ধোঁয়ার অন্তর্গত

নেশার লাটিম ঝিম ধরলে কী হয়?

নেশা কি লাটিম? চরকি পাক খায়?

কী নেশা? কিসের নেশা?

কত রকম নেশা মানুষের! ভালো নেশা। খারাপ নেশা। লাটিম ঝিম ধরে কোন নেশায়?

লেখকের কথা বলি। তার জন্মদিনে তাকে নিয়ে বানানো গান শুনেছি একটা।

দাঁড়িয়ে আছেন
অথবা হাঁটছেন
পুরনো গল্পের
শব্দ কাটছেন
ধোঁয়ার অন্তর্গত মানুষ
ধোঁয়ার অন্তর্গত…।

লেখক ধোঁয়ার অন্তর্গত মানুষ। কী বলেন?

‘ধোঁয়া ছাড়া কিছু হয় না রে মিয়া।’
আর এক কবি।
‘আপনি এসব কেন করেন?’
‘এছাড়া নত হতে পারি না।’
‘নত হতে পারেন না মানে?’
‘কবিতা লিখতে গেলে নত হতে হয়।’
‘অ।’

আর এক আর্টিস্ট।

‘কেন?’
‘এমনি।’
‘ভাব কিছু আসে?’
‘না।’
‘তবে কেন?’
‘বললাম তো এমনি।’
এটা কী আন্তরিক উত্তর?

কিছু মানুষ নেশা করে কেন? বই পড়া, মাছ ধরা, পাখি দেখা নেশার কথা বলছি না, কিছু মানুষ মাদক নেয় কেন?

আরেক কবির সঙ্গে দেখা হতো আগে। এখন আর হয় না। পরিচিত কেউই কবির সুলুক সন্ধান জানে না, রাখে না আর। মারেফত লাইনের কবি। দেখা হলেই একটা কথা বলতেন।

‘ভাইরে, দুনিয়া আনন্দময়, করে যার যা মনে লয়।’

দুনিয়া কি আনন্দময়?

যার যা মনে লয় করে?

দুনিয়া আনন্দময় বলে করে?

নাকি যার যা মনে লয় করলে আনন্দময় মনে হয় দুনিয়া?

ক্রাইস্টচার্চ হত্যাকাণ্ডের পরও! তবে সেটা পলায়নবাদিতা এবং অবশ্যই নিষ্ঠুরতাও।

আমরা আর যাই করি সময় থেকে পালাতে পারি না। সময়ের বাস্তবতা। কোন সময়ের? সময় তো ফ্ল্যাট। আমরা ভাবি অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। মহাভারতে পাপের বিনাশ হেতু যুদ্ধ জায়েজ করতে তার রথের সারথি কী বলেছিলেন অর্জুনকে- ‘যাহা ঘটিবার তাহা ঘটিয়া গিয়াছে। তুমি তো নিমিত্ত মাত্র হে অর্জুন।’

সব অর্জুনই নিমিত্ত মাত্র।

কী বলতে চাচ্ছি, বুঝতে পারছি না।

বিতং বাদ দিয়ে আর দুটো কথা বলি। আমাদের এক ফকির মামা আছেন। বলেন, আমি মামা ডিজিটাল ফকির। এই ফকির মামার কাছে শুনি,

সিদ্ধিচরণ রায়

আপনার সঙ্গে দেখা করিতে চায়,

দেরি হইলে

জালালপুর চলিয়া যায়।

সিদ্ধিচরণ রায় বুঝলেই হলো। জালালপুর কী বুঝলেই হলো। ডিজিটাল ফকির মামাও ধোঁয়ায় অন্তর্গত একজন মানুষ।

পুকুরচুরির কথা বলি এখন। পুকুরচুরির কথা আমরা পড়ি বইতে। বাস্তবে কি পুকুর চুরি হয়? বছর বিশেক আগের ঘটনা। মাছের প্রজেক্ট ছিল আমাদের এক বন্ধুর। ছোট এক পুকুরে কিছু মাগুর মাছের পোনা ছেড়েছে। লোক রেখেছে পুকুর পাহারায়। মাস দুয়েক পরে শুনি কি, ‘আরে! ওর তো পুকুর চুরি হয়ে গেছে!’

‘পুকুর চুরি হয়ে গেছে মানে!’

‘সব পোনা ধরে নিয়ে গেছে।’

‘কী করে? কারা?’

‘কারা তো বলতে পারব না রে ভাই। বৃষ্টির রাত ছিল তো কাল। বৃষ্টিতে পুকুর চুরি হয়ে গেছে। এইটুকু পুকুর। একবার জাল টানলেই হলো তো।’

‘কেন? পাহারাদার ব্যাটা ছিল না?’

‘ছিল।’

‘সে কিছু দেখল না, শুনল না?’

‘শুনবে কী করে? ব্যাটা তো এমনিতেই হাটকালা। আবার তার লাইনেরই মানুষ। টেনে ঘুম দিয়েছিল নিশ্চয়।’

আহা রে!

আহা রে! আহা রে!

আর একটা শব্দ শুনেছি ‘হটবক্স।’

মানে কী এর? গরম বাক্স?

খাবার গরম থাকে যে বাক্সে?

হ্যাঁ। তবে এটা এক অর্থ। আরেক অর্থ যেটা সেটা সাংকেতিক। ব্যবহার করে ধোঁয়ার অন্তর্গত কিছু কৌম। দরজা জানালা আটকানো ঘরে সঙ্গদোষ উদযাপন হলো হটবক্স। সংঘের একজনের কাছে শুনেছি।

‘দরজা জানালা আটকানো ঘরে কেন?’

‘ট্রিপ ভালো হয়।’

‘যে কোনো দরজা জানালা আটকানো ঘর?’

‘আমরা প্রেফার করি বাথরুম।’

‘ইউরিনাল হলে কি আরো ভালো হয় না?’

আমার প্রস্তাবনা তার পছন্দ হলো না। হওয়ার কথা না।

ধোঁয়ার অন্তর্গত শুধু কি মানুষ?

দেবতাও আছেন একজন। দেবাদিদেব মহাদেব তিনি। শিবঠাকুর। বাবা ভোলানাথ। ‘দোহার’-এর কালিকা দাদার আশ্চর্য পরিবেশনা অনেকে দেখেছেন, শুনেছেন।

গাইনজার ছিরল ছিরল ফাত

গাইনজা খাইয়া মুগ্ধ অইয়া

নাছে

নাছে ভোলানাথ…।

লোককথা আছে। স্বর্গে যখন সংবিদা মঞ্জরী ছিল না শিবঠাকুর কি তখন ছিলেন না? ছিলেন। তবে বহাল তবিয়তে ছিলেন না মোটেও। ধুতুরার ফুল, বিচি খেয়ে কোনরকমে নেশামগ্ন হয়ে থাকতেন। এই দেখে অন্য দেবতারা পড়লেন চিন্তায়। দেবীরাও। শিব-ঠাকুর তো এমনিতেই খ্যাপা, ধুতুরার ফুল বিচি খেয়ে আরো খ্যাপা হয়ে যাচ্ছেন দিন দিন। কোনদিন না বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যান! দেবাদিদেব বদ্ধ উন্মাদ হলে মুশকিল। রসাতলে যাবে ত্রিভুবন। দেবতারা ধরলেন নারদ মুনিকে, ‘কিছু একটা উপায় করে দেন, মুনিবর।’

নারদ মুনি বললেন, ‘মর্ত্যলোকে যেতে বলো ভোলানাথকে। দেখা করতে বলো লোকমান হেকিমের সঙ্গে।’

শিবঠাকুরেরও ততদিনে বিরক্তি বলতে বিরক্তি, মহাবিরক্তি ধরে গেছে ধুতুরায়। ক্ষুুধামন্দা ধরেছে। মাথা চক্কর দেয়। নারদমুনির কথা শুনে বেচারি দেখা করলেন লোকমান হেকিমের সঙ্গে। লোকমান হেকিম তাকে সংবিদা মঞ্জরীর সন্ধান দিলেন। স্বর্গে গেল সংবিদা মঞ্জরী গাছ।

গল্পের জাদুকর হুমায়ূন আহমেদের একটা বইতে আছে এই লোক কাহিনী। আমি কার কাছে শুনেছিলাম? সাদা কালো যুগের বাংলা সিনেমার এক মেকআপ আর্টিস্টের কাছে। পার্টটাইম ধোঁয়ার অন্তর্গত মানুষ ইনিও। কিছুকাল আরো কঠিন সঙ্গে ছিলেন। সর্বনাশা একটা সময় গেছে সেটা। সব গেছে। আফসোস করেন এখনো। সব নেশাই এমন আফসোসে ফুরায়। শাস্ত্রের কথা। কিন্তু শাস্ত্রের কথা শোনে কোন নেশারু? চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী। নেশার অনিবার্য পরিণতি বিনাশ। সে অবশ্য সকল কিছুরই। মহাজাগতিক প্রতিটা কণারও। আচ্ছা, ইয়াবার মতো একটা বিশ্রী মরণনেশার ‘বাবা’ নাম দিল কোন হারামজাদা? ইতরামি না? বাবা জর্দা আছে, তাও মানা যায়। বাংলা ‘বাবা’ না, হিন্দি ‘বাবা’ সেটা। মান্যিগন্যি বোধ এখনো আছে মানুষের। বাংলামোটরের এক পানঅলার সঙ্গে দরকারে কথাবার্তা হয়েছিল একদিন।

‘জর্দা দিমু পানে?’

‘দেন।’

‘কী জর্দা দিমু? মুরুব্বী জর্দা?’

‘মুরুব্বী জর্দা কী আবার?’

মুরুব্বী জর্দা হলো বাবা জর্দা। পানঅলা সেটাও মুখে বলেনি, জর্দার কৌটা দেখিয়ে দিয়েছিল।

বাবা। প্রিয় একটা শব্দ কীভাবে ভয়ঙ্কর একটা শব্দও হয়ে যায়!

ঘুম ধরে গেছে, রাত কত হলো? মোবাইল ফোন নিয়ে দেখলাম মাত্র বারটা আটচল্লিশ বাজে এবং এগারটা মিস্‌ড কল উঠে আছে। বুঝিনি, দেখিনি বলে। যতক্ষণ খোলা থাকে আমার মোবাইল ফোন সাইলেন্ট মুডে থাকে। এগার কল কে কে দিয়েছে?

কে কে না, কলার একজনই, শ্রীমান পাপ্পু। দেখতে না দেখতে আবার কল দিল। ধরলাম না। বারবার বারো বার ভালো শোনায় না, বার বার তেরো বার হোক। হলো। ধরলাম। ভীষণ উত্তেজিত কণ্ঠে শ্রীমান বলল, ‘আরে তুমি কোথায়? কল দিয়েই যাচ্ছি ধরতেছ না! কয়টা কল দিছি, দেখছ? কী করো তুমি?’

‘ঝালমুড়ি খাই।’

‘ঝালমুড়ি খাও! তুমি কোথায়?’

‘শের শাহ সুরী রোডে।’

‘অ। আচ্ছা, থাকো।’

‘কী বলবি বল।’

‘না, তুমি ব্যস্ত।’

‘ঝালমুড়ি খাই, আর কী ব্যস্ততা। বল।’

‘বলেই ফেলি তাহলে। আচ্ছা তোমার কী মনে হয়?’

‘কী বিষয়ে কী মনে হয়?’

‘না, এই তো, তুমি কী চাও? ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকুক?’

‘এ আবার কী রকমের কথা! আমি চাইলে কী? না চাইলে কী?’

‘না চাইলে কিছু না। কিন্তু ধরো তুমি যদি চাও, ট্রাম্প আর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট না থাকুক, তবে সে থাকবে না।’

‘তাই নাকি?’

‘অবশ্যই। তুমি যদি চাও বলো। তোমাকে কিচ্ছু চিন্তা করতে হবে না। আমি সব ব্যবস্থা করব। হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প আর থাকবে না।’

‘তুই ঊর্ধ্বে আছিস। রাখ পাপ্পু। তোর লগে কথা বলতে এখন আমার বিরক্ত লাগতেছে।’

‘আরে এ রকম কেন করো? ঝালমুড়ি খাওয়া শেষ হইছে?’

‘হইছে। এখন ঝোলাগুড় খেয়ে ঘুমাব।’

‘ঘুমাবে? ঘুমাও। আচ্ছা। ওকে। টেক কেয়ার। বাই।’

কেয়ারিং আছে শ্রীমান। মাঝেমধ্যেই এসবে যায় কেন তাহলে? যায়। আটকানোর মতো কেউ থাকলে যেত না। আটকানোর মতো কেউ থাকতে হয় মানুষের। মনে হয়। হয়েছে। আর কিছু মনে করতে চাচ্ছি না। ঘুম পেয়েছে। পৃথিবীর সেরা নেশা হলো ঘুম। একমাত্র নেশা, যে নেশা করে ‘সত্যিকার’ স্বপ্ন দেখা যায়। ঘুমাই। এমনিতেই ধোঁয়ার অন্তর্গত হয়ে যাচ্ছে সব।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত