ‘বাসাটা এখনো ছাড়া হয়নি। মাঝেমধ্যে এসে থাকি’, বললাম তাঁকে। ধাতস্থ হতে হতে শওগত ভাই আমাকে মনে করিয়ে দিলেন, ‘তুমি সেদিন পুরাই আউট হয়ে গেলা। বমি-টমি করে যা-তা অবস্থা।’ যেন নিজের বেসামাল হয়ে পড়ে যেতে থাকার বিপরীতে আমারও তেমন কোনো বেসামাল পরিস্থিতির বর্ণনা। ‘তোমার মনে আছে, আমি ধরে রাখলাম, তুমি বমি করলা?’ আমি কৃতজ্ঞচিত্তে জানালাম, ‘হ্যাঁ, মনে আছে।’ বাড়িয়ে তুললাম এই বলে, ‘সেদিন আপনি না থাকলে আমি হয়তো রাস্তাঘাটে পড়ে মরে যেতাম।’ শ্যামলী স্কয়ার থেকে নেমে পানদোকানের সামনে দাঁড়ান শওগত ভাই, ‘বেনসন না মালবোরো?’ আমি প্যাকেটভর্তি হলিউড দেখিয়ে বললাম, ‘আছে।’
বিদায় নেওয়ার মুহূর্তে দীপ্তির ফোন আসায় শওগত ভাইয়ের হাত ছাড়তে গিয়েও ছাড়লাম না। করমর্দনরত অবস্থায় জেনে নেওয়া দরকার দীপ্তির কাছে এক্ষুনি ছুটে যাওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে কি না। রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে দীপ্তির ড্রাংক ভয়েস শুনতে পেলাম, ‘হ্যালো সিনবাদ, আপনি কই আছেন, কই আছেন আপনি? হ্যালো সিনবাদ…’‘আমি শ্যামলীতে আছি দীপ্তি’, উৎকণ্ঠিত গলায় বলি, ‘কোনো সমস্যা?’ জবাবে, ‘অনেক সমস্যা অ-নে-ক সমস্যা’ বলে মেকি কান্না জুড়ে দেয় দীপ্তি।
‘আপনি কেন শ্যামলী? কেন আপনি শাহবাগে নাই সিনবাদ! আমি প্রচ্চুর ড্রাংক হয়ে গেছি, আমাকে একটু এসে বাসায় পৌঁছে দেন না, প্লিজ?’
একবাক্যে ‘নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই’ দুবার বলে আমি রাজি হয়ে যাই। ‘এখন কোথায় আছেন?’ জানতে চাই। বলি, ‘আমার আসতে পনেরো-বিশ মিনিট লাগবে। ততক্ষণ থাকতে পারবেন তো?’
পারলে আরও তাড়াতাড়ি পৌঁছে যেতে বলে দীপ্তি ফোন ছাড়লে আমি দীর্ঘ করমর্দনটা আকস্মিকভাবে শেষ করি। শওগত ভাই প্রশ্নবোধক চাহনি দিতে আমি বিপদে পড়া কণ্ঠে তাঁকে বললাম, ‘ভাই, দীপ্তিকে পৌঁছে দিতে হবে। ও বেশি খেয়ে ফেলছে।’ শওগত ভাই বললেন, ‘কোথায় যাবা, ড্রপ করে দিই? গাড়ি আছে…’ থামিয়ে দিয়ে আমি বললাম, ‘গাড়িতে দেরি হয়ে যাবে, বাইকে যাব। আপনি আমাকে কিছু টাকা ধার দেন।’
পনেরো মিনিটের মধ্যে ঢাকা ক্লাবের সামনে গিয়ে দীপ্তিকে ফোন দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে একজন ওকে ধরাধরি করে নিয়ে এসে আমার হাতে তুলে দিল। ‘গাড়ি ডাকেন নাই?’ পড়ে যেতে থাকায় ধরে রাখা আমাকে জিজ্ঞেস করে দীপ্তি। ‘হ্যাঁ, আসতেছে, বাংলামোটর থেকে৷’ খেপে যায় দীপ্তি, ‘কী করেন বা…, গাড়ি সাথে নিয়ে আসবেন না? জানেন না আমি বেশি মদ খাইছি!’ পড়েই যায় প্রায়, শক্ত করে ধরতে গিয়েও ধরব কি ধরব না দ্বিধায় পড়ি আমি। ‘আরে, ধরেন না! ধরলেই তো আর সব হয়ে যায় না।’
গাড়ি চলে আসে। নিবিড় করে ধরতে গেলে এবার, দীপ্তি দাবি করে, ‘আমি ঠিক আছি।’ হেলেদুলে একাই হেঁটে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। অন্য পাশের দরজা খুলে আমি ঢুকতেই হেসে ওঠে দীপ্তি, ‘কী পাইছেন, হ্যাঁ?’
