আমি জিজ্ঞাসা করি, ‘এটা কী?’
‘আঠা,’ মহিলা বললো, ‘বিশেষ ধরণের আঠা। অত্যন্ত শক্তিশালী।’
আমি পুনরায় জিজ্ঞাসা করি, ‘কোন কাজের জন্য কিনেছ?’
‘আমার প্রয়োজন আছে,’ মহিলা বললো, ‘আমার কাছে এমন অনেক জিনিস আছে, যেগুলো জোড়া লাগাতে হবে।’
‘এমন কিছুই নেই, যাতে জোড়া লাগাতে হবে,’ আমি কর্কশ গলায় বললাম। ‘আমি বুঝতে পারি না, কেন তুমি এসব আজেবাজে জিনিস কিনে আনো?’
‘যে কারণে তোমাকে বিয়ে করেছি, একই কারণে,’ পাল্টা জবাবে মহিলা বললো, ‘সময় কাটাতে।’
সেই মুহূর্তে ঝগড়া-ঝাটির মধ্যে যাওয়ার আমার কোনো ইচ্ছে ছিল না। তাই আমি চুপ করি এবং সে-ও চুপ করে থাকে।
‘এই আঠা কী ভালো?’ একসময় আমি জিজ্ঞাসা করি।
সে আমাকে ছবি দেখায়। অদ্ভূত আঠা দিয়ে লাগানো লোকটির ছবি সিলিং থেকে উল্টো হয়ে নিচের দিকে ঝুলে আছে। মনে হয় কেউ যেন জুতার তলিতে আঠার প্রলেপ রেখেছে।
‘এমন কোনো আঠা নেই, যা দিয়ে কাউকে এভাবে ঝুলিয়ে রাখা যায়,’ আমি বললাম, ‘ওরা ছবিটা উল্টো করে তুলেছে। লোকটি মেঝেতে দাঁড়িয়েছিল। তারা মেঝেতে এমন কোনো হালকা কিছু লাগিয়েছিল, যা দেখতে সিলিং-এর মতো দেখাচ্ছিল। জানালার দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। তারা পর্দায় বকলস্ পেছনের দিক থেকে লাগিয়েছে। একবার দেখ।’ আমি ছবির জানালার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করি। সে তাকায়নি।
‘আটটা বেজে গেছে,’ আমি বললাম, ‘আমাকে জলদি যেতে হবে।’
বলেই আমি আমার ব্রিফকেস তুলে নিই এবং তার গালে আলতো করে চুমু খাই। ‘ফিরতে আমার দেরি হবে আমি …’
‘আমি জানি,’ সে যেন আমাকে চপেটাঘাত করলো। বললো, ‘তুমি তো মৌজে আছো।’
অফিস থেকে আমি মিন্ডিকে টেলিফোন করি। ‘আজ আমি পারবো না,’ আমি বললাম, ‘আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যেতে হবে।’
‘কেন? কিছু হয়েছে?’
