কুসুমঘোরে

হুড়মুড় করেই বিরানমাটি ভাসিয়ে জল এলো। এই মাঝদুপুরে কালো মেঘের শামিয়ানার ছাদ এমন ফুটো হয়ে যাওয়ার কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু মেঘ ঘন করে এলে যেমন ঝরে যাওয়া ঠেকানো যায় না, তেমন করেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে দু’চোখ উপচে আসা জল ভাসিয়ে নিল আনন্দের দুপুরবেলাটি। ইদানীং এমন হুটহাটই তার মনে আকাশজোড়া মেঘ জমে ঘন হয়ে। মধ্যবয়সের বিষণ্ণতা হঠাৎ আক্রমণ করে- যেমন করে হার্ট অ্যাটাক হয়। পলকেই কী এক বেঘোর ঘোরে নিয়ে যায় কোনো প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়েই। অসহায় হুতাশে ভেসে যাওয়াটাই তখন অনিবার্য নিয়তি। আজও তাই অসময়ে তেড়ে আসা জলের জোয়ারে নিজেকে ছেড়ে দিল মেয়েটি। বাড়িতে বিয়ে লেগেছে। ছোট ভাইয়ের বিয়ে। সে আনন্দ জমে গেছে সাড়ে তিনশ’ মাইলজুড়ে। শেষ সময়ের কেনাকাটার আনন্দে একটু একটু পালক গজাতে শুরু করেছিল তার পাখির গায়ে। ঠিক সেই সময় এপিলেপ্সি রোগের মতো কামড় দিয়ে বসে বুকভরা হাহাকার। কী হলো তার! কী হয় তার! ‘বধূ শুয়ে ছিল, পাশে শিশুটিও ছিল; প্রেম ছিল, আশা ছিল, জ্যোৎস্নায় তবু সে দেখল কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?’

আহা! যদি মেয়েটি জানত! জানেননি জীবনানন্দ। জানে না মেয়েটিও। শুধু জানে, তাকে লুকাতে হবে এখনই। তার একটু আড়াল চাই। সে আড়ালে চলে গেল। জুয়েলারি শপের রাশি রাশি স্বর্ণের গয়নার সামনে হিসাব-নিকাশের হট্টগোল, দরদাম সব ছাপিয়ে মহাকাল কেটে যায় তার। কতকাল কেটে গেলে মেয়েটি এসে দাঁড়ায় তাদের বার্মা কাঠের দোতলা বাড়ির ঝুল বারান্দায়!! ওই তো দাদা নিচের উঠোনে। হাতের ওজিফাটা একই রকম। মালদাই আমগাছের ছায়ায় এক টানে কোরাসের মতো পড়ে যাওয়া ‘ফাবিয়ায়ি আলাইয়ি রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান … তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন কোন অবদানকে অস্বীকার করিবে?’ একটানা বেশিক্ষণ কোরআন পড়তে পারেন না দাদা। দমে দমে খেয়াল রাখতে হয়, উঠোন মাড়িয়ে কে এলো কে গেল।

তর্জনীতে থুথু লাগিয়ে ওজিফার পাতা ওল্টানোর সময়টুকু গালিগালাজের। ‘ওড়া! ফরি ফরি ঘুম যদ্দে নে! মনোস অর ডইক্কা গরি এন গরি ঘুম যদ্দে, আছে দে কি তত্তুন দুয়া মাইয়াফুয়া বাদে!!’ কোরআনের সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভেসে যাওয়া সোনা-রোদ্দুরের আড়ালে আব্বার নতমুখ। ওই তো আব্বা। পরপর দুটো কন্যার ভারে নত হতে হতে, অবহেলা আর তাচ্ছিল্যে ভেসে যেতে যেতেও দুই কন্যাকে দুই হাতে ধরে প্রভাতফেরিতে যাওয়া আব্বা! কী সুন্দর সেই পুরুষ! দীর্ঘদেহী, শ্যামবর্ণ, টানটান সিনা, ভরাট কণ্ঠে গমগম করে যখন পড়ে- ‘আমি জগৎ প্লাবিয়া বেড়াবো গাহিয়া আকুল পাগল পারা …’ মেয়েটি ঘোরলাগা চোখে দেখে তার বিশাল আব্বাকে। ওই তো রানী স্টুডিও! প্রতি ঈদেই আব্বা দুই মেয়েকে দু’পাশে নিয়ে একটি সাদা-কালো ছবি তুলতেন! মেয়েটি তার আব্বাকে ছেড়ে আসতে পারে না, তার ঘোর কেটে। আব্বা তাকে কালো মানিক ডাকত।

মেয়েটি কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতেই গাড়িতে টান দেয়। বাইরে ডিমের হলুদ কুসুমের মতো আবেদনময় রোদ। রোদ ভেসে যায় মেঘ হয়ে। চোখ ঢাকে রোদচশমায়। চোখ ঢাকে নাকি জল? জলই হবে বোধহয়। মেয়েটি এক হাতে স্টিয়ারিং ঘোরায় আর এক হাতে স্মৃতি ঠেকায়। সে যেতে চায় না অতীতে। কোনোভাবেই অতীতের দিকে যেতে পারে না সে। তবু ঠিক সাদা ফ্রক পরে দুই ঝুঁটি করে এই দুপুর রোদে মেঘের সাথি হতে পাশের সিটে এসে বসে পড়ে তার শৈশব। শুধুই কি সে একা আসে? না, তার সঙ্গে সঙ্গে এসে বসে তীব্র বিবমিষার এক বিকেল, ইস্রাফিল চাচা, একটি বিভীষিকার সকাল, একটি কুলগাছের ঝোপ আর শফিক দাদা।

প্রায়ই বেড়াতে আসত শফিক দাদা তাদের বাড়িতে। অবশ্য বিশাল সেই বাড়িতে প্রতিবেলায় পঞ্চাশজন মানুষের পাত পড়ে। সেখানে এসব দাদা-জ্যাঠা গ্রামসূত্রে আসতে থাকবে- এটা স্বাভাবিক। এ বাড়িতে তার কাছে এ রকম আসতে থাকা বা জুটতে থাকা আত্মীয়দের কদর নির্ভর করত আম্মার ওপর। আম্মা, জমিদারি রক্ত গায়ে নিয়ে বেশ বুঝে নিতেন কোন আত্মীয় কোন ক্লাসের। সেই অনুযায়ী সময় আর আপ্যায়ন। সেই হিসেবে কিছু একটা ভালো চাকরি করার কারণে অথবা সফেদ পোশাকের কারণে শফিক দাদা আম্মার কাছে গুরুত্ব পেতেন। আম্মার কাছে গুরুত্ব পাওয়া মানে আব্বার কাছেও গুরুত্ব পাওয়া। তো, দাদা সবসময় এসেই নিপাট ভদ্রলোকের মতো ঘোষণা দেন- ‘ওকে আমি বিয়ে করে নিয়ে যাব।’ আপাতত নিরীহ এ কথায় কেউ কোনো দোষ খুঁজে পায় না। সবাই হাসে। এসব গ্রাম্য মশকরায় হাসিই নিয়ম।

কিন্তু আট বছরের মেয়েটি কেন, কী কারণে এই নির্দোষ মশকরাকে ভয় পেয়ে লুকাত সে কথা কেউ কখনও জানতে চায়নি। সেসব কথা লেখা হয়ে আছে তার অতীতজুড়ে। শফিক দাদা এলেই মেয়েটা লুকাত। লুকাতে গিয়ে ঢুকে যেত ছাইরঙা স্টিলের বড় আলমারিটার পেছনে। দাদা ঠিকই বের করে নিয়ে আসত। এরপর যতক্ষণ দাদা থাকত ছোট্ট ওই বুকটার ধুকপুক বুঝি ওই মুনিয়া পাখির পালকের মতো হালকা হয়ে শরীর ছেড়ে বের হয়ে আসতে চায়। কেন কেউ শোনেনি সেই ধুকপুক! বুক ভরে অভিমান জমতে জমতে সে ঠিক করে নেয়, তাকে লুকাতে হবে নতুন জায়গায়। বড় দোতলা বাড়ি, বার্মা কাঠের বিশাল থাম। অসংখ্য অন্ধকার ঘর শূন্য হয়ে ভূতের বাচ্চা বিয়োয় দিন-রাত। রাত হলেই শুধু আলো জ্বলে এসব ঘরে। দিনে ঘরে আলো জ্বালানো নিষেধ কৃচ্ছ্রসাধনের সংসারে। সেসব অন্ধকার ঘর হয়ে ওঠে মেয়েটির লুকানোর জায়গা। কিন্তু ফ্রক পরা সেই মেয়েটি তখনও জানত না এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো অন্ধকারই মেয়েদের লুকিয়ে রাখতে পারে না।

এক বিকেলে সবাই খেলতে গেল। শফিক দাদাবাড়ি এসেছে বলে মেয়েটি উঠোন পেরিয়ে খেলতে যাওয়ার সাহস করেনি। দোতলায় উঠে পেছনের ঝুল বারান্দায় গাদা করে রাখা ভুসির বস্তার ওপর চুপ করে বসে ছিল শফিক দাদার চোখ এড়িয়ে। ইস্রাফিল চাচা তাকে দেখতে পেয়ে ডেকে নেয় মাঝে অন্ধকার ঘরে। ইস্রাফিল চাচা আব্বার খালাতো ভাই। বড়বাড়ির অগুনতি আশ্রিতের একজন। মাদ্রাসায় পড়ে। এখানে থাকে, খায়, ঘুমায়। মেয়েটির বয়স শুধু আট বলে, তার শরীর কোনো পুরুষের প্রবেশযোগ্য হয়নি বলে, ইস্রাফিল চাচা ব্যর্থ হয়। তারপর হাত দিয়ে তার লিকলিকে লম্ব্বা একটা অঙ্গ অন্ধকারে মন্থন করায়। এরপর পিচ্ছিল তরল মেয়েটির হাতেই ঢেলে দেয়। মেয়েটি ভয় পেয়ে আম্মা বলে ডেকে ওঠে। ইস্রাফিল চাচা জোর করে তিনটা লজেন্স গুঁজে দেয় হাতের মুঠোয়। বলে, এসব কথা কাউকে বলতে হয় না। বললে তোমার আম্মা তোমাকে খুব মারবে। আম্মার মার! ও বাবা, সে যে মুঠি মুঠি চুল উঠিয়ে নিয়ে আসা আর চিকন কঞ্চির বেতে পিঠ ফেটে রক্ত বের হয়ে আসা। তাই অন্ধকারে আশ্রয় নেওয়া মেয়েটি চুপচাপ ঝুলবারান্দার সিঁড়ি বেয়ে আলোয় নেমে আসে।

বারান্দা দিয়ে নেমেই সামনাসামনি দরমার বেড়া দেওয়া বড় পাকঘর। তারপর কলতলা। কলতলার পানি বেরিয়ে যাওয়ার মুখে বড় বড় মানকচুর ঝোপ দুটোর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে সে। এক সময় তার চোখ যায় কলতলা ছাড়িয়ে ডান পাশে। ওখানে ইট দিয়ে বানানো ধানের গোলা। তার সঙ্গে লাগানো পাকা পায়খানা। পায়খানা আর গোলাঘরের মাঝ বরাবর দেয়াল ফেটে গিয়ে বেশ বড়সড় একটা ফাঁক। সেই ফাঁক দিয়ে জ্বলজ্বল করে দুটো চোখ। দাঁড়াস সাপ। সন্ধ্যা লাগার মুখে বাচ্চা মেয়েটা হাতভর্তি পিচ্ছিল নোংরা নিয়ে সেই সাপের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেই সন্ধ্যায় সাপের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কি সে বুঝে নিয়েছি যে, জন্ম নিয়ে এই চরাচরে যে লুকিয়ে বাঁচতে চাইছে, সে জন্মটা মানুষের নয়? সে জন্ম কি শুধু নারী শরীরের? সেই কি তবে তার নারী হয়ে ওঠার শুরু? তারপর আরও কতবার, কতজন তাকে মেয়েমানুষ বানিয়েছে! নিজের চাচা, পরের চাচা, দাদা, চাল তুলতে আসা মাদ্রাসার ছোট হুজুর, চাচাদের ওস্তাদ মাদু হুজুর…।

তারও কিছুদিন পরে এক সকালে আবার এসেছিল শফিক দাদা। এসেই হাঁকডাক- ‘কই, আমার ছোট বউটা কই? আমি আজ নিয়ে যেতে এসেছি তাকে।’ কালো মেয়েটা সাদা ফ্রক পরে, দুই ঝুঁটি করে আর কোনো অন্ধকারে লুকাতে যায়নি। সে এবার আলোর কাছে লুকাতে চায়। আলোর খোঁজে মেয়েটি ছুটতে থাকে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে। যেদিকে দু’চোখ যায়, তাকে পালাতে হবে। ও পাড়ার শেষ মাথায় সাথিদের বাড়ির বেড়া ঘেঁষে বেশ ছাতার মতো প্রায় মাটি ছুঁয়ে আসে কুলগাছের ঝোপ। মেয়েটি সেই ঝোপের নিচে বসে থাকে চুপচাপ। সকালের রোদ কড়া হয়ে দুপুর হয়, দুপুরের রোদ মরে গিয়ে বিকেল হয়, বিকেলের আলো সন্ধ্যার মুখে লাগে। মেয়েটিকে কেউ খুঁজতে আসে না। সন্ধ্যা লাগলে এ পাড়ার ঘরে ‘আয় আয় আয়’ ডাক পেড়ে সবাই হাঁস-মুরগি ঘরে তোলে। মেয়েটিকে কেউ ডাকতে আসে না। সে নিজেই বের হয় এক সময়। সে জানে না, তার মাথা আর ঘাড়ে কুলের কাঁটা লেগে রক্ত বেয়ে তার সাদা ফ্রক লাল লাল ছোপ ছোপ সুন্দর ছাপা ফুল হয়ে উঠেছে। সেই লাল ছোপ ছোপের সাদা ফ্রক নিয়ে চুপচাপ ঘরে ফেরে সে। তাকে কেউ খোঁজেনি সারাদিন।

আহ্‌! কে ভাবতে চায় ওসব কথা! ওসব কথা ভাবলে তার বড় কান্না পায়। তার মনে হয়- এই যে তার শৈশব-কৈশোর, তার পুরোটা জুড়ে এত খানাখন্দ, এত মেয়ে হয়ে ওঠার ক্লান্তি আর বিবমিষা, সেসব পেরিয়ে সে এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। কত কাঁটা তো এখনও বিঁধে আছে চোরকাঁটার মতো। সেই অতীত কেন সে যাপন করতে চাইবে, যেখানে তাকে অবিমিশ্র যাপন করতে হয়েছে গ্লানিকে! সে তো কখনও পারবে না, সেসব মাড়িয়ে আর অতীতে গিয়ে কিছু ঠিক করে আসতে, যেমন করে সে নির্মাণ করেছে তার বর্তমানকে! এই বর্তমানের জন্য কত দাম চুকাতে হয়েছে সেও তো একদিন লেখা হয়ে যাবে অতীতের পাতায়। তাই অতীতকে খুব যত্ন করেই আড়ালে রাখতে চায় সে; কিন্তু পারে কই!

আম্মার প্রতি এত অভিযোগ তার! যেই দোষ করুক না কেন আম্মা তাকেই মারত। তবু আম্মাকেই তার মনে পড়ে। আম্মার গায়ে কী সুন্দর গন্ধ! আম্মার ঠাণ্ডা তুলতুলে পেট! আম্মা, ও আম্মা! ও আব্বা! এত জল কোথা থেকে আসে এই সুখ সুখ মাখা বাতাসে! বুকের ভেতর মরিচপোড়া। আম্মা সে ডাক শুনতে পায় সাড়ে তিনশ’ মাইল দূর থেকে। ‘ও মা, কাঁদিস না। আনন্দের দিনে কাঁদতে নেই। কান্না জমিয়ে রেখে দে। জীবন এ রকমই। এখানে তোর কান্নার দাম কেউ দেবে না। কান্নাকাটি না করে নিজের কাজটুকু করে যা। বাচ্চাগুলো বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে নিতে পারলে সব শূন্যতা দূর হয়ে যাবে। তোদের বুকের ভেতরে এভাবে নিতে পেরেছিলাম বলে এই জীবন আনন্দ-বেদনায় কাটাতে পেরেছি। মনে রাখিস, ভেঙে দেওয়াটা খুব সহজ। ধরে রাখাটা কঠিন। সেই কঠিন কাজটা করেছিলাম বলেই আজ তোরা নিজের আকাশে ডানা মেলে উড়তে পারছিস।’