‘এত দেরি করলেন, গাড়ি ছাড়াই চলে আসলেন, ধরলেনও না পড়ে গেলাম। কী লাভ হলো আইসা?’ বলেই হাসতে হাসতে প্রায় গড়াগড়ি খেল নিজের সঙ্গে৷ তারপর আবার ‘সরি সরি সরি, আপনি না আসলে কী যে হতো! থ্যাংকস সিনবাদ’, বলে চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে থাকল। আমাকে অপেক্ষাকৃত চুপচাপ মনে হওয়ায় জানতে চাইল, ‘কী হইছে?’
‘কিছু না তো, ঠিক আছি৷’
‘না, ঠিক নাই। নিকিতার সাথে আবার ঝগড়া হইছে?’
‘ওর সাথে তো আর কথা হয় না। দু-তিন সপ্তাহ ধরে। বলছিলাম তো আপনাকে।’
জবাবে দীপ্তি ড্রাইভারকে এসিটা বাড়িতে দিতে বলে। ‘ও আচ্ছা, আসলেই কথা হয় না তাহলে।’ স্বগতোক্তির মতো বলে। ‘কেন? বউয়ের নিষেধ?’
‘একদমই না। সূর্যমুখী বরং প্রেম না ভাঙতেই বলছিল। কথা বলি না ওর নিজের দোষে। ভাবতে পারেন, সূর্যমুখীকে ও মেসেজ পাঠায়। আমার সাথে ঘনিষ্ঠতার প্রমাণাদি সরবরাহ করে।’
‘বলেন কী! এ জন্য কথা বলেন না? প্রেমও উবে গেল?’
‘প্রেম তো আসলে আগেই উবে গেছে। সংসারে ফেরার আগেই। যখন থেকে খবরদারি শুরু করল। একক মালিকানার প্রশ্নে সব প্রেমই বোধ করি নষ্ট হয়ে যায় আমার।’
মুখভঙ্গিতে আয়ত্তের বাইরের সমস্যা হিসেবে একে চিহ্নিত করল দীপ্তি। আগেও কখনো ওকে এমন উড়নচণ্ডী দশার প্রতি তেমন কোনো সহানুভূতি প্রদর্শন করতে দেখিনি৷ একবার বলেছিল, নিজের প্রেমিককে আমার মতো এ রকম ঢিলেঢালা চরিত্রের লোক হিসেবে কখনোই প্রত্যাশা করে না। ‘তার মানে, আমার সাথে আপনার প্রেমের সম্ভাবনা জিরো?’ মজা করেই সিরিয়াসলি জানতে চেয়েছিলাম।
‘অবশ্যই। তা ছাড়া বিবাহিত লোকের সাথে প্রেম করব, আমার অবস্থা কি এতই খারাপ নাকি?’ বলেই তড়িঘড়ি করে জানালার গ্লাস তুলে দিয়ে চলন্ত গাড়িতেই বমি করতে থাকল। আমি উঠে দীপ্তিকে শক্ত করে ধরে রাখলাম, ড্রাইভারকে গাড়ি সাইড করে পানির বোতল নিয়ে সামনে আসতে বললাম। দীপ্তিকে একটানা উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিলাম, ‘করুন করুন, যতক্ষণ আসে করুন। বমি করে ফেললে ভালো লাগবে।’
সিটে বসে আমাকে থ্যাংকস জানাল দীপ্তি। আমি ওয়েলকাম করে জানতে চাইলাম, ‘এখন কি একটু ভালো লাগে?’
‘হ। অনেক ভালো লাগতাছে সিনবাদ!’ বলেই আমাকে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিল বলে প্রাথমিকভাবে আমার মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে সেটা ছিল ওর, ড্রাইভারকে বলার চেষ্টা, ‘গান চালিয়ে দেন তো ভাই।’
‘এত ভালো লাগতেছে যে এখন আমার নাচতে ইচ্ছা করতেছে।’ আমার দিকে তাকিয়ে ব্যাখ্যা করল দীপ্তি। তারপর একটা নতুন না শোনা হিন্দি গান বাজতে শুরু করলে সুরটা বুঝে ওঠার আগ পর্যন্ত নাচের উদ্যত ভঙ্গিসহ নিজেকে ফ্রিজ করে রাখল। ফ্রিজ অবস্থায় দীপ্তি আমার দিকে একবার ফলস লুক দিয়ে ফেলল প্রথমে। তারপর তাল ধরতে পেরে একটু একটু ভুল করে ফেলে ফেলে শুধরে শুধরে নেওয়া চালে নাচতে শুরু করল বসে বসে।