‘না। মানে আমি বলতে চাচ্ছি, সে একটা কিছু সন্দেহ করছে।’
তারপর আমাদের মধ্যে দীর্ঘ সময়ের নীরবতা। টেলিফোনের অন্য প্রান্তে মিন্ডির শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি।
‘তার সঙ্গে তোমার থাকার কোনো কারণ আমি বুঝতে পারছি না,’ অন্য প্রান্তে মিন্ডি ফিসফিসিয়ে বললো। ‘তোমরা কখনই একত্রে কিছু করোনি। এছাড়া তুমি কোনো কিছুর প্রতিবাদও করতে চাও না। আমি বুঝতে পারি কেন তুমি এভাবে চলো। তবে আমি বুঝতে পারি না যে, কোন শক্তি তোমাদের এক সঙ্গে রেখেছে। আমি জানি না,’ পুনরায় সে বললো, ‘কিছুতেই আমি বুঝতে পারি না …’ এবং কথাটা অসম্পূর্ণ রেখেই সে কাঁদতে শুরু করে।
‘কেঁদো না, মিন্ডি,’ আমি বললাম। তারপর মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বললাম, ‘শোন, কেউ একজন আসবে। তাই আমাকে যেতে হবে। কথা দিচ্ছি, আগামীকাল আসবো। তখন আলাপ হবে।’
আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছি। দরজা দিয়ে ঢোকার সময় আমি হ্যালো বলি, কিন্তু কোনো উত্তর নেই। আমি এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাই। সে কোনো ঘরে নেই। রান্নাঘরের টেবিলের উপর সম্পূর্ণ খালি আঠার টিউব দেখতে পেলাম। বসার জন্য আমি একটা চেয়ার তোলার চেষ্টা করি। চেয়ারটা একবিন্দুও নাড়াতে পারিনি। আমি পুনরায় চেষ্টা করি। শক্ত করে লেগে আছে। সে মেঝের সঙ্গে আঠা দিয়ে লাগিয়ে রেখেছে। ফ্রিজের দরজা খোলে না। সে আঠা দিয়ে দরজাও বন্ধ করে রেখেছে। আমি বুঝতে পারছি না, কেন সে এসব ছেলেমানুষি কাজ করে চমক দিতে চাইছে সব সময় সে সুস্থির ধরনের মানুষ। এসব কাজ করার প্রবণতা তার মধ্যে নেই। লিফোনের খোঁজে আমি বসার ঘরে প্রবেশ করি। ভাবলাম সে হয়তো মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেছে। আমি টেলিফোনের রিসিভার তুলতে পারিনি। সে আঠা দিয়ে তা-ও লাগিয়ে রেখেছে। প্রচণ্ড রাগে আমি টেলিফোনের টেবিলে জোরে লাথি দিই এবং পায়ের আঙুল প্রায় ভেঙে ফেলেছিলাম। টেবিলও একবিন্দু নড়েনি।
ঠিক সেই মুহূর্তে আমি তার হাসির শব্দ শুনতে পাই। আমার মাথার উপর থেকে শব্দ ভেসে আসে।
আমি সেদিকে তাকাই এবং সেখানে সে উল্টা হয়ে ঝুলে আছে। তার খালি পা বসার ঘরের উঁচু সিলিং-এর সঙ্গে শক্ত ভাবে লেগে আছে। আমি তার দিকে তাকাই। আমার চোখ ছানাবড়া। ‘কি ছেলেমানুষি কাণ্ড! তোমার মাথা কী খারাপ হয়েছে?’ সে কোনো উত্তর দেয়নি। তার ঠোঁটের ফাঁকে হাসি ফুটে আছে। মনে হলো হাসিটা স্বাভাবিক। তবে যেভাবে নিচের দিকে মাথা দিয়ে ঝুলে আছে, তাতে বোঝা যায় মাধ্যাকর্ষণ শক্তির জন্য ঠোঁট দু’টি ওরকম হয়ে আছে। ‘কিচ্ছু ভেবো না,’ আমি বললাম। ‘তোমাকে নিচে নামিয়ে আনবো।’
বলেই আমি বইয়ের তাক থেকে কয়েক খন্ড জ্ঞানকোষের বই এনে একের উপর আরেকটা রেখে স্তুপ করি এবং তার উপর দাঁড়াই। ‘হয়তো একটু ব্যথা পাবে,’ আমি নিজের ভার সামাল দেওয়ার সময় বললাম। তখনো সে হাসছিল। আমি আপ্রাণ জোরে টানি, কিন্তু কিছুই হয়নি। সতর্কতার সঙ্গে আমি নিচে নেমে আসি। ‘চিন্তা করো না,’ আমি বললাম, ‘পাশের বাড়িতে গিয়ে টেলিফোন করে কাউকে আসতে বলি।’
‘ঠিক আছে,’ বলেই সে হাসতে থাকে। ‘আমি কোথাও যাচ্ছি না।’
