নিয়ত নির্জন ডাকে

চোখা পাথুরে সাগর পাড়। গভীর তার রঙ। থেকে থেকে জলের সশব্দ আলিঙ্গনে পাথুরে পাড়ের শরীর ঝিক ঝিক করে ওঠে পড়ন্ত বিকেলের আলোয়। সাগরের এদিকটা বেশ নির্জন।

বিচের পাথুরে স্বভাবের জন্য লোকজনের যাতায়ত নেই বললেই চলে। তবে হ্যাঁ নির্জন বিলাসীদের জন্য এর চেয়ে উত্তম জায়গা গোটা ইতালিতে নেই।

যথেচ্চার সবুজ আর অকল্পনিয় প্রাকৃতিক রূপ লাবণ্যের জন্য এই বীচে প্রায় কুড়ি পঁচিশ বছর আগে ক্রিমিনাল লয়ার মিঃ আন্ড্রেয়া মরগান বাংলোটি তৈরি করেন। কিন্তু বেশিদিন তিনি বাংলোটিতে থাকেননি। কাজের সূত্রে নানা জায়গায় ছোটাছুটি তাঁর। এসবই ইকবাল ওর এজেন্ট এর কাছ থেকে জেনেছে। ফাহিম ইকবাল একজন আর্কিওলজিস্ট। বছরে নির্দিষ্ট একটি সময়ে কুড়ি দিন ছুটি কাটান। একান্ত নির্জনে। সমস্ত যোগাযোগের বাহিরে থাকেন এই কুড়িটি দিন। সারাদিন রাত হেলানো চেয়ারে আধশোয়া হয়ে সমুদ্র অভিমূখে চেয়ে থাকেন। আর মাঝে মাঝে হাতে কলম তুলে লিখে চলেন যা মনে আসে।

সুবর্ণা চলে যাওয়ার আজ পনেরো বছর পূর্ণ হলো। সাথে সাথে আমাদের সন্তানের বয়সও পনেরো হলো আজ। সামান্য আয়ের সংসারে সুখের কোন কমতি ছিলনা আমাদের। সন্তানের আগমনের প্রহর গুনছিলাম আমরা। আমার পিএইডি’র প্রিপারেশনও চলছিল সেই সাথে। সারারাত পড়ার টেবিলে মুখ গুঁজে থাকতাম। সকাল হতেই সুবর্ণার লাবন্য ভরা মুখ ডেকে তুলতো আমাকে। ওর ফুলে ওঠা পায়ের দিকে তাঁকিয়ে অফিস যেতে চাইতাম না। তবু ঠেলে পাঠাতো ও।

– সুবর্ণা তোমরা ভালো আছো?
– কী নাম দিয়েছ আমাদের সন্তানের?
– কী নাম?

মার্লিন কে রোজ চুমু খেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম। ওর সোনালি চুলের গোছা যেদিন ওরা খুঁজে পায় বিশ্বাস করতে পারেনি কেউ দশ মাসের বাচ্চা ছিল ওর পেটে। আর সেই পেটে দশ দশ মাস চুমুর পর চুমু খেয়ে গেছি আমি। মার্লিনের বানানো কফি খেয়ে আমি ভাবতাম আমাদের সন্তানের চোখ মার্লিনের মত সবুজ হবে। মার্লিন উলের বল গোছাতে গোছাতে বলতো,

– না তোমার মত কালো।

মার্লিনের সাথে লাইব্রেরিতে আলাপ হয়। সেদিন ছিল লন্ডনের বৃষ্টির একটি সন্ধ্যে। লাইব্রেরি থেকে বের হতেই বৃষ্টি। মার্লিনই ছাতা মেলে কফিশপ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিল আমাকে। এরপর আমাদের প্রতিদিনই দেখা হতো। কফি খাওয়া হতো, বই পড়া হতো। গির্জার ঘন্টার মতো মার্লিনের আগমন ছিল আমার শুনসান জীবনের ইবাদত। আমার আনন্দ, আমার উৎসব, আমার উল্লাস। ঘুমের ভেতর বিড়বিড় করে ডাকতাম – মার্লিন, মার্লিন, মার্লিন। ঘন সবুজ বনভূমির মত ওর চোখ ছিল নিবিড়। ওর হৃদয় সমুদ্রের চেয়েও গভীর। পিচফলের আমুদে সুবাস ছিল মার্লিনের ঘনিষ্ট আলিঙ্গনে। আমার সমস্ত কাজ কর্ম লাটে যেতে বসল দিন দিন। মার্লিন আর আমি লন্ডনের প্রতিটি শহর ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। তারপর একদিন অন্ধকারের সবটুকু নিয়ে তলিয়ে গেল মার্লিন – আমার উন্মাদ প্রেম, আশ্রয়, অস্তিত্ব। ডাইরির পাতা ভরা এইসব লেখা কেবল স্মৃতির ক্ষয়ে আসা আবেগ নয়, ফাহিম ইকবালের অবসর কাটানোর প্রধান উপজিব্য।

আজ হঠাৎই সমুদ্রের মেজাজ খারাপ। ইকবাল দরজা জানালা বন্ধ করে চুপচাপ আবার টেনে নিল ডাইরি। এইরকম বিগড়ে যাওয়া আবহাওয়া মোটেও পছন্দ নয় ওর। বারবার জীবনে ওর এইরকম বিনা সংকেতে ঝড় এসেছে, তুফানে ভেঙ্গে গেছে শান্ত নীড়। ইকবালের কিছু করার ছিল না তখন। একা আক্রোশে দিনের পর দিন নিজের সাথে সমঝোতা করে গেছে। কিন্তু ও হেরে গেছে। যখন প্রমোশন পাবার কথা ওর, পেয়েছে অন্যজন। যখন বাবা হবার কথা, তখন হয়ে গেছে নির্জন নিঃস্ব। আর যখন অনেক টাকা তখন সেটা খরচ করার মত অবস্থায় ছিল না ও। বিকারগ্রস্থ অসহায় মৃতপ্রায় অস্তিত্ব যখন তখন আলাপ হয় সিসিলিয়ার সাথে। যে কিনা ওর ল’ইয়ার হয়ে কাজ করছিল। হ্যাঁ প্রথমেই মার্লিনের খুনি হিসেবে ওকে ধরে নিলেও সিসিলি শেষ পর্যন্ত ওকে জিতিয়ে দেয়।

সিসিলিয়া বিশ্বাস করেছিল ওকে। অদ্ভুত এক ব্যাপার সিসিলিয়া ফাহিম’কে যখন মার্লিনের খুনির নাম বলে সমস্ত পৃথিবীটা আবার রোদ ঝলমলে হয়ে উঠেছিল। আবার আলোর স্রোতে ফাহিমের জীবন ভেসে গিয়েছিল। মার্লিন, সুবর্ণা দু’জনেই ফাহিমের জীবনে হলুদ অতীত। একজন জীবন্ত, অন্যজন মৃত। সিসিলিয়াকে শেষ অবধি বিয়ে করেনি ও। দু’জনের আর দেখাও হয়নি কোনদিন।

– জীবনের কাছে পরম পাওয়া কি?
– আয়ু নাকি সুখ?
– প্রেম নাকি খলবলে সংসার?
সবার হয় না। একসাথে সব সবাই কি পায়?

ফাহিমের কাছে জীবন এক নিঃসঙ্গ বরফঠাসা রাতের মতন। একাই উত্তাপে নিজের হাত নিজে জড়িয়ে থাকা। এক নিরব গানের মত ওর জীবন। বোবা পাখির মত। মরা সূর্যের মত। ফাহিম একবাল দরজা খুলে সমুদ্রের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। পায়ের নিচে চোখা ঠান্ডা পাথর। সমুখে আগ্রাসি অতল জলরাশি। তবু তারা কি প্রাণবন্ত, শব্দময়, তুমুল বেগময়। ফাহিমের সমস্ত স্বত্বা জুড়ে আনন্দ খেলে যায়। এই নির্জন এই প্রচণ্ড ঢেউয়ের কোলাহলে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে মন চায় ওর।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত