সেদিন অফিসে রায়হান ভাইকে দেখলাম খুব ঘনঘন চা খাচ্ছে।আমি বললাম,
–ভাই আপনার কি হইসে?? আপনি তো চা পছন্দ করেন না।এতো ঘনঘন চা খাচ্ছেন যে!!
— আর বইলেন না মাসুম ভাই।গতকাল আমাদের এ্যানিভার্সারী ছিলো।আমি আপনার ভাবীকে উইশ করেছি শুধু বাট সে যে একটা ডায়মন্ড এর পেন্ডেন্ট পছন্দ করেছে সেটা কিনে দিতে পারি নি তাই গতরাতে বাসায় ঢুকতে দেয় নি।
সারারাত বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম। সকালে ঢুকতে দিয়েছে।কোনরকমে ফ্রেশ হয়ে অফিসে আসলাম।এখন ঘুমে দু-চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।তাই ঘনঘন চা খাচ্ছি।
–কি ডেঞ্জারাস!! এই মাসের ১৮ তারিখ তো আমারও বিবাহবার্ষিকী।
— কি বলেন!! তাহলে তো খবর আছে!!
আগে থেকে জেনে নিয়ে সব ঠিক করে নিবেন না হলে আমার মত সারারাত বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। স্বাভাবিক ভাবেই এই দিনটা নিয়ে স্বামী – স্ত্রী দুজনের ই অনেক পরিকল্পনা থাকে।কিন্তু আমার বউ খুবই লাজুক এবং লক্ষীমন্ত বউ।আমি জানি ও মুখ ফুটে কিছুই বলবে না।তাই সপ্তাহখানিক আগে আমিই ওর কাছে জানতে চাইলাম….
–আরশি,,আগামী ১৮তারিখ তো আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। তুমি কি চাও বলো??
–আমার কিছুই লাগবে না।সবই তো আছে।
—তারপরও বলো।আমি তোমাকে কিছু একটা দিবই।তো আমি চাই সেটা যেন তোমার মনের মত হয়।এজন্য জানতে চাচ্ছি। আরশি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললো,,
– একটা ড্রেসিংটেবিল চাই। এটা বলেই ও আলমারী থেকে ছোট্ট একটা পার্স বের করে ওখান থেকে কিছু টাকা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,,
— এখানে ৫০০০/ টাকা আছে।এটা আমি ড্রেসিংটেবিল কেনার জন্য জমাচ্ছিলাম।বাজার করা টাকা থেকে বেচে যাওয়া টাকা এগুলো।তুমি এর উপরে আর কিছু দিয়ে একটা ড্রেসিংটেবিল কিনে দাও। আমি থতমত খেয়ে তাকিয়ে থাকলাম!!! কারো বউ এর ডায়মন্ড লাগে!! কারো লাগে আয়না!!
— হ্যা আমি স্বীকার করছি আমাদের সংসারে একটা ড্রেসিংটেবিল খুব দরকার কিন্ত সেটা বিবাহবার্ষিকীর গিফট হিসেবে!! আমি ফিরে গেলাম একবছর আগে।সদ্য বিয়ে করা কাপলরা সাধারণত হানিমুনে যায়।তো সম্পুর্ন নিজের খরচে বিয়ে করে,,, দেনমোহর শোধ করে আমার কাছে আছে আর মাত্র বিশ হাজার টাকা ছিলো।বউ নিয়ে ঢাকায় আসলাম। এখানে আগে মেসে থাকতাম তো সেখানের কিছু জিনিস নিয়ে একটা বাসা আগেই দেখে রেখেছিলাম সেই বাসায় উঠে পড়লাম। নিতান্ত না হলে নয় এমন কিছু জিনিস যেমন– একটা হাড়ি,,একটা কড়াই,, দুটো প্লেট -গ্লাস কিনে সাথে অল্পকিছু বাজার এনে দুটা ভাত রান্না করে খেয়ে মেসের সেই সিংগেল তোশক ফ্লোরে বিছিয়ে শুয়ে আরশি কে বললাম,,,
— আরশি,,আমি বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে।তাই তাদের সব দায়িত্ব আমাকে বহন করতে হয়।প্রতি মাসে বেতনের একটা অংশ আব্বা কে পাঠাতে হয়।সবকিছু মেইনটেইন করে বিয়ের জন্য কিছু টাকা জমিয়েছিলাম।বিয়ে শেষে এখন মাত্র ২০০০০টাক আছে।তুমি চাইলে এই টাকা দিয়ে হানিমুনে যেতে পারো আবার চাইলে তোমার সংসারের কিছু জিনিসও কিনতে পারো।সম্পুর্নটাই তোমার উপর ডিপেন্ডে করছে। ওকে এরকম প্রস্তাব দিয়ে আমি আসলে বুঝতে চাইছিলাম,, আমি এতদিন বাবা-মা কে যেভাবে সাপোর্ট দিয়ে আসছিলাম সেটা পারবো কি না!! কারন অনেক মেয়েই তো শুনি এগুলো করতে দেয় না। আরশি বললো,,
–আলহামদুলিল্লাহ। আমি খুব খুশি যে তুমি তোমার দায়িত্ব -কর্তব্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ।মায়ের পায়ের নিচে সন্ত্বানের বেহেশত।তুমি বাবা-মা কে যেমন ইচ্ছা দিতে পারো।এখানে আমার বলার কিছু নেই।
–আর শোন,,,এই বিশ হাজার টাকা দিয়ে এবং আমার দেনমোহর এর টাকা দিয়ে আপাতত একটা খাট আর একটা আলমারি এবং আরো কিছু ছোট-খাটো জিনিস কিনবো। আমার বুক থেকে একটা পাথর সরে গেলো।এরপর থেকে আরো বিভিন্ন ঘটনায় আমি বুঝে গেছি আমার বউ খুবই সংসারী। আমি যখন ফ্লাশব্যাকে তখন ওর কথায় আবার বর্তমানে ফিরে এলাম।আরশি বললো,,,
— হতে পারে সবার কাছে এটা একটা আয়না বা সামান্য একটা আসবাবপত্র মাত্র। কিন্তু আমার কাছে এটা অন্যরকম কিছু। সেই ছোটবেলায় মা কে হারিয়েছি।বাবা আমার জন্য আর বিয়ে করেন নি।বাসায় সবই ছিলো। ছিলো না শুধু একটা ড্রেসিংটেবিল।একটা ছোট আয়না ছিলো যেটা বারান্দায় পিলারের সাথে ঠেস দিয়ে বাবা দাঁড়ি শেভ করতো।বাবাকে একদিন বড় আয়নার কথা বলেছিলাম। তো বাবা সেই ছোট আয়নার বড় বোনটাকে কিনে এনে দিয়েছিলো!!
অথচ আমার খুব ইচ্ছে হতো ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে আমার চুলগুলো আঁচড়াতে,, কপালের টিপটা বা শাড়ীর কুচিগুলো ঠিকঠাক আছে কি না সেটা দেখতে।বাট বাবা সেটা বুঝে নাই আর মা ছিলো বা বলে কেউ তাকে বুঝিয়ে দেয় নাই। এরপর বিয়ে হলো।ভেবেছিলাম বরের বাড়ীতে গিয়ে শখটা পূরণ করবো।আর তাই আমার গিফট হিসেবে ড্রেসিংটেবিল চাই। আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী। গতকালই আমি আর আরশি মিলে বেশ কয়েকটা দোকান ঘুরে হাতিল থেকে একটা ড্রেসিংটেবিল পছন্দ করে এসেছিলাম।আজ ওরা সেটা ডেলিভারি দিয়ে গিয়েছে। ওরা যখন ফার্নিচারটা নামাচ্ছিলো,, সেট করছিলো তখন পুরোটা সময় আরশি ওদেরকে তদারকি করছিলো।
— ভাই একটু আস্তে ধরেন,,,সাবধানে রাখেন।এসব বলছিলো।ভাবখানা এমন যে এটা কোন ফার্নিচার নয় যেন তার সন্তান!! আসলে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর গৃহবধুদের কাছে আসবাবপত্র বিলাসিতা নয় প্রয়োজন।আর তারা এগুলো খুব আস্তে-ধীরে টাকা জমিয়ে অন্যকোন শখ কে গলাটিপে তারপর বানায়। এজন্য দরদটাও সন্তানের মতই হয়।
ড্রেসিংটেবিল সেট করা শেষে আমার বউ নিজেকে ঘুরিয়ে – ফিরিয়ে তাতে দেখছে।একবার চুল বাঁধছে তো আরেকবার খুলে আবার আঁচড়াচ্ছে। আমি মুগ্ধ নয়নে তার পাগলামি দেখছি।
গল্পের বিষয়:
গল্প