এরইমধ্যে আমিও হাসতে শুরু করি। সে খুবই সুন্দরী, কিন্তু নিচের দিকে মাথা দিয়ে উল্টা হয়ে থাকাটা ভীষণ বেমানান লাগছে। তার দীর্ঘ চুলের গোছা ঝুলছে এবং তার উরোজ যুগল দেখে মনে হচ্ছে যেন সাদা টি-সার্টের নিচে দু’ফোঁটা অশ্রু জমে আছে। অদ্ভূত সুন্দর দৃশ্য। আমি পুনরায় বইয়ে স্তুপের উপর উঠে দাঁড়াই এবং তাকে চুমু খাই। মনে হলো তার জিহ্বা যেন আমারই। হঠাৎ আমার পায়ের নিচে থেকে বই সরে যায় এবং অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে নয়, শুধু তার ঠোঁটের সঙ্গে স্পর্শ রেখে আমি শূণ্যে ঝুলতে থাকি।
লেখক পরিচিতি: পোলিশ বংশোদ্ভূত ইসরায়েলের লেখক এটগার কেরেটের জন্ম ১৯৬৭ সালের ২০ আগষ্ট। তিনি একাধারে গল্পকার, গ্রাফিক ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, কমিক লেখক এবং শিশু সাহিত্যিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভাগ্যক্রমে তাঁর পরিবার ইহুদী নিধন (হল্যাকাস্ট) কর্মকান্ডে বেঁচে যান এবং পোল্যান্ড থেকে অভিবাসী হয়ে ইসরায়েলে বসতী স্থাপন করেন। এটগার পিতা-মাতার তৃতীয় সন্তান। তার প্রথম ( ছোটগল্প সংকলন ‘পাইপলাইলস্’ প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। কিন্তু গ্রন্থটি প্রকাশের পর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি। পরবর্তীতে পঞ্চাশটি অণুগল্প নিয়ে প্রকাশিত তার দ্বিতীয় গ্রন্থ (মিসিং কিসিঞ্জার) পাঠকমহলে তুমুল সাড়া ফেলে। এই গ্রন্থের ‘সাইরেন’ গল্পটি, যা ইসরায়েলের আধুনিক সমাজের প্রচলিত মতবিরোধী বক্তব্য নিয়ে রচিত, সেই দেশের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাঠ্য হিসাবে স্থান পেয়েছে। ‘নেরাল’স্ হ্যাপি ক্যাম্পারস্’ এবং ‘গার্ল অন দ্য ফ্রিজ’ তার অন্য দু’টি ছোটগল্প সংকলন। তার একমাত্র গ্রাফিক উপন্যাস ‘পিজেরিয়া কামিকাজে’ প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। এছাড়া তিনি শিশুদের জন্য রচনা করেন ‘ড্যাড রানস্ উইথ দ্য সার্কাস’ এবং যৌথভাবে প্রকাশ করেন দু’টি কমিক বই। এটগার ইসরায়েলের চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের জন্য অসংখ্য চিত্রনাট্য রচনা করেন। তাঁর আত্মজীবনী (সেভেন গুড ইয়ারস্: অ্যা মেম্যোয়্যার) ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়। লেখালেখি এবং চিত্রনাট্যের জন্য তিনি দেশ-বিদেশের অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন। এগুলির মধ্যে ‘ইসরায়েল ফিল্ম একাডেমী’ পুরস্কার, ‘মিউনিখ ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভেল অব ফিল্ম স্কুলস’-এর প্রথম পুরস্কার এবং ‘নস্টাড ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ’ অন্যতম। এছাড়া ‘জেলিফিশ’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি স্ত্রীর সঙ্গে যৌথ ভাবে ২০০৭ সালে পেয়েছেন কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘ক্যামেরা ডি’অর’ পুরস্কার। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বেন-গুরিয়ান ইউনিভার্সিটি অব দ্য নেজেভ এবং তেল আবিব ইউনিভার্সিটির প্রভাষক। বর্তমানে তিনি সপরিবারে তেল আবিবে বসবাস করেন।
গল্পসূত্র: ‘পাগলা আঠা’ গল্পটি এটগার কেরেটের ইংরেজিতে ‘ক্রেজি গ্লু’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি লেখকের ‘গার্ল অন দ্য ফ্রিজ’ গ্রন্থে অন্তর্ভূক্ত এবং সেখান থেকে নেওয়া হয়েছে।