কেন তবু কান্না পায়! আম্মা জানে না কেন তার কান্না পায় সময়ে-অসময়ে। কী যেন হারিয়েছে তার। কী খুঁজে বেড়ায় শহরের এ-মাথা ও-মাথা। কী হারিয়েছে তার? নাকের নথ? শখের গয়না? লাল কাঁচুলি? একটা ঝুড়িতে শৈশবটা রাখা ছিল তার। আরেক ঝুড়িতে লাল-হলুদ কাচের চুড়ির কৈশোর। আরেকটা ঝুড়িতে আম্মার ঠাণ্ডা পেট জড়িয়ে ধরে শুনে শুনে প্রায় মুখস্থ করে ফেলা রিক্তের বেদন আর শিউলিমালা। সব ঝুড়ি একসঙ্গে কী করে হারিয়ে গেল? কোথায় হারাল? কে নিয়ে গেল? কাকে মেয়ে খুঁজে ফেরে নিয়াশে- তিয়াশে! কার জন্য সে আকুল করে গায়,- আমার চন্দ্রভানরে একটা গান শুনাইয়ো ও সোনামুখী রাইত দ্বিপ্রহর!’

উথাল-পাতাল কান্নাকে গলায় ঝুলিয়ে মেয়েটি কাকে যেন ফোন করে একটানে বলে যায়, ‘ও সোনা, আমার যে আব্বার জন্য পেট পুড়ে … আমাকে আব্বার কাছে নিয়ে যাবা?’

‘ও বাবু, ঘন বর্ষায় শ্রীমঙ্গলের বৃষ্টিতে আকাশের নিচে ঘুমাতে চাই আমি। আমাকে নিবা?’

‘রাসমেলায় সারারাত রাধা-কৃষ্ণের কীর্তন শুনতে শুনতে গলা ছেড়ে কাঁদবা আমার সঙ্গে সোনা? যাবা শরতের মেঘে পাহাড়ের চূড়ায়? তোমাদের পাড়ায় আড়িয়ালখাঁ নদের ওপর যে ব্রিজ হয়েছে নতুন, সেই ব্রিজের ওপরে আকাশজুড়ে কেমন হলুদ ব্যথার মতো চাঁদ ওঠে। আমাকে নেবে না সেই ব্রিজে, তুমি? টাঙ্গুয়ার হাওরে পানির নিচে কাঁসর বাজিয়ে যে সুর তোলো তোমরা, আমিও সেই সুর তুলতে চাই। কেন তুমি আমাকে বাজাবা না তেমন করে? কেন তুমি আমার কাছে আসবা না?’

কই, কেউ তো কথা বলে না! কথা কেউ বলে না। সে একাই কথা বলে। সে একাই খুঁজে বেড়ায় তাকে। তার তো কথা বলার কথাও নয়। ছায়ারা কথা বলে না তো! তবে কোন মহাকালের ঘোর থেকে কে যেন বলে ওঠে- ‘তুমি কেন এমন করো সোনা?’ কে বলে? কে? সে কি জানে না, আমি কেন এমন করি? কোনো এক ক্লান্তির সন্ধ্যায় হাতিরপুল কাঁচাবাজারের ওপাশে শর্মা হাউসের হৈ-হট্টগোলে কুড়িয়ে পেয়েছিল তাকে। তার পর থেকে সে বাজিকর হয়েছে। কে সেই বাজিকর? সে কি এই চরাচরে থাকে? সে কি রাতঘোরে পুকুরের মাঝখান থেকে উঠে আসা সোনার মোহরভর্তি কলস? যে কলসের আশায় আশায় কেবল নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হওয়া?

উহ্‌! নিঃস্ব হতেও দেয় না তো! হঠাৎ বজ্রপাতের মতো সাত আসমানের ওপর থেকে নেমে আসতে থাকে প্রিয়তর অপেক্ষার সেসব শব্দবান, ‘খুব দ্রুত আমরা একটা রাত ঘুরে বেড়াতে চাই খুব অন্ধকারে ঘিরে থাকা কোনো পিচঢালা রাস্তায়। সে অন্ধকারে আমরা শিখে নেব বিষণ্ণ সুন্দরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে শেখার নাম কী দেওয়া যায়।’ সেই শব্দগুলো মারণাস্ত্র হয়ে মারে তাকে, ‘কেন যে বানের জলে ভাসতে গেলাম! এখন আমার নৌকা ডুবু ডুবু- আমি অসহায় হয়ে তলিয়ে যাচ্ছি।’ জীবনতক দোজখের আগুনে জ্বলা মেয়েটিকে বেহেস্তের লোভ দেখিয়ে বাজিকর বলে, ‘অমাবস্যা তিথিতেও আমরা চাঁদ হবো, ঠিক আছে?’

ঠিক-বেঠিক না জেনেই মেয়েটি ভাসতে থাকে। মেয়েটি কাঁদতে থাকে। আবার মেয়েটি খুঁজতে থাকে। খুঁজতে থাকে হারিয়ে যাওয়া একটি দীর্ঘ প্রেমের কবিতা। একটি ব্রিজ। একটি চাঁদ। একটি চুমু। আর একজোড়া দুলের একটি। সে রাতে অন্য দুলটি চুমুর জলে পড়ে গিয়েছিল। সে রাতে নদীর ওপারে আকাশজুড়ে হলুদ ফুল ফুটেছিল। আকাশজোড়া সেই হলুদ ফুল দেখে মেয়েটি সে রাতে নির্বোধ হয়েছিল। যতটুকু নির্বোধ হলে একটি কানের দুল হারিয়ে ফেলা যায়, ততটুকু নির্বোধ। আর দ্রুত চলমান নদীর জলে সেই দুল খুঁজতে খুঁজতে মেয়েটি ভাবে, কী নির্বোধ সে! কী নির্বোধ!! কতবড় নির্বোধ!

যেহেতু মেয়েটি জানে, এখন তার আর আশা করার কিছু নেই, তাই সেই চুমুর আলো, নদীর ধার, তার অস্থিরতা, তার স্পষ্ট আশা ও হতাশা সবই সেই নীল কাপড়ের পুঁটলিতে পুরে ভাসিয়ে দেয় নদীর জলে। যেহেতু বাজিকরের খেলায় সে হেরে গেছে, সে অপরিপকস্ফ জুয়াড়ির মতো অপেক্ষা করতে থাকে নিজের দানের। বুঝে নিল, পুরোটা শীতকাল সে দিবাস্বপ্ন দেখেই কাটিয়েছে। সমস্ত জীবনটাকেই তার মনে হতে থাকে একটা দুর্বোধ্য, অর্থহীন পরিহাস আর অপচয়ের অঙ্ক। তার কাছে যে কোনো দূত আসবে না, ভুল করে সে রাতে যে তাকে চুমু খেয়েছিল, তার সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হবে না জেনেও সে একটি কানের দুল খুব যত্নে রেখে দেয়।

শুধু ওই নদীর জল তার ভালোবাসা সমেত কেন ছুটে চলেছে, সে হিসাব সে আর করে না। এই বর্ষাতেও হয়তো এ নদীর জল এভাবেই ছুটে যাবে, এ নদী গিয়ে মিলবে কোনো এক বড় নদীর মোহনায়, তারপর সমুদ্রে। তারপর সেই জল বাষ্প হবে। সেই বাষ্প মেঘ হবে। সেই মেঘ আজকের মতো কোনো তুমুল রোদমাখা দুপুরে হু-হু করে নেমে আসবে তার চোখে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত